বাবা ও মোবাইল

বাবা ও মোবাইল
নাম আর ছবি দেখে ভিমড়ি খেয়ে গেলাম। আব্বু ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছে। প্রোফাইল ভালো করে চেক করতে গিয়ে দেখি আজই খোলা হয়েছে একাউন্ট। জন্মতারিখ ২০০০ সাল। মাথাটা আরেকবার চক্কর দিল। কে কার সন্তান চিন্তা করতে করতেই বাপজানের কল চলে আসল।
– ও মায়ো। আছো কেমন? ( বাপ আমাকে আদর করে মায়ো ডাকে। যখন তার মুড অত্যাধিক ভালো থাকে)।
– আব্বু কি করেছেন এইটা? কে আপনাকে ফেসবুক একাউন্ট খুলে দিয়েছে?
– আরে তোমার জলিল চাচা।
এতো না করলাম শুনলই না। পিছন পিছন ঘুরতেই লাগল। বলল, ভাইজান একটা একাউন্ট না থাকলে আপনার মান সম্মান থাকে, বলেন! আমিও ভাইবা দেখলাম কথা সত্য। বললাম দেও কইরা। তবে মান সম্মান ওয়ালা একাউন্ট কইরা দিবা। পোলাপান যখন চালাইতে পারে আমিও পারব। ( আসল কাহিনী হইল আব্বু নিজেই জলিল চাচার পিছনে কয়েকদিন ঘুরেছে একাউন্ট খোলার জন্য। আমি এইটা নিশ্চিত। আর মান সম্মান ওয়ালা একাউন্ট কিভাবে খোলে আমার জানা নাই)।
– ও আচ্ছা। দাড়ান তো জলিল চাচারে একটা ফোন দেই। তারে এই কাজ কে করতে বলছে? (আসলে আমি ফোন করব না, মজা করছিলাম)।
– আরে না। কি যে বলনা তুমি! তুমি জলিলরে ফোন দিবা কেন? মির্জা বাড়ির একটা সম্মান আছে না। আমি গিয়া এখনই বলতেছি এইটা বন্ধ করে ফেলতে।
– থাক আব্বু বন্ধ করার দরকার নাই। ভালই হয়েছে। থাকুক।
আমি তখন মুখ বন্ধ হাসছি রীতিমত। আব্বুর এইসব ঘটনা আমার কাছে নতুন না। আমাদের প্রতিদিনই কিছু না কিছু নিয়ে মতের বিরোধ হবেই, এবং সেটা নিয়ে কথাও বন্ধ থাকবে আধা বেলা কিংবা একবেলা। আমার আব্বু অতি খুশিতে উদ্বেলিত হয়ে কথা বলেই যেতে লাগল। কিভাবে ভিডিও কল রিসিভ করতে হয় আর কিভাবে কল করতে হয় সব শিখে ফেলেছেন। বাপজান আমার বললেন, মা জননী তুমি আমারে ঠিক সন্ধ্যা সাড়ে ৭ টায় মেসেঞ্জারে ভিডিও কল দিবা।
আমি চিন্তা করছি আব্বু সন্ধ্যার সময় কোথায় যাইতে পারে। যাই হোক চিন্তা করে লাভ নাই। সাড়ে ৭টায় ফোন দিতেই হবে। আব্বু অপেক্ষায় থাকবে। এই সব সময় গুলিতে সাধারণত আমি কোন কথা বলিনা। চুপ করে থাকি। যা বলার আব্বু একাই বলে যায়। ২০০০ সালের দিকে আব্বু প্রথম মোবাইল কিনল। সেই মোবাইল কেনার পেছনেও রয়েছে একটা ইতিহাস। গঞ্জে আমাদের একটা ধান চালের আড়ত আছে। সেখানেই আব্বু বসে দিনের কোন এক সময়। এক হাটের দিনে সেখানে চৌধুরী বাড়ির বড় ছেলে হাতে মোবাইল নিয়ে উপস্থিত। গ্রাম এলাকায় সেই সময় মোবাইল এক আজব জিনিস। সেকি ভাব তার, পা মাটিতেই পরে না!
আব্বুকে দেখিয়ে বলেছে- কাকা এইটারে বলে মোবাইল। হাতে নিয়া দেখেন। ডরানের কিছু নাই। পরের দিনই আব্বু ঢাকায় গিয়ে মোবাইল দুইটা মোবাইল কিনেছে। একটা বাড়িতে থাকবে আমাদের কাছে আরেকটা আব্বুর কাছে। মোবাইল নিয়ে আমাদের যে সেকি উত্তেজনা! কিন্তু আব্বু তার উত্তেজনায় লাগাম টেনেছেন, অপেক্ষা করেছে হাটবারের। জানেন সেদিন চৌধুরী বাড়ির বড় ছেলের আসার কথা। সেদিন মোবাইল সাথে নিয়ে আড়তে গিয়েছেন। তবে হাতে করে নয়, পাঞ্জাবির পকেটে করে। সেদিনও আড়তে গল্প জমে উঠেছে, খালি হচ্ছে কাপের পর কাপ। আমি জানি আব্বুর মন তখন পড়ে আছে ঘড়ির কাটায়। কারণ ঠিক ৫ টায় আমার ফোন করার কথা। চৌধুরী বাড়ির ছেলে উঠতে চাইলেও আব্বু তাকে আটকিয়ে রাখেন।
– আরে রাখো মিয়া এতো যাই যাই করো কেন? বসো। গল্প করি। এর মাঝে সেই মাহেন্দ্র ক্ষণ আসে এগিয়ে। আব্বু তখন মনে মনে প্যাকটিস করছে কিভাবে মোবাইল রিসিভ করবে। মোবাইল বাজে। সবাই সচকিত হয়। চৌধুরীর দিকে সবাই তাকায়। মোবাইল বাজতেছে। কিন্তু চৌধুরীও অবাক হয় তার মোবাইল তো নয়! তবে কার!! এবার আব্বু ধীরেসুস্থে সিনেমার নায়কের মতো ভংগিতে মোবাইল বের করে। যেন এটা খুবই তুচ্ছ একটি ঘটনা! আব্বু কল রিসিভ করে। এক নিশ্বাসে কথা বলে নিজেই কল কেটে দেয়। সবাই তখন হা করে তাকিয়ে থাকে। আব্বু চৌধুরীর দিকে মোবাইল এগিয়ে দিয়ে বলে,
– ভাতিজা এইটারে বলে দামি মোবাইল। হাতে নিয়া দেখো। ডরানের কিছু নাই! সেই থেকে মোবাইল নিয়ে আমার আর আব্বুর নানা কাহিনী চলছেই। এই যেমন কারো সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। কিংবা বাসায় মেহমান কিন্তু হাসিমুখে বসতে হচ্ছে সামনে, না বসলে অভদ্রতা হয়। এসব মুহূর্ত গুলিতে ত্রাণকর্তা হিসেবে হাজির হয় আমার বাবা। মোবাইলে শুধু ছোট্ট একটা মেসেজ পাঠাই,
— আব্বু।
সাথে সাথে ফোন চলে আসে। এই সময় গুলিতে আব্বু কোন কথা বলে না। আমি একাই কথা বলতে বলতে সেখান থেকে সটকে পড়ি। আমাদের বাবা মেয়ের এই নাটকগুলি কেউ বুঝবে না।
আজ ভিডিও কল দিতে হবে মেসেঞ্জারে। ইমোতে কিন্তু কথা হতো প্রতিনিয়ত। কিন্তু মেসেঞ্জারেই কেন দিতে হবে বুঝতে পারছিলাম না। সাড়ে ৭টা বাজে। রিং হচ্ছে। আমি তখন এলোমেলো হয়ে আধাশোয়া অবস্থায় গাজর চিবাচ্ছি আর টিভি দেখছি। কল রিসিভ করার পর ওপাশে যাকে দেখলাম তাতে চমকে হাত থেকে মোবাইল ছিটকে পড়ে গেল। লাইন গেল কেটে। গাজরের হদিস পাওয়া গেল না। এলোমেলো আমি ধাতস্ত হয়ে আবার মোবাইল হাতে নিলাম। ততক্ষনে আমার মোবাইলে পাল্টা কল চলে এসেছে। ওপাশে আছেন দেশের একমাত্র জনপ্রিয় চিত্রনায়ক হাবিস খান। হাসি দিয়ে বললেন,
– আপনার বাবা মনে হয় আজই ফেসবুকে একাউন্ট করেছেন তাই বুঝতে পারছিলেন না কিভাবে মেসেঞ্জারের কল রিসিভ করতে হয়। আমি আরো বড় হাসি দিয়ে বললাম – জি একটু আগেই একাউন্ট করেছেন। তাই বুঝতে পারছেন না।
– কোন অসুবিধা নেই। আমি কালকেও এখানে শুটিং করব। আপনার বাবাকে বলবেন যখন আপনার সাথে কথা বলার দরকার হয় আমার কাছে চলে আসতে। আমি অমায়িক হাসি দিয়ে আব্বুকে চাইলাম। মাথা দিয়ে ধোয়া উঠছে। আব্বু জানে এই নায়কটাকে আমি দুই চোখে দেখতে পারিনা। মোবাইল হাতে নিয়ে আমার চেহারা দেখে আগামী ২৪ ঘন্টা মেয়ের সাথে কথা না বলাকেই তিনি উত্তম মনে করলেন। তবে ২৪ ঘন্টা পার হলোনা। নিজেই আবার ফোন করে ভোরে ঘুম ভাঙালেন আমার।
– মা গো ঘুমাচ্ছ নাকি!
– হুম।
– ভালো। ঘুমালে মেজাজ ঠান্ডা হয়।
– কি বলবেন আব্বু বলে ফেলেন।
– আচ্ছা টিকটিক বলে নাকি একটা জিনিস আছে? তোমার আছে একাউন্ট?
– না। কেন? (টিকটিক!)
– তোমার জলিল চাচা জোর করে আবার একাউন্ট খুলে দিল।
এতো না করলাম শুনলই না। বলল আমার সুপ্ত অভিনয় প্রতিভা এখানেই কাজে আসবে। অন্যের ডায়লগে নিজে কেমন অভিনয় করি সেটা দেখতে পারব। যদিও আমার অভিনয় একেবারে খারাপ না। শুটিং দেখে আমার সুপ্ত প্রতিভা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। আমার মাথার ভেতর তখন টিকটিক করছে। বাকরুদ্ধ হয়ে ফোন কেটে দেয়ার আগে বললাম আল্লাহ বাচাও আমাকে।
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত