সেই ছেলেটি

সেই ছেলেটি
-এই ছেলে অর্ধবার্ষিক পরীক্ষায় তোমার রেজাল্ট কী?
-জ্বী স্যার এ গ্রেড।
-কীহ! ফেল করে বলছো এ গ্রেড? এই ইসহাক ওর রেজাল্ট টা দেখোতো। রোল কত তোমার?
-স্যার ১৩৬।
ছেলেটির কথা শোনামাত্রই ক্লাস ক্যাপ্টেন ইসহাক অতি তাড়াহুড়ার সহিত রেজাল্ট লিষ্টের খাতাটা বের করে স্যারের উদ্দেশ্যে বললো,
-জ্বী স্যার। ৪.১২ পেয়েছে।
-তাই নাকি?
এই ছেলে সবসময় ক্লাসের লাষ্ট বেঞ্চে বসে আবার পড়া জিজ্ঞেস করলেও পড়া পারেনা সে আবার এ গ্রেড পায় কীভাবে? নিশ্চই তুমি নকল করেছো। টেষ্টেই দেখা যাবে তোমার আসল রূপ। যদি ফেল করো তবে বাপ দাদা এসে পা ধরলেও পরীক্ষা দিতে পারবা না। বসো। ছেলেটি অনেকটা নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বেঞ্চটিতে বসে পরলো। মনে হচ্ছে তাঁর কোন অনুভূতিই নেই। আমার বন্ধু মুনতাছের আমাকে হালকা কন্ঠে বলে উঠলো,
-দোস্ত। এই পোলায় এ গ্রেড পাইলো কেমনেরে যেখানে আমাদের পাশ নাম্বার নিয়াই টানাটানি? আমিও চিন্তিত মুখে বললাম,
-আমিও বুঝতেছি নারে।
বলে রাখা ভালো, আমাদের ক্লাসের প্রায় ৬০শতাংশ শিক্ষার্থীরই এস এস সি লেভেলে জিপিএ ৫ রয়েছে। তাঁর মধ্যে আমি আর মুনতাছের ও অন্যতম। কিন্তু অর্ধবার্ষিক পরীক্ষায় পাশ করেছে ১৪০ জনে মাত্র ত্রিশ জন। আর এ গ্রেড পেয়েছে মাত্র ৪জন। আমি এখনো ছেলেটির দিকে অবাক নয়নে তাকিয়ে রয়েছি। পোশাক পরিচ্ছদেই বোঝা যাচ্ছে পারিবারিক অবস্থা তেমন সচ্ছল নয় এবং অন্যান্য ছেলেদের মতোও তেমন চঞ্চল টাইপের নয়। টেষ্ট পরীক্ষার এক মাস আগে থেকে সব শিক্ষার্থীদের ভীর যখন স্যারদের বাসায় তখন ছেলেটি যেন নিশ্চিন্ত মনে বিকাল বেলা আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের রাস্তা দিয়ে বিন্দাস ঘুরে বেরাচ্ছে। আমাদের মাথায় যখন টেষ্টে পাশ করে চূড়ান্ত এইচ এস সি সমমানের পরীক্ষার টিকিট পাবার চিন্তায় নাওয়া খাওয়া প্রায় বন্ধ বন্ধ অবস্থা সেই সময়টিতে ছেলেটির এরকম বিন্দাস চলাফেরা দেখে আমার ডিপ্রেশনটা যেন আরো একধাপ এগিয়ে গেলো। মুনতাছেরতো বলেই ফেললো,
-দেখিস এই ছেলে নিশ্চিত ফেল করবো। এহন হুদাই ভাব নিতাছে। কিন্তু আমার বন্ধু যাই বলুক না কেন আমার মনের কথাটা ভিন্ন। আমি ভাবছি, ছেলেটির পারিবারিক অবস্থাতো বেশ খারাপ যদি ফেল করে আর স্যারেরা পরীক্ষা দিতে না দেয় তবে তাঁর জীবনটা কী এখানেই থমকে যাবে? ছেলেটির কী আশা আকাঙ্ক্ষা বলতে কিচ্ছুটি নেই? আমি এসব দেখে একদিন সহ্য করতে না পেরে ছেলেটিকে ডেকে জিজ্ঞেস করলাম,
-ভাই তোমার কী পুরা বই শেষ?
-না ভাই! এই টুকিটাকি পড়ছি আরকি।
-আরে মিয়া।
স্যারে কী বলছিলো তোমারে মনে আছে? যদি টেষ্টে ফেল করো তাহলে কিন্তু পরীক্ষা দিতে পারবা না। শোনো একটা বুদ্ধি দেই স্যারের কাছে পড়া শুরু করো সাজেশন্স পেয়ে যাবা। আর টেষ্টেও পাশ নিশ্চিত। আমার কথা শুনে ছেলেটি নিষ্পাপ একটি হাসি দিয়ে বললো,
-প্রয়োজন নেই আমার ভাই। আল্লাহ যা লিখে রেখেছেন তাই হবে। এই বলেই পুনরায় হাঁটা ধরলো। আমি অবাক নয়নে এখনো ছেলেটির চলার পথে তাকিয়ে রয়েছি। পাশ থেকে মুনতাছের আমাকে ধাক্কা দিয়ে বললো,
-হালায় ভাবটা নিলো কী দেখছোস? অর্ধবার্ষিকে এ গ্রেড পাইয়াই এই ভাব দেখাইতাছে। মান্নান স্যারে ওরে চিহ্নিত কইরা রাখছে। টেষ্টে নিশ্চিত ফেল তুই দেখিস। আমি ওর কথার জবাবে কিছু না বলে কোচিং এর উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম। দুইমাস পর স্যার অনেক্ষন যাবৎ জালাময়ী বক্তব্য দিয়ে বললেন,
-যেগুলায় ফেল করছো তাঁরা পরীক্ষা দিতে পারবা না আগেই বলে রাখলাম। এখন তোমাদের রেজাল্ট দেওয়া হবে।
কথাটা শোনামাত্রই আমার রক্তে এক হিমশীতল স্রোত বয়ে গেলো। কারণ আমার পদার্থ ১ম পত্র পরীক্ষাটা বেশ খারাপ হয়েছিলো। পরমুহূর্তেই ছেলেটির দিকে একনজর তাকিয়ে দেখি সে সেই পুরোনো নির্লিপ্ত ভঙ্গিতেই শেষ বেঞ্চের কর্নারে বসে আছে। অনাকাঙ্ক্ষিত কারণবসত স্যার রেজাল্টশিটের দিকে অবাক নয়নে তাকিয়ে রয়েছেন। আমরাও অপেক্ষা করছি স্যার কখন আমাদের রেজাল্ট ঘোষণা করবেন। হঠাৎই স্যার জোরেশোরে বলে উঠলেন,
-১৩৬ কে? স্যারের রোল নাম্বার ডাকতে দেরী কিন্তু ছেলেটির দাঁড়াতে দেরী হলোনা। ছেলেটির দিকে এগিয়ে এসে স্যার বললেন,
-তুমি কোথায় থাকো? হোস্টেলে নাকি বাড়িতে?
-স্যার মেছে থাকি।
-বাড়িতে বাবা মা কেউ আছে?
-না স্যার! আমার বাবা মা নেই তবে আমার অভিভাবক হিসেবে আমার মামাই আমার যাবতীয় খরচ দিয়ে থাকেন।
পাশ থেকে মুনতাছের আমাকে ফিসফিস করে বললো,
-কইছিলাম না এই হালায় নিশ্চিত ফেল? হুদাই ভাব নিছে এতোদিন বুজছোস? আমি ধমক দিয়ে ওকে বলে উঠলাম,
-চুপ কর। শোন আগে কী বলে? এভাবেই প্রায় দুইমিনিট স্যার অনেক কিছুই জিজ্ঞেস করলো ছেলেটিকে। সর্বশেষ বললো,
-তুমি কোথাও কোচিং করো? একটি নির্লিপ্ত হাসি দিয়ে বললো,
-স্যার! এতো বড় প্রতিষ্ঠানে পড়তে পারছি এটাই অনেক বেশি। কোচিং করার সামর্থ্য আমার নেই। কথাটা শুনে স্যারের মুখে অনাকাঙ্ক্ষিত কারণে কিছুটা বিষাদের ছায়া ভর করলো। পরক্ষণেই বললো,
-তুমি যদি ফেল করো তবে তুমি কী করবে? ছেলেটি অনেকটা আত্মবিশ্বাসের সহিত বললো,
-স্যার ফেল করার মতো একটি পরীক্ষাও আমি দেইনি। যদি আল্লাহ আমার নিয়তিকে সমর্থন না করে তবে আমি ফেইল করবোনা ইনশাল্লাহ। ছেলেটির কথা শুনে ক্লাসের সবাই একটু নড়েচড়ে বসলো। আমার ক্ষেত্রেও তাঁর ব্যতিক্রম ঘটলোনা। হঠাৎই মাইকের বিকট শব্দে আমি অতীত থেকে বাস্তবে ফিরলাম,
-সুপ্রিয় শিক্ষার্থীবৃন্দ এখন আমাদের প্রাণপ্রিয় অধ্যক্ষ মহোদয়ের নিকট থেকে পুরষ্কার গ্রহণ করবে এবারের এইচ এস সি(আলিম) পরীক্ষায় মাদ্রাসা বোর্ড থেকে প্রথম স্থান অর্জনকারী মো. নাফিস বিন মুনির। পরক্ষণেই সবার করতালিতে মুখোরিত হয়ে গেলো চারিপাশের পরিবেশ। আমিও কিন্তু হাত তালি দিতে ভুললামনা। আপনারা হয়তো ভাবছেন এই নাফিসটা আবার কে? হ্যাঁ এটাই সেই নিষ্পাপ মুখাবয়বের সেই ছেলেটি যে শেষ বেঞ্চে বসার কারণে স্যারেরা তাঁকে চিনতেই না, যার পোষাক পরিচ্ছদে দারিদ্র্যতার ছোঁয়া থাকায় সবার অবহেলার পাত্র ছিলো। পাশ ফিরে মুনতাছের এর দিকে এক নজর তাকিয়ে দেখলাম ওর মুখটা চাঁদের মতো হাস্যোজ্জ্বল। এটাইতো হবার কথা ছিল তাই নয় কী?
গল্পের চরিত্রগুলো ভিন্ন হলেও এটা ২০১৬ সালে মাদ্রাসা বোর্ড থেকে প্রথম স্থান অধিকার করা এক পিতৃমাতৃহীন ভাইয়ের জীবনের কিছু অবিচ্ছেদ্য অংশ। এরকম লিজেন্ড বোধহয় হাজারে একটা নয় বরং লাখে একটা জন্মায়। আর তাঁদের অধিকাংশই অত্যন্ত নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তান। একটি কথা মনে রাখবেন অর্থবিত্তের অধিকারী ব্যক্তিবর্গ যতই নিজেদের অর্থ নিয়ে মাতামাতি করুক না কেন ইতিহাসে যত বিখ্যাত জ্ঞানীগুণী এই জমীনে পদার্পণ করেছেন তাঁদের সবাই কোনো না কোনো কৃষক বাবা মায়েরই ছেলে। টাকা মানুষকে কখনো বিখ্যাত করে না বরং মেধা আর সংগ্রামই মানুষকে মনে রাখে যুগ যুগান্তর। ইহাই হয়তো বিখ্যাত হবার একমাত্র সূত্র।
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত