আমি শারিরীকভাবে বিকলাঙ্গ একটি মেয়েকে প্রাইভেট পড়াতাম। মেয়েটিকে বিকলাঙ্গ বলার মূল কারণটা ছিলো মেয়েটির বাম হাতটি স্বাভাবিকের থেকেও কিছুটা ছোট এবং নাড়াতে অক্ষম। কিন্তু এতো কিছু ছাপিয়ে মেয়েটির সবথেকে ভালো গুণ ছিলো মেয়েটি প্রচন্ড মেধাবী। ব্যপারটা আমি বুঝতে পারি যেদিন প্রথমবার মেয়েটিকে পড়াতে যাই। এলাকায় আমি বেশ কয়েকটি টিউশন করানোয় এলাকার ভিতরে টিউশন টিচার হিসেবে আমার বেশ খ্যাতিও রয়েছে। আমার আবার পুরোনো অভ্যাস বিকেলে আমি কোনো টিউশনি করাইনা। কারণ এই সময়টা আমি চায়ের টং দোকানে বয়োঃবৃদ্ধদের সাথে আড্ডা দেওয়ার জন্য বরাদ্দ রেখেছি। হঠাৎই একদিন আড্ডার মাঝামাঝি সময় মধ্যবয়স্ক এক লোক আমার নাম ধরে ডাক দিলেন। মনে ক্ষানিকটা কৌতুহল নিয়ে লোকটির সামনে দাঁড়াতেই তিনি বললেন,
-তুমিতো টিউশন করাও তাইনাহ?
-জ্বী আংকেল।
-আমার মেয়েকে তুমি পড়াতে পারবে?
-অবশ্যই কেন নয়? কীসে পড়ালেখা করে?
-এবার ক্লাস সেভেনে। টাকা পয়সার ব্যপারে চিন্তা করোনা। তোমার সন্তুষ্টি অনুযায়ীই দেবার চেষ্টা করবো। তুমি শুধু তোমার সর্বোচ্চটা দিয়ে পড়ানোর চেষ্টা করবে। আমি ক্ষানিকটা লজ্জামিশ্রিত হাসি দিয়ে বললাম,
-জ্বী আংকেল তা তো অবশ্যই।
-তাহলে কাল থেকেই এসে পরো। এই নাও আমার মোবাইল নাম্বার। প্রথমদিন মেয়েটির বাসায় যখন ঢুকবো তখনি আমি একটি মহিলার জোরগলায় চিৎকার করে কাউকে শাসন করার শব্দ শুনতে পাই।
-প্রতিবন্ধী হয়ে জন্ম নিছোস এখন তোর কারণে আমাকেও শুনতে হয় প্রতিবন্ধীর মা। জন্ম নেবার সময় মরলি না কেন? এখন ঝুলে আছিস আমার গলায় একটু শান্তি মতো থাকতেও দিবিনা। এসব কথা শোনার মাঝেই যখন তাঁদের ঘরে প্রবেশ করি তখন মহিলাটি আমাকে দেখেই চুপ করে গেলেন। কিছুক্ষণ স্থির দাঁড়িয়ে থেকে আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
-আপনি কী সাদিয়াকে পড়াতে এসেছেন?
-জ্বী আন্টি। অতঃপর অনেকটা রুক্ষ গলায় বললেন,
-ঐ রুমে যান। আপনার ছাত্রী বসে আছে। পরমুহূর্তেই অপর পাশে ফিরে বিড়বিড় করে বললেন,
-কী জন্য যে এই প্রতিবন্ধী মেয়ের জন্য টিউশন টিচার রাখে বুঝিনা। কিচ্ছু করতে পারবোনা ভবিষ্যতে হুদাই।
আমি অনেকটা লজ্জা নিয়েই সাদিয়ার রুমে প্রবেশ করি। মেয়েটিকে দেখেই আমি হতবিহ্বল হয়ে যাই। কারণ সে অন্যান্য মেয়েদের মতো স্বাভাবিক নয়। আমাকে দেখেই সাদিয়া চোখের জল মোছার বৃথা চেষ্টা করে এক হাত দিয়ে চেয়ারটা টেবিলের অপর প্রান্তে রেখে বললো,
-স্যার বসুন। এমন একটি ফুটফুটে মেয়ের এরকম অস্বাভাবিকতা দেখে আমার হৃদয়ে কিঞ্চিত শোকের ছায়া নেমে আসলো। এটাও বুঝতে বাকি রইল না যে ওর মা কেনইবা ওর প্রতি এতো অসন্তুষ্ট। আমি তখনই মনের গহীনে স্থির করেছিলাম যে কোনো মূল্যেই হোক সাদিয়াকে পড়ানোটা আমি কখনোই বাদ দিবোনা। এটা সাদিয়ার প্রতি ছোট বোন হিসেবে ভালোবাসা থেকে হয়েছিলো নাকি ওর অসহায়ত্ব দেখে দয়া হয়েছিলো সেটার উত্তর আজও পর্যন্ত আমি খুঁজে পাইনি। সাদিয়ার বাবা সাদিয়াকে ভালোবাসলেও সাদিয়ার মা ভালোবাসার থেকে ওকে অবজ্ঞাটাই বেশি করতেন। এই বিষয়টা আমার নিকট খুবই খারাপ লাগতো।
সাদিয়া কখনোই স্কুলের ক্লাস করতো না শুধু পরীক্ষার সময় পরীক্ষা দিতো। কারণ ওর বাবার ধারণা ছিলো প্রতিনিয়ত ক্লাস করলে আমার মেয়েকে অজস্র অবজ্ঞা সহ্য করতে হবে কিন্তু সেটা তিনি কখনোই চাইতেন না। তাই তিনি টিউশন টিচার দিয়েই মেয়েকে পড়ালেখা করাতেন। কিন্তু এতোকিছু সত্ত্বেও সাদিয়া ওদের ক্লাসে সবসময়েই ফার্ষ্ট হতো। শুনেছি যার পাঁচটি ঈন্দ্রীয়র ভিতরে যদি কোনো একটি কম থাকে তবে তাঁর অপর কোনো ঈন্দ্রীয় শক্তির সক্ষমতা প্রভু বহুগুণ বাড়িয়ে দেন। আমার কেন যেন মনে হতো সাদিয়ার এই প্রচন্ড মেধা তারই এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। ওর পড়ার প্রতি এতো আগ্রহ দেখে আমি প্রায়শই বিভিন্ন বই ওকে উপহার দিতাম। সাদিয়ার বাবা যখন প্রথম মাসেই আমাকে চারহাজার টাকা হাতে তুলে দিয়ে বলেছিলেন,
-এটা কী যথেষ্ট? আমি ক্ষানিকটা মুচকি হাসি দিয়ে বললাম,
-জ্বী আংকেল। কিন্তু আমার মনের কথাটা ছিলো অন্যরকম। আমি নিশ্চুপ স্বরে সেদিন বলেছিলাম,
-আংকেল আপনি যদি আমাকে একটি টাকাও না দেন তবুও আমি কিছু মনে করবোনা। কারণ এই একমাসে আমি কোনো ছাত্রীকে পড়াইনি বরং আমি নিজের আপন বোনকেই পড়িয়েছিলাম। সাদিয়ার বাবার দেয়া সেই চারহাজার টাকার একটাকাও আমি নিজের জন্য খরচ করিনি বরং সাদিয়ার জন্য একগাদা বই, শিক্ষা উপকরণ এবং একটি দামি ড্রেস ওর জন্য কিনেছিলাম। আমার ছোট বোন না থাকায় আমি সাদিয়ার ভিতরে খুঁজে পেতাম রক্তের সম্পর্কযুক্ত এক ছোটবোনের অস্তিত্ব। আমি আপনাদের বোঝাতে পারবোনা একটি মেয়ে কতটা খুশি হলে কেঁদে দিতে পারে। হয়তো একজন বড় ভাইয়ের শূণ্যতাটা আমাকে দিয়েই পূরণ করেছিলো সে।
সাদিয়ার বাবামাও সাদিয়ার প্রতি আমার ভালোবাসা দেখে আমাকেও এক সুউচ্চ আসনে বসিয়ে ফেলেছিলেন।
যখন প্রথমবার জেলাভিত্তিক অলিম্পিয়াডে সাদিয়া প্রথম হয় তখন অনেকটা আবেগেই সাদিয়া আমাকে জড়িয়ে ধরেছিলো। আমার চোখদিয়েও সেদিন ক্ষানিকটা অশ্রুজল বের হয়েছিলো এই ভেবে যে হ্যাঁ আমি পেরেছি, আমি সার্থক হয়েছি এক অসহায় মেয়েকে সাফল্যের চূড়ায় এগিয়ে দিতে। কিন্তু এখানেই আমার মিশনের ইতি ঘটেনি কিন্তু। আমি ছিলাম সাদিয়ার প্রতিটি সাফল্যের পথপ্রদর্শক। সাদিয়ার ছোটবেলা থেকেই ইচ্ছা ছিলো ও অটিজমের ডাক্তার হবে। কারণ ও নিজেই অনুভব করতে পারতো যে একজন বিকলাঙ্গ কিংবা প্রতিবন্ধী শিশুকে কতটা মানসিক যন্ত্রনা সহ্য করতে হয়। তাই আমি প্রতিনিয়তই ওকে উৎসাহ দিতাম ওর সকল ভালো পদক্ষেপগুলোতে।
এসব ভাবছি হঠাৎই পেছন থেকে কেউ একজন বলে উঠলো,
-ভাইয়া। সরি সরি। তোমাকে এতক্ষণ ধরে অপেক্ষা করালাম। আমি ক্ষানিকটা মায়াময়ী মুচকি হাসি দিয়ে ওর দিকে ফিরে তাকালাম। পরক্ষনেই আবার বলা শুরু করলো,
-আসলে হয়েছে কী আজ একটি বাচ্চা ছেলেকে নিয়ে ওর মা এসেছিলো। ছেলেটিকে দেখে খুব মায়া হলো জানো? এতো সুন্দর ছেলেটির একটি পা ছোট আরেকটি বড় একমনে এভাবেই বকবক করছিলো সাদিয়া। আর আমি ওর নিষ্পাপ মুখের দিকে একনয়নে তাকিয়ে রয়েছি। সেই প্রথমদিনের সাদিয়ার মায়ের কথাটা আমার আজ খুব করেই মধ্যকর্ণে বারংবার আঘাত করছে,
-কিচ্ছু করতে পারবেনা ভবিষ্যতে এই প্রতিবন্ধী মেয়ে। অথচ তাঁর লক্ষ্যে জয়ীতার ন্যায় পৌছে আজ সে অটিজমেরই এক ডাক্তার। এটাই বোধহয় প্রভুর অসহায়ত্বের প্রতি ভাগ্যের লীলাখেলার এক অপূর্ব উদাহরণ।
এরকম অজস্র সাদিয়ার মতো প্রতিবন্ধী ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে আমাদের সমাজের অবলীলায়। কিন্তু সমাজের নিকৃষ্ট বচনভঙ্গি অনুসারে তাঁরা পরিচিতি পায় এক নিম্ন শ্রেণীর মানুষ কিংবা বালির বোঝা হিসেবে। এভাবেই তাঁরা পরিবার এবং সমাজের অবজ্ঞায় নিজেকে গুটিয়ে ফেলে ঘরের কোণায় কিংবা নেমে যায় ভিক্ষাবৃত্তির মাধ্যমে নিজের অক্ষম দেহটিকে বাঁচিয়ে রাখার প্রয়াসে। কিন্তু আমরা কী পারিনা তাঁদের হাতটি ধরে কাধে কাধ মিলিয়ে আমাদের সহোচর বানিয়ে সামনে এগিয়ে নিতে? উত্তরটা হলো না। কারণ আমরা খুব স্বার্থপর। নিজের স্বার্থ হাসিলেই ব্যস্ত থাকি সর্বদা সেখানে একজন প্রতিবন্ধীকে কী সাহায্য করবো? আসলেই কী তাই? প্রশ্নের উত্তরটা কিন্তু চাই।
গল্পের বিষয়:
গল্প