– তাসমিয়া সুলতানা কেয়া। বয়স ৩৫ এর কাছাকাছি। ১৫ বছর পূর্বে পারিবারিকভাবেই আমরা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হই। কিন্তু আমাদের ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস , গত ১৪ বছরে আমাদের সংসারে কোন বাচ্চাকাচ্চা আসেনি। তবে এটা নিয়ে আমাদের কারও মাঝেই কোন অভিযোগ ছিলোনা। সর্বোচ্চ সুখী দম্পতি হিসেবেই আমাদের পারিবারিক জীবনটা কেটেছিল। যদিও একরাতে হঠাৎ তাসনিয়া আমাকে বলেন,
“যদি কিছু মনে না করেন তাহলে আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করবো।”
“ঠিকাছে, করেন।”
“সত্যি করে বলবেন, কোন রাগটাগ করা যাবেনা কিন্তু।”
“ওকে, বলেন।”
“এতদিন পর্যন্ত যে আমাদের কোন সন্তান-সন্ততি হচ্ছেনা, এজন্য কি আপনি মনে কষ্ট পাচ্ছেননা? বা আমাদের সম্পর্ক নিয়ে আপনার রাগ হচ্ছেনা?
“এটা কি বললেন আপনি? এতদিন আমার সাথে সংসার করেও আপনি আমাকে চিনতে পারলেন না! আপনি কি মনে করেন, আমি আমার রবের কৃতজ্ঞ বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত নই? আপনি আমার সম্পর্কে এমন জঘন্য ধারণা কিভাবে করতে পারলেন?” “আমিতো এমনি এমনি জিজ্ঞাসা করেছি, আপনি রেগে যাচ্ছেন যে! সরি, আমার ভুল হয়েছে।” “রেগে যাওয়ার কারণ আছে, যেখানে আমাদের সৃষ্টিকর্তা বলেছেন,( আমি যাকে চাই ছেলে দেই, যাকে চাই মেয়ে দেই, যাকে চাই উভয়টা দেই, আবার যাকে চাই তাকে কোনটাই দেইনা।) তাহলে আপনার কথা দ্বারা বুঝা যাচ্ছে, আমি আমার প্রভূর আয়াতকে অস্বীকার করছি! সৃষ্টিকর্তার বণ্টনে আমি সন্তুষ্ট নই!” “নাউজুবিল্লাহ! সত্যি, আমি ওভাবে ভাবিইনি। এর জন্য আপনার কাছে ক্ষমা চাচ্ছি। ক্ষমা করেছেন?” “ক্ষমা চাইতে হবেনা, ভুল যেহেতু বুঝতে পেরেছেন এতেই যথেষ্ট। আমিওতো আপনার উপর হঠাৎ রেগে গিয়েছি, সেজন্যও সরি।”
এরপর থেকে গত ১৪টি বছর এই বিষয়ে আমাদের মাঝে নতুন করে কোন টুনটান পর্যন্ত হয়নি। প্রেম, ভালবাসা আর ছোটখাটো খুনসুটিতেই আমাদের দিনগুলো চলে যেতে লাগলো। দু’জন মিলে রান্না করা, বসে বসে গল্প করা, বিভিন্ন গল্পের বই নিয়ে আলোচনা সমালোচনা করা, একসাথে কুরআন তিলাওয়াত করা, কুরআন মুখস্থ করার প্রতিযোগিতা করা, তাহাজ্জুদে দাঁড়িয়ে রাতের একতৃতীয়াংশ পাড় করে দেওয়া _এসব করতে করতেই দিন চলে যেতো আমাদের।
বাচ্চাকাচ্চা ছাড়াই ১৪টি বছর অতিবাহিত হল। নয়মাস আগে যখন জানতে পারলাম, আমরা বাবা-মা হতে চলেছি, আমাদের কোলজুড়ে রবের উপহার ‘কুররাতু আ’য়ুন’ আসতে যাচ্ছে, আমাদের বাতিহীন ঘরে প্রদীপের আলো নিয়ে কেউ একজন আসছেন তখন আনন্দে দু’জনের প্রাণটাই ভরে গেলো।
সুসংবাদ পাওয়ার সাথে সাথেই দু’জনে ১০০ রাকাত তাহাজ্জুদের সালাত মানত করেছিলাম। ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম বৃদ্ধ বয়সে সন্তান ইসমাইলকে পেয়ে যেমনিভাবে আনন্দে আত্মহারা হয়ে গিয়েছিলেন, আমরাও ঠিক তেমনই আনন্দিত হয়েছিলাম। আর রবের কাছে বেশি বেশি দু’আ করেছিলাম, “হে আল্লাহ! আমাদেরকে একটি নেক সন্তান দান করুন অর্থাৎ আমাদের আসন্ন সন্তানটি যেন তোমার নেক বান্দাহদের অন্তর্ভুক্ত হয়।” “হে আল্লাহ! আপনি আমাদেরকে এমন সন্তান এবং জীবনসঙ্গিনী দান করুন, যারা আমাদের জন্য চক্ষুশীতলকারী হয়।” এভাবেই দিনগুলো অতিবাহিত হতে লাগলো। যতই দিন যাচ্ছিলো আসন্ন সন্তানের জন্য আমাদের মধ্যে ততই মায়া জন্মাতে লাগলো। কয়েকদিন পরপরই আমরা ডাক্তারের স্মরণাপন্ন হতাম এবং দিকনির্দেশনা নিয়ে বাসাত যেতাম। ৯ মাস হওয়ার পর আজ সকালে হঠাৎ উনি পেটে প্রচণ্ড ব্যাথা অনুভব করলেন। ধীরে ধীরে ব্যাথা বাড়তে লাগলো, তাই দেরি না করে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে আসলাম।”
— এতক্ষণ আমার কক্ষে বসে কথাগুলো বলছিলেন তাসমিয়ার স্বামী আশিকুর। কথাগুলো যখন বলছিলেন তখন তার চোখ বেয়ে বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছিলো। একজন স্ত্রীর প্রতি তার স্বামীর নিঃস্বার্থ ভালবাসা কেমন হতে পারে উনাকে না দেখলে হয়তো তা বুঝতেই পারতামনা। অ্যাসিস্ট্যান্ট এর ডাক পেয়ে উনাকে আমার কক্ষে রেখেই আমি সোজা তাসমিয়ার কক্ষে চলে গেলাম।
যেহেতু আমি পেশায় একজন গাইনী বিশেষজ্ঞ সেই হিসেবে আমার কাজ ডেলিভারি রোগীদের নিয়েই। বলতে পারেন জন্ম-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণেই আমার বসবাস। প্রত্যহ আমার দিনগুলো কাটে দুইভাগে_কিছু সময় সুসংবাদের আনন্দধারায় আর কিছু সময় দুঃসংবাদের অশ্রুধারায়। মনটাকে সাময়িক সময়ের জন্য আনন্দ উল্লাসে রাখতে চাইলেও পারিনা। কখনো হাসির মাঝেই অশ্রু বিসর্জন দিতে হয়, কখনোবা দুঃখের অশ্রু মুছতে না মুছতেই আনন্দের খবর শুনতে হয়। তাই মুখে সর্বদা হাসি-আনন্দ জিইয়ে রাখি_কখন যে কোনটার প্রয়োজন পড়ে যায়।
কত ডেলিভারি কেইস নিজ হাতে হ্যান্ডেল করেছি ২০ বছরের এই ডাক্তারি জীবনে। কখনো সফল হয়েছি আবার কখনোবা ব্যর্থ হয়েছি। সফলতার পরে যেমনিভাবে আলহামদুলিল্লাহ বলেছি, তদ্রুপ ব্যর্থতার পরেও আলহামদুলিল্লাহ বলেছি। জানতাম, সৃষ্টিকর্তা কখনো সৃষ্টির অকল্যাণ চান না, যা করেন আমাদের ভালোর জন্যই করেন; তবে সাময়িক খারাপ লাগা কাজ করেই থাকে। আর খারাপ লাগাটাও স্বাভাবিক; কারণ আমরাতো রক্ত মাংসে গড়া মানুষই। বিশ্বনবীর জীবনেতোও এমনটা হয়েছিল।
সন্তানের মৃত্যুতে তার চোখ মুবারক বেয়ে বেয়েও অশ্রু গড়িয়েছিল। তখন সাহাবিদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছিলেন, “আমিতো মানুষই, মানবিক দুর্বলতাতো আমার মাঝেও আছে; তবে তা অতিমাত্রায় না।” তবে অন্যদিনের কেইসগুলোতে আমি ততটা কষ্ট পাইনি যতটা কষ্ট আজকে পেয়েছিলাম। যখন দেখলাম তাসমিয়ার শরীর থেকে অতিমাত্রায় ব্লাড নির্গত হচ্ছে। একাধিক ফর্মুলা অবলম্বন করেও যখন কোন ফল পাচ্ছিলাম না তখন আমাদের সবার চেহারায় ব্যর্থতার একটা ছাপ স্পষ্ট হয়ে গেলো। তবুও আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলাম। ঘন্টাখানেক পর মোটামুটি নিয়ন্ত্রণে এসেছিল। রাত ১১টার দিকে তাসমিয়া ফুটফুটে একটি কন্যাসন্তান প্রসব করল। মিনিট দুয়েক পর পুনরায় ওর শরীর থেকে ব্লাড যেতে শুরু করে। ব্লাড নিয়ন্ত্রণের জন্য আমরা আমাদের সর্বোচ্চটা দিয়ে চেষ্টা করে যাচ্ছিলাম।
তাসমিয়ার অবস্থা যখন বেশি সুবিধাজনক মনে হচ্ছিলনা, তখন বাচ্চাটাকে কিছুক্ষণের জন্য ওর বুকের উপর রাখলাম, জীবনের শেষমুহূর্তে একটিবারের জন্য হলেও যেন বাচ্চাটিকে দেখে যেতে পারে। বুকের উপর রাখা বাচ্চাটির দিকে তাকিয়ে অন্যান্য মায়েদের মতো আনন্দের হাসি না হেসে তাসমিয়া কান্না করে দিল, ওর চোখগুলো অঝোরে অশ্রু বিসর্জন করে যাচ্ছিল। দীর্ঘ প্রতিক্ষার পর পাওয়া পুষ্প-কন্যাকে এটাই যে তার শেষ দেখা_সেটাও হয়তোবা ইতোমধ্যে তার জানা হয়ে গিয়েছে। যখন দেখলাম, তাসমিয়ার শরীর ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে, তখন ওর বুকের উপর থেকে বাচ্চাটাকে আমার কোলে নিয়ে নিলাম। ৩-৪ মিনিটের মাথায় তাসমিয়া দুনিয়ার জীবন ত্যাগ করে পরপারের মেহমান হয়ে আমাদের ছেড়ে চলে গেলো।
বাচ্চাটার দিতে তাকাতেই কেন যেন অঝোরধারায় কান্না চলে আসলো আমার। অথচ এমন ঘটনা প্রতিনিয়তই ঘটছে আমার সাথে। চোখের সামনে কত নবজাতকের মায়ের মৃত্যু দেখেছি। কিন্তু কখনো আজকের মতো কান্না আসেনি। বাচ্চাটি নিয়ে আমার রুমে অপেক্ষমাণ বাবা আশিকুরের কোলে তুলে দিলাম। বাবা বাচ্চাটির দিকে তাকিয়ে আলহামদুলিল্লাহ বলে আনন্দের একটা হাসি দিলো, তারপর কপালে দুটো চুমু খেলো। দুই তিনমিনিট পর আমি উনার প্রিয়তমা স্ত্রীর মৃত্যুর খবর উনাকে জানালাম। খবরটি শোনামাত্রই আশিকুর জ্ঞান হারিয়ে ফেললেন।
গল্পের বিষয়:
গল্প