অতিক্রম

অতিক্রম
বাসের ভেতর মানুষের ভীড়ে স্পর্শকাতর অংশে ছেলেটার দু-একবার ছোঁয়া লাগায় শিউলি অস্বস্তি বোধ করলেও চোখ নামিয়ে নেয় । তাদের মফস্বল শহরে এই ছুঁয়ে দেখার লুকোচুরি খেলাটা এরচেয়ে বাজেভাবে ঘটে । ঢাকা শহরে এমনটা আশা করেনি সে। অবশেষে বাবার হাত ধরে বাসস্টপে নেমে স্বস্তির শ্বাস ফেলে শিউলি । ফজল আলী চারপাশে মানুষের ভীড়ে একটু বিপন্ন বোধ করলেও মেয়ের দিকে তাকিয়ে সাহস সঞ্চয় করে । মেয়েটা অনেকক্ষণ ধরে কিছু খায়নি ।
ফজল আলীর ফতুয়া টাইপ পাঞ্জাবির ভেতরের পকেটে ভাংতি মিলিয়ে পনেরো ষোলো শ টাকা আছে । কাগজে লেখা ঠিকানাটি খুব একটা দূরে না হলেও, অভুক্ত মেয়েকে নিয়ে তার এই মুহূর্তে যেতে ইচ্ছে করছেনা । ফজল আলী খুব মেপে মাঝারি মানের একটা রেস্টুরেন্টে প্রবেশ করে । মেয়ের জন্য চিকেন বিরিয়ানি আর নিজের জন্য পাতলা রুটির অর্ডার দিয়ে ফজল আলী মনে মনে বিলের হিসেব কষে নেয় । বউয়ের জন্য ভালো একটা শাড়ি কেনা হয়নি অনেকদিন । ফজল আলী সোনালী পাড়ের লাল একটা শাড়ি কল্পনা করার ফাঁকে খাবার চলে আসে । বিরিয়ানির ঘ্রাণটা ভালো । ফজল আলী আড়চোখে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস চেপে যায় । বাড়িতে শেষ কবে বিরিয়ানি কিংবা কোরমা পোলাও রান্না হয়েছিল, ফজল আলী মনে করতে পারে না । বাবার শুকনো রুটি দেখে শিউলি প্লেটটা টেনে নিয়ে বিরিয়ানির সাথে মুরগির রানের কিছুটা বাপের প্লেটে তুলে দিয়ে পোলাও আর মুরগির মাংসটা মাখাতে গিয়ে ক্ষিদে টের পায় ।
দারিদ্র্যের মধ্যে বেড়ে উঠলেও বিচিত্র কারণে শিউলি আর তার একমাত্র ভাই রাজু জন্ম থেকেই শিষ্টাচার শিখেছে ।
বাপ বারোয়ারী ব্যবসা করে । কখনো সব্জির ব্যবসা, কখনো রাজমিস্ত্রীর কাজ । তাদের মা অভাব নিয়ে মাঝেমাঝে অভিযোগ করলেও আশপাশের মহিলাদের মতো কখনো খিস্তি খেউড় করেনি । ঝরঝরে পোলাওয়ে নিপুণ আঙ্গুল চালানোর ফাঁকে মা আর ভাইয়ের কথা মনে পড়ে শিউলির । বাপের নিচু মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে ; বাজান, আমারে কি তোমাদের সাথে রাখতে পারতা না ? শুকনো রুটি ফজল আলীর গলায় সমস্যা সৃষ্টি করে । সে নিয়ত করেছে রুটি ভাজি শেষ হলে সামান্য বিরিয়ানিটুকু খাবে । শুকনো রুটি মুখে নিয়েই বলে ; তারা মানুষ খুব ভালোরে মা, তোর অনেক আদর যত্ন হবে । ফজল আলী আকরাম শেখ চেয়ারম্যানের ছেলের নাম চেপে যায় । আজকালকার ছেলেরা বখাটে হলেও আকরাম শেখের ছেলে তাজুল শেখ অনেক ক্ষমতা রাখে । উপজেলায় রাজনীতি করায় তাজুলের উপর কেউ কথা বলে না ।
গরীবের বউবাচ্চা সুন্দর হওয়ার নিয়ম নাই । সেই নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটিয়ে সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে শিউলি সুন্দর থেকে সুন্দরতম হয়ে উঠেছে । তাজুল শেখ ক্ষমতা পাকাপোক্ত করে শিউলির দিকে নজর দিয়েছে । কুপ্রস্তাব নয়, তাজুল শিউলিকে তাদের বাগানবাড়িতে দাওয়াত দিয়েছে কয়েকবার । কানাঘুষা চলে এর আগে নাকি তাদের এলাকায় দু’একটা মেয়েকে তাজুল শেখ তাদের বাগানবাড়িতে নিয়েছে । কিন্তু ফজল আলী একদিন দিনের বেলা অনেকের সামনে তাজুলকে দৃঢ় কন্ঠে নিষেধ করে বিপদ ডেকে এনেছে । উপায়ন্তর না দেখে অবশেষে মেয়েকে নিয়ে ঢাকা এসেছে । ঢাকায় এলাকার গণ্যমান্য ব্যবসায়ী রাসেল শিকদার সাহেবের অবস্থা খুব ভালো । গ্রামে থাকাকালীন ফজল আলী একসময় শিকদার সাহেবের সাথে সাথে থাকতো । ফজল আলী শিকদার সাহেবের সাথে আলাপ করায় তিনি শিউলিকে তার বাসায় পাঠিয়ে দেয়ার কথা বলে ভাড়ার টাকাও পাঠিয়ে দিয়ে পুরনো দিনের বিশ্বস্ত ফজল আলীর প্রতি বদান্যতা দেখিয়েছেন । ঢাকা শহরে কাজের মানুষের অনেক সম্মান ।
রাসেল শিকদার সাহেব বাসাতেই ছিলেন । ফজল আলীর মেয়ে শিউলিকে দেখে তিনি একটু চমকে উঠলেও চেপে যান । যৌবনে ফজল আলী যে সুন্দর ছিল, মুহুর্তে সেই ছবি তার চোখে ফুটে ওঠায় ওনার চোখেমুখে প্রশান্তির ছায়া খেলা করে । শিকদার সাহেবের এক ছেলে আর এক মেয়ে । ছেলেটি প্রাইভেট ইউনিতে পড়ে, মেয়েটা সদ্য কলেজে ভর্তি হয়েছে । মিসেস ফারজানা আলম শিউলিকে প্রথম দেখাতেই পছন্দের পাশাপাশি সিকদার সাহেবের মতো অস্বস্তি বোধ করলেও দ্রুত চেপে যান । নাগরিক জীবনে অস্বস্তি চেপে যাওয়া একটা আর্ট । এই কাজে যে যতটা পারদর্শী, তার কদর তত বেশি । ফারজানা আলম মেয়েটাকে একটু ধাতস্থ হওয়ার সুযোগ করে দেয়ার পাশাপাশি কিচেনের লাগোয়া সার্ভেন্টস রুমটা দেখিয়ে দিলেন । ছোট্ট রুমে সিঙ্গেল একটা খাট । আলনায় মাকড়সার জাল দেখে বোঝা যায় বহুদিন এই রুমে কেউ থাকেনি । শিউলি বাপকে সাথে নিয়ে ঘন্টাখানেকর ভেতর রুমটা পরিপাটি করে সাজিয়ে তোলে ।
ফজল আলীকে শিকদার সাহেব রাতের খাবার খেয়ে যাওয়ার অনুরোধ করলেও ফজল আলী বিনয়ের সাথে বাস পেতে দেরি হওয়ার অজুহাত দেখিয়ে রওয়ানা দেয়ার তোড়জোড় করে । ফজল আলী মেয়ের রুমে একান্তে তার মাথায় হাত রেখে বিড়বিড় করে জানা কিছু দোয়া আউড়াতে থাকে । ফজল আলী মেয়ের মাথায় হাত রেখে চোখ বন্ধ করতেই আঠারো বছর আগে ফিরে যায় । শরতের এক বৃষ্টি রাতে ফজল আলী যেদিন মেয়েটাকে কোলে তুলে নিয়েছিল, তার মনে হয়েছিল মেয়ে তো নয়, যেন এক থোকা শিউলি ফুল । মেয়েটার শরীরের নবজাতকের ঘ্রাণ ফজল আলীর হতাশা এক ঝটকায় দূর করে দিয়েছিল । মেয়েদের নিয়ে তার একটা গোপন পাপ থাকায়, ছেলে আশা করেছিল ফজল আলী । চোখের জল ধরে রাখতে শিউলির কষ্ট হলেও বাপের কথা ভেবে শব্দ করে হেসে ওঠে । ফজল আলী চোখ খুলে মেয়ের হাসিমুখ দেখে নিজেও হাসে ।
পরিবারটির সাথে শিউলির মিশে যেতে দিন দশেক সময় লাগে । ঘরের কাজকর্ম খুব বেশি নয় । ওয়াশিং মেশিনে কাপড় ধোয়া, ব্রাশ দিয়ে ফ্লোর পরিষ্কার করার পর মপ করার কাজটা সে দ্রুত আয়ত্ত করে নেয় । রাইসা মেয়েটা খুব ভালো । পারতপক্ষে সে শিউলিকে খুব একটা হুকুম করে না কিন্তু রনির রুমে চা কিংবা কফি নিয়ে গেলে শিউলি ভয়ংকর অস্বস্তি বোধ করে । রনি বিছানায় আধশোয়া অবস্থায় শিউলির শরীরে যে প্রখর দৃষ্টি বুলায়, অগ্রসরমান উপজেলায় বেড়ে ওঠা অষ্টাদশী শিউলির সেই দৃষ্টির অর্থ বুঝতে সমস্যা হয়না । মেয়েদের জীবন যেন হরিণীর মতো । প্রতিনিয়ত শিকারী বাঘের আতংকে কানদুটো খাড়া করে রাখতে রাখতে হরিণী যেমন একসময় সন্ত্রস্ত জীবনে অভ্যস্ত হয়ে যায়, মেয়েরাও তেমন । পুরুষ জানতেও পারে না কীভাবে একটা মেয়ে সন্তর্পণে ধীরেধীরে পরিপূর্ণ নারী হয়ে ওঠে ।
মাস তিনেকের ভেতর ফজল আলী একদিনের জন্য মেয়েকে দেখতে এসে চমকে ওঠে । ভালো খাবার আর শহুরে আলো বাতাসে তার কলিজার টুকরো যেন এখন বিলের সদ্য ফোটা পদ্ম । শিকদার সাহেবের বলা লাগে না, শিউলি নিজে থেকেই বাপকে দুপুরে নিজের রুমে নানান পদের তরকারি দিয়ে খাইয়ে দেয়ার ফাঁকে মা আর রাজুর আদ্যোপান্ত জেনে নেয় । ফজল আলী দেশি মুরগির ঝাল ফ্রাই তৃপ্তি সহকারে খাচ্ছে দেখে শিউলি মিটিমিটি হেসে বলে ; বাজান, তরকারি কিন্তু আমি রান্না করছি । ফজল আলী মনে মনে বউ রেবার প্রতি কৃতজ্ঞতা বোধ করে । ফজল আলীর নিষেধ সত্বেও রেবা মেয়েকে রান্নাবান্না শিখিয়েছে । সেই বিদ্যা আজ কাজে লাগায় ফজল আলীর চোখ সিক্ত হতে গিয়েও সে নিজেকে সামলে নেয় ।
এক বছরের মাথায় মেয়েকে ছুটিতে নিয়ে যাওয়ার আগেই শিকদার সাহেব ফজল আলীকে ফোন করে শিউলির ছোট একটা অপারেশনের কথা জানালে, ফজল আলী কালবিলম্ব না করে চলে আসে । শিকদার সাহেব শিউলির মাসান্তের বেতনের চেয়ে বিকাশে দশ হাজার বেশি পাঠানোয় ফজল আলীর মনে কু ডেকে ওঠে । গরীবের কাছে অযাচিত অর্থ মানে বিপদের পূর্বাভাস । ফজল আলী মেয়েকে যখন ক্লিনিকে দেখতে যায়, শিউলি ততক্ষণে অপারেশনের প্রাথমিক ধাক্কা সয়ে নিয়েছে ।
ক্লিনিকে যাওয়ার পর শিউলি তার বাপকে জড়িয়ে ধরে অনেক কান্নাকাটি করে বললো ; বাপজান, তুমি যার কাছে আমাকে রেখে গিয়েছিলে, সেই শিকদার আঙ্কেল আমাকে পাশবিকতার শিকার বানিয়েছেন । এক বছরের ভেতর শিউলির শুদ্ধ ভাষায় পরিপক্কতা এসেছে । ফজল আলী প্রথমে বুঝতে না পারলেও, নার্সদের তীর্যক হাসি, আর পঁচিশ বছর আগে শিকদার সাহেবের দ্বারা একটা মেয়ে প্রেগন্যান্ট হয়ে যাওয়ার পর ফজল আলী গর্ভপাতে সহযোগিতা করার স্মৃতি রোমন্থন করে যা বোঝার বুঝে নেয় । ফজল আলী শিউলির মাথায় হাত বুলিয়ে বলে ; কপালের দোষরে মা, এরচেয়ে তাজুল ছেলেটা যদি তোকে বিয়ে করতো, তোর এতবড় সর্বনাশ হতো না । শিউলি এত কষ্টের মাঝেও মাথা নিচু করে বলে ; তাজুল আমাকে বিয়ের কথা বলেছিল কিন্তু আমি বিশ্বাস করিনি । ফজল আলী বিশ্বাস অবিশ্বাসের দোলায় মেয়ের দিকে তাকায়।
দামি ক্লিনিকে চিকিৎসা করিয়ে শিকদার সাহেব এবারও বদান্যতার পরিচয় দেয়ায় ফজল আলী দিন তিনেক প্রাসাদোপম বাড়ি আর ক্লিনিকে গুটিসুটি মেরে পড়ে থাকে । শিউলি সামান্য সুস্থ হলে একরাতে ফজল আলী শিকদার সাহেবের পায়ের কাছে দামি কার্পেটে বসে মেয়েকে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে । শিকদার সাহেব একটু আনমনা কন্ঠে বলেন ; আমার ছেলে একটা ভুল করেছে ফজল মিয়া, তুমি কি সেইটা গোপন রাখবা? ফজল আলী মুখ না তুলেই বলে ; স্যার, আপনার পরিবারের সম্মান আমার জানের চেয়েও বড়, আমারে শুধু মেয়েটারে নিয়া যাইতে দেন । শিকদার সাহেব কেঁপে ওঠেন । এই ফজল আলীর কন্ঠ সেই ফজল আলীর । ওনার যৌবনে গ্রামে তাঁর বাবার বাগানবাড়িতে ভোগ বিলাসে ফজল আলী ছিল একান্ত অনুগত । বিত্তশালী হওয়ার অনেক ফাসাদ । তাগড়া জোয়ান ফজল আলী সেই সময়ে শিকদার সাহেবকে আগলে রেখেছিল ।
তখন ফজল আলী আগলে না রাখলে বিশিষ্ট ব্যবসায়ী শিকদার সাহেবের শরীরে দুর্গন্ধ লেগে থাকতো । শিকদার সাহেব একটা দীর্ঘশ্বাস চেপে গম্ভীর কন্ঠে বলেন ; তোমারে আমি পুরাপুরি বিশ্বাস করি ফজল আলী, তুমি তো জানো আমার টাকা পয়সার কমতি নাই, কিন্তু এই বয়সে দুর্নাম কামাতে চাই না । ফজল আলী শিকদার সাহেবকে কথা দেয় । মেয়েকে নিয়ে ফিরে আসার সময় শিকদার সাহেবের দেয়া হাজার টাকার দুটো চকচকে তোড়া সে অস্বীকার করে না । পঁচিশ বছর আগে শিকদার সাহেবের সাথে চোরাগলিতে হেঁটে ফজল আলী জেনেছে এই টাকা তার রক্ষাকবচ । ঢাকায় থাকলেও শিকদার সাহেবের হাত এখনো তাদের উপজেলায় অনায়াসে পৌঁছে যায় । ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতা এখন মোবাইল ফোনে কাজ করে । শিউলিকে নিয়ে বাড়ি ফিরে আসার সময় ফজল আলী সারাটা পথ মাথা নিচু করে রাখে । এখন বড়লোক যখন মান সম্মান খুইয়ে মাথা উঁচু করে চলে, গরীব মানুষ তখন মাথা নিচু করে সম্মান বাঁচাতে চায় ।
একবছরে তাজুলের অনেক উন্নতি হয়েছে । এলাকার লোকজন তাকে এখন সম্মান করে । সবাই জানে আকরাম শেখের পর তার যোগ্য ছেলে তাজুল শেখই চেয়ারম্যান হবে । শিক্ষা দিক্ষায় কম হলেও সময়ের বাস্তবতায় এই তাজুল এখন অনেক পরিণত । কিন্তু সমস্যা অন্য জায়গায় । হাতের দামি মোবাইলের অনেক Apps ব্যবহারে সে দক্ষ হলেও মেয়েদের মন বুঝতে অক্ষম । শিউলির আপাদমস্তক মেপে জিজ্ঞেস করে ;কেমন আছো ? শিউলি তাজুলের চোখের উপর চোখ রাখে । সেই দৃষ্টিতে পলক না ফেলেই উত্তর দেয় ; এবোরশনের পর এখন বেশ সুস্থ আছি ।
তাজুল হা করে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে ; তুমি কি বললা ? শিউলি একটু কাছে এসে ফিসফিস করে বলে ; এখন আপনি আমারে নিয়া মজা করতে পারেন । আমাকে আপনার বাগানবাড়িতে নিয়ে যাবেন ? তাজুল ঝড়ের বেগে বেরিয়ে আসে । সাঙোপাঙোরা তার দৃঢ় চোয়াল দেখে কোনো প্রশ্ন করে না কিন্তু বুঝতে পারে কোথাও একটা সমস্যা হয়েছে । রাতে প্রচুর পান করে একসময় শূন্য বোতল ভেঙ্গে ফেলে তাজুল । তার চিৎকার করতে ইচ্ছে করে সে তো এমন জীবন চায়নি কিন্তু কেন এমন হলো ? জীবনে প্রথমবার বাবার টাকা আর ক্ষমতার উপর ঘৃণার একটা সুক্ষ্ম বাতাস ঢেউ খেয়ে আবার বাতাসে মিলিয়ে যায় । পরদিন সন্ধ্যার মোহনীয় আলোয় তাজুল ফজল আলীর কাছে শিউলিকে বিয়ের প্রস্তাব দেয় । ফজল আলী দ্বিতীয়বার মেয়ের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে তাজুলকে সত্যটা জানিয়ে বিস্মিত হয় ।
আকরাম চেয়ারম্যানের ছেলে তাজুল শেখ ফজল আলীর চোখের দিকে পলকহীন চোখে তাকালে, পোড় খাওয়া ফজল আলীর বুঝতে অসুবিধা হয়নি যে তাজুল খবরটা জেনেছে । মেয়ে নিরাপদ আছে জেনেও ফজল আলী মেয়েকে দেয়া কথা রাখে । রাসেল শিকদার গ্রামে বেড়াতে এসে পুরোনো পাইক পেয়াদাদের অন্যতম ফজল আলীকে ডেকে পাঠান । শিকদার সাহেবের সাথে ফজল আলীর সখ্যতা সবাই জানে । ফজল আলী সেই জানাকে সত্য প্রমাণ করে । অনেকদিন পর ফজল আলীর কনুইয়ের সাথে লেপ্টে থাকা ঝকঝকে দা দেখে কারো মনে প্রশ্ন জাগে না । ফজল আলী প্রকাশ্যে সেই ডাব কাটার জন্য ঝকঝকে ধারালো দায়ের এককোপে রাসেল শিকদারের ধড় থেকে মাথাটা আলাদা করে ফেললেও, কেউ কোনো প্রশ্ন করে না । সবাই জানে মাঝবয়সী তাগড়া পেশিবহুল ফজল আলী কম কথা আর বেশি কাজে অভ্যস্ত ।
তিন বছর পর । তাজুল শিউলিকে নিয়ে জেল হাজতে ফজল আলীকে দেখতে এসেছে । তাজুল শেখ ফজল আলীর ফাঁসি কার্যকর করার আভাস পেয়ে চড়া দামে একান্তে আলাপ করার সুযোগ কিনে নিয়েছে । ক্লিনিকে সেই রাতে তার কলিজার টুকরা মেয়েটা রাসেল শিকদারের নাম জানিয়ে দেয়ায় ফজল আলী মেয়ের মুখ চেপে কানেকানে বেঁচে থাকার জন্য চুপ থাকার পাশাপাশি বিচারের কথা দিয়েছিল । শিউলি টেরও পায়নি তার মাঝবয়সী বাপের পেটানো শরীরের চেয়ে মনের ভেতর একটা ক্ষুধার্ত বাঘ ঘাপটি মেরে ছিল । টের পেলে অবুঝ মেয়েটা নষ্ট হওয়ায় কষ্টটা চেপে যেতো ।
রাত দুটোর সময় একটা এম্বুলেন্সে করে বাপকে নিয়ে শিউলি বাড়ির পথে রওয়ানা দিয়েছে । শিউলি পরম মমতায় বাপের হাত ধরে বসে আছে । এম্বুলেন্সের জানালার কাচ সরিয়ে দেয়ায় কোজাগরী পূর্ণিমার আলো ফজল আলীর মুখে এসে লুটিয়ে পড়ছে । শিউলি বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করে তীব্র মাখন গলা জ্যোৎস্নায় ফজল আলীর মুখে এক টুকরো হাসি যেন লেপ্টে আছে। শিউলি পরম মমতায় বাপের মুখে হাত বোলাতে থাকে । তাজুল তার ডান হাতটা শিউলির মাথায় রেখে, ঠায় বাইরের দিকে তাকায় । তাজুল জানতেও পারে না এই জ্যোৎস্না ধারায় তার সমস্ত পাপ ধুয়েমুছে গেছে ।
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত