পারফেক্ট

পারফেক্ট
রেস্টুরেন্টটা নতুন খুলেছে। নামটা কি যেন ঠিক মনে পড়ছে না। পড়বে না-ই বা কেন? কাল থেকে মারাত্মক টেনশনে ভুগছি। টেনশনটা শুরু হয়েছে গতকাল বিকেলের দিকে। গার্লফ্রেন্ডের সাথে ফোনে কথা বলছিলাম, মা সবটা শুনে ফেলেছে। অবশ্য এমন কোনো ব্যাক্তিগত কথাও বলিনি যে মা বুঝে যাবে আমি প্রেমালাপ করছি। সর্বনাশটা ডেকে এনেছি ফোনে বারবার “জান” শব্দটা ব্যাবহার করে।
ফোনটা রাখতেই পিছে ঘুরে দেখি মা শীতল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমার বুকটা ধড়াম করে কেঁপে উঠলো। শিরদাঁড়া বেয়ে বিন্দু ঘামের কণা নেমে গেল। না জানি মা কতক্ষণ ধরে আমার কথা শুনছিলেন। আমি আমার সাধ্যমতো স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করে মাকে তোঁতলাতে তোঁতলাতে জিজ্ঞাসা করলাম, “মা..তু..তুমি এখানে! কিছু লাগবে?” মা আমার দিকে ওই এক-ই শীতল নয়নে চেয়ে রইলো। আমার হঠাৎ পা কাঁপা-কাঁপি শুরু করে দিলো। মাকে আমি অনেক ভয় পাই। মা খুব শাসন করে আমাকে। অবশ্য মায়ের শাসনের কারণেই আমি আজ দেশ সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছি। স্কুল-কলেজ জীবনে পড়াশোনা বাদে অন্য কিছু করতে দেখলেই মা কেমন যেন মহিষের মতো তেড়ে আসতো আমার দিকে। আর আজ তো একেবারে প্রেম করতে করতে ধরা পড়েছি। না জানি আজ কপালে কি আছে।
আমি সব কিছু উপরওয়ালার উপর ছেড়ে দিয়ে নিজেকে বোঝালাম,যা হবে দেখা যাবে। ভার্সিটিতে পড়ি। প্রেম করার বয়স তো বহুত আগেই হয়েছে। মা এখন আমার ব্যাপারে নাক গলাতে যাবে কেন ইত্যাদি ইত্যাদি। তো মা আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞাসা করলেন,”মেয়ের নাম কি?” আমি তোঁতলাতে তোঁতলাতে জিজ্ঞাসা করলাম,”কো..কোন মেয়ে মা?” মা জবাব দিলেন,”কোন মেয়ে তাও বলে দেওয়া লাগবে এখন? যাকে জান জান করে ডাকছিলি। তার নাম কি?” আমি চুপ করে রইলাম। লজ্জা আর ভয় দুটোই একসাথে কাজ করছে। আমার গলা দিয়ে কোনো আওয়াজ বের হচ্ছিলোনা।
এরপর মা আমার পাশে এসে বসলেন। আমার কাধে হাত দিয়ে বললেন,”তোর বাবা চলে যাওয়ার পর থেকে তোকে একা হাতে মানুষ করেছি। তোকে খুব ভালোমতো চিনি আমি। আমার ছেলে প্রেম করে অথচ আমি জানি-ই না। আমাকে বলিসনি কেন এই ব্যাপারে?” আমি মুখ খুললাম অনেকক্ষণ পর। জবাব দিলাম, “মা এখনো বলার সময় হয়নি। যখন হতো তখন এমনেই বলতাম আমি। আমি এখন বলা প্রয়োজন মনে করিনি।” মা হেসে জবাব দিলেন,”আচ্ছা ঠিকাছে বুঝলাম, এত কাল প্রয়োজন মনে করিসনি, তাই বলিসনি। কিন্তু এখন যেহেতু জেনে গিয়েছি, তাহলে সবটা খুলে বল। কত সময় ধরে প্রেম চলে?” আমি বললাম,”তিন বছর শেষ। চার বছরে পা দিবে।” মা যেন আকাশ থেকে পড়লেন। এরপর জিজ্ঞাসা করলেন,”মেয়ের নাম কি?”
“মোহনা।”
এরপর মা একটার পর একটা প্রশ্ন করেই চললেন, আমিও জবাব দিয়ে গেলাম। সব জানা হয়ে গেলে তিনি মোহনার সাথে দেখা করার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। তার-ই ফল আজকে এই রেস্টুরেন্টে মাকে নিয়ে আসা।
মায়ের সাথে দেখা করার কথা মোহনাকে বললে সে আবার সুন্দর মতো রাজি হয়ে যায়। আমি ভেবেছিলাম সে দেখা করতে চাইবে না। মা ছেলে ধীরে ধীরে ঢুকলাম রেস্টুরেন্টে। আমার বুকের ভেতরটা এত জোরে ধড়ফড় করছে যে, মনে হচ্ছে এখনই ফেটে যাবে আর বুকে রক্তক্ষরণ হবে। মায়ের কেমন মেয়ে পছন্দ আমি ঠিক জানি না। তবুও আশা করছি যে মোহনাকে মায়ের অপছন্দ অন্তত হবে না। মোহনা একেবারে খাঁটি বাঙালি মেয়ে। মাও সংস্কৃতমনা। তাও বুঝে উঠতে পারছি না কিছুই।
ভেতরে ঢুকে মোহনাকে খুঁজতে যেয়েই দেখতে পাই সে জানালার পাশের একটি সিটে বসে বই পড়ছে। লম্বা লম্বা চুল গুলো পিঠে মেলে রেখেছে। কালো সালোয়ার-কামিজের সাথে কালো ছোটো হিল পড়েছে। মেক-আপ তেমন একটা করেনি, তবে ঠোঁটে লালচে বাদামী লিপস্টিক দিয়েছে। ফর্সা মুখে লিপস্টিকটা একেবারে ফুটে উঠেছে। কপালে দিয়েছে ছোটো টিপ। দেখতে তাকে বেশ সুন্দর দেখাচ্ছে। বরাবরের মতো আমি আজও তার উপর ক্রাশ খেলাম, অতঃপর মনে পড়লো সাথে মাকে নিয়ে এসেছি। মোহনার কাছে যেয়ে তাকে ডাক দিলাম, “মোহনা?” মোহনা চমকে উঠলো। বোঝা গেলো বইয়ের গভীরে ডুবে গিয়েছিল সে। আমার দিকে একবার তাকিয়ে সাথে সাথে মায়ের দিকে তাকিয়ে সালাম দিলো,”আসসালামু আলাইকুম আন্টি। ভালো আছেন?” মাও হাসি মুখে জবাব দিলো,”ওয়ালাইকুম সালাম মা, আমি ভালো আছি। তুমি ভালো আছো?” প্রথম দেখায় মা বলে সম্বোধন করাতে ভেবেছিলাম মোহনা ঘাবড়ে যাবে। কিন্তু মোহনা ঘাবড়েনি, উল্টো আমি ঘাবড়ে গিয়েছি। ভাবছি মায়ের কি হলো, মা তো এত নরম নয়! তাদের মধ্যে আরও কিছুক্ষণ কথাবার্তা চললো। এর-ই মধ্যে অর্ডার এসে হাজির। খাওয়া দাওয়া হলো। কথাবার্তা সব হলো।
যাওয়ার সময় মা মোহনার সামনে আমার দিকে তাকিয়ে বললো,”মেয়ে কিন্তু আমার খুব পছন্দ হয়েছে। কথা বলেই বোঝা যাচ্ছে একেবারে যোগ্য বউ। বুঝতে হবে, আমার ছেলের পছন্দ বলে কথা।” আমি আর মোহনা দুজনেই দুজনের দিকে হা করে তাকিয়ে আছি। যেন কিছু বুঝতে পারছিনা। আমাকে একটু দূরে দাঁড় করিয়ে রেখে মা আর মোহনা কি যেন বলাবলি করলো। আমি কিছু শুনতে পাইনি। তারপর দেখলাম মা মোহনার কপালে আলতো করে চুমু দিলেন। এই দৃশ্য দেখে আমার মাথায় যেন বাজ পড়লো। মেয়ে কী জাদু করেছে যে আমার মা এত গলে গেলো? বাড়ি ফিরে সন্ধ্যায় মোহনাকে ফোন করে জিজ্ঞাসা করলাম,”আচ্ছা মোহনা, মা তখন তোমাকে কি বলছিলেন?” মোহনা জবাব দিলো,”উনি বলছিলেন যে আমি তোমাকে কখনো তোমার মায়ের থেকে আলাদা করে ফেলবো কি না। আসলে সব মায়েদের এই একটা ভয় থাকে আর কিছু না।”
“আচ্ছা তারপর? তুমি কী জবাব দিলে?”
“আমি জবাব দিলাম না তোমাকে বলবো না।”
“আরেহ বলো না। কি বলেছো মাকে?”
“বলেছিলাম যে, আমি যদি কখনো আপনার ছেলেকে আপনার থেকে আলাদা করার চেষ্টা করি, তাহলে কপালও আমাকে আমার ভবিষ্যৎ ছেলে মেয়ে থেকে আলাদা করার চেষ্টা করবে। শুধু শুধু নিজের পায়ে নিজে কুড়াল কেন মারবো বলুন?”
“সত্যি? তুমি এটা বলেছো?”
“জ্বী এটাই বলেছি।”
“বাব্বাহ, বিয়েই হলো না, আর এখনি উনি বাচ্চার স্বপ্ন দেখছেন।”
“এই, বাজে কথা বলবে না। আমি স্বপ্ন কই দেখলাম হ্যাঁ? আমি বাস্তবতাটা মাকে বললাম শুধু।”
“হ্যাঁ হ্যাঁ, বুঝি বুঝি। আমি সব বুঝি। তোমারও তো ইচ্ছে করে তাই না? সব-ই হরমোনের খেলা।”
“আই দেখো,
তুমি যদি আরেকবার এসব বলো, আমি কিন্তু তোমার মাকে বিচার দিবো সত্যি”, এই বলে মোহনা ফোনটা কেটে দিল। আমি তার প্রতিক্রিয়া দেখে হাসতে হাসতে শেষ। একই সাথে প্রশান্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। বিড়বিড় করে বললাম, দিন শেষে মনে একটাই শান্তি, যাকে অর্ধাঙ্গিনী বানানোর স্বপ্ন দেখছি, সে অন্তত অনেক ভালো মনের মানুষ বৈকি খারাপ মানুষ নয়।
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত