আমার উচ্চশিক্ষিত ব্যাংকার স্বামী যখন তার সহকর্মীর প্রেমে পরল যতটা না দুঃখ পেলাম তারচেয়ে অনেক বেশি অবাক হলাম।মাঝারি উচ্চতার শ্যামলা বর্ণের মানুষ, বয়সের সাথে পাল্লা দিয়ে ভুড়িটা বেড়ে চলছে, চোখের নিচে ক্লান্তির ছাপ। দুই ছেলের বাপ এমানুষটার প্রেমে পরবে কে? পাশের বাসার ভাবী ব্যাপারটা আমাকে চমৎকার বুঝিয়ে দিল। দুজনে পার্কে বসে বাদাম খাওয়া, হাতে হাত ধরে রিকশায় ঘুরে বেড়ানোর মত প্রেমের বয়স সে কাটিয় এসেছে দেড় যুগ আগে। এবয়সে আর প্রেম হয় না।হয় পরকীয়া। কাউকে ভালো লাগল, তারও আপত্তি নেই অতঃপর তাকে নিয়ে বিছানায় চলে যাও।
এতটুকু শুনে কানে হাত চাপা দিলাম।একজন মেয়ে বিয়ের পর হাতের মেহেদীর রং না শুকাতেই বিশ্বাস করতে শুরু করে তার স্বামীর ভিতর বাহির তার মত করে আর কেউ জানে না। আমিও তাই বিশ্বাস করতাম। রাস্তাঘাটে, বিভিন্ন পার্টিতে কত মেয়ে ঘুরে বেড়ায়। কখনও দেখি নি সে একবারের বেশি দু’বার কোনো মেয়ের দিকে তাকাচ্ছে।কাজ করার সময় আনুর মার শরীরে কাপড় ঠিক থাকে না। আমার সাহেব মগ্ন হয়ে পেপার পড়েন, কে কি করছে তা দেখার প্রয়োজনবোধ করে না। অন্যের কথা বাদ দিলাম। ১৩ বছর ধরে এক ছাদের নীচে বাস করছি। বিয়ের আগে পাড়ার ছেলেদের কাছ থেকে রুপের স্তবক স্বরুপ অহরহ চিঠি পেতাম।আমার স্বামী কোনদিন বলে নি,
-বাহ নীরা! তোমাকে তো সুন্দর লাগছে।
সে মানুষটা হুট করে রুপ দেখে কারো প্রেমে পরে গেল এব্যাপারটা মানতে কষ্ট হয়। ঘটনা জানতে পারি মাসখানেক আগে। তার অফিসের এক কলিগের সাথে রাস্তায় দেখা। ভদ্রলোক কিছুতেই কফি না খাইয়ে ছাড়বেন না। কফিতে ছোট্ট চুমুক দিয়ে ভদ্রলোক বললেন,
-ভাবী, স্যারের দিকে একটু নজর রাখবেন।
-কেন? বলুন তো।
-কথাটা আপনাকে ঠিক কিভাবে বলব বুঝতে পারছি না।
-সঙ্কোচ করবেন না, প্লিজ।
-অফিসে নতুন একটা মেয়ে ক্যাশিয়ার হিসেবে জয়েন করেছে। লম্বা, ঢ্যাঙা চেহারা মেয়েটা স্যারের সাথে বেশি মাখামাখি শুরু করেছে। অফিসের গাড়িতে করে প্রায়ই দুজনে হাওয়া খেতে যায়।
-নাম কি মেয়েটার?
-সুমী।
“সুমী”। হ্যা, প্রায়ই দেখি সুমী নামের একটা মেয়ে বার বার ওকে কল করছে।সেদিন ভাত বেড়ে দিলাম।দু’গ্রাস মুখে না তুলতেই সুমীর ফোন।সে খাওয়া ছেড়ে উঠে গেল। পনের মিনিট বারান্দায় গিয়ে বকবক করার পর সে ফিরল। জিঞ্জেস করলাম,
-কে ফোন করেছিল? খাওয়া ছেড়ে উঠে যেতে হল।
-আর বলো না। অফিসে একটা নতুন মেয়ে এসেছে নাম সুমী। কাজের কাজ কিচ্ছু পারে না, খালি ফোন করে বিরক্ত
করে।আরেক চামচ ডাল দাও।
-ভাবী, কিছু ভাবছেন?
-না। তেমন কিছু নয়।মেয়েটা কতদিন আগে জয়েন করেছে?
– তা প্রায় ছয়মাস। আমি যে আপনাকে জানালাম আপনি প্লিজ স্যারের সাথে শেয়ার করবেন না।নিতান্ত শুভাকাঙ্খী হিসেবে কথাগুলো জানালাম।
-মাথা খারাপ। ওকে কিছু জানাব না।আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন।
ওর সাথে এমন ঠুনকো ব্যাপারে কথা বলতে কেমন লজ্জা করছিল।যার প্রতিটা লোমকূপের অস্তিত্ব আমার জানা তাকে ঘেরা বিশ্বাসে এত সহজে চিড় ধরে নি।না, তাকে শার্টের ভাজে কোনো লম্বা চুল খুঁজতে যাই নি, ফোনকল চেক করে নি।শুধু সেদিন রাতে বুকে নাক ঘষতে ঘষতে বলেছিলাম,
-ভালোবাসো? সে হেসে ফেলেছিল। আলতো করে মাথার চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে উত্তর দিয়েছিল,
-নীরা, কি বাচ্চামি করছ?
-আহ! উত্তর দাও।
-তোমার কি মনে হয় ভালোবাসি না?
মাথা উঠিয়ে তার দু’চোখে চোখ রেখেছিলাম। চোখের স্বচ্ছ মণিতে প্রশান্তির ছোঁয়া। বিশ্বাসে ফাটল ধরে নি। তার ঠিক কিছুদিন পরে মাঝরাতে ঘুম ভাঙল ওর ফোনের শব্দে। সবসময় ওর ফোনে ভাইব্রেশন দেওয়া থাকে আজ হয়ত ভুলে রিংটোন দিয়েছিল।ঘুম ভেঙে গেল। সে চুপি চুপি পায়ে উঠে বেলকুনিতে গেল। একটু পর জোরালো হাসির আওয়াজ। হাত পায়ে নিস্তেজ অনুভূতি। কতদিন পর তাকে এইভাবে হাসতে শুনলাম।এক,দুই না একযুগ পর রাত জাগার পালা শুরু। সে অপেক্ষায় থাকে কারো ফোনকলের,আমি অপেক্ষায় থাকি তার হাসি শোনার। কথা বলা শেষ হলে সে চুপচাপ বিছানায় শুয়ে ঘুমিয়ে পরে, আমার ঘুম হয় না। রাতজাগা দীর্ঘশ্বাস দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়।
তার দৈনিক রুটিনে হেরফের হয় না।রোজ ঠিকসময়ে ঘুম থেকে ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করছে, আমার সাথে টুকিটাকি প্রয়োজনীয় কথা, বাচ্চাদের স্কুলে ছেড়ে অফিসে চলে যাওয়া, বাড়ি ফিরে বাসি পত্রিকায় নাক ডুবানো,সাথে এককাপ আগুন গরম চা এতো তার রোজকার রুটিন।সপ্তাহে দুই একদিন বাড়ি ফিরতে রাত দশটার উপরে বাজে।সেদিন ফোন করে জানিয়ে দেয়,
-খেয়ে ফিরব, তুমি খেয়ে নিও।
-তুমি কোথায়?
-বন্ধুদের সাথে হ্যাং আউটে যাচ্ছি। বা কোনদিন বলেে,
-অমুকের বাসায় তাস খেলছি।
সে সেইসময়টা বন্ধু বা বান্ধবীর সাথে সময় কাটায় তা বুঝতে আমার কষ্ট হয় না। তারপরও চুপ থাকি। কি বলব তাকে! বলব না, বলব না করেও একদিন বড় আপাকে জানালাম। বড় আপা মুখে কুলুপ এটে রাখার মানুষ নয়। সে ঠিক জনে জনে প্রচার করে দিল। সেদিন বিকেলে মায়ের ফোন,
-তুই আজই বাড়ি চলে আয়। হারামজাদাকে জেলের ভাত খাইয়ে ছাড়ব।
-ছি মা! এসব কি বলছ!
-তোদের কাবিননামা জানি কত টাকার ছিল?
-কাবিননামার কথা আসছে কেন?
-তুই এই দুশ্চরিত্র ব্যাটার ভাত খাবি? ডির্ভোসটা হোক। কড়ায় গণ্ডায় সব উসুল করে নিব।
তোর ছোট মামা বলেছে নারী নির্যাতনের কেইস করবে। আমার মেয়ের জীবন নষ্ট করা।অপর্দাথ জানি কোথাকার। আমার মাথা কেমন ঝিমঝিম করতে লাগল। ডির্ভোস! তার দুই সন্তান আমার গর্ভে ধারণ করেছি পৃথিবীর কোন আইনে আমি তা অস্বীকার করব! অনেকদিন পর আয়নায় নিজেকে খুঁটিয়ে দেখছি । তলপেটের কাছটায় মেদ জমেছে, দুগালে মেস্তার দাগ, চুল ঝরে সিঁথির প্রস্থ বেড়েই চলছে। সংসার, সন্তান সামলে নিজের দিকে নজর দেবার সময় দেবার সময় কই! সত্যি তো, ডির্ভোসের কথা শোনার পর থেকে আমি শুধু সন্তানদের ভবিষ্যতের কথা ভেবেছি। ওর কথা ভাবি নি একবারও। দুজনের দূরত্ব বেড়েছে। দায় শুধু ওর একার কেন হবে! আমারও নিশ্চয়ই। আয়নায় নিজেকে দেখে আর সামলাতে পারলাম না।দু’হাতে মুখ ঢেকে মেঝেতেই বসে পড়লাম।পরাজিত সৈনিক আমি। এতবছর একই ছাদের নিচে বাস করে আমি তাকে জয় করতে পারলাম না। ছোটটা আমায় মেঝেতে বসে কাঁদতে দেখে অবাক হল। গলা জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করল,
-মা, মা, তুমি কাঁদছ কেন?
ছোট্ট শরীরটা বুকে চেপে ধরে শান্ত হলাম। আমাকে শক্ত হতে হবে। সোমবারের রাত। মশারি ঠিকঠাক করে তার দিকে তাকালাম। আমার দিকে পিছন ফিরে ঘুমানোর অভিনয় করে বিছানায় মিশে আছে।একবার ভাবলাম,তার কাঁধ ছুঁয়ে ডেকে বলি,
-শুনছ,সুমী নামের মেয়েটা দেখতে কেমন? তোমার কাছে ছবি আছে নিশ্চয়ই।একেবারে দেখতে দিবে?
লাইট অফ করে বিছানায় গা রাখলাম। ঘড়ির কাটা যখন একটা ছুুঁই ছুঁই মেয়েটার ফোন। সে কিছুক্ষণ আমার দিকে পর্যবেক্ষণ করে বিছানা থেকে নামল। অতি কষ্টের এমুহূর্তেও তার হাবভাব দেখে আমার হাসি পেল। ছোট্ট বাচ্চারা যেন স্কুল পালিয়ে মজা পায়, ভাবে এই বুঝি কোনো মহৎ কর্ম করে ফেললাম তার ভাবভঙ্গিও ঠিক সেই রকম।
নিষিদ্ধ জিনিসে কৌতুহল মানুষের জন্মগত স্বভাব। এইযে সে মেয়েটার সাথে ঘুরছে ফিরছে, লুকিয়ে ফোনে কথা বলছে স্রেফ পুরোটাই কি প্রেম! নাকি নিরানন্দ জীবনে খানিকটা বৈচিত্র্যে খুঁজে পাওয়া! উত্তরটা জানতে হবে।
বাচ্চাদের স্কুল বন্ধ। ওদের আর ঘুম ভাঙালাম। ব্যাগ গুছিয়ে গোসল সেরে নিলাম। ঘর ছেড়ে বেরোব সে পত্রিকা থেকে মুখ তুল চাইল।
-কোথায় যাচ্ছ?
-তা জেনে তোমার লাভ কি?
-এসব কি ধরনের কথা! আমি তো কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না।
– আজ থেকে বেলকুনিতে দাঁড়িয়ে মশার কামড় খেয়ে ফোনে কথা বলতে হবে না।
বিছানায় শুয়ে আরামে কথা বলো। আমি থাকলে তোমার সমস্যা হয়। আসছি আমি। ভালো থেক। ওকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বেরিয়ে এলাম।সিএনজিতে উঠার আগে শেষবারের মত তাকালাম।সে বেলকুনিতে দাঁড়িয়ে হতভম্বের মত আমার চলে যাওয়া দেখছে। চাইলে মায়ের বাসায় উঠা যেত।তা না করে ভায়ের বাসায় উঠলাম।ভাবী জব করে,সারাদিন ব্যস্ত থাকে।বাড়তি কৌতুহল কম। আমি কোনো খবর না দিয়ে হুট করে কেন এলাম কিছুই জিজ্ঞেস করল না। মা, আপার কাছ থেকে শুনে কিছুটা ঘটনা আন্দাজ করতে পেরেছিল। দু’দিন পর খানিকটা ইতস্তত করে ভাইয়া জিজ্ঞেস করল,
-আবিদ ভাই,কল করেছিল?
-ফোন বন্ধ করে রেখেছি।
-ও।দেখো,তোমার যা ভালো মনে হয়।
আমি নিশ্চুপ। রাতে ঘুম আসে না। ঘুম ভাঙে অনেক বেলা করে।দিনগুলি চুপচাপ কেটে যায়। আমি শুয়ে বসে নিজের সংসারের কথা ভাবি।আনুর মা আছে, ও নিজেও টুকটাক রান্না জানে। বড়টা নিজের হোমওর্য়াক নিজেই করে, এমনিতে খুব শান্ত। খালি গোসল করতে চায় না। ছোটটা কিছুতেই দুধ খেতে চায় না। দুধ না খাওয়া, গোসল না করার মত ছোটখাট ব্যাপারগুলো বাবাদের চোখে পরে না। ও ঠিক গুছিয়ে নিবে। পাঁচ দিন চলে গেল।আমিই বোকা, ভেবেছিলাম আমায় ছাড়া একটা দিনও চলবে না। মাঝরাত। কিছুক্ষণ আগে একরাশ বৃষ্টি হয়ে গেল।আবহাওয়া শীতল। শীত শীত লাগছে। চাদর নেই। গায়ের ওড়নাটা ভালোভাবে জড়িয়ে নিলাম। দরজায় কড়াঘাত।কাকভেজা হয়ে সে দাঁড়িয়ে আছে।
-নীরা, বাড়ি চলো।
-তুমি এত রাতে? বাচ্চাদের কিছু হয়েছে?
-উহু! তুমি বাড়ি চলো।
-ওদের একা বাসায় রেখে রেখে এসেছ!
-ওরা মায়ের বাসায়।তুমি যেদিন চলে আসো সেদিন বিকেলেই মা এসে নিয়ে গেছেন।
-বেশ তো! একা বাসায় তোমার আরো সুবিধা হবার কথা। চাইলে সুমীকে নিয়ে আসতে পারো। ও আমার মুখ চেপে ধরল,
-প্লিজ নীরা, চুপ করো । প্রথমবারের মত আমাকে ক্ষমা করা যায় না?
-এই শেষবার হলে করা যায়। তোয়ালে এগিয়ে দিলাম।
-ভালোমত মাথা মুছে নাও। আমি ব্যাগ গুছিয়ে আসি। পা বাড়াতেই সে আমার হাত চেপে ধরল।
-নীরা ভাত খাওয়াবে? প্রচণ্ড ক্ষুধা লেগেছে।
গল্পের বিষয়:
গল্প