অন্য দিবস

অন্য দিবস
– শুনো মা, প্রতিবছর এই দিনটাতে বাবা অনেক ঝামেলা করেন। এবার কিন্তু আমি এরকম কিছু সহ্য করবো না বলে দিলাম। আমার কথায় মায়ের কোনো ভ্রুক্ষেপ হল না। কড়াইয়ের গরম তেলে পেঁয়াজ কুচি ভাজতে ভাজতে তিনি বলেন,
– এই করোনার মধ্যেও তোর ধুমধাম করে জন্মদিন পালন করতে হবে! তাও আবার বাইরে গিয়ে বন্ধুদের সাথে!
– করোনায় কি কোনোকিছু আটকে আছে? মানুষ বিয়ে করছে, হানিমুনে যাচ্ছে, বাসা চেইঞ্জ করছে সবই তো চলছে। তাছাড়া নিজের বার্থডে’তে কেউ ঘরে বসে থাকে? ফ্রেন্ডদের সাথে বের হয় না, সেলিব্রেট করে না? আমি একাই করি এসব?
– তোর বাবা এসব পছন্দ করে না। তবুও প্রত্যেকবার জেদ ধরে বসে থাকিস, শেষমেশ তোর বাবাও তোর জেদের কাছে হার মেনে যায়। আর তারপর আমি মায়ের কাছে এগিয়ে গেলাম,
– তারপর সকালে অফিসে যাওয়ার আগে আমি ঘুমে থাকতেই আমার বালিশের কাছে টাকা রেখে যান, এটাই তো বলতে নিচ্ছিলে? কিন্তু পরের কয়েকদিন যে মুখ গম্ভীর করে থাকে তার বেলায়? ঠিক করে কথাও বলে না আমার সাথে। মা একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন,
– সে’ই তো। তাই বলছি, এত ঝামেলার কি দরকার? তার চেয়ে বরং বাসায় থাক, আমি তোর পছন্দের খাবারগুলো রান্না করি।
– উফ মা, বোকার মত কথা বলো না তো। আমি আমার বন্ধুদের সাথে প্রোগ্রাম সেট করে ফেলেছি। তুমি যে করেই হোক বাবাকে বুঝাবে।
সন্ধ্যার পর বাবা অফিস থেকে ফিরে মায়ের কাছে সব শুনে কড়া নির্দেশ জারি করে দিলেন, “আগামীকাল কিছুতেই আমার বাইরে যাওয়া চলবে না। যা করার ঘরে থেকেই যেন করি।”
তারপর রাগ করে আর ভাত খেলাম না রাতে। দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়লাম। মাঝে কয়েকবার এসে মা খাওয়ার জন্য ডেকে গেলেও কানে তুললাম না। পরে অবশ্য সবাই ঘুমিয়ে যাওয়ার পর ক্ষিদের জ্বালায় টিকতে না পেরে চুপিচুপি ডাইনিং এ গিয়ে পেট ভরে খেয়ে নিয়েছিলাম। পরদিন সকালে আমার ঘুম ভাঙলো অনেকটা দেরি করে। আড়মোড়া ভেঙে কম্বলের ভেতর থেকে হাত বের করে বালিশের পাশে মোবাইল খুঁজতে গিয়ে এক হাজার টাকার চারটা কচকচে নতুন নোট আবিষ্কার করলাম। খুশির চোটে ঠান্ডার দাপট আর ঘুমের রেশ দুটোই একসাথে কেটে গেল। তাড়াতাড়ি করে বিছানা ছেড়ে উঠে ফ্রেশ হতে চলে গেলাম। আজ আমার ২২তম জন্মদিন৷ অবশ্যই আমার জন্য বিশেষ একটা দিন। আর বিশেষ দিন কাটাতে হয় একজন বিশেষ মানুষের সাথে, যাকে আমি আমার সবথেকে কাছের এবং প্রিয় মানুষ বলে বিশ্বাস করি। তাই আজকের দিনটা নিয়ে কোনো হেলাফেলা চলবে না। প্রতিটি মুহূর্ত, প্রতিটিক্ষণ খুব তৃপ্তির সাথে উপভোগ করতে হবে।
পিচ কালারের নতুন শাড়িটা আলমারি থেকে বের করে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে গায়ে জড়িয়ে ধরে একবার ট্রায়াল দিয়ে নিচ্ছি। আমার প্রিয় মানুষটা বলে, আমাকে নাকি এই রঙে বেশ মানায়। কিন্তু পিচ কালার ব্যক্তিগতভাবে আমার তেমন পছন্দ না বলে কখনো তার সামনে সেভাবে পরা হয়নি। আজ পরবো। চোখে কাজল পরতেও আমার ভালো লাগে না, বড্ড সেকেলে মনে হয়। কিন্তু আমার প্রিয় মানুষটা আমার চোখে কাজল দেখতে ভালোবাসে। অনভ্যস্ত হাতে তাই যত্ন নিয়ে কাজল টেনে নিলাম দু’চোখে। তারপর এক এক করে ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক, মানানসই হাতঘড়ি, ছোট্ট একজোড়া পাথরের কানের দুল পরে নিলাম। পিঠ সমান সিল্কি চুলগুলো খোলা রাখবো না বেঁধে রাখবো, এ নিয়ে দ্বিধান্বিত ছিলাম খানিকক্ষণ। তারপর মাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলে মা বললেন,
– সুন্দর করে বেনী করে ফেল, ভালো লাগবে। মনে মনে নাক ছিটকালেও বাইরে তা প্রকাশ করলাম না।
– তুই না পারলে বল, আমি করে দিচ্ছি। মায়ের কথা শুনে সাথে সাথে যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। বাসা থেকে বের হওয়ার আগে মা আরেকবার মনে করিয়ে দিলেন, “সন্ধ্যার আগে বাসায় ফেরার কথা”। সাথে মুখ কালো করে মিনমিন করে বলার চেষ্টা করলেন, “না বের হলে কি হত না!” প্রথম কথাটা কানে তুললেও দ্বিতীয়টা বুঝেও না বুঝার ভান করে রইলাম।
সাবধানী হাতে শাড়ির কুচি আলগা করে ধরে রিক্সা থেকে নেমে সরাসরি প্রিয় মানুষটার অফিসের ভেতর ঢুকে গেলাম। বুক ধকধক করছে, হাত পা কাঁপছে এবং একইসাথে অজানা আনন্দে মন ভরে উঠছে। ক্ষণে ক্ষণে এক মিশ্র অনুভূতির সাক্ষী হচ্ছি৷ আচ্ছা, তার সামনে গিয়ে দাঁড়ানোর পর তিনি কি অবাক হবেন আমাকে দেখে নাকি অসন্তুষ্ট হবেন? এভাবে অসময়ে অফিসে এসে সারপ্রাইজ দিতে গিয়ে আবার বিব্রতকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে না তো আমাকে? ধীর পায়ে হেঁটে তার ডেস্কের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই ফাইলের উপর থেকে মুখ তুলে মোটা ফ্রেমের চশমার ফাঁক দিয়ে তার স্বভাবসুলভ গম্ভীর দৃষ্টি নিয়ে তাকালেন আমার দিকে। অন্য সময় হলে আমি ভয়ে জড়সড় হয়ে পড়তাম কিন্তু এখন কেন যেন ভয়ের থেকে স্বস্তি কাজ করছে বেশি। মাস্ক খুলে মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করলাম,
– কেমন সারপ্রাইজ দিলাম বাবা? চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বাবা বিস্মিত স্বরে জানতে চাইলেন,
– তুই এখানে! বন্ধুদের সাথে বের হস নি? টেবিলের উপর থেকে বাবার অফিস ব্যাগটা কাঁধে তুলে নিয়ে প্রতিউত্তর করলাম,
– তাড়াতাড়ি ছুটি নিয়ে নাও। একসাথে লাঞ্চ করবো আজ। ট্রিট আমি দিবো। এত বড় রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ করাতে নিয়ে আসায় বাবা খানিকটা বিরক্ত হলেন। ভ্রু কুঁচকে বললেন,
– শুধু শুধু এতগুলো টাকা নষ্ট করার কি দরকার ছিল? বিল তো আমিও পে করতে পারতাম। তুই করতে গেলি কেন?
টিস্যু দিয়ে মুখ মুছে নিয়ে আমি বাবার মুখোমুখি আরো এগিয়ে বসলাম।
– আমাকে দেখতে আজ কেমন লাগছে বলো তো? বাবা স্বাভাবিক ভঙ্গিতে উত্তর দিলেন,
– ভালোই লাগছে।
বরাবরই বাবা কম কথার মানুষ। প্রশংসা করার কাজে একেবারেই পটু নন। ছাড় দিলাম তাই। কথা বাড়ালাম না।
বাবার ঘোর আপত্তি থাকা সত্ত্বেও নিজে পছন্দ করে একটা পাঞ্জাবি আর দুটো শার্ট কিনে দিলাম বাবাকে। মায়ের জন্য একটা শাড়িও নিয়ে নিলাম। বাবা বারবার করে বললেন,
– জন্মদিন তোর, তুই কিছু নে। আমি কিনে দিচ্ছি, পছন্দ কর। কিন্তু কাজ হল না। মায়ের কথামতো সন্ধ্যার আগেই বাসায় ফিরে আসলাম। বাবাকে আর আমাকে একসাথে দেখে মা খুব অবাক হলেন।
– তোমরা একসাথে ফিরলে কিভাবে?
আমি কিছু বলার আগেই বাবা ভেতরে চলে গেলেন। কোনো প্রতিউত্তর করলেন না। আমার মনে হল, বাবা আমার প্রতি খুশি হন নি। এখনো রেগে আছেন বা অসন্তুষ্ট আছেন। মন খারাপ হল কিছুটা। রাতে মা নিজের হাতে আমার পছন্দের সব খাবার রান্না করলেন। তৃপ্তির ঢেকুর তুলে আমরা রাতের খাবার শেষ করলাম। খাওয়াদাওয়ার পর একটা প্রয়োজনে বাবার কাছে যাচ্ছিলাম। রুমের সামনে যেতেই শুনতে পেলাম বাবা কাতর কণ্ঠে মাকে কিছু বলছেন। ভালো করে মনোযোগ দেয়ার পর যা শুনতে পেলাম তা শোনার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না।
“দেখো প্রীতির মা, মেয়েটাকে আমি কত বকাঝকা করি সবসময়, কড়া শাসনে রাখি। তবুও মেয়েটা আমার মুখের উপর কখনো কথা বলেনি। বেয়াদবি করে নি। হ্যাঁ আমি জানি, তোমার কাছে এসে আমার নামে হাজারো অভিযোগের লিস্ট নিয়ে বসে। তা বসুক। তারও তো ভালো লাগা খারাপ লাগা আছে। কোথাও না কোথাও গিয়ে তো সেই অভিমান বা ক্ষোভটুকু প্রকাশ করতে হবে৷ আমি এসব বুঝেও না বুঝার ভান করে থাকি। এতদিন আমি ভাবতাম, বড় হওয়ার সাথে সাথে প্রীতি অনেক স্বার্থপর হয়ে গেছে। জন্মদিনে তার আমাদের জন্য সময় হয় না, বন্ধুদের জন্য ঠিকই সময় হয়। সবসময় নিজের ভালো লাগা নিয়ে পড়ে থাকে।
এদিকে আমারও যে ইচ্ছে করে মেয়েটার সাথে তার জন্মদিনটা পালন করতে, তা একবারও বুঝার চেষ্টা করে না৷ দিন দিন বড় হচ্ছে আর আমার কাছ থেকে যেন দূরে সরে যাচ্ছে। কাল রাতেও তো তোমাকে বলছিলাম এসব। আজ সারাটাদিন আমার স্বপ্নের মত কেটেছে জানো? কতদিন পর মেয়েটাকে এভাবে কাছে পেলাম বলো তো? আর কি সুন্দর লাগছিলো দেখতে! আমার পছন্দের রঙের শাড়িও পরেছিলো, সাথে চোখভর্তি কাজল! খুশিতে আত্নহারা হয়ে পড়েছিলাম কিন্তু প্রকাশ করতে পারছিলাম না। আরো কি করেছে জানো? বড় রেস্টুরেন্টে নিয়ে গিয়ে নিজের টাকায় আমাকে খাইয়েছে। পাঞ্জাবী শার্ট কিনে দিয়েছে। মনে হচ্ছিলো, আমাদের মেয়েটা হয়তো দায়িত্ব নিতে শিখে গেছে।” দরজার পেছনে দাঁড়িয়ে আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম, “বাবার চোখ ভিজে আসছে, গলা কাঁপছে।”
আমি আর নিজেকে সামলে রাখতে পারলাম না৷ ঘরে এসে দরজা বন্ধ করে লাইট অফ করে দিয়ে বালিশে মুখ চেপে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়লাম। এই সময়টায় আবেগ নিয়ন্ত্রণে রাখা একদমই জরুরী মনে করছি না। ভাগ্যিস, গতকাল রাতে চুপিচুপি ডাইনিং এ গিয়ে খেতে বসেছিলাম। তখনি বাবা মায়ের ঘর থেকে তাদের আলাপচারিতা শুনতে পেলাম, বাবার আক্ষেপ উপলব্ধি করতে পারলাম। তৎক্ষণাত সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম, এবারের জন্মদিনটা বিশেষভাবে পালন করবো আমার জীবনের বিশেষ মানুষটার সাথে।
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত