আমার স্বামী যখন মারা যায় তখন আমার বয়স ২৫ বছর।সেদিন ছিলো আমার এম বি এ ফাইনালের শেষ পরীক্ষা।ভার্সিটি থেকে বের হয়ে অপেক্ষা করছিলাম আমার স্বামী সায়েমের জন্য।সায়েমের সাথে আজ দুপুরে বাইরে খাওয়ার কথা।কিন্তু ৩০ মিনিট পার হবার পরেও যখন ও আসলো না কেমন জানি লাগলো।ফোনটাও বন্ধ। টেনশন হওয়া স্বাভাবিক ছিলো।ভাবলাম অফিসের কাজে আটকে গেছে।
উবার ডেকে সরাসরি বাসায় চলে এলাম।বাসায় এসে দেখি মানুষের সমাগম।আমার শ্বাশুড়ির মাথায় দুজন মহিলা পানি ঢালছে।আমার তিন বছরের ছেলেটা ফ্লোরে বসে কাঁদছে।কে জানি এসে বললো রোড এক্সিডেন্টে নাকি সায়েম মারা গেছে।স্পট ডেথ।ব্রেন নাকি বেরিয়ে গেছিলো মাথা থেকে।এইটুকুই শুনেছি।এরপর কি হয়েছে জানি না।যখন জ্ঞান ফিরলো শুনলাম দুদিন পেরিয়ে গেছে।সায়েমের দাফন শেষ।প্রচন্ড শকের মধ্যে ছিলাম।মনে হচ্ছিলো এসব যেনো দুঃস্বপ্ন। এখুনি ভেঙ্গে যাবে আর দেখবো সায়েম আমার পাশে শুয়ে আছে।কিন্তু বাস্তবতা যে দুঃস্বপ্নের চেয়েও ভয়ংকর।বাবা মা চেয়েছিলো তাদের সাথে নিয়ে যেতে কিন্তু যাই নি আমি।এই ঘরে সায়েমের স্মৃতি জড়িয়ে আছে।এই ঘর ছেড়ে যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব ছিলো না।খুব বেশিদিন শোক পালন করতে পারলাম না।দিন পনেরোর মধ্যেই ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে অনেকটাই স্বভাবিক হলাম।
এবার আমার নিজের পরিচয়টা দেই।আমি নীরা।চট্টগ্রাম জেলার মীরসরাই উপজেলায় বাস আমাদের।বাবা সরাকারি কলেজের প্রফেসর আর মা গৃহিনী।তিন বোনের মধ্যে আমিই বড় সবার।তবে বাকি তিন বোনের তুলনায় আমার গায়ের রং বেশ ময়লাই ধরা যায়।আর আমার ছোট দু বোন ছিলো মায়ের মতো আগুন সুন্দরী।আমি হয়েছি আমার বাবার মতো।কিন্তু পড়াশোনায় অন্য দুজন থেকে ভালো ছিলাম বলেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিন্যান্সে চান্স পেয়ে গেলাম সহজেই।ময়লা গায়ের রং বলে বাবা ছাড়া কারো কাছে কদর পাই নি। বাবার পর একমাত্র সায়েমের চোখে ছিলাম আমি আমার জন্য ভালোবাসা দেখতে পেয়েছি।
সে ছিলো আমার ৫ বছরের সিনিয়র।বলেছিলো ফ্রেসার প্রোগ্রামে আমার আবৃত্তি শুনেই নাকি আমার প্রেমে যায় সে।ডিপার্টমেন্টের সিনিয়র হিসেবে টুকটাক কথা হতো কিন্তু হঠাৎ ই দুম করে প্রপোজ করে বসে আমাকে।আর আমিও কেনো যেনো রাজি হয়ে যাই যার উত্তর আজও পাই নি।কিন্তু যতই দেশের সেরা জায়গায় পড়ি না কেনো মফস্বলে মেয়েদের তাড়াতাড়ি বিয়ের দেওয়ার প্রবনতা আছে।আমার পরিবারও এর ব্যতিক্রম নয়। একবার চট্টগ্রামের বেশ বড় ব্যবসায়ী পরিবাদ থেকে বিয়ের সম্বন্ধ আসে।কিন্তু পছন্দ করে আমার মেজো বোন রূপাকে।আমার পরিবার এই ছেলে হাতছাড়া করতে চায় নি বলে রূপার সাথেই বিয়ে দেবার মনস্থির করে আর আমিও হাফ ছেড়ে বাঁচি।রূপাও বেশ খুশি এরকম বড়লোক বাড়ির বউ হয়ে। এরপর পরই সায়েম আমার বাড়িয়ে আসে বিয়ের প্রোপোজাল নিয়ে।কিন্তু ততদিনে আমার পরিবার আমার জন্য খুঁজছিলো রূপার মতো বড়লোক ছেলের।পরে আমার জেদের জন্য বাধ্য হয় সায়েমের সাথে বিয়ে দিতে।তবে আলহামদুলিল্লাহ সায়েমের কম ছিলো না।সায়েমের বাবা নেই।
পরিবারে মা আর ছোট বোন।ঢাকায় নিজস্ব ফ্ল্যাট আছে।কিন্তু বিয়ের পর বুঝতে পারলাম সায়েমের মা বোনেরও আমাকে খুব একটা পছন্দ না।একমাত্র আমার গায়ের রংয়ের জন্য।অবশ্য এটা স্বাভাবিক। সায়েম দেখতে রাজপুত্রের মতো সেখানে তার পাশে গাঢ় শ্যামলা, ছিপছিপে গড়নের অধিকারী আমাকে বেশ বেমাননই লাগে।তবে একটা জিনিস খুব অবাক লাগে শুধু মাত্র গায়ের রংয়ের জন্যই আমার যোগ্যতা আমার গুনাবলি সবকিছুকেই অদেখা করা হতো।আমার বিয়ের পরপরই ননদ সীমার বিয়ে হয়ে যায়।২ বছরের মাথায় আমার ছেলে আয়মান আসে ঘর আলো করে।সুখের কোনো কমতি ছিলো না কিন্তু আল্লাহর হয়তো মর্জি অন্যরকম ছিলো তাই সায়েমকে নিয়ে গেলেন। কিন্তু সায়েমের মৃত্যুর পর সব এভাবে বদলে যাবে ভাবি নি।সায়েমের মৃত্যুর পর আমার শ্বাশুড়ি আমার স্বাভাবিক চলা ফেরা মেনে নিতে পারলেন না।আমি ঘর থেকে বের হই চাকরি খুঁজতে এটাও তার পছন্দ ছিলো না।
সায়েমের একাউন্টের চেক বই নিজের কাছে নিয়ে গেলেন।আমার আর আয়মানের খরচ দিতেন না।আমার জমানো টুকটাক টাকা দিয়ে মা ছেলের চলতে লাগলো।দিন দিন কটু কথা বাড়তে লাগলো।আর এখন তো আমাকে আগলে রাখার জন্য সায়েম নেই।এমনকি ইদানীং খাওয়া দাওয়া নিয়েও কথা শোনায়।এম বি এ এর রেজাল্ট পাচ্ছিলাম না বলে ভালো কোনো চাকরিও পাচ্ছিলাম না আমি। তাও মুখ বুজে পড়ে রইলাম। মাস ছয়েক পর একদিন শ্বাশুড়ি সোজা এসে বললো ঘর থেকে বের হয়ে যেতে।আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলাম।উনি আমার ছেলের কথাটাও চিন্তা করলেন না।প্রথমে ভেবেছিলাম হয়তো রাগের বসে বলে ফেলেছে।কিন্তু পরদিন যখন বাবা আমাকে নিতে এলো সব পরিষ্কার হয়ে গেলো।আর এর পিছনে ইন্ধনদাতা যে আমার ননদ আর তার স্বামী তা আর বুঝতে বাকি রইলো না।আর কোনো কথা বললাম না।নিজের ঘরে এসে গোছগাছ শুরু করলাম।এরমধ্যে আমার শ্বাশুড়ি এসে বিয়ের সব গয়না নিয়ে গেলো। এগুলো নাকি তার টাকা দিয়ে বানানো তাছাড়া আমি বিধবা মানুষ গয়না দিয়ে কি করবো।
এও বলে দিলো আমি যেনো কোনো সম্পত্তি দাবি করতে না আসি।তাদের নাকি অনেক উপরের লোকজনের সাথে যোগাযোগ আছে।আমি মামলা করে নাকি সুবিধা করতে পারবো না।আমি শুকনো হাসি হেসে দিয়ে দিলাম সব।যেখানে আমার জীবনের সবথেকে দামী অলংকারই হারিয়ে ফেললাম সেইখানে এই গয়না আর সম্পত্তি কি আর?ব্যাগে আমার আর আমার ছেলে আহনাফের কাপড় চোপড় আমার সায়েমের কিছু ছবি নিয়ে বাবার হাত ধরে চলে এলাম বাবার বাসায়।প্রচন্ডরকম খারাপ লাগছিলো কিন্তু বাবার সামনে আর কিছু প্রকাশ করলাম না।বাবা হার্টের রোগী।সায়েমের মৃত্যুর খবরে এমনিতেই একবার হার্ট এটাক হয়ে গেছে তার।বাড়ি এসে ভেবেছিলাম ঘুম দিবো একটা।মাথা প্রচন্ড ধরেছে।কিন্তু এসেই দেখলাম মা আর আমার ছোট বোন রুপা বসে আছে।সাথে অবশ্য তার স্বামীও আছে।আমি নিজের ঘরে যেতে পারলাম না এসে তারা আমাকে বসিয়ে সায়েমের সম্পত্তির হিসেব নিতে শুরু করলো।
তারা নাকি কাল গিয়ে মামলা করবে।আমার শ্বাশুড়ির এতো বড়ো সাহস হয় কিভাবে আমাকে বের করে দেওয়ার। আমি বললাম ‘আমি কোনো মামলা করতে চাই না।আমার এতিম ছেলেকে তার প্রাপ্য থেকে যারা বঞ্চিত করেছে এই জবাব তারা আখিরাতে দিবে।আমি এই কোর্ট কাচারিতে পড়তে পারবো না।’এই কথা শুনে মা কিছু বলার আগে রুপা আমাকে যাচ্ছে তাই বলতে লাগলো।আমি অবাক হয়ে দেখলাম সে আর বড় বোনকে তার স্বামীর সামনে কটু কথা শোনাতে একটু বাধছে না।আর আমার মা ও চুপ থেকে নীরব সম্মতি দিচ্ছে।বাবা ওঘর থেকে একবার ডাক দিয়ে জিজ্ঞেস করেছে কি হয়েছে।আমি আর কিছু বলি নি বাবাকে।চুপ করে আহনাফকে নিয়ে নিজের ঘরে চলে এলাম।রেজাল্ট হলেও কেনো যেনো চাকরি হচ্ছিলো না আমার ভালো।এভাবে তো বসে খাওয়া যায় না।
বাবা রিটায়ার্ডমেন্টে চলে গেছে।পেনশনের কটা টাকায় বাসা ভাড়া আর ৫ জন মানুষের তো হয় না তাই পাশেরই এক স্কুলে চাকরি নিয়ে নিলাম। এর মধ্যে আবার আমার ছোট বোন রুমি চট্টগ্রামের প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি।অবশ্য আমাদের সংসার চলার পিছনে রুপার বেশ হাত আছে।মাসে মাসে মোটা অংকের টাকা মায়ের হাতে দেয় তা না হলে এই সংসার চলতো না।সেই হিসেবে নিজের ইচ্ছে মতো প্রভাব খাটায়।আমার অবশ্য এতে কোনো সমস্যা ছিলো না কিন্তু সমস্যা বাধে তখনই যখন মা আর রুপা মিলে আমাকে না জানিয়ে আমার জন্য পাত্র খোঁজা শুরু করে।ওর এই পরিবারের উপর সব অধিকার খাটানো মেনে নিলেও এটা মানতে পারলাম না।কড়া স্বরে প্রতিবাদ করলাম।সায়েম আমার সবটা জুড়ে আছে।হোক সে এই দুনিয়ায় নেই কিন্তু এখনও বেঁচে আছি এখনও শ্বাস নিচ্ছি একমাত্র আমার ছেলে আয়মানের জন্য।আর একটাই আশা এই দুনিয়ায় তো পেলাম না বেশিদিনের জন্য ওই দুনিয়ায় অনন্তকালের জন্য হয়তো পাবো। কিন্তু আমার এই প্রতিবাদের বিনিময়ে ওর কাছে শুনতে হলো আমি নাকি সব সময় নিজের ইচ্ছেমতো চলেছি বলে আমার এই হাল।মাও সায় দিলো রুপার এসব কথায়।
আমি চুপ করে শুনে গেলাম সব।ভাবতে লাগলাম মেয়েদের নিজের ঘর কোনটা? স্বামীর বাড়িতেও জায়গা হলো না আর বাবার বাড়িতেও প্রতি পদে পদে অপদস্ত হতে হচ্ছে।ভেবেছিলাম বাকি জীবন এইখানেই কাটিয়ে দিবো।ভাই নেই ভাইয়ের বউয়ের খোঁচা শোনারও ভয় নেই কিন্তু বোন মায়ের কাছ থেকে এরকম ব্যবহার পাবো ভাবি নি। হতাশ হলাম না।চলুক না জীবন জীবনের পথে।দেখি না কোথায় নিয়ে দাঁড় করায়। তার ও বেশ কিছুদিন পর রুমির জন্য বিয়ের প্রস্তাব আসে।মা বাবাও আগায় কারণ বাবার শরীরটা ভালো যাচ্ছিলো না।রুপা দুদিন আগেই চলে আসে।সাথে তার ৬ বছরের ছেলে।আমি কিচেনে বসে বসে নাস্তা বানিয়ে রাখছিলাম আগে ভাগেই।কারণ মেহমান আসার দিন এতো কাজ একসাথে করা সম্ভব না। আর রূপা তো কোনোদিনও রান্নাঘরে ঢুকবে না।বড়লোক বাড়ির বউ কিনা!!
হঠাৎ আয়মানের কান্নার শব্দ পেলাম ও ঘর থেকে।গিয়ে দেখি আয়মান গালে হাত দিয়ে কাঁদছে।তার সামনেই রূপা রাগী ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে।আমি সবার প্রথমে আয়মানের গাল থেকে হাত সরিয়ে দেখি পাঁচ আঙ্গুলের দাগ বসে গেছে সাথে ঠোঁট টাও বেশ খানিকটা কেটে গেছে।বুঝতে পেরে আয়মানকে একটু আদর করে ওর নানার ঘরে পাঠিয়ে দিলাম।এরপর রূপার উপর গলার চড়িয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “তোর এতো বড়ো সাহস হয় কি করে আমার ছেলের গায়ে হাত তোলার?” “তো কি করবো কোলে নিয়ে আদর করবো? আমার ছেলে ল্যাপটপে গেম খেলছিলো তোর ছেলে এসে পানি ফেলে দিয়েছে।” আয়মান যথেষ্ট শান্ত জন্ম থেকেই।আমি কখনও তাকে কোনো রকম দুষ্টুমি করতে দেখি নি।সায়েমের মৃত্যুর পর আরো চুপচাপ হয়ে গেছে। আমি রূপার ছেলে আনামকে জিজ্ঞেস করলাম, “বাবা আয়মান পানির গ্লাসটা কি টেবিলে ছিলো নাকি আয়মান নিয়ে এসেছিলো?”
“এটা তো আগে থেকেই ছিলো।আমি কি গেম খেলছিলাম দেখার জন্য ল্যাপটপের কাছে বসতেই কেমনে যেনো পড়ে গেছে পানি।” রূপা ফুঁসে উঠে, “দাদি বাড়ির মতো ঢং ভালো জানে তোর ছেলে।নিজের নেই তাই বলে অন্যকেও খেলতে দিবে না।কি জিনিস নষ্ট করেছে জানিস তুই? এটা লেটেস্ট ম্যাকবুক ছিলো।তোর ছেলেকে বেঁচলেও তো এটার দাম উঠবে।” এটা শুনে আমি জ্বলন্ত চোখে রূপার দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে যাবো তখনই মা আমাকে বলে, “দেখ নীরা আয়মানকে সামলা।সময় মতো লাগাম ধর।এখনই এইরকম ইবলিশ না জানি বড় হয়ে কি হয়। বাপ ছাড়া ছেলেপুলে আবার মানুষ হয় নাকি।আর তুইও এই ছেলের জন্য নিজের জীবনটা নষ্ট করছিস।”
মার এরকম কথায় আমি বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। চোখ উপচে পানি বের হয়ে আসতে লাগলো।বুঝলাম আমার এই বাড়িতে প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে।আমি আর আমার ছেলে বোঝা ব্যতীত আর কিছু নই। আর কিছু না বলে নিজের কাজে মন দিলাম সাথে নিয়ে নিলাম কঠিন এক সিদ্ধান্ত। রুমাকে ছেলেপক্ষ দেখে বিকেল চারটায় বিদায় নিলো। ৫ টার সময় আমি ব্যাগ নিয়ে বসার ঘরে গেলাম।আমার হাতে ব্যাগ দেখে মা জিজ্ঞেস করলো, “কিরে কই যাচ্ছিস?”
“সিলেট যাচ্ছি মা।রাত ১০ টায় চট্টগ্রাম থেকে সিলেটের ট্রেন।আমার একটা চাকরি হয়েছে।” “তোর মাথা ঠিক আছে? একা তুই সিলেট যাবি?এইখানে চাকরিটা খারাপ কি ছিলো? তোর আর আয়মানের তো চলেই যাচ্ছিলো?”
রূপাও মায়ের কথায় সুর মেলায়। “সব থেকে বড় কথা তুই পারমিশন নিয়েছিস মায়ের যে চাকরি করতে অতদূর
যাবি।আত্মীয় স্বজন কতো কথা বলবে জানিস? কোথাও যাওয়ার দরকার নেই তোর।” আমি রূপার দিকে তাকিয়ে স্মিত হেসে বললাম, “রূপা তুই ভুলে যাচ্ছিস তুই ছোট বোন আমার।আমি বড়। তুই আমাকে আদেশ করার সাহস কোত্থেকে পাস? আর আমি তোর খাই না পড়ি।আমার আর আয়মানের খরচ কিন্তু আমি নিজেই চালাই।” রূপা কিছু বলার জন্য মুখ খুলেছিলো কিন্তু আমি হাত তুলে থামিয়ে দেই তাকে। “আর পারমিশনের কথা বলছিস না সেটা আমি বাবা থেকে নিয়ে রেখেছি।বাবা বাস স্টেশনে অপেক্ষা করছে।আর তোকে বলছি সেদিন কিছু বলি নি তার মানে এই না তোর করা সব অন্যায় আমি মেনে নিবো।
আমার অতটুকু বাচ্চার গায়ে হাত তুলতে তোর বাধলো না যে কিনা এখনও ঠিক করে গুছিয়ে কথাও বলতে পারে না।আর তোর কাছে আমার সন্তানের দাম তোর ওই ল্যাপটপের দাম থেকে কম হলেও আমার কাছে আমার সন্তান অমূল্য।আর মা তুমি সেদিন ঠিকই বলেছিলে সময় মতো লাগাম না ধরলে সন্তান বিগড়ে যায়।আমার বেলায় সময় মতো লাগাম ধরেছিলে ঠিকই কিন্তু তোমার মেজো মেয়ের বেলায় ধরতে ভুলে গেছো।এখন দেখো ধরতে পারো নাকি? আসছি আমি।” এই বলে আয়মানকে নিয়ে বেড়িয়ে এলাম আমি।আমার কিছুদিন আগেই সরকারি পরিসংখ্যান ব্যুরোতে চাকরি হয়েছিলো। কিন্তু পোস্টিং সিলেট হওয়াতে ভেবেছিলাম জয়েন করবো না কিন্তু রূপার আর মায়ের ওইদিনের ব্যবহারে মত পাল্টে ফেলি।বাবাকে কিছু বলি নি।শুধু বলেছি ভালো চাকরি আর এটা করা উচিত। বাবা আর তেমন অমত করে নি।
সময় ও স্রোত কারো জন্য অপেক্ষা করে না।আজ ১০ বছর আমি সিলেটে।শাহ পরাণ মাজারের পাশেই সরকারি কোয়ার্টার পেয়েছি।প্রমোশনও পেয়েছি।সামনের প্রমোশনে গাড়িও পাবার কথা।যতটুকু আশা করেছিলাম তার থেকেও বেশি পেয়েছি।মুখ থুবরে পড়ে যাওয়ার পর চিন্তা করি নি এভাবে উঠে দাঁড়াবো।আয়মান এই বছর ক্লাস ৮ এ উঠলো।ঠোঁটের উপর হালকা গোফ দেখা দিয়েছে।যতো বড় হচ্ছে ততো যেনো তার বাবার প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠছে।কথা বলার ধরণ পছন্দ অপছন্দের বেশিরভাগই মিলে সায়েমের সাথে।আজ রাতে ঢাকা রওনা হবো শ্বাশুড়ির সাথে।আমার শ্বাশুড়ি এখন একটা বৃদ্ধাশ্রমে থাকেন।
শুনেছি আমার ননদ ফ্ল্যাটটা নিজের নামে করে মাকে রেখে এসেছে এইখানে।আমি মাঝে মাঝে গিয়ে দেখে আসি উনাকে।উনি কোনোদিনও কথা বলেন না আমার সাথে এখন সেটা অনুতাপ থেকে অথবা নিজের ইগো থেকে সঠিক জানি না।শুধুমাত্র সায়েমের মা বলে আমি চেয়েছি আমার কাছে এনে রাখতে উনি রাজি হন নি।আমিও আর চাপাচাপি করি নি।ঢাকা থেকে যাবো চট্টগ্রাম।আমার নিজের মাকে দেখতে। বাবা মারা গেছে ৫ বছর। আর রুমা স্বামীর সাথে জার্মানি থাকে।রূপার নাকি ইদানীং কি যেনো মানসিক সমস্যা দেখা দিয়েছে।তাই মা বলতে গেলে সারামাস ওইখানেই থাকে।যদিও আমার ওইখানে যাওয়াতে উনি খুশি হন বলে মনে হয় না কিন্তু সন্তান হিসেবে দেখে আসা দায়িত্ব আমার দেখে আসি।মার হয়তো মনে হয় আমার অভিশাপে রূপার এই অবস্থা।আমি কখনও কাউকে মন থেকে কোনো অভিশাপ দেই নি।হ্যাঁ শুধু কষ্ট পেয়েছি আপন মানুষগুলোর ব্যবহারে। আমি তো খুব বেশি কিছু চাই নি কারোর কাছ থেকে চেয়েছি একটু আশ্বাস।সিলেট থেকে আগত ট্রেন ঢাকা প্ল্যাটফর্ম ছুঁয়েছে।
হঠাৎ মনে পড়লো ১৫ বছর এমনি এক সকালে এই প্ল্যাটফর্মেই সায়েমের হাত বধূবেশে এসেছিলাম।আজ আবার আরেক সকাল।শাড়ির কুঁচি ধরে নামতে পারছিলাম না বলে সেদিন ভরসার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলো সায়েম।আর আজ আমার ছেলে আয়মান।আয়মান ভীরের মধ্যে আমার হাত শক্ত করে ধরে ভীর ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে সামনে যেনো হাত ছাড়লেই হারিয়ে যাবো আমি।না চাইতে চশমার ঘোলাটে গ্লাসে দেখলাম আরেক হাত এসে ধরেছে সায়েম।মুখে চিরচেনা হাসি।আমিও শক্ত করে চেপে ধরলাম।এই দুনিয়া থেকে বিদায় নিলেও আমি অস্তিত্ব থেকে এক সেকেন্ডের জন্যও আলাদা হয় নি সে।পুরো দুনিয়া যদি ছেড়েও দেয় এই দুই অনুপ্রেরণার হাত পেয়েছিলাম আর পাবোও….
গল্পের বিষয়:
গল্প