লক ডাউন

লক ডাউন
কাল রাতে আমার নামে একটা চিঠি এসেছে। আমি খানিক বিচলিত হলাম! এই যুগে কেউ চিঠি লিখে? প্রেরকের নাম দেখে তো রীতিমতো ভিমড়ি খেলাম। লেখা নিলুফা বেগম। আবার ব্র্যাকেটে লিখা পাশের বাসার আন্টি। আমি ঢিপঢিপ বুকে চিঠি খানা খুলতে খুলতে ভাবছি কি থাকতে পারে এতে? জরুরি কিছু কি? কিন্তু আমার কাছে উনার জরুরি কি কাজই বা থাকবে? চিঠিটা খুলে উৎকন্ঠা সমেত পড়তে লাগলাম। অতিব প্রিয় আদরের তারা, চিঠির প্রথমেই আন্টির স্নেহ নিও। কেমন আছো? কি করেই বা ভালো থাকবে।আন্টির চেহারা না দেখে কি তুমি ভালো থাকতে পারো? আন্টিও একদম ভালো নেই। যে কোন মুহূর্তে যা কিছু হয়ে যেতে পারে। এই লকডাউনের কারণে তো তোমাদের সাথে দেখাও হচ্ছে না। এই সময়টাকে মনে হচ্ছে যুগ যুগ ধরে চলছে। যেন এর কোন শেষ নেই।
কতদিন তোমার ওই চাঁদমুখখানা দেখি না। সেটা বড় বিষয় না। বড় বিষয় এই যে তোমার মাথায় হাত বুলিয়ে দেওয়ার ছলে কতদিন তোমার চুল,তোমার গায়ের রঙ, তোমার উচ্চতা, সর্বোপরি তোমার বডি শেমিং করি না । যেই দুঃখে আমি যারপরনাই হতাশ। কোথা থেকে এই ছাতার মাথা করোনা এসে আমার আর তোমার রেসাল্টের সম্পর্ক ভেঙ্গে ফেলার নিন্দনীয় চেষ্টা করছে। তোমার রেসাল্টের খবর পর্যন্ত নিতে পারি নি। তোমার না কিছুদিন আগে রেসাল্ট বেরিয়েছে? কি পেয়েছো? আমার টুনির চেয়ে বেশি? নাকি কম? কম পেলে কত কম? কিছুই জানতে পারছি না। বিস্তারিত জেনে তোমার মাকে একটা খোঁচা না মারতে পেরে তো দুঃখে আমার বুক ফেটে যাচ্ছে।
সেদিন ফেইসবুকে নোটিফিকেশন আসলো তোমার জন্মদিনের। তা মা বয়সটা কত হল যেন? বয়স তোমার এবাউটে গিয়ে খুঁজলাম জানো? পেলাম না। অনলি মি করে রেখেছো কেন? খুঁজে না পেয়ে আন্টির খুব অস্থির অস্থির লাগছিল। তোমাকে মেসেজ দিব ভাবলাম। পরে তো তোমার আইডি আর খুঁজেই পেলাম না। গতবার তোমার বাসায় গিয়ে যে জিজ্ঞেস করলাম তোমার মাকে তোমার বিয়ে কবে দিবে তিনি তো কিছু বললেনও না। সেই কথা মনে পড়ে আমার অস্থিরতা আরো বেড়ে গেল। তোমার মায়ের ফোন নাম্বারটাও হারিয়ে ফেলেছি। তাই ফোন করেও জিজ্ঞেস করার উপায় নেই। বাধ্য হয়েই এই চিঠি লিখছি।
এই চিঠি যখন লিখছি তখন বাজে রাত বারোটা। সারা শহর নিস্তব্ধ, ঘুমন্ত। কিন্তু আন্টির চোখে ঘুম নেই। চোখ বুঝলেই তোমার চেহারা ভেসে উঠছে। তোমার বিয়ের চিন্তায়, তোমার রেসাল্টের চিন্তায় আন্টি ঘুমাতে পারছি না।
আন্টির অবস্থা বেশি ভালো না। কতদিন পাড়ার ছেলে মেয়েগুলোর খোঁজ খবর নিতে পারি না। কতদিন সবার হাঁড়ির খবর পাই না। তোমার মায়ের কাছে গিয়ে কতদিন তোমাকে নিয়ে একটু খোঁচা মেরে কথা বলতে পারি না। আমার দম বন্ধ লাগছে। যে কোন মুহুর্তে মনের দুঃখে হার্ট ফেইল হতে পারে। আর হার্ট ফেইল না হলেও আমি ঠিক করেছি আমি আর বাঁচবো না। এই জীবন রেখে কি লাভ। যেখানে অন্যের হাড়ির খবর নেই, রেসাল্ট নিয়ে খোঁচানো নেই, মেয়ের বিয়ে দিবেন কবে বলে অতিষ্ঠ করা নেই, বেকার ছেলেদের যোগ্যতা নিয়ে তাচ্ছিল্য করা নেই, সেই জীবন রেখে কি লাভ বলো! এই কষ্ট আমি আর সহ্য করতে পারছি না। প্রতি মুহুর্ত আমার কাছে বিষময়। এই কষ্ট সহ্য করা যে কত কঠিন তা একমাত্র আমার মতো পাশের বাসার আন্টিরাই জানে। শেষ পর্যন্ত হয়তো এই লকডাউনের সাথে হার মেনে আমায় আত্নহত্যার পথ বেছে নিতে হতে পারে।
দুঃখে কষ্টে খাওয়া দাওয়া ত্যাগ করেছি। দাঁড়াতেও পারছি না। তাও বহু কষ্টে তোমাদের বাসা পর্যন্ত গিয়েছিলাম।কিন্তু তোমাদের বজ্জাৎ দারোয়ান আমাকে করোনা আক্রান্ত ভেবে বিদায় করে দিয়েছে। একটা শেষ চেষ্টা করতে চাই। আমার বাঁচা মরা এখন তোমার হাতে। প্লিজ তারা প্লিজ আন্টির জীবন বাঁচাও। তুমি পর্যাপ্ত স্বাস্থ্য বিধি মেনে তোমার মাকে নিয়ে আন্টির বাসায় আসো।আন্টি তোমার রেসাল্ট নিয়ে, তোমার বিয়ে নিয়ে এবং যাবতীয় তুমিময় জগত নিয়ে তোমার মাকে একটু খোঁচা মারি। পালাক্রমে পাড়ার সবাইকে “আমাকে একটু খোঁচা মারতে দিন” কার্যক্রমে ইনভাইট করবো। তোমরা প্লিজ এসে আমার জীবন বাচাও। তোমাদের একটুখানি সাহায্য আমার আত্নহত্যা ঠেকাতে পারে। আমার জীবন প্রদীপ নিভে যাওয়ার আগেই তুমি একটুখানি আলো নিয়ে আসবে সেই প্রতিক্ষায় রইলাম।
ইতি নিলুফা বেগম চিঠিটা পড়ে আমার চোখ দিয়ে পানির ধারা বইছে অনবরত। আন্টির দুঃখে আমার হৃদয়ের আনাচে কানাচে ব্যথা দৌড়ে বেড়াচ্ছে। আমি কোন ভাবেই নিজেকে সামলাতে পারছি না। ছুটে দিয়ে আন্টিকে বলতে ইচ্ছা করছে, “না আন্টি না, আপনি আমাদের ছেড়ে এভাবে চলে যেতে পারেন না।আমার পরবর্তী জীবনের আন্টি স্বত্তা আমাকে নাড়া দিচ্ছে। বলছে- যা তারা যা। এটা যে কতটা কষ্ট তুই কয়েক বছর পরেই বুঝতে পারবি। আমি চোখ মুছতে মুছতে ঠিক করলাম আমাকে যেতেই হবে। আন্টির জীবন বাঁচাতে যদি আমাকে একটু খোঁচা খেতে হয় তাতে কি। আন্টি ভেঙ্গে পড়বেন না। আমি আসছি।
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত