শ্রাবণী নামের মেয়েটা মাথা নিচু করে চুপচাপ আমার সামনে বসে আছে। আমি মুচকি হেসে শ্রাবণীকে বললাম,
–তরকারিতে লবণ বেশি দেওয়ার কারণে আমার বাবা মায়ের ডিভোর্স হয় শ্রাবণী অবাক চোখে আমার দিকে তাকাতেই আমি হেসে বললাম,
–কি! আশ্চর্য লাগছে বিষয়টা তাই না? ঠিক আছে আমি তাহলে পুরো ঘটনাটা খুলে বলি আমি তখন ক্লাস ফাইভে পড়াশোনা করি। একদিন রাতে খেয়াল করি বাবা খুব রেগেমেগে বাসায় ফিরে মাকে বললো,
-“টেবিলে তাড়াতাড়ি খাবার দাও” খাবারটা গরম করতে মা’র একটু দেরি হচ্ছিলো। আর এটা দেখে বাবা ডাইনিং টেবিলে রাখা কাচের দুইটা গ্লাস ভেঙে ফেললো। মা শব্দ শুনে দৌড়ে রান্নাঘর থেকে এসে বাবাকে বললো,
-“রাগ করেন না যে। একটু অপেক্ষা করেন। খাবার গরম করছি তো তাই দেরি হচ্ছে” বাবাকে টেবিলে খাবার দিয়ে মা ভাঙা গ্লাসের টুকরো গুলো ঝুড়িতে তুলছিলো। আমিও যখন মাকে সাহায্য করতে গেলাম তখন মা আমায় বললো,
-” তুই তুলতে পারবি না। হাত কেটে যাবে” তখন বাবা মাকে বললো,
-“লবণ কি পুরোটাই তরকারিতে ঢেলে দিয়েছিলে” মা তখন মাথাটা নিচু করে বললো,
-“তরকারিতে আসলেই লবণ একটু বেশি হয়ে গেছে। অল্প তরকারি নিয়ে একটু কষ্ট করে খেয়ে নেন। আসলে আমি বুঝতে পারি নি লবণ এতটা বেশি হয়ে যাবে।” মায়ের কথা শুনে বাবা খাবারের প্লেটটা ছুড়ে ফেলে দিয়ে বললো,
-” তুই বুঝবি কি করে? তোর মন তো এই সংসারে নেই। তোর মন তো সারাক্ষণ ভার্সিটির বন্ধু বান্ধবের দিকে পড়ে থাকে” মা হেসে বললো,
-“আপনি নিশ্চয়ই বাহিরের কোন ঝামেলার কারণে রেগে আছেন। আর সেই রাগটা আমার উপর ঢালছেন। রাগ ঢালেন সমস্যা নেই কিন্তু দয়া করে অভদ্র মানুষদের মত নিজের স্ত্রীকে তুই তুকারি করেন না যে” মা’র কথা শুনে বাবা আরো রেগে গিয়ে মা’র গালে একটা থাপ্পড় মারলো। মা একহাতে নিজের গালটা ধরে আরেক হাতে আমায় ধরে অন্য রুমে যেতে যেতে বাবাকে বললো,
-“আপনি এখন খুব রেগে আছেন। তাই এই ভুল কাজটা করে ফেলেছেন। আপনার রাগটা আগে কন্ট্রোল করেন তারপর সকালে আমায় একবার সরি বলে দিয়েন আমি আর কিছু মনে করবো না। কিন্তু নেক্সট টাইম আমার গায়ে হাত তুলার কথা চিন্তাও করেন না যে” এইকথা বলে মা যখন আমায় নিয়ে অন্য রুমে যাবে তখন বাবা মাকে আরো একটা থাপ্পড় মেরে বললো,
-” তোকে আবারও মারলাম। এখন তুই কি করবি বল?” থাপ্পড়টা খাওয়ার পর মা বললো,
-“কি আর করবো! তোকে ডিভোর্স দিবো” যে মা বাবাকে আপনি বাদে কখনো কথা বলতো না সেই মা শেষ বেলায় বাবাকে তুই করে কথা বলে সেই রাতেই আমাকে সাথে নিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে গিয়েছিলো ডিভোর্সের পরবর্তী জীবনটা আমার মায়ের কখনোই সুখে যায় নি। নানু সব সময় মাকে দোষারোপ করতো আর বলতো,
-“তোর মত জেদি মেয়েকে পেটে ধরে আমি ভুল করেছি। সংসার করতে গেলে স্বামী স্ত্রীর একটু ঝামেলা হয়। ভুল করে জামাই একবার তোকে মেরেছিলো বলে ডিভোর্স দিতে হবে নাকি? তোর বাবাও তো মাঝেমধ্যে আমার গায়ে হাত তুলতো। কই আমি তো তোর বাবাকে ডিভোর্স দিয়ে তোর মত সংসার ছেড়ে পালিয়ে যায় নি” নানুর এই কথার উত্তরে মা সবসময় হেসে বলতো,
-“এই জন্যই তো তুমি এই সংসারে এতটা অবহেলিত। বাবা তো তোমাকে মানুষ বলেই মনে করে না। তুমি নিজে নিজেকে সম্মান করো না, অন্যজন তোমায় কি সম্মান দিবে বলো?” একবার একটা ঘটনা ঘটলো। পাত্র পক্ষ আমার ছোট আন্টিকে দেখে খুব পছন্দ করলো। বিয়ে প্রায় ঠিকঠাক। তখন পাত্রের বাবা আমার নানাকে বললো,
-” আপনার বড় মেয়ের জামাই কি করে? আর তাকে দেখছি না তো” নানা আমতা আমতা করে বললো,
-“বড় মেয়ের জামাই ব্যবসা করে। অনেক বড় ব্যবসা ওদের। ব্যবসার কাজে ব্যস্তত তাই আজ আসতে পারে নি”
মা তখন হেসে বললো,
-” কেন মিথ্যা বলছো বাবা? সত্যিটা ওদের বললেই হয়” মা পাত্রের বাবাকে বললো,
-” আমার জামাই আগে ছিলো এখন নেই। ও আমার গায়ে একবার হাত তুলেছিলো আর এজন্য আমি তাকে ডিভোর্স দিয়ে দেই” মা’র কথা শুনে পাত্রের বাবা অবাক হয়ে বললো,
-“একবার হাত তুলেছিলো বলে ডিভোর্স দিতে হবে?” মা তখন বললো,
-” ডিভোর্স দিবো না তো কি মরে লাশ হবার জন্য অপেক্ষা করবো? যে পুরুষ অন্যের রাগ নিজের স্ত্রীর উপর মিটানোর জন্য স্ত্রীর গায়ে হাত তুলতে পারে, সেই পুরুষ নিজের স্ত্রীকে গলা টিপে হত্যা করবে না তার কি গ্যারান্টি আছে?” মা’র এইসব কথার ফলস্বরূপ ছোট আন্টির বিয়েটা ভেঙে যায়। আর নানা তখন মাকে সোজা বলে দিলো, মায়ের জন্য তার বাকি মেয়েদের জীবন নষ্ট করতে পারবে না। তাই বাসা থেকে বের হয়ে যেতে বললো। মা যেহেতু চাকরি করতো সে হিসাবে আমাদের তেমন কোন অসুবিধা হলো না। আমরা অন্য ফ্ল্যাটে উঠলাম। কয়েকদিন পর সেখানেও সমস্যা দেখা দিলো। বাড়িওয়ালা প্রায় সময় আমাদের ফ্ল্যাটে এসে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকতেন। মা যে বিরক্ত হচ্ছেন সেটা মা আকার ইঙ্গিতে উনাকে বুঝাতেন তবুও তিনি যেতেন না। একদিন মা সরাসরি বাড়িওয়ালাকে বললেন,
-” দেখেন ভাই, আপনি বাড়িওয়ালা আর আমি ভাড়াটিয়া। মাস শেষে আপনি আসবেন এককাপ চা দিবো খেয়ে টাকা নিয়ে চলে যাবেন। প্রতিদিন তো আসার দরকার নেই” মা’র কথা শুনে বাড়িওয়ালা চুপচাপ মাথা নিচু করে চলে গিয়েছিলো আর তার ঠিক ৯ দিন পর আমাদেরও বাসা থেকে বের করে দিয়েছিলো। এইভাবেই একের পর এক কষ্ট সহ্য করে মা আমায় মানুষ করেছে। চাইলেই মেয়েরা মাথা উঁচু করে বাঁচতে পারে সেটা আমি আমার মাকে দেখেই বুঝেছি। আমার কথা গুলো শুনার পর খেয়াল করে দেখি শ্রাবণীর চোখের কোণে পানি জমে আছে। আমি তখন একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললাম,
— তোমায় দেখার আগে অর্পিতা নামের একটা মেয়েকে আমাদের পছন্দ হয়েছিলো। কিন্তু শেষে গিয়ে বিয়েটা ভেঙে গেলো শ্রাবণী চোখের কোণে জমে থাকা জলটা মুছে বললো,
-“কেন?” আমি হেসে বললাম,
— মা অর্পিতাকে বলেছিলো, ” তোমার স্বামী অন্যায় ভাবে তোমার গায়ে হাত তুললে তুমি কি করবে?” অর্পিতা উত্তর দিয়েছিলো,
-” সংসারে টুকটাক ঝামেলা ভুল বুঝাবুঝি হবেই। আমি সহ্য করে নিবো” এজন্যই মা বিয়ে ভেঙে দিয়েছিলো আমাদের কথা বলার মাঝে হঠাৎ মা এসে আমায় বললো,
-” তোদের কথা বলা শেষ হলে আমি মেয়েকে একটা প্রশ্ন করতে চাই ” মা তখন শ্রাবণীকে বললো,
-” আচ্ছা মা, ধরো বিয়ের পর আমার ছেলে কোন কারণে অন্যায় ভাবে তোমার গায়ে হাত তুললো। তখন তুমি কি করবে?” শ্রাবণী তখন বললো,
-” আমি কোন অন্যায় করলে আমায় বুঝাবে। তবুও যদি আমি না বুঝি তাহলে দ্বিতীয়বারও বুঝাবে। দ্বিতীয়বার না বুঝলে তৃতীয়বার একটু শাসন করবে আমি সেটা মেনে নিবো। কিন্তু অন্যায় ভাবে আমার গায়ে হাত তুললে আমি সেটা মেনে নিবো না। প্রথমে আপনার ছেলের মাথা ফাটাবো তারপর সাংসারকে লাথি মেরে চলে আসবো” শ্রাবণীর কথা শুনে মা হাসতে হাসতে বললো,
-“আলহামদুলিল্লাহ, মেয়ে আমাদের পছন্দ হয়ছে” মা’র চোখে মুখে তখন বিজয়ের হাসি আর আমার চোখে মুখে তখন আতংক মা শেষে কি না নিজের সন্তানকে জল্লাদের হাতে তুলে দিচ্ছে…
গল্পের বিষয়:
গল্প