রূপান্ধ

রূপান্ধ
চোখের সামনে যখন প্রিয় মানুষকে বান্ধবীর কাছে প্রেম নিবেদন করতে দেখেছিলাম, তখনই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছিলাম, “যেভাবেই হোক! সৌন্দর্য আমাকে ধারণ করতেই হবে।” আর আজ তার পরিণতি পেলাম!
ইন্টার্ন চিকিৎসকের প্রশ্নে উত্তর না দিয়ে কিঞ্চিৎ হেসে এগুলোই মনে মনে ভাবছে আল্পনা। দিনটা ছিল একুশে ফেব্রুয়ারি। এমন দিনে কালো সাদা শাড়ি পরে হাজির হতে চেয়েছিল স্বপ্নীলের সামনে। স্বপ্নীল তার স্বপ্নের মানুষ। দিনটির আগের দিন রাতে তার সাথে ম্যাসেজিং করেছিল এই বিষয়ে। স্বপ্নীল তখন অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, “শোক দিবসে প্রপোজ!”
আল্পনা– হ্যাঁ! তাতে কোনো সমস্যা?
স্বপ্নীল– অবশ্যই! তোমার প্রিয় মানুষকে তুমি শোক দিবসে প্রেম নিবেদন করবে সেটা কেমন দেখায়!
আল্পনা– তার পছন্দের রং কালো আর সাদা।
স্বপ্নীল– তাকে আমার পক্ষ থেকে চিমটি দিয়ে দিও।
আল্পনা– হা হা!
তখন আল্পনা মনে মনে হেসে বলছিল, “আপনিই নিজেকে চিমটি দেন!” কিন্তু এর পরের ম্যাসেজটি পড়ে তার সব স্বপ্ন ভেঙ্গে যায়।
স্বপ্নীল– আচ্ছা, একটা প্রশ্ন করি কিছু মনে করো না। তোমার বান্ধবী কুমকুম কি সিঙ্গেল?
সেদিন কুমকুমের বিপক্ষে সে অনেক আজেবাজে কথা বলেছিল। কুমকুমকে অনেকটা নিচু করেছিল সে। স্বপ্নীল তার কথাগুলো বিশ্বাস করে ফেলেছিল প্রায়। ঘুমানোর আগে কিছুটা সংশয় নিয়ে আল্পনা আগামী দিনের কথা ভাবতে থাকে। আর তার সংশয় সত্যি হয়। পরেরদিন সাদা কালো শাড়ি পরে চলে আসে বটমূলের সামনে। যখন সে স্বপ্নীলকে আসতে বলার জন্য ফোন হাতে নেয়, তখন তার কাঁধে হঠাৎ কারো স্পর্শে সে চমকে উঠে। পেছনে ঘুরে দেখে কুমকুম দাঁড়িয়ে সাদা জামদানি পরে। অসাধারণ লাগছে তাকে! কাঠগোলাপের মত সাদা গায়ের রং আর টানা টানা চোখ তার আসল সৌন্দর্য। খাড়া নাক আর লম্বা চুল তার সৌন্দর্যকে দ্বিগুন বাড়িয়ে দিচ্ছে। মুখে হাসি ধরে রেখে সে বলছে, “এই দেখ কি?”
আল্পনা– কি?
কুমকুম– দেখ তুই।
আল্পনা দেখলো, একটা ফুলের তোড়া আর একটা সুন্দর নেকলেস। সে যখন সেগুলো দেখছিল, তখন কুমকুম বলছিল, “স্বপ্নীল ভাইয়া আমাকে ভালোবাসে জানতামই না! আমি তো মনে করতাম সে তোর পিছে পিছে ঘুরে। সে আজ প্রপোজ করেছে। অদ্ভুত না? শোক দিবসে প্রেম নিবেদন!” কথাগুলো আল্পনার মনকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল তখন। কাঁপা কণ্ঠে সে প্রশ্ন করেছিল, “তুই রাজি?” লজ্জা পাওয়া ভঙ্গিতে কুমকুমের উত্তর ছিল, “রাজি না হওয়ার কারণ আছে কি?” “আমার সাথে এমন করলো কেন! কেন করলো এমন?” এগুলো বলতে বলতে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল আল্পনা। তাকে গাছের নিচে বেঞ্চিতে বসিয়ে চোখে মুখে পানি ছিটানো হয়। আধো আধো খোলা চোখে তাকিয়ে সে দেখতে পেয়েছিল স্বপ্নীলের চিন্তিত মুখ তার খুব কাছাকাছি। সেটাই ছিল শেষ দেখা। স্বপ্নীলকে দেখে সামলাতে তার খুব কষ্ট হয়েছিল। কিন্তু সে উঠে দাঁড়িয়ে হাটতে শুরু করে, পেছন ফিরে একবারও তাকায়নি।
বাসায় এসে দরজা আটকে ঘরে থাকা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের সৌন্দর্যের খুঁত খুঁজতে শুরু করলো সে। গায়ের রং শ্যামলা, চোখ গুলো টানা টানা। কিন্তু নাকটা বোঁচা। ঠোঁটও সিগারেটে পোড়া ঠোঁটের মত বেগুনি রঙের। মুখটা গামলার মত বড়, গালে কতগুলো ব্রণ। চুলগুলো হালকা কুঁকড়ে আছে। ভ্রু জোড়া চোখের সাথে মানানসই। তবে সবচেয়ে বাজে বিষয়, তার থুতনির নীচে ডাবল চেইন অর্থাৎ এক খাবলা মাংস ঝুলে আছে। মেদযুক্ত পেট আর উচ্চতায় সে পাঁচ ফিট। বিশ্ব সুন্দরীদের তালিকা করলে কুমকুমের নামটা বিবেচনা করা যায়। থুতনিতে ছোট্ট কালো তিল। চোখগুলো বাদামি রঙের। হাসলে গোলাপি ঠোঁটে আলো ঝিলিক দেয়। আল্পনা বলতে গেলে কুমকুমের বিপরীত।
সিদ্ধান্ত নেয় আল্পনা, যেকোনো উপায়ে সুন্দর হতে হবে। স্বপ্নীলের থেকে হাজার গুণ সুন্দর কাউকে সে নিজের সৌন্দর্যের জালে আটকে নিবে। তখন আল্পনা তার হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল। তার মাঝে মনুষ্যত্ব কাজ করেনি। হিংসা এবং প্রতিশোধ পরায়ণ মন তাকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে গিয়েছিল। সুদর্শন স্বপ্নীল, কেন তার সাথে এমন প্রতারণা করলো সেটা জানতে সে তখনই ফোন করেছিল স্বপ্নীলকে। স্বপ্নীল তার ফোন ধরেনি। হয়তো সময় কাটাচ্ছিলো কুমকুমের সাথে। রাতের বেলা স্বপ্নীল তাকে ম্যাসেজ করে, “ফোন দিব?” এটা দেখে আল্পনা নিজেই ফোন দেয়। স্বপ্নীলকে কিছু বলতে না দিয়ে সে বলে উঠে, “আপনি জানতেন তাই না? আপনি জানতেন আমি আপনাকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলাম কথাগুলো।”
স্বপ্নীল– হুম। আমি জানতাম।
আল্পনা– তাহলে এটা কেন করলেন! কিভাবে পারলেন এমনটা করতে?
স্বপ্নীল– ইউ আর এ চিপ গার্ল (তুমি একটা সস্তা মেয়ে)। তোমার মাইন্ড তোমার চেহারা সবকিছু সস্তা।
আল্পনা কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল, “আপনি আমার কাজগুলোই করলেন! আমি চেয়েছিলাম মনের কথা বলতে! কিন্তু আপনি ঠিক একই কাজ করলেন!” স্বপ্নীল ক্রোধের সাথে বলেছিল, “তুমি নিজে কি মেয়ে? তোমার বান্ধবীকে আমি পছন্দ করি অথচ তুমি তার নামে আমার কাছে কত বাজে কথা বলছো! তোমার কি উচিত ছিল না আমাকে এড়িয়ে যাওয়া কিংবা স্যাক্রিফাইস করা? তুমি যদি স্যাক্রিফাইস করতে না চাও তবে আমাকে এড়িয়ে যেতে পারতে! কিন্তু তুমি তোমার বান্ধবীকে বারো ভাতারি বানিয়ে দিয়েছো! কতটা নিচু মনের মেয়ে! ছি!”
আল্পনা– আপনি যদি বুঝেই গিয়েছিলেন যে আমি আপনাকে প্রপোজ করতে চাইছি তাহলে আপনি কেন এমন অপমান করলেন আমাকে? আপনি কেন সেদিন ভান করলেন যে কুমকুমের কুকর্ম আপনাকে কষ্ট দিয়েছে!
স্বপ্নীল– সত্যি বলতে আমি সেদিন বুঝে গিয়েছিলাম তুমি আমাকেই মিন করছো যে আমি তোমার প্রিয় মানুষ। আমি চেয়েছিলাম তুমি যেন প্রোপজ করে লজ্জায় না পরে যাও। তাই কুমকুমের কথা বলে তোমাকে বুঝিয়েছিলাম আমি তোমাকে একসেপ্ট করবো না। কিন্তু তুমি কুমকুমকে যথেষ্ট নিচু করেছো। এটা দেখে আমার রাগ চেপে গিয়েছিল, এখনো রাগ হচ্ছে। তাই ঠিক করলাম, তুমি যেভাবে প্রপোজ করতে চেয়েছো, সেভাবেই আমি কুমকুমকে প্রপোজ করবো। ইচ্ছে ছিল দুজন মিলে তোমার সামনে যাব। কিন্তু কুমকুম আগে যেতে চাইলো, তোমার অনুভূতি দেখার জন্য। আমি একপ্রকার প্রতিশোধ নিলাম কুমকুমের পক্ষ থেকে। ফারদার আমাকে কল করবা না সস্তা মেয়ে!
আল্পনা– আপনি এতটা নিষ্ঠুর! আমাকে বললে আমিই সরে আসতাম।
স্বপ্নীল– উহু, আমি তোমার বলা কথাগুলোর জবাব দিলাম এভাবেই। আর তুমি কিভাবে ভাবলে আমি তোমাকে একসেপ্ট করবো! তুমি কি আর আমি কি! তোমার চেয়ে কুমকুম হাজার গুণ সুন্দরী। স্বপ্ন দেখার আগে ভাবতে হয় সেই স্বপ্ন আদৌ বাস্তব হওয়া সম্ভব কিনা। রাখছি!
তারপর থেকে আল্পনার মাঝে জিদ তৈরি হলো। জিমে ভর্তি হয়ে নিজের ওজন কমানো শুরু করলো। বিভিন্ন ঔষধ খেতে লাগলো লম্বা হওয়ার জন্য, যদিও তার লম্বা হওয়ার বয়স শেষ। গায়ের রং ফর্সা করতে নানান ক্রিম মাখতে শুরু করলো, উপকারও পেলো। এভাবে নিজেকে অনেকটা পরিবর্তন করলো সে। আল্পনা এখন আর শ্যাম বর্ণের মেয়ে নয়। কৃত্রিম সৌন্দর্য তাকে পুতুলের মত রূপ দিয়েছে। আল্পনা বড়লোক বাবার মেয়ে। তার টাকার অভাব নেই, তাই সার্জারি করে বোঁচা নাক সূচালো করেছে। কোমল মুখে ব্রণের ছিটেফোঁটা নেই। ঠোঁটগুলো গোলাপের ন্যায়। সর্বসুন্দরী সে! শুধু উচ্চতা বাড়াতে পারেনি। তার সৌন্দর্য দেখে অনেক ছেলে তাকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। প্রেম বিয়ে, এসবের প্রস্তাব পেয়েও সে পিছিয়ে গেছে। স্বপ্নীলকে দেখিয়ে দিতে চেয়েছিল, তার চেয়েও বেশি সুদর্শন আর যোগ্য একজনকে বিয়ে করবে সে। তার সৌন্দর্য ধারণ করতে প্রায় এক বছর লেগে যায়। এরই মাঝে শুনতে পায়, স্বপ্নীল বিয়ে করেছে কুমকুমকে। কিন্তু সে পারেনি তার মনে অন্য কাউকে জায়গা দিতে। খুব চেয়েছে স্বপ্নীলকে ভুলে যেতে। পারেনি সে।
কিছুদিন পর তার খেয়াল হয়, কুমকুমের চোখ ছিল বাদামি রঙের। তখন সেও সেই রং করার জন্য লেসিক করার চিন্তা ভাবনা করলো। আল্পনা চশমা পরতো আগে থেকেই। তার চোখের পাওয়ারও অনেক। সেই সূত্রে লেসিক করাটা যুক্তিসঙ্গত মনে হয়েছে তার। কিন্তু তার বাবা কিছুতেই রাজি ছিল না। লেসিক করালে চোখের ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। একমাত্র আদরের মেয়ের আবদার না মেনে থাকতে পারেননি তিনি। তাই বিদেশে ভালো হাসপাতালে লেসিক করানো হলো। কিন্তু ভাগ্য! রূপে অন্ধ হয়ে গিয়েছিলো আল্পনা। তার হিংসা তাকে আগুনের মাঝে ঠেলে দিয়েছিল।
লেসিক করিয়ে ডাক্তাররা চিন্তিত হয়ে গিয়েছিল তাকে নিয়ে। যেদিন দুই চোখ সাদা কাপড়ের আবরণ থেকে মুক্ত করা হয়, তখন সে কিছুই দেখতে পাচ্ছিল না। ঝাপসা ছিল সবকিছু। ডাক্তার তার দ্বিতীয় অপারেশনের সিদ্ধান্ত নেয়। প্রায় ছয় মাস পর আবারো অপারেশন করা হয়। এইবার সে কিছুটা দেখতে পায়, পুরোপুরি নয়। ডাক্তাররা আমতা আমতা কণ্ঠে বলেছিল, সুস্থ হতে সময় লাগছে। তার ভেতরে কিছু ত্রুটি থাকায় এই সমস্যা হয়েছিল। কিছুদিন পর আবার ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু আর ঠিক হয়নি। আস্তে আস্তে অন্ধত্ব বরণ করে নিলো সে। বুঝতে পারলো তার হিংসার দহন কতটা পুড়িয়েছে তাকে।
বাংলাদেশে ফিরে এসে সে ঘরবন্দি হয়ে গেল। চিরচেনা ঘরের কোণে থাকা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখার চেষ্টা করলো সে, কতটা রূপবতী হয়েছে আগের তুলনায়। আজ সেই রূপ দেখার কোনো সুযোগ নেই। স্বপ্নীলকে দোষ দেয়না সে। স্বপ্নীলও চেয়েছিল সুন্দর প্রিয়তমা পেতে। তাই তার চিৎকার করে কেঁদে উঠে বলেছিল, “আল্লাহ! আমার সাথেই কেন এমন হলো! কেন হলো? আমি রূপবতী হয়েছি, দেখতে কেন পাচ্ছি না! আমার দৃষ্টি ফিরিয়ে দাও। দয়া করো আল্লাহ!” আজ সাড়ে চার বছর হয়ে গেল, ব্রেইল পদ্ধতিতে পড়াশোনা করছে আল্পনা। প্রতি তিন মাস পরপর তার চেকআপের প্রয়োজন হয়। আজকেও এসেছে। তার কোনো ইচ্ছে নেই নিয়ম করে চোখ দেখানোর। কিন্তু বাবার অনুরোধ ফেলতে পারে না। বিয়ে করেনি আল্পনা। ব্রেইল পদ্ধতিতে পড়ানো হয় এমন এক স্কুলে ছোট বাচ্চাদের সাথে সময় কাটায় সে। সেই সময়টা তার প্রতি দিনের সবচেয়ে সুন্দর মুহূর্ত। ডাক্তার তার আত্মীয়। এখনো আসেনি, তাই তাকে ডাক্তারের ঘরে অপেক্ষা করতে বলা হয়েছিল। তখন ইন্টার্ন প্রশিক্ষণরত ডাক্তার তাকে বলেছিল, “আপনি কি জন্মগত অন্ধ? জন্মগত হলে তো চিকিৎসা করে লাভ নেই।”
আল্পনা– লেসিক করানোর কারণে এমন হয়েছে।
ডাক্তার– লেসিক কেন করালেন!
এর উত্তরে মুচকি হেসে পুরোনো কথা ভাবছিল আল্পনা। এরপর হেসে উত্তর দিলো, “রূপে অন্ধ ছিলাম। বলতে পারেন আমি রূপান্ধ!” ডাক্তার ঠিক বুঝে উঠতে পারেনি তার কথার অর্থ কি! তাই প্রশ্ন করেছিল, “রূপান্ধ? সেটা কি?” তখন প্রবেশ করে তরুণ চিকিৎসক স্বপ্নীল, “আজ আসতে পারবেন না ডক্টর ঝুমুর। উনি হঠাৎ স্ট্রোক করেছেন।”
আল্পনা কন্ঠ না চিনতে পারায় উত্তেজিত হয়ে বলেছিল, “কিহ্! সত্যি?” স্বপ্নীল অবাক চোখে তাকিয়ে। কি অবস্থা আল্পনার! চিনতে পারছে সে আল্পনাকে। কোনো উত্তর না পাওয়ায় আল্পনা বলে উঠে, “বাবাকে জানাতে হবে। এখনই! ডাক্তার, আমার ফোনের ডায়ালে গিয়ে দেখুন সেখানে বাবা নামে একটা নাম্বার সেভ করা। একটু কষ্ট করে ফোন দিয়ে দিবেন?” ডাক্তার ফোন হাতে নিলো। স্বপ্নীল কাছে এসে প্রশ্ন করলো আল্পনাকে, “তোমার এই অবস্থা কেন?” আল্পনা প্রথমে বুঝতে পারলো না, “দুঃখিত, আপনি কে?”
স্বপ্নীল– আমি স্বপ্নীল।
আল্পনা কিছু বলার ভাষা পেলো না। চোখ ভরে উঠছে অশ্রুজলে। কিন্তু সে তার দুর্বলতা বুঝতে দিতে চায় না। দ্রুত সামলে উঠে বললো, “সত্যি বললে হাসবেন। আমি কারো হাসির পাত্র হতে চাই না।”
স্বপ্নীল– একটু সময় দেয়া যাবে?
আল্পনা– নাহ!
বাবার সাথে ফোনে কথা বলে চলতে শুরু করলো আল্পনা। বাহিরে আছে তার সহকারী। পেছন ফিরে স্বপ্নীলকে বললো, “কুমকুমের মত বাদামি চোখের অধিকারিণী হতে চেয়েছিলাম। তাই আজ এই অবস্থা। আমি রূপান্ধ।”
চলে গেল আল্পনা। স্বপ্নীল তার চেম্বারে গিয়ে বসলো। রোগী দেখার সময় শেষ। তবুও চেম্বারে কিছুক্ষণ একা সময় কাটাতে চাইলো। আর ভাবতে লাগলো, রূপান্ধ সেও হয়েছে! মনের চোখে সে অন্ধ!
সেদিন থেকে কুমকুম তার ভালোবাসার মানুষ। এক বছরের মাঝেই বিয়ে করে নিলো। স্বপ্নীল সুদর্শন, ভবিষ্যতে ভালো ডাক্তারদের মাঝে তার নাম থাকবে সেই নিশ্চয়তা দেয়া যায়। কিন্তু তার পারিবারিক অবস্থা ছিল শোচনীয়। তার একমাত্র ছোট বোনের ভার বহন করতে হয়, তার বাবা নেই। বড় ভাই সংসারের কোনো কিছু খেয়াল রাখে না। মায়ের দুটো কিডনি নষ্ট তাই প্রতি সপ্তাহে ডায়ালাইসিস করতে হয়। সেখানে প্রচুর খরচ হয়। এসব ভুলে সে রূপের জালে ফেঁসে কুমকুমকে ঝোঁকের মাথায় বিয়ে করে। কুমকুম তার বাহ্যিক অবস্থা দেখে বিয়ে করতে রাজি হয়। কিন্তু বেশিদিন টিকেনি সেই সম্পর্ক। শুরু হয় মনোমালিন্য আর তাসের সংসার। কুমকুম অন্তঃসত্ত্বা হওয়ায় তাদের মাঝে সম্পর্কটা কিছুদিন স্থির পর্যায়ে থাকে। তবুও সেই অসুস্থ অবস্থায় কুমকুম পরকীয়ার সম্পর্কে জড়িয়ে যায়। একদিন এই বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে কুমকুমের সকল ক্ষোভ বেড়িয়ে আসে সেদিন।
স্বপ্নীল– তুমি আমাকে কেন একসেপ্ট করেছিলে?
কুমকুম– আরে ওই আল্পনা তোমাকে পছন্দ করতো। ভাবতো তুমিও ওকে পছন্দ করো। আমার তখন তোমাকে ভালোই লাগতো। আবার হিংসা হতো এইভেবে যে তুমি ওই মুটকিকে কেন পছন্দ করো!
স্বপ্নীল– এর অর্থ, তুমি শুধু আল্পনাকে দেখানোর জন্য আমাকে ইউজ করেছো!
কুমকুম– ঐরকমি। তবে তোমার পারসোনালিটি ভালো লাগতো বলেই আমি বিয়ে করতে রাজি হয়েছি। কিন্তু আগে তো বুঝিনি, এসব সুদর্শন স্মার্ট ব্যক্তিত্বের পিছে কাপুরুষ লুকিয়ে থাকে।
স্বপ্নীল– কুমকুম! কি বলছো এসব?
কুমকুম–আমার কত রূপ! অথচ তোমার মত একজন কামলা খাটুনি খাটে এমন লোককে বিয়ে করতে হয়েছে আমায়! তখন বোকা ছিলাম তাই বুঝিনি তুমি কত বড় প্রতারক। আমার যোগ্যই না তুমি। বাচ্চা হবে, তোমাকে দিয়ে যাব। এরপর যা ইচ্ছা করো। ডিভোর্স দিব আমি তোমাকে। কাপুরুষ একটা! মায়ের সংসার সামলাতে গিয়ে বউকে ভুলে যায়। তুমি তো পুরুষ হওয়ার যোগ্যতাই রাখো না! কোনো দিক ঠিকমতো সামাল দিতে পারো না। তোমার ভাইকে দেখো। সে তোমার ভাবীর কথা মেনে চলে!
তখন মনে মনে হেসে স্বপ্নীল একটা প্রশ্ন করেছিল নিজেকে, “মাকে দেখাশোনা না করে বউয়ের আঁচলে বেঁধে থাকা ছেলেগুলো কি সত্যিই বীরপুরুষ?” ডিভোর্স হয়েছে তিন বছর হলো। চার বছরের একটি বাচ্চা মেয়ে আছে স্বপ্নীলের। নাম রেখেছে কল্পনা। কেন যেন এই নামটি রাখতে খুব ইচ্ছে করছিল তখন। মা মারা গেছে দুই বছর হলো। বোনকেও বিয়ে দিয়েছে। এখন কল্পনা একাই থাকে। সে যখন বাইরে থাকে তখন কল্পনাকে একটি ডে কেয়ার সেন্টারে রেখে আসে। মেয়েটা বাবার জন্য অনেক অপেক্ষা করে। মাকেও চায় সে। কিন্তু কাউকে বিশ্বাস করেনা স্বপ্নীল। বিয়ে করতে সাহস পায়না। তার মেয়েকে ভালোবাসবে এমন কেউ নেই বলে তার ধারণা।
দুই মাস ধরে এই হাসপাতালে চাকরি করছে স্বপ্নীল। এখন তার মনে হচ্ছে, আল্পনার দেখা পাওয়ার জন্যই এখানে আসা হয়েছে। তার মনে নানান কথা ঘুরপাক খাচ্ছে “আমিও রূপান্ধ আল্পনা। মনের চোখ রূপের কাছে অন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কুমকুমের মন দেখিনি আমি, রূপ দেখেছিলাম। আজকে বুঝতে পারলাম তুমিও রূপের অনলে দগ্ধ। তোমার কাছে ফিরে যাওয়ার সাহস আমার নেই। এভাবেই আমাদের জীবন অনিশ্চিত ভাবে এগিয়ে যাবে আল্পনা?”
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত