শাপভ্রষ্ট দেবা

শাপভ্রষ্ট দেবা
অতি উচ্চস্তরের এক জানোয়ার রাত দুইটা সময় ইশিতাকে ফোন দিয়ে থ্রেট দিয়েছিল, “একদম আওয়াজ করবি না খানকির বাচ্চা। তাইলে কিন্তু জায়গামতো ভরে দিব!” মেয়েটা আওয়াজ করার সাহস পায়নি। ঘেন্নায় নিজের ভেতর কুকড়ে গিয়েছিল। ইঁদুর মারার বিষ খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিল। অল্পের জন্য বেঁচে গিয়েছে।
ইশিতার এই আত্মঘাতী সিদ্ধান্তের কথা শুনে অমিতের চোখের তারায় ঘোর অমানিশা নেমে আসে। মাথাটা কেমন জানি ঝিমঝিম করতে থাকে। সেদিনই প্রথম ইশিতার বাসায় যায় অমিত। প্রিয়তম মেয়েটার শয্যার পাশে বসে অশ্রুসিক্ত নয়ন ও ব্যথাভরা কণ্ঠে জানতে চেয়েছিল,”এইটা তুই কেন করতে গেলি ইশিতা? আজকে যদি তুই সত্যিই মারা যেতি ইশিতা অস্ফুট কণ্ঠে বলে,”বেঁচে যেতাম।” ওর কথা শুনে অমিতের বুকের ভেতর ধ্বক করে একটা আগুনের হল্কা উঠে। সে পাথুরে গলায় জানতে চায়,”সমস্যা কি?” ইশিতা উত্তর দেয় না। ঠোঁটের কোনায় ওর একফালি তাচ্ছিল্যের হাসির রেখা ফুটে উঠে। মেয়ে হয়ে এই দেশের জন্ম নেওয়াটাই পাপ। প্রতিদিন একশটা যন্ত্রণার ঘা। অমিত রণচোখে হুংকার দিয়ে জানতে চায়,”চুপ করে আছিস কেন, বল..”
“কি বলব?”
“নিজেকে এইভাবে মেরে ফেলতে চাইছিস কেন? সমস্যা কি?”
“সমস্যা হাজারে হাজার। কয়টা বলব তোকে?”
“সবক’টাই বল। আমি শুনতে চাই।”
“আমার পেছনে একটা ফেউ লেগেছে। ফেউ মানে কি জানিস?”
“ইভ টিজার?”
“হ্যা। আপাতদৃশ্যে খুব নিরীহ একটা শব্দ। কিন্তু এই জিনিস যখন কারও পিছু ধরে, ওর জীবনটা জাস্ট নরক হয়ে যায়। এই শালা গতকাল সন্ধ্যায় ফেরার পথে আমাকে জোর করে মাইক্রোতে উঠিয়ে নিতে চাইছিল। অল্পের জন্যে বেঁচে গেছি।”
“ছেলেটা কে?”
“মহল্লাতেই থাকে।”
“করে কি?”
“নেট লাইনের ব্যবসা আছে।
মদ-গাঁজা ইয়াবার ব্যবসাও আছে বোধহয়। ওর হাত থেকে বাঁচানোর জন্যই বাপ-মা আমারে এক আধ-বুড়ার সঙ্গে রাতারাতি বিয়ে দিয়ে বিদায় করতে চাইছে। একটা মেয়েকে সুরক্ষা করার ক্ষমতা যে বাপ-মার ঘেটিতে নেই, তারা কেন মেয়েদের জন্ম দিবে? শুধুমাত্র যৌনসুখের তাড়নায় ঘটনা ভয়াবহ। কিছু একটা বলা দরকার। কিন্তু বেচারা অমিত কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না। কিছু একটা সান্ত্বনা দেওয়া দরকার। যে ছেলেটা ওকে ডিস্টার্ব করছে, জোর করে গাড়িতে তুলে নিতে চাইছে, তারও একটা বিহিত করা দরকার।
কিন্তু অমিত জানে, আদতে কিছুই করতে পারবে না। খোঁজ নিয়ে দেখা যাবে ঐ শালা নেটওয়ালার মায়ের ভাসুরের ফুপাত ভাইয়ের ছোট মেয়ের সাথে কোন এক মন্ত্রীর পিএস-এর ঘষাঘষি রয়েছে। কিংবা কোন সচিব, পুলিশের পদস্থ অফিসার.. ইত্যাদি ইত্যাদি। আঠারো কোটি মানুষের এই দেশে প্রতিটা অসভ্য মানুষই কোন-না-কোন এমপি-মন্ত্রী হনু-মনুর আত্মীয়। আর বেচারা অমিত? সে হল এক শাপভ্রষ্ট দেবতা। চারকূলে কেউ নাই। এমন কি একটা হাবিলদারের সঙ্গেও কোন সূত্রেই ওর আত্মীয়তা নেই! দূরবীনে চোখ রেখে যতদূর তাকায়, একা, ভয়াবহ একা। সেই বাল্যকালে বাপ-মায়ের হাত ধরে দক্ষিণের চরাঞ্চল থেকে উঠে এসেছে। জায়গা-জমি যা ছিল নদীর তলায় হারিয়ে গেছে। দেশ-গ্রামের ফেরার টান কখনো অনুভব করেনি আর। তার উপায়ও ছিল না।
মায়ের মৃত্যু হয়েছে ঢাকায় আসার কয়েক বছরের মধ্যেই। বাবা ছিলেন ছুতার মিস্ত্রি। অল্পস্বল্প পড়াশোনা জানতেন। পুত্রকে এলেবেলে পাশ করার সাধ্য নেই জেনেও স্কুলে পাঠিয়েছিলেন। ছেলে এসএসসি পাশ করার পর বাবার উৎসাহ বেড়ে গিয়েছিল। অমিতকে তিনি কলেজেও ভর্তি করিয়েছিলেন। এই কলেজ চত্বরে পা রাখার সুবাদেই ইশিতার মতো দেবী গোত্রের একটা মেয়ের সঙ্গে ওর বন্ধুত্বের সৌভাগ্য। দেবীর সাথে প্রেম-টেম করার সাধ্য অমিতের ছিল না। কলেজ জীবন শেষ হবার আগেই অন্যদিক থেকে ধাক্কা এল। সামান্য এক জ্বরের দহনে বাবা মারা গেলেন। অমিতের বয়স তখন মাত্র ষোল কি সতের। বাবার মৃত্যুর আগেই ড্রাইভিংটা শিখে রেখেছিল। একলা মানুষ। এইটুকুর সুবাদেই এখন একা একটা রুম নিয়ে এক অচ্ছুৎ ও নিভৃত জীবনানন্দ উপভোগের চেষ্টা করে যাচ্ছে। একটা মাত্র মেয়ের সাথে এই জীবনে ওর বন্ধুত্ব হয়েছে, সেও আজ খাদের কিনারে। ওর জন্যে কিছু একটা করা দরকার। কিছু একটা মাস্ট!
“ইশিতা!”
“হু।”
“ছেলেটার ছবি দিতে পারবি আমাকে? কিংবা দূর থেকে শুধু একবার দেখিয়ে দিবি!”
“কি করবি তুই? ওর একটা বা-আ-আ-ল ছেঁড়ার ক্ষমতাও তোর নেই..”
“হয়ত তাই-ই সত্য। তবুও আমার একটা রিকুয়েস্ট আছে। তুই শুধু আগামী দুই-তিন দিনের জন্যে বিয়েটা ঠেকিয়ে রাখ। বাকিটা আমি দেখছি!”
“কি দেখাবি তুই?”
“খেলমা!”
“ঢপ দিচ্ছিস?”
“না। বাজি ধরে বলছি, ভয় পাবি না। একদমই ভয়ের কিছু নেই, ওকে?!”
“হু।”
“বিশ্বাস করছিস আমার কথা? ভরসা রাখতে পারবি আমার উপর?”
“হ্যা, পারব।” ইশিতার সাথে কথা বলে ফেরার পথে খুব ঠান্ডা মাথায় একটা সিদ্ধান্ত নেয় অমিত। বাসায় ফিরে রাতের খাবার রান্না করে আয়েশ করে খায়। এরপর মানিক বাবুর একটা স্মারক গ্রন্থ হাতে নিয়ে পড়ার চেষ্টা করে। সিগারেট পুড়ায়। প্রতিটা পাতা পড়ে আর উল্টেপাল্টে মানিক বাবুর ছবিটা দেখে। বইয়ের কভারে সাতাশ-আটাশ বছরের এক যুবক। এই মানুষটা আর সবার থেকে আলাদা। আগুনের মতো তেজস্বী একটা মুখ। চোখে গোলগাল চশমা। চশমার ভেতরে ক্ষুরধার চক্ষুজোড়া।
চোখের কোনা দিতে অত্যন্ত নির্মোহ ভঙ্গিতে ভগবানের সৃষ্টিকর্ম দেখছে, আর ভ্রুকুটি করে যেন ভাবছে,”এত বড় ক্ষমতার অধিকারী যে ভগবান প্রজ্ঞা যার অসীম যার ইচ্ছেতে তৈরি হয়েছে অনন্ত নক্ষত্রমালা, অনন্ত গ্যালাক্সি রাশি বিপুলা সমুদ্র বৃক্ষ, পুষ্প, নদী সবই ঠিক আছে, কিন্তু মানুষের মতো এত নিচ ও ইতর প্রাণ কেন তৈরি করলেন তিনি?” মানিক বাবুর ছবির দিকে তাকিয়ে অমিত এইসব আশ্চর্য ভাবনা ভাবে। বলাই বাহুল্য, ভাবনাগুলি মানিক বাবুর নয়, একান্তই ওর নিজের! স্মারক গ্রন্থ রেখে দিয়ে কাঠের ফ্রেমে বাঁধানো ছোট্ট একটা গোলগাল আয়না হাতে তুলে নেয় অমিত। আয়নায় নিজেকে দেখে। তেইশ বছরের নিঃসঙ্গ এক যুবক সে। শাপভ্রষ্ট এক দেবতা। রোদে-জলে পোড়-খাওয়া মুখ। কদিনের না-কামানো দাঁড়িগোফ। থুতনিতে একটা কাটা দাগ। টলমল জলভেজা নিবিড় মায়াময় একজোড়া চোখ!
অমিত জানে, জীবন ওর প্রতি কখনো সদয় ছিল না। এক জীবনে পায়নি সে কিছুই। পাওয়ার আশাও আর করে না। তবুও দয়াময় ভগবান করুণা করে শূণ্য হতে এই মানুষে প্রাণ দিয়েছেন। এই প্রাণের একটা মূল্য আছে। এর পেছনে একটা মহৎ উদ্দেশ্য অবশ্যই আছে। কী সেই উদ্দেশ্য? বহুকাল আগে পড়া মানিক বাবুর একটা গল্পের কথা মনে পড়ে ওর। গল্পের নাম, “ছিনিয়ে খায়নি কেন” সেই গল্পে লেখক দেখিয়েছেন, কেড়ে খাওয়ার ইচ্ছেটাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যে অবশ্যই নিজেকে তিনবেলা ভরপুর খাইয়ে তরতাজা করে রাখতে হবে। শুধুমাত্র একবেলার অভুক্তিতেই একজন মানুষের ভেতরটা ন্যাতিয়ে যেতে পারে। এরপর ওর ভেতর থেকে কেড়ে খাওয়ার মানসিকতা লীন হয়ে যায়। মৃত্যুর অপচ্ছায়া নেমে আসে প্রাণে। অমিত শিক্ষা নেয়। দীক্ষা দেয় নিজেকে। লোহা তাতানো আছে। এই তো শ্রেষ্ঠ সময়।
সে আজ রাতের মধ্যেই প্রস্তুতি নিবে এবং আগামী দুই-তিন মধ্যেই কিছু একটা করে দেখাবে। নিশ্চয়ই দেখাবে!
আয়নার ওপাশে ভেসে উঠা নিজের প্রতিচ্ছবির দিকে তাকিয়ে অমিত নাটকীয় কণ্ঠে জানতে চায়,”এই শালা ভেরেন্ডার বাচ্চা- জেগে আছিস, নাকি ঘুমে?” ওপাশে ভগবান নেই। অমিত নিজেই দাঁড়িয়ে আছে। সে অবিকল মানিক বাবুর মতো চোখের কোনা দিকে ভগবানের সৃষ্টি ও অনাসৃষ্টিসমূহ দেখে। সুতীব্র শ্লেষ ও বিক্ষোভ ভরা কণ্ঠে উত্তর দেয়, “আছি আছি, অমৃতের সন্তানেরা চিরকাল জেগে থাকে। অবিকল তাতানো লোহার মতো, দিবানিশি দাউদাউ অমৃতের সন্তানেরা কখনো ঘুমায় না। নেভার ফর এভার পরিমলের মনে আজ বেজায় সুখ। নতুন একটা খেপ মেরে লাখ দশেক টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। পকেটে টাকা ঢুকলে বুকের ভেতর আলগা একটা আগুনে হল্কা টের পাওয়া যায়। সেই আগুনের হল্কায় বিশ্ব সংসার পুড়িয়ে দেওয়ার হিম্মৎ জাগে প্রাণে।
জাগে প্রেম৷
পরিমলের মনেও প্রেম জেগেছে। মেয়েটার নাম ইশিতা। ঘোষপাড়ার এক নরসুন্দরের কন্যা। বয়সে কাঁচা, দেহের বাঁধুনি অহ গড শালীর উদ্ভিন্ন বুকজোড়ার কথা মনে হলেই শিশ্নদণ্ড খাড়ায়ে যায় অনেকদিন ধরেই মেয়েটার উপর নজর রাখছে সে। ইঙ্গিতে কয়েকবার টেকা পয়সার লোভও দেখিয়েছে। এই বয়সী মেয়েরা সাধারণত নগদ পয়সা গন্ধ পেলে গলে যায়। “ওহ দাদা, তুমি না একটা ইয়ে..” বলে গায়ের উপর ঢলে পড়ে। কিন্তু ইশিতা মাইয়্যাটা বদমায়েশের ঝাঁড়। প্রথম দিকে পরিমল নিজে কদিন ওকে ফোন দিয়ে গলানোর চেষ্টা করেছে। ফোন সে পিক করত ঠিকই, কিন্তু কথা বলত কেমন জানি মাস্টারনি টাইপ। গলায় একটুও দরদ নাই। নাই কোন আদব-লেহাজ। পরিমলের মাথায় আগুন ধরে যেত। একদিন মধ্য রাতে ফোন দিয়ে বেলাইনে কথা বলেও আগুন নেভানোর চেষ্টা সে করেছে,
“ইশিতা ভালো আছো?”
“জ্বি দাদা, ভালো।”
“আমি কিন্তু একটুকুও ভালো নেই।”
“কেন দাদা?”
“একা একা বিছানায় শুয়ে আছি৷ আর তোমার কথা ভাবছি। এখন যদি তুমি আমার পাশে থাকতে ইশিতা ফোন কেটে দেয়। পরিমল আবারও কল দেয়। ঠান্ডা গলায় বলে,”মাঝেমধ্যে কি ইচ্ছে হয় জানো?”
“কি?”
“তোমার উরুসন্ধিতে পিস্তল ঠেকিয়ে তোমাকে ইশিতা ফোন কেটে দেয়। সুইচ অফ করে দেয়। এরপর এই নাম্বারে আর কোনদিন পাওয়া যায় না ওকে। পরিমল নিজের ক্ষমতার জেল্লা দেখাতে একদিন মাইক্রো নিয়ে ওর অফিসের সামনে উপস্থিত হয়। মেয়েটা গেটের বাইরে আসতেই সে হাসিমুখে ওর পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। ইঙ্গিতে অর্ধকোটি টাকায় কেনা গাড়িটা দেখিয়ে নরম গলায় বলে,”চল তোমাকে বাসায় পৌঁছে দেই!” ইশিতা কেঁপে উঠে। ওর কম্পিত বুকজোড়া পরিমলের বুকের ভেতর আগুন ধরিয়ে দেয়। ওর রাজহংসীর মতো উরু আর তানপুরার মতো নিতম্বের নেশা কিন্তু পরিমল ধৈর্য ধরে খেলাতে পছন্দ করে। সে খুব নিষ্পাপ একটা হাসির রেখা মুখের উপর টেনে রাখে,”ভয় পাচ্ছিস কেন পাগলী। আমি তো শুধু প্রেম করতে চাইছি তোর সঙ্গে ইশিতা ওকে পাশ কাটিয়ে চলে যায়। সে আলগোছে মেয়েটার ফর্সা হাত ধরে মিনতি করে,”ইশিতা প্লিইইজ।” মেয়েটা অস্ফুট কণ্ঠে কেঁদে উঠে। পরিমল ওর হাত ছেড়ে দিয়ে প্রশ্রয়ের হাসি হাসে,”আচ্ছা যা, পাগল মেয়ে একটা!”
ইশিতা হনহনিয়ে দূরে সরে যায়। পেছন থেকে পরিমল লালায়িত দৃষ্টিতে মেয়েটার গুরুভার নিতম্বের ঢেউ দেখে। এই মেয়েটা একদিন আপোষে ওর সামনে দাঁড়িয়ে পাজামার ফিতা খুলে লাজুক ভঙ্গিতে হাসবে একদিন নিশ্চয়ই আর তা যদি না করে, তবে জোর করেই ওর উরুসন্ধিতে পিস্তল ঠকিয়ে জাস্ট ভরে দিতে হবে সন্ধ্যার আবছা অন্ধকারে ক্লাব-ঘরের বারান্দায় বসে পরিমল বিদেশী চুরট টানে আর ইশিতার কথা ভাবে। এইসব মেয়েদের নিয়ে প্রেম-প্রেম লীলা করতেই জগতে এসেছে সে। অবশ্যি ইশিতা একা নয়। ডজনখানেক মেয়ে আছে ওর নিশানায়। কেউ কেউ আপোষেই চলে এসেছে। দুয়েকটাকে আনতে হয়েছে কপালে পিস্তল ঠেকিয়ে। আর দুয়েকটা আছে, সদ্য শিকারের তালিকায়। ইশিতা তাদেরই একজন। তাইজন্যই প্রেম প্রেম ভাব নিয়া ধীর-তালে খেলা করা হচ্ছে।
খেলায় গুটি বরাবরই ওর কব্জায়। বেচারা ইশিতা জানেও না, চাইলে আজ রাতেই ওর বাসায় ঢুকে, ওর বাপ-মায়ের তলপেটে পিস্তল ঠেকিয়ে আরামসে সে রসলীলা সাঙ্গ করে দিয়ে আসতে পারে। কিন্তু পরিমলের এত তাড়া নেই৷ সেদিনের ঘটনায় মেয়েটা বোধহয় খুব ঘাবড়ে গিয়েছে। দুইদিন ধরে বেরুচ্ছে না বাসা থেকে। সাপিনী গর্তের ভেতর দেহ লুকিয়ে মনে মনে হয়ত ভাবছে, খুব নিরাপদে আছি। গর্তের প্রতিটা মুখেই যে পরিমল ফাঁদ পেতে রেখেছে, এই কথাটা যদি একবারও আন্দাজ করতে পারত, হা হা হা! হু হুহ..! ক্লাব-ঘরের চত্বর থেকে আনুমানিক দেড়শ ফুট দূরে একটা চায়ের দোকানের বেঞ্চিতে চুপচাপ বসে আছে অমিত। সেই সন্ধ্যা থেকেই মাথা নুইয়ে একটার পর একটা সিগারেট টানছে আর চোখের কোনা দিয়ে ক্লাবের ছেলেদের দেখছে। ওদের মধ্যমণি পরিমল এতক্ষণ ছিল না। মিনিট কুড়ি হল সে এসে হাজির হয়েছে।
গোলাকার একটা টেবিলের চারপাশে গোল হয়ে বসেছে ওরা। মহিষাসুরের বাচ্চা পরিমল হল কেন্দ্রভূমি। চ্যালাগুলি চারপাশে। অসুর রাজের দিকে তাকিয়ে গদগদ কণ্ঠে কথা বলছে। অসুরের বাচ্চারা জানে না, ওদের বাপের ঠাকুরকে আজ প্রেতলোকে পাঠানো হবে। গণার দিন ফুরায়ে আসছে। বিগত তিন দিন ধরে খুব আড়াল থেকে শুয়ারটার গতিবিধি খেয়াল করছে অমিত। সে কোথায় থাকে, কোন পথে বাসায় ফিরে, কোথায় বসে গ্যাজায় এবং গাঁজা খায়।
রাত প্রায় এগারটার দিকে পরিমল ক্লাব ঘর থেকে বের হয়। ক্লাব থেকে অনেক দূরে অন্য আরেকটা দোকানের অন্ধকার কোনায় বসে আছে অমিত। সে জানত, শুয়ারটা ঠিক এই সময়েই বের হবে। শহীদ-স্মরণীর বাঁ-পাশের ছোট্ট একটা গলিতে ঢুকে ডানে মোড় নিতে। এরপর আবার একটা চওড়া রাস্তা। মিনিট পাঁচেক সেই পথ ধরে হেঁটে গেলেই ওর বাসা। অমিত অনেক ভেবে চিন্তে ঘটনাস্থল ঠিক করেছে। শহীদ-স্মরণী থেকে গলিতে ঢুকার মুখেই… জায়গাটা খুব নিরিবিলি একদম প্রেতলোকের মত
সময়টা আশ্বিন মাস। এলাকায় বারোয়ারী দুর্গাপূজার ব্যবস্থা হবে। সেই উপলক্ষে মহিষাসুর পরিমল একটা তের সদস্যের কমিটি গড়ে দিয়েছে। এরা প্রতিটা বাড়িতে গিয়ে চান্দা উঠাবে। পূজার প্যান্ডেল, দেবীর প্রতিমা, গানা-বাজনার ব্যবস্থা করবে। সাকুল্যে খরচা হবে লাখ তিনেক। টাকা উঠানো হবে তিরিশ লাখ। পঞ্চাশ-ষাটজন অতি বিত্তবান মানুষের একটা শর্টলিস্ট করা হয়েছে। পূজা উপলক্ষ্যে এদের প্রত্যেকের অফিসে হানা দিয়ে লাখ টাকার নজরানা উঠানো হবে। পাঁচ ফিট ছয় ইঞ্চি লম্বা, গোলগাল ভুড়িওয়ালা পরিমল হাতে একজোড়া আই-ফোন, অন্য হাতে একটা চাবির রিং ঘুরাতে ঘুরাতে খুব আমোদে মেজাজ নিয়ে শিষ দিচ্ছিল আর সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। গলিতে ঢুকার মুখে একটা কংক্রিটের পিলারে আড়াল থেকে শাঁই করে একটা ছেলে এসে ওর সামনে দাঁড়াল, “ভাইয়া একটা গান শুনাই?” পরিমল থতমত খেয়ে থমকে দাঁড়ায়। বিরক্ত স্বরে জানতে চায়,”এই তুমি কে?” অমিত চোখ টিপে দুষ্টামি করে। ফুরফুরে কণ্ঠে বলে,”দুগ্গা মায়ের বাহন, অমিত সিংহ!”
“হোয়াট?”
ছেলেটাকে পাগল ভেবে পরিমল বিরক্ত কণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠে। অমিত কিন্তু ততক্ষণে হাতের কাজ গুটিয়ে এনেছে।
দুই-দিকে শানিত সাড়ে এগার ইঞ্চি লম্বা একটা চকচকে কিরিচ পরিমলের নাভির উপর তাক করে আলগোছে ধরে রেখেছে। পরিমল আচমকা নিচের দিকে তাকিয়ে শিউরে উঠে। অমিত খুব শান্ত-সৌম্য কন্ঠে বলে, “একদম আওয়াজ করবি না খানকির বাচ্চা। তাইলে কিন্তু জায়গামতো ভরে দিব!” পরিমলের চোখের তারায় অন্ধকার নেমে আসে। বুকের ভেতর গলা কাটা পশুর তরপানি টের পায়। সে ফ্যাকাসে কণ্ঠে জানতে চায়, “কে তুমি? আমার কাছে কি চাও?” এই কথার উত্তর দেওয়ার ইচ্ছে বা সময় অমিতের হাতে ছিল না। হাতের মুঠোয় ধরে রাখা পিতলের বাটে জোরসে একটা ধাক্কা দিল,
“ঔঁ জয়ন্তি মঙ্গলা কালী, ভদ্র কালী কপালিনী”
পরিমলের লাশ নিয়ে ওর দলের ছেলেরা বিরোধী দলের নাম করে মিছিল করতে চেয়েছিল। উপর মহল থেকে অনুমতি পাওয়া যায়নি। ময়নাতদন্ত এবং নানাবিধ আইনী ঝামেলা মিটিয়ে নেবার পর ওর বিকৃত ও অর্ধ-গলিত দেহ যখন তমসা নদের ওপারে শ্মশানবাড়িতে পুড়ানো হচ্ছে তখন অনেকের চোখেই অশ্রু ছিল। কিন্তু এই অশ্রুতে এতটুকু বিষাদ ছিল না৷ অধিকাংশই ছিল নামকাওয়াস্তে অভিনয়। অন্যদিকে, ঠিক একই সময়ে, রায়বাড়ির পূজার মণ্ডপে দুর্গতিনাশিনী দেবী দুগ্গার প্রতিমার সামনে দাঁড়িয়ে একুশ বছরের যুবতী মেয়ে ইশিতা আকুল হয়ে কাঁদছিল। এই অশ্রুতে এতটুকু ফাকি ছিল না। সুতীব্র বিষাদ ছিল, আর ছিল আরাধনা চারিদিকে রঙচঙা জামাকাপড় পরা মানুষের ভিড় কলকোলাহল উৎসবে আমুদে ঢাক-ঢোল বাজছে খোল করতাল খঞ্জনির সুতীব্র ঝংকার মা দুর্গার প্রতিমার পাদমূলে প্রণাম জানাতে গিয়ে অনেকেই উচ্চস্বরে সংস্কৃত মন্ত্র আবৃতি করছে,
“সর্ব মঙ্গল মঙ্গল্যে শিবে সর্বার্থ সাধিকা মানুষের প্রেম আর শুভবোধের উপর থেকে ইশিতার আস্থা উঠে গিয়েছিল কিন্তু ওর ঠিক গা ঘেঁষেই এখন যে ছেলেটা দাঁড়িয়ে আছে যার নাম অমিত সিংহ এবং যে মাত্র দুইদিন আগে একটা অসুরের তলপেটে ছুরি ঢুকিয়ে দিয়ে ইশিতাকে নরক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিয়েছে ইশিতা জানে না, শেষ পর্যন্ত ছেলেটা নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে পারবে কিনা অমিত চাইছে খুনের দায় কাঁধে নিয়ে সে নিজেই পুলিশের কাছে ধরা দিবে ইশিতা ওকে দুইহাতে আকড়ে ধরে প্রতিবাদ করেছে। অশ্রুভেজা কণ্ঠে বলেছে, “পাপ যদি সত্যিই তুমি করে থাক, তার হিসেব দিবে ভগবানের কাছে। একটা বিপন্ন মেয়েকে অসুরের হাত থেকে মুক্তি দিয়েছ তুমি। তুমি আমার স্বামী, আমার প্রাণের দেবতা ইশিতা খুব কাঁদছিল৷ অমিত খুব হালকা গলায় হেসে উঠেছিল মনে মনে অমিত হয়ত চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে সে ধরা দিবে দয়াময় স্রষ্টা খুব ছোট্ট একটা কাজের দায় কাঁধে চাপিয়ে ওকে পৃথিবীতে প্রেরণ করেছেন। ওর কাজ ও করে ফেলেছে।
এইবার বিদায়ের পালা। ফাঁস কিংবা জেল, যাই হোক হাসিমুখে মেনে নিবে অমিত ইশিতার দুইচোখ বানের জলে ভেসে যাচ্ছে এই হয়ত অমিতের সঙ্গে ওর শেষ দেখা শাপভ্রষ্ট দেবতা অমিত যে কোনদিন ইশিতাকে ছুঁয়েও দেখতে চায় নি, বুকে জড়িয়ে আদর করতে চায় নি। সে শুধু দূর থেকে নিজের মত করে ইশিতাকে ভালোবেসে গিয়েছে আর প্রিয়তম মেয়েটার সবচাইতে বিপদের দিনে পরম বন্ধুর মতো বুক পেতে আগলে দাঁড়িয়েছে ইশিতা কান্নাভেজা কণ্ঠে আরাধনা করে, “দয়া কর মা দুগ্গা, তোমার এই পাগল ছেলেটাকে সু-মতি দাও। বাঁচিয়ে দাও ওকে, শুধুমাত্র আমারই জন্যে। শাপভ্রষ্ট দেবতা আমার.. ওকে শাপ থেকে মুক্তি দাও মা। একটুখানি ভরসা দাও, একটুখানি আলো…
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত