আমার যেদিন বিয়ে ঠিক হলো,মারিয়া এসে বললো ‘দোস্ত তোর সুখের জীবন শেষ!বিয়ের পর আর শান্তি নাই রে।শাশুড়ি,ননদ এদের জ্বালায় অতিষ্ঠ হয়ে যাবি।আমি তো ত্যাক্ত-বিরক্ত হয়ে যাচ্ছি।’ আমি মৃদু হেসে বললাম,আচ্ছা দেখা যাবে।
বিয়ে হওয়ার পর প্রথম যেদিন সে বাড়িতে গেলাম,আশেপাশে ঘর ভর্তি অনেক মানুষ ছিলো।ভিতরে ভিতরে খুব ভয় লাগছিলো।একটু পর শাশুড়ি কাছে এসে ফিসফিস করে বললো,ভয় লাগছে মা?ভয়ের কিছু নাই।নতুন বউ লোকজন তো একটু আসবেই।তুমি একদমই ভয় পাইয়ো না। বিয়ের দিন সারাদিন খুব ধকল গিয়েছিল।কিছুই খাওয়া হয়নি।খুব ক্ষুধাও লেখেছিল।কিন্তু কাউকে বলতেও পারছিলাম না। ঠিক তখন দেখলাম শাশুড়ি মা রুমে এসে টুকটাক যারা ছিলো তাদের তাড়া দিয়ে বের করে দিচ্ছে।সবাই বের হয়ে যাওয়ার পর দেখলাম শাশুড়ি মা একটা প্লেটে খাবার নিয়ে এসেছে।এতো ভালো লাগলো তখন! তিনি আমার কাছে এসে বললেন,’আমি জানি মা,তোমার অনেক ক্ষুধা লেগেছে।সারাদিন যা ধকল গেলো!কিছু তো মনেহয় খাওয়া হয়নি।আমার বিয়ের দিনেও এমন হয়েছিল।কাউকে বলতেও পারছিলাম না লজ্জায়।হাহাহা।
আমিও হেসে ফেললাম।তারপর তিনি নিজে মেখে খাইয়ে দিতে লাগলো।আমার মায়ের কথা মনে পরে গেলো।উনি ব্যাপারটা বুঝতে পেরে বললো,’মায়ের জন্য খারাপ লাগছে বুঝি?লাগাটাই স্বভাবিক।কিন্তু আমিও কিন্তু তোমার একটা মা।একদম মন খারাপ করবা না।তাহলে কিন্তু আমি কষ্ট পাব।মনে থাকবে?’ আমি উনার দিকে তাকিয়ে একটা হাসি দিয়ে মাথা নাড়লাম।তিনি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। প্রথমদিকে আমি রান্নাবান্না পারতাম না।টুকটাক নাশতা বানাতে পারতাম।বাকি কাজগুলো শাশুড়ি মা ই করতেন।কখনও এ নিয়ে কিছুই বলেনি।কিন্তু আমার নিজেরই খারাপ লাগতো।আমি পারতাম না আর উনিও কিছু বলেনি দেখে আমি কিন্তু হাত গুটিয়ে বসে থাকি নি।উনি যখন রান্না করতো,আমি পাশে দাড়িয়ে দেখতাম।একসময় নিজে নিজে চেষ্টা করতে লাগলাম।শাশুড়ি মা মাথায় হাত বুলিয়ে বলতো ‘বাহ মেয়ে তো বড় হয়ে যাচ্ছে!’ আমি তখন হেসে দিতাম।
প্রথম যেদিন রান্না কলেছিলাম।সবাই খেয়ে খুব প্রশংসা করছিলো।খুব খুশি লাগলো।ভাবলাম ভালোই হয়েছে হয়তো।আমি যখন খেলাম এতো বাজে লাগলো খেতে!কিন্তু সবার এতো প্রশংসায় খুব অবাক হলাম।সবার দিকে অভিমানী দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললাম,’তোমরা আমার মিথ্যা প্রশংসা করলা কেনো?’ শাশুড়ি মা মৃদু হাসি দিয়ে বললো, ‘প্রথমবারেই কেউ পারফেক্ট ভাবে কোনো কিছু পারে না।করতে করতেই একসময় সেরাটা বেরিয়ে আসে।প্রথমবার হিসেবে অনেক ভালো হয়েছে।’ ননদ বললো,’ভাবী আমার কাছে কিন্তু ভালোই লেগেছে।একদিন তুমি মায়ের থেকেও ভালো রাঁধতে পারবা।মিলিয়ে নিও আমার কথা।’ সেদিনের রান্নাটা ভালো হোক কিংবা খারাপ,কিন্তু সবার সেই সুন্দর সুন্দর কথাগুলোই কিন্তু পরবর্তীতে ভালো রাঁধুনি হতে সাহায্য করেছে। একটা অজানা অচেনা পরিবেশে মানিয়ে নেওয়ার জন্য আশেপাশের মানুষ গুলোর সাপোর্ট খুব প্রয়োজন। আমি কখনো কোনো ভুল করলে সুন্দর করে বুঝিয়ে দিতো।কোনো কারনে মন খারাপ হলে সবাই মিলে মন ভালো করে দিতো।
একটা সুন্দর পরিবার গঠন করতে হলে পরিবারের সাবাইকে সবার বুঝতে হয়। সুখি পরিবার মানেই যে তাদের মান অভিমান হয়না তা কিন্তু নয়।আমাদের মাঝেও মান অভিমান হতো কিন্তু কেউ সেটা পুষে রাখতাম না। আমি যখন অভিমান করতাম মা এসে বলতো,’আজকালকার ছেলে-মেয়ে গুলার এতো অভিমান কই থেকে আসে কে জানি বাপু!ভালো লাগে না আর দুনিয়া-দারি!’ আমি তখন হেসে দিয়ে জড়িয়ে ধরতাম। আবার মা যখন অভিমান করে থাকতো,আমি মায়ের আশেপাশে ঘুরঘুর করতাম আর বলতাম,’আমাকে কেউ ভালোই বাসে না!সবাই খালি অভিমান করে!’ মা তখন মুখ বাঁকিয়ে বলতো,’এখন খুব আহ্লাদ করা হচ্ছে।কষ্ট দেওয়ার সময় মনে থাকে না?’ আমি মাকে জড়িয়ে ধরে বলতাম,’মেয়েদের কথায় মায়েরা কষ্ট পায় বুঝি!’ মা তখন হাসতে হাসতে বলতো,’খুব পাকা হয়েছিস।’
আমরা আমাদের রাগ-অভিমান গুলো ঘরের মধ্যেই রাখতাম।পাশের বাসার আন্টি এসে বলতো,খুব ভালো বউ পেয়েছেন।আমার বউটা তো একেবারে…! আন্টি কথা শেষ করার আগেই মা বললো,’বাচ্চাদের ভুল গুলো অন্যদের কাছে না ছড়িয়ে তুমি ওকে বুঝিয়ে বলো।দেখবা ঠিকই পরেরবার থেকে শুধরে নিবে।তাকে অন্যের মেয়ে কিংবা বউ না ভেবে আগে একটু নিজের মেয়ে ভেবে দেখো।দেখবা সে ও তোমাকে নিজের মায়ের মতোই ভালোবাসবে।তোমার মেয়ের ভুলগুলো যেমন সুধরে দেও ওরটাও তেমন সুধরে দেও।দেখবা কি সুন্দর সবকিছু শিখে যাবে।
বড়রা যদি সুন্দর ভাবে না শিখিয়ে দেই ছোটরা শিখবে কিভাবে?আর ভুল গুলো বেশি হাইলাইট না করে ভালো গুন গুলো হাইলাইট করো।দেখবা ওর খারাপ দিকগুলোও একসময়ে ভালোতে রূপান্তরিত হবে।’ আমি বললাম,’আন্টি সৎ সঙ্গে কিন্তু স্বর্গবাস হয়।আপনি যেহেতু ভালো সেহেতু আপনার বউ টা ও ভালো হতে বাধ্য।শুধু আপনার সুন্দর সঙ্গটা দিন তাহলেই হবে।সে খারাপ করছে দেখে যদি আপনিও খারাপ করেন তাহলে স্বর্গবাস টা হবে কি করে?’ আন্টি সেদিন কিছু না বলে উঠে চলে গেলো।মা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,’আসলে আমরা কেউ কাউকে বুঝতে চাই না!তাই তো এতো অশান্তি।’ আমি হেসে দিয়ে বললাম,’সবাই তো আর আপনার মতো হয় না মা।’ মা আমাকে কাছে টেনে নিয়ে বললো,’সবাই তো তোমার মতোও হয় না।’
একবার রিয়াদের সাথে আমার ঝগড়া হলো।মা সেটা কিভাবে যেনো বুঝে গেলো।আমি মায়ের রুমের পাশ দিয়ে যেতে লাগলাম তখন দেখলাম রিয়াদের সাথে কথা বলছে।মা বলতে লাগলো,’মেয়েটা ওর পরিবার পরিজন ছেড়ে একটা অচেনা পরিবেশে এসে মানিয়ে নিচ্ছে।এমনিতেই আপনজনদের ছেড়ে এসে কত কষ্ট পাচ্ছে।তার উপর তুইও ঝগড়া করছিস!একটু মানিয়ে নিতে পারছিস না!এই শিক্ষা দিয়েছি তোকে?তুই আর আমার সাথে কথাই বলবি না যাহ! আমি রুমে চলে আসলাম।কিছুক্ষণ পর রিয়াদ এসে মলিন মুখ করে বললো,’তোমার জন্য মা ও আমার সাথে কথা বলবে না বলছে।কি যে যাদু করলা!এখন আমাকে ক্ষমা করে উদ্ধার করেন মহারানী।’ আমি মুখ বাঁকিয়ে বললাম,’উচিৎ শিক্ষা হয়েছে।করবো না ক্ষমা।’ সেবার আমার হঠাৎ খুব জ্বর আসলো,মা কাঁদো কাঁদো মুখ করে বললো,’ফেললা তো জ্বর বাধিয়ে।আহারে বাচ্চা মেয়েটা কত কষ্ট পেতে হচ্ছে।’ আমি মায়ের হাত ধরে বললাম,’অযথা চিন্তা করছো।দেখবা কালকেই ঠিক হয়ে যাব।’
সেদিন মা রিয়াদ কে রুম থেকে বের করে দিয়ে সারারাত জেগে জেগে সেবা করেছিলো।একটু পরপর এটা ওটা এনে জোর করে খাওয়াচ্ছিলো। আমার মনে একেবারের জন্যেও মা-বাবা জন্য শুন্যতা অনুভব হয়নি।বুঝে গেলাম শাশুড়ি মা আর শাশুড়ি মায়ের জায়গায় নেই।কখন আপন মায়ের জায়গা দখল করে ফেলেছে বুঝতেই পারি নাই।আসলে মা তো মা ই!আপন আর পর কি! একবার মায়ের এতো বেশি শরীর খারাপ হয়েছিলো যে হসপিটালে এডমিট করতে হয়েছিলো!পুরো এক সপ্তাহ হসপিটাল থাকতে হয়েছিলো।তখন আমার ভিতরে এতো কষ্ট হতে লাগলো!মায়ের সাথে আমিই হসপিটালে রইলাম।মাকে ছাড়া ওতো বড় বাড়িটাতে থাকতামই বা কিভাবে?মা ছাড়া যে পুরো বাড়িটাই ফাঁকা যেদিন মা সুস্থ হয়ে গেলো,মনে হলো যেনো এক আকাশ পরিমাণ শান্তি পেলাম।
অনেক মাস পর যখন বাবার বাড়ি আসছিলাম সেদিন শাশুড়ি মায়ের সেকি কান্না।ননদ পাশ থেকে বললো,’তুমি যেভাবে কাঁদছো মনে হচ্ছে যেনো ভাবি সারা জীবনের জন্য চলে যাচ্ছে!আমার বিদায়ের সময়েও তো মনে হয় এতো কাঁদো নাই! আমার দিকে তাকিয়ে বললো’ঠিক বলেছি না?বলো ভাবি?’ আমি মা দুজনি তখন হেসে দিলাম। সেদিন বাসায় আসার সময়, বাসে মারিয়ার সাথে দেখা হয়ে গেলো।মারিয়া ওর বরকে ওর পাশের সিট থেকে উঠিয়ে দিয়ে আমাকে বসালো আর ওর বরকে আমাদের সিটে পাঠিয়ে দিলো। তারপর আমার দিকে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,’কিরে বিবাহিত জীবন কেমন যাচ্ছে তোর?আমার কথা মিললো তো?’ আমি হাসি দিয়ে বললাম ,আমার জীবনটা অতিষ্ঠ হয় নাই।কিন্তু স্বর্গ হয়ে গেছে। মারিয়া অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,তাহলে তো তোর রাজ কপাল।ভালো শাশুড়ি পেয়েছিস।
আমি বললাম,পৃথিবীর সব মায়েরাই সেরা মা।তাদের কাছে সব মেয়েরাই রাজকন্যা।কিন্তু কথা হচ্ছে আগে তাদের কাছে মেয়ে হয়ে উঠতে হবে।আগে তাদের কাছে আপন হয়ে উঠতে হবে।শাশুড়ি না ভেবে নিজের মা ভাবতে হবে।দেখবি তখন তার ভুল গুলোও তোর চোখেই পরবে না!তোর কপাল ও রাজ কপাল হয়ে যাবে। ‘মারিয়া চুপ করে তাকিয়ে রইলো।আমি মৃদু হাসি দিয়ে বললাম,’আচ্ছা একটা কথা বলতো,তুই কি কখনো তোর শাশুড়িকে জড়িয়ে ধরেছিস?কখনো একসাথে বসে হাসি মুখে গল্প করেছিস?’ মারিয়া ভ্রু কুঁচকে বললো,’উনি ও তো করেনি কখনো।’ আমি একটু জোরে হেসে দিয়ে বললাম,’উনি করেনি দেখে তুইও করিসনি!তাহলে উনার মাঝে আর তোর মাঝে তফাত টা রইলো কই?শুরুটা নাহয় তুই ই করলি।’ মারিয়া আমার হাত ধরে বললো,’তুই আসলেই অনেক ভালো রে।’
আমিও ওর হাতটা শক্ত করে ধরে বললাম,’আমরা সবাই ই ভালো।শুধু কেউ কাউ বুঝতে চাইনা।কেউ কমপ্রোমাইজ করতে চাই না!এটাই সমস্যা।’ বেশ কিছুদিন পর মারিয়া একদিন ফোন দিয়ে বললো,’থ্যাংকিউ দোস্ত।তুই আমাকে অন্যভাবে বুঝতে শিখিয়েছিস।জানিস আমার শাশুড়ি মা এখন আমাকে এত ভালোবাসে তোকে বলে বুঝাইতে পারবো না।’ তৃপ্তিরএকটা নিশ্বাস ছেড়ে ভাবলাম,পৃথিবীর প্রতিটা ঘরে বউ-শাশুড়ি থেকে মা-মেয়ে তৈরি হোক না!প্রতিটি ঘরেই একটা করে সুখের গল্প তৈরি হোক।ক্ষতি কি তাতে
গল্পের বিষয়:
গল্প