পার্লার থেকে বউ সেজে গাড়িতে উঠার সময় মাথার লাল সোনালি ওড়নাটা পেছনে থাকা ভাবীর হিলের সাথে আটকে একটু ছিঁড়ে গেলো। আমার চেয়ে ভাবী বেশি হা হয়ে গেলো। যেন কিছু একটা অশুভ হয়েছে এমন একটা ভাব চেহারা জুড়ে। মন যে আমারও খারাপ হয় নি তা না। বিয়ের সাথে যুক্ত সকল কিছুই তো আজীবন সামলে রাখার জিনিস। কিন্তু এই মুহূর্তে হা হুতাশ করে তো নতুন ওড়না পাওয়া যাবে না। ভাবীকে আমি স্বাভাবিক করলাম বলে যে,
“আরে বেশি ছিঁড়ে নি তো।ক্লাবে গিয়ে কয়েকটা পিন মেরে দিও। তাহলে দেখা যাবে না। এখন চলো। বর বসে আছে আমার” বলেই আমার ব্লাসন দেওয়া গাল দুটো যে আরও লাল হয়ে গেলো কেউ না বললেও বুঝতে পেরেছি। আমি গাড়ীতে উঠলাম, সাথে সাথে মোবাইল বেজে উঠল। উফ, এখন আমি এই শাড়ী ওড়না সামলাব নাকি মোবাইল ধরবো।
শেলি আমার বান্ধবী, আমার থেকে ব্যাগ নিয়ে বলল “এখন আর ফোন ধরতে হবে না। ব্যাগ আমার কাছে থাক। স্টেজে নিস” ফোন বেজেই চলছে, সাথে গাড়িও রওনা হলো। এতবার তো কারো ফোন করার কথা না। শেলি ব্যাগ খুলে মোবাইল চেক করে আমাকে কুনই দিয়ে ধাক্কা দিয়ে বলে “আহারে আমাদের দুলাভাইয়ের দেখি আর দেরি সয় না” আমি লাল হই আবার, লাল হয়ে মুচকি হাসিও দেই। ভাবী বলল “আরে ফোনটা ধরো না, এতবার করছে যখন” শেলি বলে উঠল “না না, আমাদের মেয়েকে এখন আর পাবে না। পাবে একেবারে কবুল বলার পরই” ড্রাইভার চাচা, সামনে বসা আমার ভাই, ভাবি ,শেলি সবাই হো হো করে হেঁসে উঠে। আমিও হো হো করতে চাই, কিন্তু বউ বলে মুচকিতেই খুশি থাকি। কিন্তু ফোনটা খুশি থাকে না। সে বাজতেই থাকে। মাঝে দুইবার মেসেজ আসার আওয়াজও পাওয়া যায়। এবার আমিও একটু ব্যাকুল হই। হলো কী শাহেদের?
“শেলি দে তো ফোন”
শেলি কিছুক্ষণ না দেওয়ার ভান করে দিয়ে দিলো পরে।
“হ্যালো, কী হলো, আর একটু দেরি সহ্য হচ্ছে না?” বানানো বিরক্তি মুখে নিয়ে বললাম।
“রূম্পা, রূম্পা আমার কথা শুনো মন দিয়ে” অপর পাশে উদ্বিগ্ন শাহেদের গলা।
মুচকি হাসি, বানানো বিরক্তি আস্তে আস্তে মিলিয়ে গেলো মুখ থেকে। খুব ধীরে কান থেকে মোবাইলটা নামিয়ে রাখলাম। এতই ধীরে যে কারো চোখেই পড়ল না আমার কানে আর ফোন নেই। আমি আর কথা বলছি না। মোবাইলটা হাতে নিয়ে নিথর বসে রইলাম। ঠিক কতক্ষণ ওভাবে বসে ছিলাম জানি না। হুশ যখন ফিরে তখন আমি আমার বাসায়, আমার রুমে, আমার বিছানায়, আমার চিরচেনা পরিবেশে। যখন থেকে স্মৃতি মনে থাকে তখন থেকে আমি এই বাসায়। এই আমার ঘর। এই আমার পরিবার, এই আমার চরম আপন বাসস্থান। পার্লারে যাওয়ার আগে যে জামাটি বিছানায় ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে গিয়েছিলাম, সেই জামাটি এখনো বিছানায় । আমার স্পঞ্জের স্যান্ডেল খাটের পাশে উলটো পড়েছিল, এখনো সেভাবেই আছে। কেউ দেখে নি স্যান্ডেল উলটো পড়ে আছে?
যে ট্রলি করে আমার যাবতীয় জিনিশ ভরে নিয়েছিলাম নতুন ঠিকানায় যাব বলে, সেই ট্রলিও এখন আমার রুমে।
দেখি এখনো সেই লাল মেজেন্টা লেহেঙ্গা আমার পরনে। খুলি নি এখনো? গহনা? কেউ এগুলো খুলে দেয় নি কেন?
আমি বিছানা থেকে নেমে সোজা বাথরুমে ঢুকি। এক এক করে খুলি আমার প্রিয় লেহেঙ্গা, যেটা শাহেদকে সাথে নিয়ে কিনেছিলাম। দোকানে ওড়না আমার মাথায় জড়িয়ে ধরে বলেছিল “বৌ” জীবনে সেইদিনের চেয়ে ভাল কোনোদিন লেগেছিল কিনা জানি না। সেই সুখের চেয়ে আর কোন সুখ এসেছিল কিনা জানি না। আমি সেই ওড়না মাথা থেকে টেনে খুলে ফেলি। নাকের নথ আমার ভাল লাগত না। শাহেদের মায়ের জন্য পরেছিলাম। তিনি বলেছিলেন “বউদের নথ পরলে সুন্দর লাগে, আমার ছেলের বৌকে নথ পরা দেখতে চাই বিয়ের দিন” আজ বিয়ের দিন হওয়ার কথা ছিল, নথ পরেছিলাম। এখন না পরলেও চলবে। এক এক করে সব অলংকার খুলি। এক এক করে সব কাপড় খুলি। খুলে আমি কল ছেড়ে দেই। শীতল জল আমার মাথা দিয়ে ধীরে ধীরে বয়ে যায়। এবং শীতলতার মাঝে আমার দুই গাল বেয়ে উষ্ণ জলও গড়ায়। নীরবে। আমি যখন বাথরুম থেকে বের হই আমার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে যেন। কিছু মনে পড়ে যায়। আমি মাকে খুঁজি। “ভাবী মা কই” ভাবী যেন বুঝতে পারে না কি বলছি। আমি আবার বলি “ভাবী মা কই? রুম্পা,শান্ত হও, মা আছে, রুমেই আছে। শরীর খারাপ হয়ে গেছে। তাই শুয়ে আছে।
আমি ছুটে যাই মার রুমে। মা কপালে হাত রেখে চোখ বন্ধ করে আছে। চোখের দুই কোণে জল শুকিয়ে দাগ হয়ে গেছে। এই দাগ আমার জন্য। কিন্তু এই মুহূর্তে সেটা ভাবতে ইচ্ছে করছে না। আমি শুধু একটাই উত্তর জানতে চাই।
আমি মার পাশে গিয়ে বসি। মা চোখ খুলে। শুকিয়ে যাওয়া জলের দাগ আবার ভিজে উঠে। আমি সেদিকে ভ্রূক্ষেপ করি না। আমি নিরাবেগ কণ্ঠে বলি “আমি তোমার মেয়ে না?” মা বিস্ফারিত চোখে আমার দিকে তাকায়। সেই চোখ অনেক কিছু বলে ফেলে গল গল করে বয়ে যাওয়া জল দিয়ে। আমি আবার শুকনো চোখে এবং কম্পনহীন গলায় বলি “আমি তোমার মেয়ে না?” মা আমাকে জাপটে ধরে জোরে একটা ঝাঁকুনি দেয়। উন্মাদের মত ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলে “তুই আমার মেয়ে, তুই আমার মেয়ে, তুই আমার মেয়ে” ঝাঁকুনি থামিয়ে এবার মা চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করে। সবায় ছুটে আসে মার রুমে। মা আমাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদে। বাথরুমে আমার চোখ দিয়ে যে নীরব জল বয়ে যাচ্ছিল সে জল এখন কেন আসছে না? এখন কেন আমার মায়ের এই গগনবিদারী চিৎকার শুনেও কান্না আসছে না? কেন আমার কান বধির হয়ে যাচ্ছে না। কেন আমি মাকে জড়িয়ে ধরতে পারছি না? কেন ?
দিনের পর দিন আমি রুম থেকে বের হই না। আমার যে খুব খারাপ লাগে তাও না। খুব কষ্ট হচ্ছে তাও না। বিয়ের দিন আমার হবু বর এবং ছয় বছরের প্রেমিক আমাকে জানায় তার পরিবার তাকে আমার সাথে বিয়ে করতে দিবে না কারণ আমি নাকি পালক সন্তান। সে আমাকে ভালোবাসে কিন্তু সে আমাকে বিয়ে করতে পারবে না। সে আমাকে ভালোবাসে কিন্তু সে একটা পালক মেয়েকে বউ করতে পারবে না। সে আমাকে ভালোবাসে কিন্তু সে তার পরিবারকে কষ্ট দিতে পারবে না। সে আমাকে ভালোবাসে এবং সে আমাকে বিয়ের দিনই তীব্র অপমানটা করতে পারে। আমার যে সেই দিনের স্মৃতি খুব মনে পড়ে, তাও না। আমি ইচ্ছে করে মনে করি। ইচ্ছে করে মনে করি যে শাহেদ আমাকে বিয়ের দিন ছেড়ে গেছে কারণ আমি নাকি পালক। আমি ইচ্ছে করে মনে করি যে আমাকে কোনোদিন কেউ জানতে দেয় নি যে আমি পালক। ইচ্ছে করে মনে করি কারণ আমি কাঁদতে চাই। চিৎকার করে কাঁদতে চাই। ভেতরে কিছু একটা জমে শক্ত হয়ে গেছে সেটা কান্না না করলে নরম হবে না। কিন্তু আমার কান্না আসছে না। আমি বুঝতে পারি মা প্রতি রাতে এসে আমাকে দেখে যায়। মা কিছু বলতে চায়। কিন্তু আমি বলার সুযোগ দেই না। ভান করি ঘুমের।
এক রাতে আমিই আমন্ত্রণ জানাই মাকে জেগে থেকে। মা এসে একটু অপ্রস্তুত হয় আমাকে এভাবে বসে থাকতে দেখে। মা আসো। মা আসে, আমার পাশে বসে। মা অপেক্ষা করে কিছু শোনার জন্য। কিন্তু আমি অনেকক্ষণ চুপ করে থাকি। মা? হুম, বল রূম্পা। আমি কি তোমার মেয়ে না? মা সেই বিষ্ফারিত চোখে তাকায় আমার দিকে আবার। সেই দৃষ্টি সহ্য করা কঠিন হয়ে পড়ে আমার জন্য। আমি চোখ নামিয়ে একটু থেমে একটু ধীরে আবার বলি “আমাকে কি জন্ম দাও নাই তুমি?” মা এবার আর আমার দিকে তাকায় না। পাশে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বলে “তোকে আমি জন্ম পেটে দেয় নি। তোকে আমি হাসপাতালে পেয়েছিলাম। তোকে যে জন্ম দিয়েছিল সে কাউকে কিছু না জানিয়ে তোকে ফেলে চলে যায়। আমার হাত কাঁপে। পা কাঁপে। ধীরে ধীরে পুরো শরীর কাঁপে। মা বুঝে। বুঝে আমার হাত ধরে।
আমার তখন সেই হাসপাতালে জরায়ু অপারেশন হয়। তোর বাবা আর আমার খুব ইচ্ছে ছিল আমাদের যেন একটা মেয়ে হয়। কিন্তু তোর ভাই হওয়ার দুই বছর পরই সেই ইচ্ছের মৃত্যু হয় আমার টিউমারের কারণে। মা বলতে থাকে। আমি কাঁপতে থাকি। যেদিন আমাকে ডিসচার্জ দেওয়ার কথা সেদিন হাসপাতালে এই নিয়ে হইচই শুনছিলাম। মা একটু থামে। এরপর আবার বলা শুরু করে, জানিস তোর বাবা আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করে নি। বা আমিও তাকে মুখ ফুটে কিছু বলি নি। কেউ কাউকে বলি নি যে ওই ফেলে যাওয়া অবুঝ শিশুকে নিয়ে আসি। শুধু দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে ছিলাম কিছুক্ষণ। এরপর তোর বাবা বের হয়ে অনেকক্ষণ ফিরে আসে একটা তোয়ালে পেঁচানো নরম নিষ্পাপ কন্যা শিশু নিয়ে। আমি তোকে দেখে নীরবে সুখের জল ফেলছিলাম চোখ দিয়ে। তোর বাবাকে সেদিন আমি প্রথম কাঁদতে দেখি। তোর ভাই হওয়ার সময়ও তোর বাবা কাঁদে নি । কিন্তু সেদিন কেঁদেছিল। সুখে।
তোকে আমার কোল থেকে নিয়ে বলেছিল, “এ আমার মেয়ে জেসমিন, এ আমার মেয়ে” তোর বাবা মারা যাওয়ার সময় তুই তখন মাত্র হাই স্কুলে পড়িস। আমাকে কী বলেছিল জানিস মরার আগে? বলেছিল, আমার মেয়েকে আরও বড় হতে দেখে যেতে পারলাম না। মা আর কিছু বলতে পারে না। আমার হাতটা শক্ত করে ধরে নিশ্চুপ কাদঁতে থাকে। আমার থর থর করে কাঁপতে থাকা শরীর বুঝতে পারে মার শরীরও কাঁপছে। আমি মাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদি। দীর্ঘ তেইশ দিন পর আমি কাঁদতে পারি। বুঝতে পারি ভেতরে জমে শক্ত হয়ে যাওয়াটা ধীরে ধীরে নরম হচ্ছে।
গল্পের বিষয়:
গল্প