যখন ডাক্তার বললেন আমার ডান পা টা কেঁটে ফেলতে হবে তখন আমার হৃদয়ের গহীনে যে প্রকম্পনটা অনুভূত হয়েছিলো তা যদি রিখটার স্কেল দিয়ে মাপা যেতো তবে বোধহয় অতীতের সব রেকর্ড ভেঙ্গে নতুন এক রেকর্ডের আবির্ভাব ঘটতো। আমি তখন চিৎকার দিয়ে বলছিলাম,
-নাহ! আমার পা আমি কাঁটতে দিবোনা। আমার এই প্রলয়ঙ্করী বেদনাভূত আক্ষেপমাখা চিৎকার শুনে ডাক্তার আমার স্ত্রীকে আলাদা ডেকে নিয়ে কী যেন বললেন। অতঃপর আমার স্ত্রী তিশা কিছুক্ষণ অন্তর আমার দুর্বল হাতটি ধরে বললো,
-দেখো। তোমার পা যদি কাঁটা না হয় তাহলে ক্যান্সার হয়ে যেতে পারে। আরে আমি আছিতো তোমার এতো চিন্তা কীসের?
পাশে থাকা বাবা মায়েরও একই স্বর। মায়ের অশ্রুসিক্ত চোখের দিকে তাকিয়ে সেদিন বুঝেছিলাম তাঁরা আমার এই দুঃসময়ে অবশ্যই পাশে আছে। পরিবারের সকলের মতের সাপেক্ষে এবং তাদের ভালোবাসার ছায়াতে আবদ্ধ হয়ে নিশ্চিন্তে আমার পা কাঁটার অনুমতি দিয়েছিলাম ডাক্তারকে। সামান্য একটা এক্সিডেন্টে যে আমার পা টা হারাতে হবে তা যেন আমার কল্পনাতেই ছিলো না। প্রভু হয়তো আমার ভাগ্যটা নিয়ে এক শ্রেষ্ট খেলায় নেমেছে। কিন্তু প্রভুর উর্ধ্বেতো আর আমি যেতে পারবোনা তাই বাকী জীবনের ভারটা তাঁর উপরেই ছেড়ে দিলাম। প্রথম বেশ কয়েকদিন পরিবার এর প্রতিটি সদস্যই বেশ খেয়াল রাখছিলো এই পঙ্গু দেহটিকে। অফিস থেকেও আমাকে সান্ত্বনারস্বরূপ বিনা ডিউটিতেই মাস শেষে বেতনটা আমার ব্যাংক এ্যাকাউন্টে ভদ্রতার সহিতই পাঠিয়ে দিতো। বোনকে এক ডাক দিলেই দৌড়ে এসে বলতো,
-ভাইয়া কিছু লাগবে? আর আমার স্ত্রী তিশার কথা আর কী বলবো। দিন কী রাত সবসময়েই আমার পাশে বসে গল্প করতো। ওয়াশরুমে যাওয়া, গোসল করিয়ে দেয়া কোনো কিছুতেই যত্নের কমতি ছিলোনা। আমি তখন প্রভুর নিকট নিজ স্ত্রীকে নিয়ে এতোটাই শুকরিয়া জ্ঞাপন করছিলাম মনে হয়না কোনো স্বামী তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে এতোটা গর্বিত হয় কীনা।
একসময় অফিসের বস পিয়নকে দিয়ে আমার নিকট একটি চিঠি পাঠায়। চিঠিটা খুলে ভিতরের কাগজটা মেলতেই দেখতে পাই রিজাইন লেটার। আমি বুঝে গিয়েছিলাম তাঁদের আর এই অক্ষম দেহটিকে প্রয়োজন নেই। কেনইবা প্রয়োজন থাকবে কারণ একজন মানুষকে দিয়ে যদি তাঁদের কোন কাজই নাহয় তবে তাঁকে শুধু শুধু বেতন দিয়ে কী লাভ? অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে এরপর থেকেই আমার স্ত্রী তিশার আচরণগত ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয় আমার নিকট। বাবা মা আর বোনও সেরকমভাবে আমাকে গুরুত্ব দিচ্ছে না। তিশাকে প্রায়শই দেখতাম জানালার পাশে অন্যমনষ্ক হয়ে বসে থাকতে। আমার নিকট ও যে নিজের অবস্থার কারণে খারাপ লাগতো না তা কিন্তু নয়। এরকম অবহেলাগুলো সহ্য করতে না পেরে একদিন তিশার হাত ধরে জিজ্ঞেস করেই বসলাম,
-তুমি আমাকে ভালোবাসোনা?
-হঠাৎ এই প্রশ্ন?
-না মানে তুমি কীরকম যেন বদলে গেছো। হসপিটালে সেদিনতো কথা দিয়েছিলে সবসময় পাশে থাকবে এখন কেনো এরকম করছো? হঠাৎই তিশা উত্তেজিত হয়ে বললো,
-কী বলতে চাও তুমি? আমি তোমার খেয়াল রাখিনা? এমনিতেই পঙ্গু হয়ে আছো তাঁর উপর আবার আমার এতো কষ্ট। তোমাকে বিয়ে করাটাই ভুল ছিলো আমার। তিশার এরকম রূঢ় ব্যবহার দেখে আমার নয়ন দুটি অজানা কারণে জলে ছলছল করে উঠেছিল। যেই তিশা কোনোদিন ঝগড়া তো দূরের কথা উচ্চ গলায় একটি কথাও বলেনি সেই তিশা আজ আমার অসহায়ত্বের সুযোগে আমাকে অবজ্ঞা করছে? তিশার কথা শুনে সেদিন আমি একটি মুচকি হাসি দিয়ে হুইল চেয়ারটি পেছনে ঘুরিয়ে বারান্দায় বসে পশ্চিম আকাশের অস্তমিত লাল সূর্যটির দিকে তাকিয়ে ভাবছিলাম,
-আমার সূর্যটাও হয়তো এভাবেই কোন একসময় অস্ত যাবে। যেই বন্ধুরা প্রতিদিন আড্ডাস্থলে আমার আসার অপেক্ষায় প্রহর গুণতো আজ তাঁরাও আর খোঁজ নিতেও আসেনা যে তাঁদের প্রিয় অসহায় বন্ধুটি আজ কেমন আছে? খোঁজ নিবেই বা কেন কারণ এখনতো আর তাঁদের বন্ধুটি নিজ পকেটের টাকায় চা সিগারেট খাওয়াতে পারবেনা তাঁদেরকে তাইনাহ? হঠাৎই একদিন তিশাকে নিজ বিছানার পাশে দেখতে না পেয়ে তিশা বলে কয়েকবার ডাক দেওয়ার পরও কোনো সাড়াশব্দ পেলাম না। আমার ডাকাডাকিতে বাবা মা আর বোন অনেকটা ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আমার হাতে একটি কাগজ ধরিয়ে দিয়ে যে যার রুমে চলে যায়। কাঁপা কাঁপা হাতে কাগজের ভাঁজগুলো খুলে চিঠিটা পড়া শুরু করলাম। প্রতিটি শব্দ উচ্চারণের সাথে সাথে মনে হচ্ছিল কেউ যেন আমার হৃদয়ে এক এক করে তীর নিক্ষেপ করছে। হ্যাঁ আপনারা ঠিকই ভাবছেন।
তিশা এই পঙ্গু দেহটির দায়িত্ব পালন করতে করতে একপ্রকার হাঁপিয়ে উঠেছিলো তাই সে দাসত্ব থেকে মুক্তি নিয়ে নতুন ঘরবাঁধার স্বপ্নে অবহেলায় জর্জরিত দেহটিকে রেখে পাড়ি জমিয়েছে এক স্বর্গীয় নিবাসে। বিশ্বাস করুন সেদিন আমি একটুও কাঁদিনি কারণ আমি জানতাম এরকম পরিস্থিতি কোনো একদিন হবেই হবে। এরপর বাবা মায়ের ভালোবাসার অবলম্বনে বেঁচে থাকার ক্ষুদ্র প্রয়াসটাও যেন কর্পূরের মতোই উবে গেলো। তাঁরা আমাকে ভাবতে শুরু করলো পরিবারের এক মূল্যহীন ছাইয়ের বস্তা। সর্বশেষ এতো এতো অবহেলা সহ্য করতে না পেরে একপর্যায়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে উপনীত হলাম যে এই মূল্যহীন বস্তাকে পৃথিবীর আলো বাতাসে রেখে অন্যের কাধের ওজনটা ভারী করবোনা আর। গলায় যখন ফাঁসির দড়িটা পেঁচিয়ে ঝুলে পরলাম অজানার উদ্দেশ্যে তখন অতীতের সব সুখময় দৃশ্যের ভান্ডার চোখের সামনে পরিলক্ষিত হচ্ছিলো। হঠাৎই কারো ধাক্কায় এক নৃশংস ঘুমন্ত স্বপ্ন থেকে বাস্তবে ফিরলাম। চোখ মেলে তাকাতেই দেখি আমার স্ত্রী তিশা সৌন্দর্য্যে ভরপুর এক জামদানী শাড়ি পরে দাঁড়িয়ে আছে।
-কী হলো ঘামছো কেন? আর নিজের গলা নিজেই টিপে ধরেছিলে। খারাপ স্বপ্ন দেখেছো নাকি? আমি তিশার কথার উত্তর না দিয়ে নিজের ডানপাটার দিকে তাকালাম। নাহ আমার পা জায়গামতোই আছে তার মানে এতক্ষণ যাবৎ এটা স্বপ্ন ছিলো? আজ আমার আর তিশার বিবাহবার্ষিকী তাই পরিবারের সদস্যদের ছাড়াও বেশ কিছু মেহমান এসেছে। অনুষ্ঠানের মধ্যপর্যায়ে যখন সবাই একে অন্যের সাথে গল্পে ব্যস্ত তখন সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললাম,
-আজ আপনাদের একটি গল্প শুনাবো। সবাই কৌতুহলের দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাতেই বলা শুরু করলাম নিজের ব্যখ্যাহীন স্বপ্নের প্রতিটি অংশ। গল্পের অন্তিম পর্যায়ে সকলের দিকে একনজর তাকাতেই দেখি অনেকের মুখেই লজ্জার আভা আর আমার স্ত্রী আর মায়ের চোখে জলের আভা। তাঁরা হয়তো কখনোই ভাবেনি তাঁদেরকে এরকম বাস্তবতার রূপরেখা সংবলিত গল্প শুনাবো। পরিশেষে একটি প্রশ্ন সবার উদ্দেশ্যে করলাম,
-আজ যদি স্বপ্নটা সত্যি হতো তবে আপনারা কী এখানে থাকতেন নাকি স্বপ্নের মতোই দূরে সরে যেতেন?
কারো মুখেই কোনো জবাব নেই। প্রভু হয়তো স্বপ্নের মাধ্যমে আমাকে দেখিয়ে দিয়েছেন পৃথিবীতে কারো কাছেই তুমি প্রিয়জন নও বরং প্রয়োজন।
আপনি কী সত্যিই আপনার পাশের মানুষটিকে খুব আপন ভাবেন? আমি নিশ্চিত হয়ে বলতে পারি আপনার প্রতি তাঁর প্রয়োজন যখন ফুরিয়ে আসবে তখন সেও আপনাকে দূরে ঠেলে দিতে দ্বিধাবোধ করবেনা এমনকি রক্তের সম্পর্ক হলেও না। কিন্তু মাঝেমাঝে প্রকৃত ভালোবাসাগুলো দেখলে খুব হিংসে হয় জানেনতো। যখন দেখি একজন অক্ষম স্বামী, স্ত্রী, বাবামা কিংবা সন্তানকে তাঁর প্রিয়জন শত বাধা বিপত্তিতেও ছেড়ে যায়না। কিন্তু এরকম দৃষ্টান্ত কী আপনার প্রিয়জনের নিকট উপস্থিত আছে? আপনি একবার হলেও পরীক্ষা করে দেখবেন যে আপনার প্রিয়মানুষগুলো কী বিপদে আপনার পাশে থাকে নাকি স্বপ্নের আদলে দূরে ঠেলে দেয়ে? আপনি কী তাঁদের প্রিয়জন নাকি প্রয়োজন? প্রশ্নের উত্তরটা কিন্তু চাই…
গল্পের বিষয়:
গল্প