শেষ দেখা

শেষ দেখা
ব্রোকেন ফ্যামিলির সন্তান হবার কারনে জীবনে নানা অজানা অনুভূতির ভেতর দিয়ে পথ চলতে হয়েছে আমাকে। গতকালও একজন কলিগ বলে বসলেন, “আপনি তো বেশ ভাগ্যবান, ফ্যামিলির ঝুট ঝামেলা থেকে বেঁচে গেলেন।” উনার সুক্ষ খোঁচা বুঝেও সিঙেল মাদারের সান্নিধ্যে বেড়ে ওঠা আমি নিশ্চুপ ছিলাম। বয়স যখন কম ছিলো, তখন নানান জনের বাঁকা কথায় চোখ জলে ভাসতো। এখন সবই গায়ে সয়।
তবুও আজ মনটা ভীষন ভার, যেনো শতমণ ওজনের পাথর বুকে বইছি। কিছুতেই ঘুম আসছেনা। পাশ ফিরলাম। ঘরের মৃদু আলোয় ইরার ঘুমন্ত মুখটা দেখে ভেতরটা কেমন হু হু করে উঠলো। মাত্র মিনিট তিরিশ আগেই ঘুমিয়েছে ও। ইনসম্নিয়ার সমস্যাটাও ইদানিং বেশ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। রাত নিশ্চই এখন অনেক। ক’টা বাজে দেখতে মোবাইল ফোনটা হাতে নিলাম। তিনটা বেজে সাতাশ মিনিট। ফোনটা সাইড টেবিলে রাখতে যাবো ঠিক তখনই, রাতের নিশ্ছিদ্র নীরবতায় ঝংকার দিয়ে বেজে উঠলো যন্ত্রটা। এই শেষ রাতে কার মনে পড়লো আমার কথা? স্ক্রিনে ভেসে উঠলো অচেনা নাম্বার। অপরিচিত নাম্বার থেকে আজকাল আর তেমন একটা কল আসেনা। তবুও সবুজ বোতামে দ্বিধাজড়িত আঙুল ছুঁইয়ে বললাম,
-হ্যালো। ওপাশ থেকে কান্না জড়িত পুরুষ গলায় একজন বলে উঠলেন,
– আপনি কি আতিক বলছেন? আতাহার আহমেদ কিছুক্ষন আগে ইন্তেকাল করেছেন।
চিনেছেন তো উনাকে? ফরিদপুরের এডভোকেট আতাহার সাহেব। বাড়ির নাম মাধবীলতা। আমি কি বলবো ঠিক বুঝে উঠতে পারছিনা। হাত পা অবশ হয়ে আসছে। মুহুর্তেই যেনো বাকশক্তি লোপ পেয়েছে। আমার কন্ঠের সাড়া না পেয়ে ওপাশ থেকে ক্রমাগত হ্যালো হ্যালো করে যাচ্ছেন উনি। আমি উনাকে চিনিনা। আচ্ছা উনি কি হন আমার? আমাকে নিরুত্তর দেখে উনি এবার কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললেন,
– কাল বাদ জুমা জানাজা। আপনি কি আসবেন? আমি ঠিকানা মেসেজে পাঠিয়ে দিচ্ছি। এবার আর নির্বাক থাকাটা নিজের কাছে অশোভন মনে হলো। বললাম,
– দেখি, আমি যোগাযোগ করবো। ওনার গলায় যেনো কান্নার রেশ স্বজোরে ছড়িয়ে পড়লো। বললেন,
– উনার শেষ ইচ্ছে ছিলো, আপনি যেনো তার জানাজায় সামিল হন। শেষবার তাকে কবরে শুইয়ে দিয়ে আসেন।
বুঝতে পারছিলাম, এই দুই বাক্য বলতেই ভদ্রলোক বাঁধভাঙা কান্নায় হিমশিম খাচ্ছেন। গলার ভেতরে বসত করা তীব্র ইচ্ছেটাকে আর দমিয়ে না রেখে জিজ্ঞেস করলাম,
– আচ্ছা, আপনার নামটা? মানে যদি যোগাযোগ করতে চাই তখন।
– আমার নাম আসিফ। আসিফ আহমেদ। আমার নাম্বারটা সেইভ করে রাখুন।
– ঠিক আছে। রাখছি এখন।
কথা শেষে নিশ্চুপ হয়ে বসে রইলাম কিছুক্ষন। এভাবে ঠিক কতক্ষণ বসে ছিলাম জানিনা। মুয়াজ্জিনের আজানের ধ্বনিতে সম্বিৎ ফিরলো। আম্মা নিশ্চই এতক্ষনে উঠে গিয়েছেন। বাইরে আলো ফোটার এখনো অনেক দেরী। রুমে উঁকি দিয়েই দেখি আম্মা জায়নামাযে বসে। সবেমাত্র সালাম ফিরিয়েছেন। খবরটা জানাবো কি জানাবোনা এই নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছি। কাছে গিয়ে পাশে বসলাম। ছুটির দিনে এত ভোরে উঠতে অভ্যস্ত নই আমি। তিনি জানেন সেকথা। একমনে দোয়া দরুদ পড়ছেন। চোখের ইশারায় কাছে যেতে বললেন।
– এদিকে আয়, ফুঁ দিয়ে দেই। আমি শান্তভঙিতে মাথা নিচু করে কাছে গেলাম।
– আম্মা, একটা কথা ছিলো। ভীষণ জরুরী।
– কাল রাতে ঘুমোসনি নাকি? ভোরবেলা আবার কি এমন জরুরী কথা মনে পড়লো?
আম্মার চোখে মুখে উৎকন্ঠা ভেসে উঠলো। আমি পরবর্তী অবস্থার জন্য নিজেকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করছি। আম্মা কিভাবে ব্যাপারটা সামলে নেন। কিংবা আদৌ সামলে নিতে পারেন কিনা। তাই ভেবে আমার অস্থিরতা ক্রমশ বাড়ছে। আমি গলার স্বর সর্বনিম্নে নামিয়ে আম্মার মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম,
– এডভোকেট আতাহার আহমেদ আর বেঁচে নেই। ঘন্টা খানেক আগে মারা গিয়েছেন। আম্মার চোখের কর্ণিয়ায় হীরের কণার মতো বিচ্ছুরিত হতে শুরু করেছে নোনা জল। কিন্তু তিনি সে জলকে চোখের সীমানা প্রাচীর ডিঙোতে দিলেননা। সমস্ত কৌতুহল দমন করে নিশ্চুপ বসে রইলেন। আমিই কথা চালিয়ে নিয়ে গেলাম।
– যিনি আমাকে খবরটা জানিয়েছেন, তিনি সম্ভবত ওনার আত্নীয়। আমাকে কাল যেতে বলছেন ফরিদপুর। আমি কি যাবো আম্মা? এবারও আম্মা প্রত্যুত্তর করলেন না। জানলার বাইরে ভোরের নরম আলোর রোশনাইতে ঘরময় স্নীগ্ধ একটা আবেশ ছড়িয়ে পড়েছে। সেই আবেশে আম্মার শোকাতুর মুখটাকে মনে হচ্ছে একটা জীবন্ত এপিটাফ। প্রানের স্পন্দন আছে কিন্তু তাতে জীবনের আনন্দ নেই। হাওয়াই মিঠাই রঙের সুতি ওড়নায় আবৃত আম্মার মুখাবয়ব। লম্বাটে মুখটাতে অস্বচ্ছ মার্বেলের মতো চোখদুটো আমার দৃষ্টি থেকে পালাতে চাইছে বারবার। শুকনো ঠোঁট জোড়া নড়ে উঠছে থেকে থেকে। আয়াতুল কুরসি পড়ছেন। পড়া শেষে আমার সর্বাঙ্গ এ মৃদু ফুঁ বুলিয়ে দিয়ে বললেন,
– যাওয়া না যাওয়া তোর ইচ্ছে। তবে মানুষের ইচ্ছের মুল্য দেয়া উচিৎ।
আম্মার কথাটা যেনো সেকেন্ডে তিন লক্ষ মিটার গতিতে মস্তিস্কে ঘুরপাক খেতে লাগলো। ‘ইচ্ছের মুল্য’ এই শব্দ দুটি যে বড় চেনা আমার। জন্মাবধি নিজের ইচ্ছেগুলোকে মুল্য না দিয়ে বরং জলাঞ্জলি দিতেই শিখেছি। ক্লাস সিক্সে যখন হাল ফ্যাশনের একজোড়া জাম্প কেডসের আবদার করেছিলাম। তখন এগারো বছর বয়েসী আমাকে শেখানো হয়েছিলো কিভাবে অদম্য ইচ্ছেগুলোকে শামুকের মত শক্ত খোলসে গুটিয়ে ফেলে নিঃশ্বাস নিতে হয়। একবার মাঘের শীতে আম্মার কাছে ব্যাডমিন্টনের র্যাকেট আর শাটলকক কেনার টাকা চেয়েছিলাম,পাইনি। বন্ধুদের আনা র্যাকেট দিয়ে খেলতে সংকোচ হতো খুব। কিছু বললেই আম্মা তখন বলতেন, বাবাহীন সন্তানের এত চাহিদা থাকতে নেই। বুঝেছিলাম, উচ্চাশার পালক শরীর থেকে ছেঁটে ফেললেই সুখী হওয়া যায়।
আম্মার ঘর থেকে বেড়িয়ে এলাম। দরজা পেরোতেই কি মনে করে একবার পেছনে ফিরেছি। সেজদায় মাথা ছুঁইয়ে পড়ে আছেন। ক্ষণে ক্ষণে কেঁপে উঠছে তার শীর্ণ শরীর। আম্মা কাঁদছেন! ইরা উঠে পড়েছে। কিচেনে তার কাজের টুং টাং শব্দ পাচ্ছি। আজ সন্ধ্যায় ওর আবার গাইনোকলজিষ্টের কাছে এপয়ন্টমেন্ট আছে। সন্তান জন্মদানে আমার আংশিক ব্যার্থতার দায় নির্দ্বিধায় কাঁধে তুলে নিয়েছে সে। যদিও আমার অনুর্বরতাকে ইরা স্রষ্টার দেয়া পরীক্ষা হিসেবেই দেখছে। অথচ আমাদের আনুষ্ঠানিক বিয়ের দিন এই আমিই তার সব দ্বায়িত্ব নিবো বলো সগৌরবে মাথা তুলেছিলাম। কী সেলুকাস! গোসল সেরে একেবারে ধোপদুরস্থ হয়ে টেবিলে এসেছি। আম্মা নিজের ঘর থেকে আর বের হননি। থাকুক নাহয় আজ কিছুটা সময় নিজের মতো। ইরা প্লেটে রুটি দিয়ে বললো,
– বক্সে করে কিছু খাবার দিয়ে দিবো? যদি পথে তোমার খিদে পায়।
– না থাক, তোমার শরীরটা ভালো নেই। কিছু দিতে হবেনা।
শুধু সন্ধ্যায় ডাক্তারের কাছে যাবার সময় আম্মাকে বড় মামার বাসায় রেখে যেও। একা বাসায় যদি কোনও বিপদ আপদ হয়। আমি বড়মামাকে ফোনে বলে দিয়েছি। আমি যে ফরিদপুর যাচ্ছি সেকথা ওকে জানিয়েছি। কৌতুহল হলেও ‘মাধবীলতায়’ যাচ্ছি শুনে আর কথা বাড়ায়নি। বাড়ির গেটে দাঁড়িয়ে আছি দুজন। ইরা পানির বোতল ব্যাগে ঢুকিয়ে বললো,
– অনেক আশা নিয়ে আছি। যদি এবার পজিটিভ আসে। আমি কিছু না বলে শুধু ওর হাতটা ধরে বললাম,
– আসি।
আমি জানি ইরা আরো মিনিট দুয়েক দাঁড়িয়ে থাকবে। যতক্ষন আমাকে দেখা যাবে ঠিক ততক্ষন। এই সাত বছর নিঃসন্তান থেকেও মেয়েটা আমায় ছেড়ে যায়নি কেনো আমি জানিনা। এর নামই হয়তো মায়া। হেঁটে এসে বাস ধরলাম। এই বাস সোজা যাবে ফেরীঘাট। ফেরীতে উঠে আসিফ সাহেবকে কল করে জানাতে বলেছেন। নদীর ওপারে উনি স্বশরীরে আসবেন যাতে ওপারে গিয়ে আমাকে আর বিপাকে পড়তে না হয়। ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিলো। এই জৈষ্ঠ মাসের গরমে জানলার পাশে সিট পেলাম। বাস ছেড়েছে এইমাত্র। সামনের সিটে ছোট ছেলে সহ এক দম্পতি উঠেছেন। একটু পর পরই অবান্তর প্রশ্নের জন্য বাচ্চাটাকে ধমকে যাচ্ছেন মা। তবুও মায়ের নিষেধ উপেক্ষা করে বেশ জোরে শোরেই চলছে বাবা ছেলের কথোপকথন। হয়তো এটা জগতের সুন্দরতম দৃশ্যের একটি। কিন্তু নিজের অপুর্ণতার কথা ভেবে মনটা বিষন্নতায় আচ্ছন্ন হয়ে গেলো। চোখ ফিরিয়ে নিলাম। আর কতদূর ফরিদপুর?
আমার মস্তিস্কে বাবাকে নিয়ে উল্ল্যেখযোগ্য কোনো স্মৃতি নেই। বড় হবার পর থেকে জেনেছি আমার ফ্যামিলি মানে শুধু মা। সেখানে বাবা নামক ব্যাক্তিটির অনুপ্রবেশ নেই। আরেকটু বড় হবার পর জানলাম, আমার মা ডিভোর্সী। অবশ্য ততদিনে অভিধান খুঁজে ডিভোর্স শব্দের আক্ষরিক অর্থ আমি জেনে গিয়েছিলাম। ‘ বিবাহবিচ্ছেদ’। আম্মা সচেতন ভাবেই বাসায় আমার বাবার কোনোও ছবি রাখেননি। ছেলেবেলায় স্কুলপড়ুয়া আমি বন্ধুদের বাবাদের দেখে মনে মনে বাবার একটা স্থিরচিত্র তৈরী করতে চাইতাম। কিন্তু পারতাম না। বাবা মানেই মনে হতো ভারী কণ্ঠস্বরের দৃড়চেতা কিন্তু দরদী একজন মানুষ। যে পরীক্ষায় ফেল করলেও, পিঠ চাঁপড়ে উদ্যম দিয়ে হাসিমুখে বলবে, ‘বেটার নেক্সট টাইম।’ কিন্তু, জীবনের কোনও পরীক্ষার রেজাল্ট কার্ডই আমার বাবার হাতের সই দিয়ে ভরে ওঠেনি।
বাস থেকে নেমেছি অনেকক্ষন। ফেরীতে নদী পার হতে দ্বিগুণ সময় নিলো। হাতে ছোট ব্যাগটা নিয়ে ডক পেড়িয়ে একটা টঙে এসে বসলাম। জার্নিতে শরীরটাতে কেমন যেন আড়ষ্টতা ভর করেছে। অচেনা জায়গা, চারিদিকে অপরিচিত লোকজন। আসিফ নামক ভদ্রলোক কিভাবে আমাকে খুঁজে বের করবেন এই নিয়েও আমি কিছুটা সন্দিহান। ফোনের মাধ্যমে আমার বর্তমান একটি ছবি তাকে পাঠিয়েছি। তবুও এতদূর এসে মনের ভেতর কেমন যেনো খচ খচ করছে। চা শেষ করে উনার বলে দেয়া একটা খাবারের হোটেলের সামনে দাড়ালাম। ফোন বাজছে। নিশ্চই উনি।
– মেরুন শার্ট আর কালো প্যান্ট তাই তো? হাতে একটা ব্রাউন লেদারের ব্যাগ আছে।
– এসেছেন আপনি? কই আমি তো দেখতে পাচ্ছিনা।
– পেছনে ঘুরুন প্লিজ। সাদা পাঞ্জাবীর মানুষটাই আমি।
আমি কান থেকে মোবাইল ফোন নামালাম। চোখে চশমা, গায়ে সাদা সুতি পাঞ্জাবীর সাথে রংচটা জিন্স। চেহারায় তারুণ্যের জেল্লা উথলে উঠছে। বয়স আন্দাজ করলে সাতাশ আটাশের বেশি কিছুতেই হবেনা। আমার চেয়ে দশ বারো বছরের ছোটই হবে হয়তো। আমি অস্বস্তি আড়াল করে হাত মেলালাম। উনিও অপ্রস্তুতভাবে মুখে হাসির রেখা টানতে চাইলেন। তারপর একবাক্যে বললেন,
– গাড়িতে উঠুন। যেতে যেতে বাকি কথা বলা যাবে।
গাড়ি চলছে, ড্রাইভার আর অন্য একজন সহ আমরা চারজন গাড়িতে। কেউ কথা বলছেনা। আমিই নীরবতা ভাঙলাম। একপ্রকার বাতাসে প্রশ্ন ছুঁড়লাম।
– উনি কি আগে থেকেই অসুস্থ ছিলেন?
– আসলে উনার ওপেন হার্ট সার্জারি হয়েছিলো দু’ মাস আগে।
ভালোই রিকভারি করেছিলেন। কিন্তু গত পরশু রাতে হঠাত বুকে প্রচন্ড পেইন শুরু হলো। তড়িঘড়ি হাসপাতালেও নিয়েছি। কিন্তু ধরে রাখতে পারলাম না। আসিফের গলা ধরে এসেছে। আমার ভীষন জানতে ইচ্ছে করে আতাহার সাহেব সম্পর্কে কি হন ছেলেটির। কিন্তু পরক্ষণেই মত বদলাই। এখন থাক নাহয়।
মাধবী লতার ঝাড় লোহার গেইটটাকে আগাগোড়া মুড়িয়ে রেখেছে। গেইট সংলগ্ন দেয়ালে, শ্বেতপাথরের ফলকে বড় করে লেখা ‘মাধবীলতা’। নানান রকম মানুষের ভীড় ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই ছিমছাম ডিজাইনের দোতলা বাড়ি চোখে পড়লো। আসিফ আমাকে সোজা নিয়ে গেলো দোতলায়। আমি চারপাশে সরু চোখে তাকালাম। টের পাচ্ছিলাম, আমাকে সবাই ভীষন রকমভাবে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। বাতাসে একটা চাপা গুঞ্জন ভাসছে। এই সেই আতিক!
দোতলার কোণার একটা ঘরে বসার ব্যাবস্থা হলো। কিছুক্ষন পর পর একেকজন উঁকি মারছে ঘরে। তবে কেউই ভেতরে ঢুকছে না। মিনিট পনেরো অপেক্ষার পর একজন ভদ্রমহিলা এসে পাশের সোফায় বসলেন। ধীরস্থির গলায় বললেন,
– তোমার সাথে দেখা হবে আমি জানতাম। তুমি করেই বলছি। আমার ছেলের বয়েসি তুমি।
– আপনার পরিচয় জানলে আমার কথা বলতে সুবিধা হতো।
– আমি আতাহার আহমেদের স্ত্রী। আর কিছুক্ষন পর যার জানাজা হবে।
এবার আমি ভালোভাবে তাকালাম। ভদ্রমহিলার পরনে সাদা কাপড়। বড় ঘোমটার জন্য চেহারা দেখা যাচ্ছেনা।
– তোমাকে একটা চিঠি দেবার ছিলো। আসলে চিঠিটা ঠিক তোমাকে নয়, তোমার মাকে উদ্দ্যেশ্য করে লেখা।
– আমার আম্মাকে?
– হ্যাঁ, আমি চাই তুমি তাকে চিঠিটা দাও। আমি হাত পেতে নিলাম। চিঠিটা নতুন। তবে খাম নেই।ক’ দিন আগেই হয়তো লেখা হয়েছে। কালির ঘ্রান এখনো তাজা। উনি উঠে পড়লেন দ্রুত।
– মরা বাড়ি। কাজের শেষ নেই। যাই,তোমার জন্য কিছু খাবারের ব্যাবস্থা করি।
– ব্যস্ত হবেন না। আমি কিছু খাবোনা এখন।
– তাহলে এক গ্লাস শরবত অন্তত পাঠাই। গলা ভিজিয়ে নাও। এতদূর থেকে এলে।
অন্যের চিঠি পড়া অন্যায় জেনেও চিঠির ভাঁজ খুললাম। কে আম্মাকে লিখেছে চিঠিটা? কি হন তিনি আম্মার? না জেনে কি করে থাকি। আজ থেকে এক সপ্তাহ আগের তারিখ দেয়া। মধু, কেমন আছো তুমি? আতিক কেমন আছে? তোমাদের পুরোনো বাসার ল্যান্ড নাম্বারে আর কল যায়না। যদিও প্রতিবারই রিসিভ করে তোমাদের চাইলে, কেউ না কেউ লাইন কেটে দিতো। আমি জানতাম এ জীবনে আর তোমার সাথে কথা হবেনা। আটত্রিশ বছর আগে পাঠানো চিঠিতে তুমি লিখেছিলে, ‘যদি আমার কান্না তোমাকে না ছোঁয়। তবে তুমি আমার কাগজের সহধর্মী, সহমর্মি নও!’
তার মাস ছয়েক পরেই আমাদের কাগজের সম্পর্কেরও ইতি টেনে দিলে। সহমর্মি হবার দ্বিতীয় সুযোগটুকু দিলেনা। সাত মাসের আতিককে নিয়ে চলে গেলে নারায়ণগঞ্জ। ছেলে দেখতে কেমন হয়েছে জানতে ইচ্ছে হতো খুব। লোক মারফত খোঁজ খবর নিতাম। ছবিও যোগাড় করেছি কিছু। প্রতিবছর ছেলের জন্মদিনে মসজিদে মিসকিন খাওয়াতাম। অথছ সেই ছেলের মুখে বাবা ডাক শোনার সাধ আর মিটলোনা। এই অপ্রাপ্তিটুকু নিয়েই বেঁচে রইলাম। তাই নিজেকে এই বলে স্বান্তনা দেই। সব পেলে তাকে কী জীবন বলে, সে তো জান্নাত। বরং অভাব থাকলে পাওয়ার সুখটা আরো গাঢ় হয়। তখন সত্যিকারের জান্নাতে যাওয়ার লোভটা বাড়ে। এই অভাব আমার শেষ হলোনা আর। আমার অপারগতা, আমার অপরাধ ক্ষমা করো মধু। নিজের মতপার্থক্য,আত্ন অহং থেকে সরে দাঁড়াইনি। তোমার ওপর মত মর্জির মস্ত বোঝা চাপিয়ে দিয়েছিলাম। তবুও আজ করজোড়ে ক্ষমা চাই। আমার ছেলেকেও বলো, তার এই ব্যার্থ বাবাটিকে ক্ষমা করে দিতে। ক্ষমা করে দেয়া কঠিন, অসম্ভব নয়। আর একটি অনুরোধ, আমার জানাজায় যেনো সে সামিল হয়। শেষশয়নে সন্তানের স্পর্শ থেকে বঞ্চিত করো না আমাকে। ভালো থেকো মাধবীলতা।
ইতি
আতিকের বাবা চিঠি শেষ করে বসে আছি। এর মাঝে ঠিক কতক্ষন সময় গিয়েছি জানিনা। আম্মাকে উনি মাধবীলতা বলে ডাকতেন, একথা আমার জানার কথা নয়। এ বাড়ির নামও আম্মারই নামে। সম্পর্কের ওপর দিয়ে এত ঝড় ঝঞ্জা গেলো। কিন্তু নামফলকে ‘মাধবীলতা’ অম্লান হয়ে ঠিকই টিকে রইলো। আসলে, আমরা সম্পর্কের নাম দেই শুধু। অনুভূতির নাম দেবার সাধ্য আমাদের নেই। সেই ভদ্রমহিলা আবার ঘরে এলেন। এসেই প্রশ্ন করলেন।
-চিঠি পড়েছো?
– জ্বী পড়েছি। আপনিও নিশ্চই পড়েছেন? আসলে, খোলা ছিলো, তাই বললাম।
– হ্যাঁ পড়েছি।
– আপনার খারাপ লাগেনি? আপনি তো উনার বর্তমান ছিলেন।
– না লাগেনি। এক মুহুর্তের জন্যও লাগেনি। ভালোবাসা অভ্যেস হয়ে দাড়ালে তাকে অস্বীকার করা কঠিন। আমার অভ্যেস ছিলেন উনি। এটুকু বলেই ডুকরে কেঁদে উঠলেন তিনি। তারপর ঝটপট নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন,
-তুমি কি উনাকে শেষ একটিবার দেখতে চাও? আমি দৃড় কন্ঠে উত্তর দিলাম,
– না।
আমার কাছ থেকে হয়তো এমন উত্তর আশা করেননি তিনি। কিন্তু আমার জীবনে পাওয়া শত শত তিরস্কার, অপমান আর বঞ্চনার কালশিটে দাগ, কি করে শুধুমাত্র একটি চিঠির জলফেনায় ধুয়ে ফেলি! জানাজার আয়োজন করা হয়েছে বাড়ির আঙিনায়। মানুষের উপচে পড়া ঢল। অজু করে দাড়ালাম। ভাবতে পারছিনা খাঁটিয়ার কাফনে জড়ানো মৃত মানুষটি আমার জন্মদাতা। এখনো বুকে সেই পাথরচাপা কষ্টটা ঘাটি গেঁড়ে আছে। আসিফ ডাকছেন আমাকে। বললেন,
– খাঁটিয়া তুলতে হবে, আপনি সামনে দাড়ান। আমি বাবার খাঁটিয়া কাঁধে নিলাম। ভাবছি, বাবার কাঁধে চড়ে বেড়াবার কোনও স্মৃতিতো আমার মেমোরিতে নেই! মোহগ্রস্থের মতো কালিমা শাহাদাত পড়তে পড়তে পা ফেলছি। চারপাশে অচেনা মানুষজন। কবরস্থানে এবার নামানো হবে উনাকে। কেউ একজন পাশ থেকে বললেন।
– তোমরা দু’ভাই মিলে নামাও। আমরাও সাথে ধরছি।
আসিফের সাথে আমিও হাত দিয়ে ধরলাম। মৃতবাবা কি আমার সেই স্পর্শ টের পাবেন? আমি জানিনা। একজন জোরে জোরে বলছেন, মুর্দার কাফনের বাঁধন খুলে দাও। আমি এক এক করে সব বাঁধন আলগা করে দিলাম। তারপর মুখের কাফনও সরিয়ে দিলাম। দেখলাম বাবার মুখ। আমার বাবা। কলিজার ভেতর যেনো কেউ একশো হাঁতুড়ি পেটাচ্ছে। দুমড়ে মুঁচড়ে দিচ্ছে এতোদিনের ক্ষোভের দেয়াল। নোনা অশ্রুর স্ফুলিঙ্গ পুড়িয়ে দিচ্ছে চিবুক। আমি শরীরের সমস্ত শক্তি একত্র করে চিৎকার করে ডাকছি,
– বাবা, বাবা, বাবা। আসিফ এসে আমার মাথাটা বুকে চেপে ধরেছে, পীঠে পরম মমতায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে যাচ্ছে,
– বাবা আর কথা বলবেনা। মৃত মানুষ কখনো কথা বলে না!
এরপর ঠিক কতক্ষন আমি অজ্ঞান ছিলাম জানিনা। চোখ মেলে নিজেকে মাধবীলতার ঘরে আবিষ্কার করলাম। ধাতস্থ হয়ে মোবাইলফোন হাতে নিয়ে দেখি ইরার মিসড কল। ইনবক্সে টেক্সট মেসেজ। ওপেন করলাম। ইরা লিখেছে, ‘ রিপোর্ট পজিটিভ, তুমি বাবা হতে যাচ্ছো আতিক’ দু’চোখ বেয়ে জল উপচে পড়ছে। মুহুর্তেই যেনো মৃতবাবার হাহাকারময় অনুভূতিগুলো চেতনায় খলখবলিয়ে উঠতে চাইছে। আমি অস্ফুটে বাবার লেখা চিঠির বাক্য উচ্চারন করি, অসংখ্য অসংখ্য বার। ক্ষমা করে দেয়া কঠিন, অসম্ভব নয়, অসম্ভব নয়। তোমাকে ক্ষমা করে দিলাম বাবা।
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত