বন্ধু

বন্ধু
ছেলেটাকে আমি ভালোভাবে চিনেছিলাম চতুর্থ শ্রেনীতে থাকতে।আগেও চিনতাম।ভালো করে না।মুখ চেনা যেটাকে বলে আর কি। দুজন দুইস্কুলে পড়লেও প্রাইভেট টিউটর এক হওয়ার কারনে আমরা একসাথে প্রাইভেট পড়তাম।সংখ্যায় তখন তিনজন ছিলাম।আমি,সে আর তার বোন।যেহেতু স্কুল আলাদা সেহেতু আমাদের মধ্যে খুব বেশি সখ্যতা ছিল না।তখন তার মধ্যে একটা নিষ্ক্রিয় ভাব ছিল।আমার আর মেয়েটির মধ্যে একটা অঘোষিত প্রতিযোগিতা চলছিল।কে বেশি পড়া পারবে,এগিয়ে থাকবে এই নিয়েই ছিল প্রতিযোগিতা।ছেলেটা বোকা বোকা ভাব নিয়ে এক কোনায় বসে থাকতো।তার মধ্যে কোন প্রতিযোগিতা ছিল না।কোনরকম টেনেটুনে পড়া টা স্যার কে দিতে পারাতেই সে খুশি।মহাখুশি। ছেলেটাকে তখন থেকেই আমার ভীষণ ভালো লাগতো। হয়তো তার বোকা বোকা ভাবের কারনেই।
মাধ্যমিকে উঠে প্রিয় মফস্বল ছেড়ে সদরে চলে গেলাম।দু’বছর জীবনের সবচেয়ে জঘন্য শিক্ষাজীবন কাটিয়ে ঘটনাচক্রে আবার নিজের মফস্বলে ফিরে এলাম।ততদিনে আমার মধ্যে থাকা সম্ভাবনাময় বুদ্ধিদীপ্ত কিশোরীটি হারিয়ে গেছে।জীবনের খেই হারিয়ে ফেলেছিলাম।
আবার ছেলেটির সাথে দেখা হলো।এবারও আমরা দুজন দুই স্কুলের বাসিন্দা কিন্তু প্রাইভেট টিউটর একই।বোকা বোকা ছেলেটি ততদিনে বেশ জেগে উঠেছে।নিষ্ক্রিয় ভাব কাটিয়ে কেমন জীবন চিনে ফেলেছে।যে সময়টায় আমরা আড্ডা দিতাম ছেলেটা সেই সময়েও বইয়ে মুখ গুঁজে থাকতো। এমন না যে সে দুষ্টামি করে না।হঠাৎ হঠাৎ দুয়েকটা কথা বলে পেটে খিল ধরিয়ে দেয়ার অসাধারণ ক্ষমতা ছিল তার। আমাদের ১০ জনের একটা সেরাবন্ধু চক্র ছিল।ছেলেটি তার মধ্যে একজন। দুনিয়ার নানারকম আকাজ কুকাজ সেই মাধ্যমিকের তিনবছরে করেছিলাম আমরা।কিন্তু ছেলেটি কোন আকাজে অংশ নিতো না।আমরা পিকনিক করলে সে রসায়ন বই নিয়ে বলতো,”কারো অন্তত পড়া শেখা উচিৎ। একজন থেকে দেখে বাকিরা লিখে মার থেকে বাঁচা যাবে।আমি শিখি।তোরা রান্না কর।খাওয়ার টাইমে ডাক দিস।”
রান্না ছাড়াও কাজ অনেক।লাকড়ি কুড়ানো,বাজার করা।মনে মনে নারাজ হলেও পড়ার চেয়ে কাজ করে আনন্দ করাটাই আমাদের কাছে বুদ্ধিমানের কাজ মনে হয়েছিল।কিন্তু ছেলেটার যত আনন্দ সব ছিল বইয়ে সীমাবদ্ধ।
তার স্বপ্ন ছিল বিশাল।প্রায়ই উদাস মুখে বলতো,”আমি যদি জিপিএ ফাইভ পেতাম?” আমাদের বন্ধুচক্রে ঝগড়াঝাটি খুব কম ছিল।শুধু আমি আর ছেলেটি স্রোতের বিপরীতে গিয়ে সারাক্ষণ ঝগড়া করতাম।আমাদের মধ্যে ভালো কথা খুব কম হতো।প্রতিটা কথাতেই তর্কযুদ্ধ হয়ে যেতো। নবম শ্রেণিতে উঠে হঠাৎ আমাদের মধ্যে ডায়েরি লেখার চল শুরু হলো।আমরা নিজেদের ডায়েরীতে বন্ধুদের প্রোফাইল সংগ্রহ করতে শুরু করলাম।নিজেদের পছন্দ অপছন্দ একজন অন্যজনের ডায়েরিতে লিখে দিলাম।ছেলেটি তখন আমার ডায়েরীতে লিখেছিল,”মনি আমার একটা কথাও মাটিতে পড়তে দেয় না। সাথে সাথে ঝগড়ায় লিপ্ত হয়। “
প্রোফাইলে একটা অপশন ছিল “জীবনে দাগ কাটে”। ওইটুকু ছোট একটা জীবন আমার। দাগ কই পাবো?তাই অনেক ভেবে আমি লিখলাম ” অষ্টম শ্রেনীতে বৃত্তি পাই নাই”। আমার সেই লেখা পড়ে ছেলেটি সেদিন খুব হেসেছিল।হাসতে হাসতে বলল,”নাট্যই মারদ্দে না বেডি(নাটক করিস মহিলা)?জীবনে দাগ কাটা মানে বুঝস?? কে জানতো পরবর্তীতে এই ছেলেটিই বাস্তব প্রমান দিয়ে জীবনে দাগ কাটা ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিবে? সময় গড়াতে লাগলো।হাসি মজার মাঝেই কখন যেন ছেলেটি আমাকে প্রিয়তমা বলে ডাকতে শুরু করলো।আমিও বিপুল উৎসাহ নিয়ে তাকে প্রিয়তম ডাকতাম।তারপর শব্দগুলো সংক্ষিপ্ত হয়ে প্রিয়/প্রিয়া হয়ে গেছিলো। বেঁধে দেয়া সময় পর্যন্ত তাকে আমি প্রিয়ই ডেকেছিলাম। স্কুললাইফ শেষ হলো।ছেলেটি জিপিএ ফাইভ পায় নি।আমাদের সেই ব্যাচে একটাও জিপিএ ফাইভ ছিল না।
এবার আমরা সত্যিই আলাদা হলাম।বন্ধুরা চারদিকে ছড়িয়ে গেলাম কয়েকজনের বিয়ে হয়ে গেল।আমার মধ্যকার সম্ভাবনাময় তরুনীকে আবার খুঁজে পেলাম। মন লাগালাম পড়াশোনায়। আমাদের বন্ধুত্ব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সীমাবদ্ধ হয়ে গেলো।সবাই যার যার জীবনে ব্যস্ত।হঠাৎ হঠাৎ টাইমিং মিলে যেতো।আমরা যেকোন একজনের বাসায় মিলিত হতাম।বেশি হলে দু ঘন্টার আড্ডা।তার মধ্যে দেড় ঘন্টাই স্কুল জীবনের সোনালী অতীত এর স্মৃতিচারণ হতো।শেষ আধঘন্টা নিজেদের ভবিষ্যৎ এর আলাপ। আমরা কেউ জানতাম না ভবিষ্যতে কে কি করব।শুধু ছেলেটি বলতো।বড় চাকরি করব,পরিবারের দায়িত্ব নিবো।আমার অনেক দায়িত্ব। সত্যিই তার অনেক দায়িত্ব।তিনবোনের একমাত্র ভাই।মা বাবার একমাত্র পুত্র সন্তান।তার দায়িত্ব থাকবে না তো কার থাকবে? ছেলেটি ছিল ছায়ার মত।একটু আপনভোলা।তাকে খুব বেশি আমরা পেতাম না।মাঝেমধ্যে সে এলাকায় থাকতো কিন্তু আমরা দেখা করার প্ল্যান করলেও আসতো না।এড়িয়ে যেতো।
রাস্তায় দেখা হয়ে গেলে কেউ বলতে পারবে না আমরা আদতে প্রানের বন্ধু।কারন কাছ ঘেঁষে যাওয়ার সময় সে খুব সুক্ষ্মভাবে হাত নেড়ে নিচু গলায় বলতো,”হ্যালো সুন্দরী”।তারপর বাসায় গিয়ে ম্যাসেঞ্জারে বলতো,কলেজে যাস নাকি বিয়ে বাড়িতে? হেসে উড়িয়ে দিলে তো দিলাম কিন্তু মন খারাপ ভাব দেখালে সাথে সাথে বলতো,আমি তো মজা করছি প্রিয়। আমাদের ছায়া ছায়া ধরনের বন্ধুটি হঠাৎ আবার সক্রিয় হয়ে উঠেছিল।সেবার ঈদে দাওয়াতের জন্য হঠাৎ মরীয়া হয়ে উঠলো।আমাদের একত্রিত হওয়ার খুব বেশি ইচ্ছা ছিল না।কিন্তু ছেলেটি বারবার বলতে থাকলো, দাওয়াত দে না।দাওয়াত দিস না কেন? দাওয়াত দিলাম।ছেলেটি এলো। ও আচ্ছা ছেলেটি ছিল নিখাঁদ ভোজনরসিক।সে খেতে ভীষণ পছন্দ করে।শুধু খায় তা না।খাওয়ার পর সে রান্নার প্রশংসা করে,ভুল ধরে। সেবার তার বলা প্রত্যেকটা কথা আমার মুখস্ত। “এই মনি তোর পুডিং এ মিষ্টি কম হইছে।আচ্ছা না না মিষ্টি কম হয় নাই।আমি আগে সেমাই খাইছি।তাই মিষ্টি কম লাগছে।
এই একটা কথা বলি তোরা রাগ করবি না।কেমন?আমার না অন্যধর্মের মেয়েদের প্রতি প্রেম ধরনের অনুভূতি আসে না।তোদের আমি খুব ভালোবাসি।কিন্তু জীবনেও প্রেমে পড়ে যাব না। ধুর আমি প্রেমই করব না।প্রেম মানে প্যারা।এটা নিয়ে রাগ,ওটা নিয়ে রাগ।এত রাগ কে ভাঙাবে?আগে নিজের পায়ে দাঁড়াবো।পরিবারের দায়িত্ব নিবো।তারপর এক্কেবারে বিয়ে করে ফেলব।বিয়ের পর কি প্রেম হয় না?” সেদিন শুধু ছেলেটি বলেছিল।আমরা শুনেছিলাম।ওকে দেখে মনে হচ্ছিলো কতদিন ধরে এই কথা গুলো জমা করে রেখেছে।আমাদের বলার জন্য। পরদিন অন্য এক বান্ধুবির বাসায় দাওয়াত ছিল।ছেলেটি পরিবারের সাথে কাপ্তাই ঘুরতে গেছে।জানালো সে আসতে পারবে না।আমরাও ধরে নিলাম সে আসবে না। কিন্তু আমাদের অবাক করে দিয়ে সে এলো।লাজুক হাসি দিয়ে বলল,একটুও এনার্জি নাই।তাও মুনমুন রাগ করবে বলে চলে এলাম। আমি একটু অবাক হলাম।ছেলেটির চিরাচরিত স্বভাবের সাথে এই কাজটি একদমই যায় না।সে কারো মন খারাপের ধার ধারবে এটা ভাবাই যায় না। খেতে খেতে সেদিনও মাথা নেড়ে বলেছিল,বিরিয়ানিতে ধোয়ার গন্ধ লাগে।
বান্ধুবীর বাসা থেকে বের হয়ে ছেলেটির সাথে রাস্তা পর্যন্ত আসলাম।ছেলেটি আবার নিচু গলায় বলল,”একা যেতে পারবি?” আমি আশ্বাসের হাসি হাসলাম। আমি জানতাম না সেটাই হবে আমাকে বলা তার শেষ কথা। মাত্র তিনদিনের ব্যবধানে অন্য এক বন্ধু ফোন করে বলল,”এই জয় এক্সিডেন্ট করছে।” শঙ্কা নিয়ে বললাম,ব্যথা পাইছে? বন্ধুটি বলল,বেশি পায় নাই মনে হয়। আমি হেসে বললাম,আমরা সব বন্ধুরা কৈ মাছের প্রান নিয়ে দুনিয়ায় আসছি।দেখিস নাই মানিকছড়ি গাড়ি উল্টে গেলো।একজন মরে গেলো।আর আমি সামান্য ব্যথাও পেলাম না।দেখিস নাই? বন্ধুটি হাসলো,হ্যাঁ তাইতো। আমি ভুলে গেলাম ছেলেটি এক্সিডেন্ট করেছে।রাত আবার বন্ধুটি ফোন করে বলল, মনি জয়ের অবস্থা খারাপ। আমি অবাক হয়ে বললাম,কিন্তু তুই বলছস ও ব্যথা পায় নাই। বন্ধুটি আকুল হয়ে বলল,একটু দোয়া কর না প্লিজ।আমার জয়ের যেন কিচ্ছু না হয়।
অন্য সময় হলে আমার জয় বলার অপরাধে তক্ষুনি ঝগড়া শুরু করতাম। আমার জয় মানে কি? জয় কি তোর একার? ঝগড়া করলাম না।ফোন রেখে বোকার মত নিজের হাতে চিমটি কাটলাম। আমার কোন অনুভূতি হয় নাই। জানি না ঠিক কতক্ষন পর সেই বন্ধুটিই জানিয়েছিল, আমার জয় আর নাই রে। জীবনে প্রথম আমি চিৎকার করে কেঁদেছিলাম। আমার জীবনে দাগ কাটছিল।একটা অদম্য স্বপ্নের মৃত্যু মেনে নেয়া সহজ কথা ছিল না।আমি তখনো বিশ্বাস করতে পারছিলাম না এমনও হতে পারে। বন্ধুকে দেখতে গেলাম।ওকে দেখে মনে হচ্ছিলো না সে জীবন যুদ্ধে পরাজিত। মনে হচ্ছিলো ও ঘুমাচ্ছে।এক্ষুনি জেগে উঠবে আর একগাল হেসে বলবে,ফ্যান ছেড়ে কাঁথা গায়ে দিয়ে কখনো ঘুমাইছস? সেই আরাম।অথবা গম্ভীর হয়ে বলবে, আমার অনেক দায়িত্ব রে। খুব ইচ্ছে ছিল একটাবার ওর গাল স্পর্শ করার।সুযোগ পেলাম না।
একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম। ঘোর কেটে যাওয়ার পর অনুভব করলাম জীবনের দাগটা দগদগে ঘা তে পরিনত হচ্ছে। একটা পরিবারের প্রদীপ নিভে গেছে। তিনটা বোনের একমাত্র ভাই অসময়ে তার দায়িত্ব চুকিয়েছে। আমার মধ্যের স্বপ্নময় তরুণীটি হারিয়ে গেছে।দু’দিনের দুনিয়ায় কিসের স্বপ্ন? কি হবে এত ভেবে? আগামীকাল তার জন্মদিন।বছর ঘুরে তার জন্মদিন আসে কিন্তু বয়স একচুলও বাড়ে না।শেষবার তার জন্মদিন ভুলে গেছিলাম।সে খুব অভিমান নিয়ে বলেছিল,কেউ উইশ করলি না।অন্তত তোদের থেকে আশা করছিলাম।এখন আর তার জন্মদিন আমি ভুলে যাই না।সারাবছর মনে থাকে। আমার খুব ইচ্ছা করে ১২.০১ মিনিটে বলি, “শুভ জন্মদিন প্রিয়”। কিন্তু কাকে বলব?
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত