পুরুষত্ব

পুরুষত্ব
আমার স্বামী সেদিন যখন আমার কাপড় ধুয়ে দিয়েছিলো সেদিন তার মা পুরো দিন বলেছিল আমার পাপের প্রায়শ্চিত্ত আমি নরকেও করতে পারব না। কিন্তু আট বছর ধরে তার প্রতিদিনের অফিসের, ঘরের, সুন্দর সুন্দর শার্ট প্যান্ট গুলো ধুয়ে আয়রণ করাতে যেসব পূন্য হতো তা দিয়ে সেদিন কাটাকাটি হলো না। আমি সে গজগজ এর উত্তর দিতে গিয়ে দিতে পারি নি সেদিন।
জমিয়ে রেখেছিলাম। একাউন্টিং পরীক্ষার সময় বড় অংক মিলানোর জন্য টেবিল থেকে উঠতে পারছিলাম না জামাইকে বলেছিল ভাত টা দেখতে। সে দেখেছিল। তারপর ও একটু লেগে গিয়ে পোড়া গন্ধ যখন উঠছিল আমার সব বই পানিতে চুবিয়ে রাখা উচিত বলে আলোচনা হচ্ছিল। মাইগ্রেনের ব্যাথায় বিছানা ছেড়ে উঠতে পারছিলাম না বলে যেদিন আমার জামাই তার মেয়ে হাগু পরিস্কার করেছিল সেদিন ও পুরুষ জাত থেকে নেমে গিয়েছিল। আমার জামাই এসব করেছে বলে ভাববেন না সে অনেক হেল্পফুল আর খোলা মনের। মোটেও না। যেগুলো বললাম সে ওগুলো একবারেই করেছিল। আর করে নি। তার পুরুষত্বে লেগেছিল। কারণ তাকে তো ছেলে হিসেবে বড় করেছে মানুষ নয়। বউয়ের কাপড় কেন ধুচ্ছিস যখন প্রশ্ন করা হলো, সে উত্তর দিয়েছিলো,
– আমি ধুয় নি ও ধুয়ে রেখেছে। আমি বাচ্চার গুলো ধুয়েছি।
সে উত্তর দে নি, কি হয়েছে তো আমি ধুয়ে দিলে, ওর তো ঠান্ডা লেগেছে। সে উত্তর দে নি, ভাত একটু লেগেছে তো কি হয়েছে আমি দেখলে? তুমি কেন একটু রান্নাটা করছো না যখন ওর পরীক্ষা চলছে? বাচ্চাটা আমারও তো, বাবা তো আমায় ডাকে। আমি করব না তো কে করবে? না সে উত্তর গুলো দে নি। সে বরং কাজ গুলো আর করে নি। আট বছরে যে কাজ গুলো আমি হাজার বার করেছি, সে একবার একবার করায় তা মনে রাখতে সহজ হয়েছে। তাই বলতেও সুবিদা হয়, করেছে তো।
আমি মিলাতে যাই না সে হিসাব। দুইপাল্লার মাপ ধরার জন্যেও তো পাল্লাটা সমান হতে হয়। আমি শুধু চেয়ে থাকি যখন সে বলে। আসলে আমি শব্দ খুজে পাই না। এখনো পাচ্ছি না। কি বলা যাই। যেদিন সে নেশা করে বাড়ি ফিরেছিলো, সেদিন তাকে পুরুষত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয় নি৷ তাই সে একই কাজ অনেক বারেই করেছে। যখন সে আরাম করার জন্য ছোট অযুহাতে চাকরি ছেড়ে ঘরে শুয়ে বসে খেয়েছিলো তার পুরুষত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয় নি, তাই সে একই কাজ অনেক বার করেছিলো। যখন সে বউয়ের ছোট ছোট ইচ্ছে গুলো পূরণ করতে পারে নি বলে বউ কত কেঁদেছে, সেদিন তার পুরুষত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয় নি। তাই সে কখনো ইচ্ছেপূরণের কথা ভাবে নি। পুরুষত্ব শব্দটা আসলেই সম্মানের ছেলেদের জন্য। পুরুষত্ব আসলেই দরকার। সেটা না থাকলে তাকে তুমি পুরুষ মানবে কেন? কিন্তু সে শব্দটা সঠিক উদাহরণ কোনগুলো?
বাসে উঠলে যখন একটা শক্ত হাত রড টা ধরে অন্যদের থেকে আমাকে আগলে রাখে সেটা পুরুষত্ব। আমায় যখন বিনা দোষে কেউ কথা শুনাচ্ছে তখন সে যখন নির্দ্বিধায় বলবে, আর একটা কথাও বলবে না। সেটা পুরুষত্ব। আমি বছরের পর বছর যখন তার পরিবার আগলে রেখেছি। অসুস্থ যখন থাকব তখন সে আমার সবটা যখন নিজের দায়িত্ব বলে করবে, কোন করুণা নয়, সেটাই পুরুষত্ব। যে বউয়ের গায়ে হাত তুলে সে পুরুষ নয়, যার বউ বলতে পারবে আমার স্বামী কখনো আমার গায়ে হাত তোলার কথা চিন্তাও করে নি। সেটাই পুরুষত্ব। তখন আপনি পুরুষ। যখন কোন পুরুষ বলে, এত গুলো বছরে আমার স্ত্রী আমার সব খেয়াল রেখেছে। তখন যদি সেটা নারীত্ব হয়। সেইম কথা যখন আপনার স্ত্রী আপনার জন্য বলবে সেটা আপনার পুরুষত্ব। অনেক দিন পর আমার সে কাপড় ধোয়ার কথাটা আবার খোটার সুরে বলে উঠেছিলো শাশুড়ী, সেদিন আমি ছাড়ি নি। ঠাট্টার সুরে বলেছিলাম,
-আমার কাপড়ে তো পায়খানা লেগে ছিলো না যে, সে কাপড় ধুয়ে আপনার ছেলে খারাপ কিছু করে ফেলেছে। মেয়ের কাপড় ধুয়েছিল তখন আমার একটা জামা আর একটা পেটিকোট ধুয়ে দিয়েছিল।
– তাও? বউয়ের পেটিকোট জামাই কেমনে ধুয়ে দিবে?
– আচ্ছা, পেটিকোটেই তাহলে সমস্যা? কি লেগে ছিলো সে পেটিকোটে?
-কি থাকবে? মেয়েদের নিচের অংশ অপবিত্র না? আমি ঝাড়ু দিতে দিতে স্থির হয়ে গিয়েছিলাম। আবার হেসে বললাম-
– তাহলে তো আমিও অনেক অপবিত্র কাপড় ধুয়েছি আপনার ছেলের। প্যান্ট, লুঙি, আন্ডারওয়ার। ওগুলোও তো নিচের ছিলো। এইবার উনি কথা খুঁজে পাচ্ছে না। আসলে দোষ টা কখনোই উনার বলব না। উনি এই ভাবনায় গেঁথে আছেন ছোট থেকে। মেয়েদের কাপড় অপবিত্র। ছেলেদের আবার পবিত্র অপবিত্র কি? উনাকে আমি বললাম,
-আচ্ছা মা, ছেলে মেয়ের ভিন্ন গঠন ঠিক আছে। মেয়েদের নিচের অংশ যদি নোংরা হয়, সে অংশ দিয়েই বের হওয়া ছেলেরা পবিত্র কেমনে হয়? আপনি ছেলের মা হওয়ার আগে তো আপনিও মেয়ে। আপনারও পিরিয়ড হতো বলেই তো আপনি মা হয়েছে। ছেলে হয়েছে বলে কি আপনি পবিত্র হয়ে গিয়েছেন? উনি উত্তর দিতে না পেরে মাথা নেড়েছিলেন। তাও আবার বললেন,
-তাই বলে বউয়ের কাপড়? যাও যাও, এত কথা বুঝি না। ইচ্ছে হলে ধোয়াও। রান্না করাও৷ ঘর মোছাও।
– হে মা, সব করাবো। আপনার শেখানো উচিত ছিলো যাতে আপনার অসুখ লাগলে করতে পারে। আপনি যখন শেখান নি আমাকে শেখাতে দেন। আমি না থাকলে যেন একদিন সে রেঁধে খেতে পারে। যদি সে কোন কাজ করলে আপনি এইভাবে বলেন তাহলে সে কিছুই করবে না। কাজ করলে সে মেয়ে হয়ে যাবে না। বাইরে কাজ করলে কি মেয়েরা ছেলে হয়ে যায়? ঘরের কাজ করলে ছেলেরাও মেয়ে হয় না।
এখন অনেক ছেলেই কাজের সুত্রে, পড়ালেখার জন্য একা থাকে তারা সবাই এইসব কাজ পারে। এতে তাদের পুরুষত্বটা কমে নি, বরং আরো বেড়েছে। যারা বিদেশ থাকে তার সব নিজের টা নিজেই করে। আর আপনি নয়, আপনার মতো অনেক মানুষেই আছে যারা ছেলেকে পবিত্র কিছু ভেবে বড় করেছে। তাই তারা মেয়েদের সম্মান করে না। তাই এত যে মেয়েদের প্রতি অত্যাচার অনাচার তারা সেসব মায়েদেরই ছেলে হয়। পুরুষত্ব আসলেই থাকা দরকার। তা না হলে আমি তাকে পুরুষ মানবো কেন? তাই বলে মেয়েরা অপবিত্র হবে কেন?
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত