চার বছরে মিতুর তিনবার মিসক্যারেজ হয়েছে। আমাদের বিয়েটা পারিবারিক ভাবেই হয়েছে।তাই বিয়ের আগে জানাশোনাটা হয়ে ওঠেনি।ভেবেছিলাম মানিয়ে নিতে অনেকটা কষ্ট হবে।কিন্তু মেয়েটা এতো মিশুক আর এতো অমায়িক ব্যাবহার যে,অল্পকয়েক দিনেই সবাইকে আপন করে নিলো। কিন্তু সবচাইতে বেশি ভালোবাসতো বাচ্চাদেরকে।আমাদের বাসার পাশে যতগুলো বাচ্চা আছে সবাই মিতুর জন্য পাগল।সারাদিন মিতুর আশেপাশে ঘুরঘুর করতো।সারাক্ষণ এটা সেটা আবদার করে যেতো।আর মিতুও সেগুলো হাসিমুখে পালন করতো।আমার কাছে প্রায় সময় মনে হতো বাচ্চাগুলো ওদের মায়ের কাছেও হয়তো এতো আবদার করে না!
বাচ্চগুলো যেখানেই থাকতো না কেনো,মিতু ডাকলেই ছুটে চলে আসতো। আমি মজা করে মিতুকে “হেমিলিয়নের বাঁশি ওয়ালা” ডাকতাম। মিতু হেসে লুটিয়ে পড়তো।হেসে হেসে বলতো,”বাচ্চাদের বশ করতে ‘হেমেলিয়নের বাঁশি ওয়ালা’ হতে হয় নাকি?তাদের বশ করার জন্য একটু ভালোবাসাই যথেষ্ট!একটু মিষ্টি মিষ্টি কথা বললেই গলে যাবে।হিহি!” প্রথম যেদিন জানলো মিতু কনসিভ করেছে,সেদিন তার সেকি কান্না!আমি বললাম,’তুমি কি খুশি হওনি?কাঁদছো যে?’ মিতু চোখ মুছতে মুছতে বললো,’আমার এই অনুভূতিটা আপনাকে বোঝাতে পারবো না।কেমন জানি সুখ সুখ লাগছে।কান্না আটকে রাখতে পারছি না!’ ঠিকই তো!আমি একজন মায়ের অনুভূতি কি করে বুঝবো? মিতু খুব সাবধানেই চলাফেরা করতে লাগলো।২-৩ মাসেই মিতু বাবুদের বিভিন্ন জিনিস কিনতে শুরু করে দিয়েছিলো।কত-শত পাগলামি করছিলো।আমি দেখতাম আর মনেমনে হাসতাম।
সব ঠিকই ছিলো।কিন্তু একদিন হঠাৎ করেই মিতুর অনেক পেট ব্যাথা শুরু হলো।হসপিটাল নিয়ে গেলাম।কিন্তু রইলো না আমাদের বাচ্চাটা! ডক্টর যখন এসে বললো আপনাদের বাচ্চাটা মিসক্যারেজ হয়ে গেছে,তখন মনে হলো নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছিলো। পরক্ষণেই মিতুর কথা মনে পড়লো।ভাবলাম আমার কাছে এমন অসহ্য যন্ত্রণা লাগছে,আর যে তিন-চার মাস যাবত নিজের ভিতর অস্তিত্ব টা বিরাজ করছিলো তার কেমন অনুভূতি হবে! আমি মিতুর কাছে যেতেই,মেয়েটা আমার হাত ধরে কাঁদতে কাঁদতে বললো,”আমার বাচ্চাটা ঠিক আছে তো, না? কেমন জানি খালি খালি লাগছে! এমন লাগছে কেনো বলো না?” আমি সেদিন কিছু বলতে পারিনি। সেদিনের পর মিতু অনেক চুপচাপ হয়ে গেলো।সারাদিন টিয়া পাখির মতো পুটুরপুটুর করা মেয়েটার এমন নিরবতা সহ্য হচ্ছিলো না।কিন্তু ওকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষাও জানা ছিলো না।
তখনও জানা ছিলো না, সামনে আমাদের জন্য আরো কত ভয়াবহ সময় অপেক্ষা করছিলো!মিতু যখন অনেকটা স্বাভাবিক হলো তারপর ওর মাঝে আগমন ঘটলো আমাদের দ্বিতীয় বেবির।ঠিক তার চার মাস পর দ্বিতীয় বেবিটাও মিসক্যারেজ হয়ে গেলো। সারাটাদিন কেঁদেছে সেবার। আমার হাত ধরে কান্না মিশ্রিত সুরে বললো,”আচ্ছা,আমি কি খুব বড় অন্যায় কিছু করেছি বলেন তো? যার কারণে আল্লাহ্ আমাকে শাস্তি দিচ্ছে।” আমি তখন মৃদু হেসে বললাম,”ধুর বোকা! তুমি কি জানো না আল্লাহ্ যাদের খুব বেশি ভালোবাসেন তাদের একটু বেশি কষ্ট দিয়ে পরীক্ষা নেন। সে যদি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে যায় তখন তাঁকে অনেক অনেক সুখ দেয়।তোমাকেও একদিন অনেক অনেক সুখ দিবে,দেখো। আদরমাখা একটা ফুটফুটে বাচ্চা আসবে।” আমার কথাটা বোধহয় মিতুর খুব পছন্দ হয়েছিল। নিঃশব্দে দু ফোঁটা স্বস্তির অশ্রু বিসর্জন দিয়েছিলো। প্রথম দুইটা বেবি মিসক্যারেজ হয়ে যাওয়াতে তৃতীয় বেবিটার বেলায় খুব ভয়েভয়ে থাকতো। দুদিন পরপর চেকআপ করাতে যেতো। কিন্তু আল্লাহ্ না চাইলে কি কিছু হয়?হয় না।
সেবার মিতু কাঁদলো না।কেমন একটা মুখ করে সারাদিন বসে থাকতো।পাশের বাসার বাচ্চাগুলোর সাথেও আগের মতো প্রাণখোলা গল্প ও করতো না।বাচ্চাগুলো ও বোধহয় ওর কষ্টগুলো উপলব্ধি করতে পারছিলো।মিতুর গালে ছোটছোট দুহাত রেখে বলতো,”আন্টি,তোমাকে কি কেউ বকেছে?আমাদের বলো,মেরে দিবো ওই পঁচা টাকে।”মিতু তখন মৃদু হেসে ওদের একটু আদর দিয়ে দিতো।ওরা চলে যেতেই ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠতো।” ততোদিনে আশেপাশের সবাই কথা শুনাতে শুরু করে দিয়েছে। যেখানে একটা মেয়ে ভিতরে ভিতরে কাতর হয়ে আছে সেখানে তার সেই ব্যথাটাকে আরো গাঢ় করার জন্য উঠে পরে লেগেছে! আরো আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে সবাই-ই মেয়ে। একটা মেয়ে হয়ে আরেকটা মেয়ের কষ্ট টাকে উপলব্ধি -ই করতে পারছে না!! পরীর মতো মেয়েটা তার রূপ-লাবণ্য বিসর্জন দিয়ে দিয়েছে। খাওয়া-ঘুম সবকিছু এক প্রকার বাদ-ই দিয়ে দিয়েছে। প্রায় সময় আমি এসে জোর করে খাইয়ে দিতাম। ও তখন আমার দিকে তাকিয়ে কি যেনো ভাবতো। হয়তো এতো সবকিছুর জন্য নিজেকেই দায়ী করতে শুরু করে দিয়েছিলো!কি বোকা মেয়ে!
প্রায় মাঝরাতে মিতু ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠতো।এতো কষ্ট লাগতো। ভেবে পেতাম না এই উজাড় করে ভালোবাসা বিলানো মেয়েটাকে আল্লাহ্ কেনো এতো কষ্ট দিচ্ছিলেন! আমাকে ততোদিনে বাচ্চা হারানোর শোকের চাইতে মিতুর কষ্ট টাই বেশি স্পর্শ করে ফেলেছিলো। একটা মাত্র বাচ্চার জন্য আমাদের ছোট্ট সংসারটা শূন্যতায় ছেয়ে যাচ্ছিলো।এক টুকরো সুখের জন্য হাহাকার করছিলো আমাদের সংসারটা। সেদিন যখন অফিস থেকে আসার পর যখন দেখলাম মিতু চুপচাপ বসে আছে। আমি কাছে গিয়ে বসতেই আমার হাতে প্রেগনেন্সির কিট ধরিয়ে দিলো। দেখে বুঝলাম মিতু আবার কন্সিভ করেছে। আমি মৃদু হেসে বলেছিলাম ‘আলহামদুলিল্লাহ।’ কিন্তু মিতু নির্বিকার ভঙ্গিতে বসে রইলো। হয়তো ও ধরেই নিয়েছিলো এই সুখ প্রতিবারের মতোই ক্ষণিকের। কিছুদিন পর আবার এক বুক কষ্ট দিয়ে চলে যাবে!
আমি মিতুর গালে হাত রেখে বললাম, এইবার আল্লাহ্ আমাদের নিরাশ করবে না (ইনশাআল্লাহ) দেখো। মিতু আমার দিকে কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,”আপনি খুব বেশি ভালো। আল্লাহর কাছে হাজার শুকরিয়া যে তিনি আপনার মতো একজন জীবন সঙ্গী দিয়েছেন।” পাঁচ মাস পর চেক আপ করে যখন জানলো বাচ্চা সুস্থ আছে সেদিন মিতু কাঁদলো। খুব কাঁদলো। ডক্টর বলেছিলো যেহেতু আগে তিনবার মিসক্যারেজ হয়েছে তাই একটু বেশি সাবধানে থাকতে হবে। মিতুর যখন সাত মাস চলে তখন আমি অফিস থেকে তিন মাসের ছুটি নিয়ে নিলাম। আমি ছুটি নিয়েছি শুনে মিতু অবাক চোখে তাকিয়ে বললো, “আশ্চর্য আপনি এতোদিন ছুটি নিয়েছেন কেনো?” আমি একটু হেসে বললাম, “তুমি এতো এতো ত্যাগ শিকার করছো আর আমি সামান্য তিন মাস ছুটি নিতে পারবো না?”
মেয়েটা তখনও কাঁদলো। সবাই এতো কটু কথা শোনায় সেখানে আমি ওকে এতো সাপোর্ট দিচ্ছি সেটাই যেনো ওর বিস্ময়ের কারন। হয়তো ভেবেছিলো সবার মতো আমিও ওকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করবো। কটু কথা শোনাবো! মনে করবেই বা না কেনো? আমাদের সমাজ টা তো এমনই! একটা মেয়ে যেখানে এতো এতো কষ্ট সহ্য করে দুমড়ে মোচড়ে যাচ্ছে সেখানে আমাদের সমাজ সেই মেয়েটাকে আরো ক্ষত-বিক্ষত করার জন্য উঠে পড়ে লাগে! যেখানে কিনা ওর কোনো দোষ-ই নেই! আটমাসের শেষের দিকে হঠাৎ মিতুর খুব পেট ব্যথা উঠে। সাথে সাথে হসপিটাল নিয়ে গেলাম। সাথে সাথেই ওকে ও.টি তে নিয়ে যাওয়া হলো। সেদিন আমার মনে এক অজানা ভয় গ্রাস করে নিচ্ছিলো। না, অনাগত বাচ্চাটাকে নিয়ে নয়,মিতুকে নিয়ে। কিছুক্ষণ পর ডক্টর বেড়িয়ে বললো, রোগী ও বাচ্চার অবস্থা খুব বেশি ভালো না।রোগীর অবস্থাই বেশি খারাপের দিকে যাচ্ছে। আমি হয়তো সেদিন পৃথিবীর সবথেকে নিষ্ঠুর বাবা হয়েছিলাম। আমি ডক্টরকে বললাম, “আমার বাচ্চা লাগবে না ডক্টর! আমার মিতুটাকে লাগবেই লাগবে!”
ডক্টর আমার কাঁধে হাত রেখে বললেন,”আই উইল ট্রাই মাই বেস্ট। বাকিটা আল্লাহর হাতে।” আমার হাত-পা কাঁপতে লাগলো। চোখ বেয়ে দু ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো। ততক্ষণে মিতুর আর আমার পরিবারের সবাই চলে এসেছে হসপিটালে। আমাকে একেকজন একেক কথা জিজ্ঞাসা করছে। কিন্তু আমি কিছুই বলতে পারছিলাম না। কি ভিষণ কষ্ট হচ্ছিল! ঠিক তখনই ডক্টর বেড়িয়ে এলো। হাতের গ্লাভস খুলতে খুলতে ডাকলো, মি.আবরার ? আমার গলা শুকিয়ে যাচ্ছিলো। ডক্টর আমাকে অবাক করে দিয়ে হেসে বললেন, আলহামদুলিল্লাহ মা-বাচ্চা দুজনই সুস্থ আছে। কি এক অদ্ভুত শিহরণ বয়ে গেলো শরীরে! চোখ বেয়ে এবারও দু ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো! উঁহু, কষ্টের না,সুখের অশ্রু!উফফ কি অসহ্য সুখ সুখ ব্যথা হতে লাগলো!
গল্পের বিষয়:
গল্প