কাউকে দেখলে যে ভেতরে এতোটা বিব্রত লাগতে পারে আমি বুঝতে পারিনি – নিউ মার্কেটের এক গহনার দোকানে হুট করেই ছোট ছেলের বউয়ের সাথে দেখা হয়ে গেলো আসলে আমি চমকে গেলাম ওকে দেখে – তিন বছরে কতো কি পাল্টে গেছে ! সালাম দিয়েই জিজ্ঞেস করলো —
“কেমন আছেন আপনি ? অনেক শুকিয়ে গেছেন”
“আমার ভালো থাকা খারাপ থাকা নিয়ে তোমার কিইবা আসে যায় মৌ? “ মেয়ে ফিক করে হেসে উত্তর দিলো —
“ছেলের বউ নাই দেখে কি দেখা হলে জিজ্ঞেস করতেও মানা?” আমি কঠিন চোখ নিয়ে কড়া কিছু বলতে চাইলাম কিন্তু দোকানে থাকা ছেলেটা এসে বললো—
“আপু একটু বসুন জিনিসটা হয়েছে কিনা কারখানায় দেখতে লোক পাঠিয়েছি”
দুজনকে আত্মীয়া ভেবে ওরা পানীয় দিলো দুজনেই পাশাপাশি বসলাম সোফায় – হ্যাঁ আজীবন গর্ব করা আমি এই মেয়েকে চিনতে সত্যিই ভুল করেছিলাম –যে আমাকে সবাই সমীহ করে চলতো শুধুমাত্র এই মেয়ের কারণেই সেটা ভেঙ্গে গিয়েছিল।
“কি করছো এখন ? থাকো কোথায় ?”
“একটা এনজিওতে আছি আলহামদুলিল্লাহ খারাপ নাই”
“আমার নাতিন কেমন আছে? ওকে কার কাছে রেখে অফিস করো ?” আমি বুঝলাম না এই কথায় এতো অবাক হবার কি আছে ! হাঁ করে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে উত্তর দিলো–
“আমার মেয়ে ভালই আছে অফিসেই ডে-কেয়ার সেন্টার আছে সমস্যা হয় না” আমার কথাটায় জোর দিলো মনে হচ্ছে !
“সব থাকার পরেও ডে-কেয়ারে থাকতে হয় ওকে?”
“ওকে নিয়ে একদম ভাববেন না শুধু দোয়া করবেন আমি যাতে ওকে মানুষ হিসাবে গড়তে পারি”
আমার মুখে আর কোনো কথা আসেনা আমি আড়ষ্ট হয়ে যাই সময় কি নির্মম ! আমি লাইজু বেগম – স্বামী ছিলো একটু সরল টাইপের তাই আমি কঠিন হাতে সংসার সামলেছি উনার বৈষয়িক দিকে নজর ছিলো না কিন্তু আমি খুব হিসাব কষে চলতাম ডাকসাইটে হিসাবে দুই পরিবারেই সবাই আমাকে জানতো।
স্বামী মারা যাবার পরে দুই ছেলেকে উচ্চশিক্ষিত করেছি ওদের চাকুরী হবার পরে ভালো ভালো পরিবার থেকে বড় ছেলের জন্যে প্রস্তাব এলেও আমার হিসাব ছিলো সম্পুর্ণ ভিন্ন— গরীব পরিবারের সুন্দরী মেয়ে বৌ করার ইচ্ছে ছিলো আমার সবাই এতে মহৎ কিছু খুঁজে পেলেও আমার মনের খবর আমি ছাড়া কেউই জানতো না-এই মেয়েরা কৃতজ্ঞ থাকবে সাথে তাদের বাড়ির মানুষেরাও তাই বড় পুত্রের বিয়ে ঠিক করলাম কিন্তু ছেলের মনঃপুত হলো না কিন্তু আমার ইচ্ছার কাছে বলি হলো সে– তবে সত্যি বলতে কি বউটা আসলেই ভালো বিয়ের তিন দিনের মাথায়ই রান্নাঘরের দায়িত্বটা চাপিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত হলাম কিন্তু সবকিছুই আমার হাতে ধরে রাখলাম সবটা ছেড়ে দেবার মতো বোকা আমি নাহ এরপর শুরু করলাম ছোট ছেলের জন্যে পাত্রী দেখা- ১৪ জন দেখার পরে ঘটকই জানিয়েছিল আমি যেমন চাই সেরকম তার কাছে নাই পরিচিত একজনের কথা শুনে পাত্রী দেখতে গিয়ে দেখি তারা পার্লার থেকে সাজিয়ে এনেছে – এভাবে কি একটা মেয়ের আসল রঙ বোঝা যায় ? দ্বিতীয়বার সেই মেয়েকে দেখে খারাপ লাগেনি কিন্তু লুকিয়ে কলেজে খবর নিয়ে এসে যখন জানালাম মাশাল্লাহ মেয়ে আমার পছন্দ হইছে কিন্তু ওপাশ থেকে জানিয়ে দিলো এই বিয়েতে নাকি মেয়েরই মত নাই কারণ হিসাবে বলা হলো কেউ একজন নাকি কলেজে গিয়ে মেয়ের সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে আমি অস্কীকার করে বললাম—
“নিশ্চয়ই এই মেয়ের পছন্দ আছে শুধু শুধু আমাদের ভোগালো !”
বড় বউয়ের মায়ের কাছেই শুনেছিলাম মা-বাপ মরা এক মেয়ে আছে মামা-মামীর কাছে বড় হইছে দেখতে গিয়ে খুবই পছন্দ হলো কিন্তু দুই ছেলেই জানালো বয়সের পার্থক্যটা বেশি যেহেতু মেয়ের পরিবারের অমত নাই তাই সেটাকে উড়িয়ে দিলাম আর শুভ কাজে দেরী করতে নাই বলে তাড়াতাড়ি বিয়েটা সেরেই নিলাম — ভেবেছিলাম অনাথ মেয়ে কোথায় কৃতজ্ঞ থাকবে ! এইটুকু মেয়ে আমাকে জ্ঞান কপচাইতে আসে ? আমি কখনো বউদের কিছু বলি না ছেলেদের দিয়েই শাসন করাই
“আম্মা আপনি অবেলায় দুনিয়ার জিনিস কিনে নিয়ে আসেন কেনো ? ভাবির বাচ্চা ছোট আর গোসলের পর এসব কুটতে ভালো লাগে না”
“পরিচিত মাছ আর সব্জিওয়ালা জোর করে ধরিয়ে দিয়ে যায়”
“সামান্য কয়টা পয়সা বাঁচাতে গিয়ে আমাদের উপর অবিচার”
খুব আস্তে করে বললেও কথাটা ঠিকই আমার কানে যায় তবে সংসারে সব কথা কানে দিতে হয়না বলে না শোনার ভান করেই থাকি মনে মনে বলি তুমি অতিরিক্ত চালাক মেয়ে বেশি চালাক মেয়েরা সংসারে সুখী হয় না। আমার সবচে বড় শক্তি আমার দুই ছেলে যেকোনো কাজ করতেই মায়ের অনুমতি নেয়—আমি ছোট বেলা থেকেই ওদেরকে শিখিয়েছি—
“বউ গেলে বউ পাওয়া যায়”
দুই ছেলের বিয়ের পরেও সব টাকা-পয়সা আমার হাতেই দিতো যার যখন যা দরকার চেয়েই নিতো বড় ছেলের ব্যাংকের চাকুরী -হুট করেই বদলী হলো আশুগঞ্জ বউকে নিতে চাইলেও আমি নাতিন ছাড়া থাকতে পারবোনা বলে আটকে দিলাম প্রায় প্রতি সপ্তাহে ছেলে ঢাকায় আসতো ।
“এই যুগে এসে এতো নিয়ম কানুন ভালো লাগে না মেয়েদের কতো কি দরকার হয় ! ওদের হাতে কিছু টাকা আলাদা করে দিয়ে রাখলেইতো ভালো মা”
ছোট ছেলের মুখে এই কথা শুনে বুঝতে পারি সমস্যাটা আসলে কোথায় ! আমি কিছু না বলে খাবার টেবিল থেকে উঠে গেলাম সব রাগ গিয়ে পড়লো ছোট বউয়ের উপরে আমার এতকালের নিয়মের মধ্যে বাগড়া দেবার জন্যে আমি ওর মামা-মামীকে ডেকে এনে বিচার দিলাম সেদিন রাতে বউ রুম থেকে বের হলো না খাবার খেলো না ভাবলাম ঔষুধে কাজ হয়েছে । বড় বৌ দ্বিতীয়বারের মতো মেয়ের জন্ম দেওয়ায় আমি হাসপাতালে গেলাম না দেখে সে নিজেই এসে বললো—
“এটা অন্যায় আম্মা এটা আল্লাহপাকের হাতে আপনার ভাবিকে দেখতে যাওয়া দরকার ছিলো”
“আমার শরীর ভালো নাই প্রেশার উঠানামা করছে তাই যাইনি”
হাসপাতাল থেকে ফেরার পরেও বাচ্চা দেখার জন্যে ততোটা ব্যাকুলতা দেখালাম না আমার বংশরক্ষা নিয়েই আমি চিন্তিত হয়ে পড়েছিলাম । ছোট ছেলের বউকে বুঝালাম আমার শরীর ভালো না কখন কি হয়ে যায় অন্তত বংশ রক্ষা দেখে যাই—
“যদি বংশ রক্ষা না হয়?”
“তোমার মুখে সবসময় অলুক্ষুনে কথাবার্তা থাকে”
“দিন বদলেছে মা সবকিছুকে সহজ করে দেখতে শিখুন কতজনের বাচ্চাই হয় না আর আপনি আছেন এক বংশ নিয়ে পড়ে!”
বউটার পেটের বাচ্চার বয়স যখন পাঁচমাস খুব আগ্রহ নিয়েই ডাক্তারের কাছে গিয়ে সনোগ্রাফি করিয়ে মেয়ে শুনে নস্ট করার জন্যে চাপ দিলাম— “আপনি একটা প্রাণ খুন করতে চান ? মা হয়ে কিভাবে ?” আমাদের মা-ছেলের চাপাচাপিতে একদিন ঝড় উঠলো বাসায় তুমুল ঝগড়ার পর বউ বেরিয়ে যাবার সময় আমাকে বললো—–
“মা ছিলোনা বলে মনের ভেতরে অনেক আক্ষেপ ছিলো আমার মামা-মামী গরীব হলেও এখানে বিয়েতে একদমই রাজি ছিলো না কিন্তু আপনার মিস্টি কথায় গলে আমিই মত দিয়েছিলাম আজ বলছি আপনি শুধুই আপনার দুই সন্তানের মা – দুই বউয়ের মা হবার ইচ্ছেই হয়নি কখনো আপনার , সংসারের সব ক্ষমতা ধরে রাখতে চেয়েছেন অথচ যে মা সে কখনো নিজের সন্তানের মা হয়েই খুশী থাকার কথা নাহ আফসোস নারী হয়েও আপনি আমার আর ভাবির মা হতে পারেননি” ছেলে মুখের উপর কথা বলার পর চড় দিয়েছিল—
“যে পুরুষ নিজের স্ত্রীকে সম্মান দিতে জানে না সে কি ঘরের কাজ আর খাওয়ানো পরানোর জন্যেই বিয়ে করে? সাইনবোর্ডওয়ালা স্বামী থাকার চাইতে একা থাকাও অনেক সম্মানের” আমি স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম তবে যেতে বাঁধা দেইনি – মামা আর কয়দিন বসিয়ে খাওয়াবে ? তাদের অবস্থা জানা আছে আমার – এখানেই ফিরে আসতে হবে বয়সতো আর কম হয়নি জানি বুঝি আমি । কিন্তু আমার হিসাবে ভুল ছিল, আমার চেনা জগতের বাহিরেও ছিলো সেই মেয়ে। ওর মামাকে ডেকে খুব করে রাগ ঝাড়লাম মা –ছেলে মিলেই তারপর নাতীন হবার পর ছেলে দেখতে গেলে বউ দরজাই খুলেনি ভেতর থেকে জানিয়েছিল—- “এই মেয়েটা শুধুই তার”
বড় ছেলে বউ মিলে গেলেও তার রাগ পড়েনি তারপর থেকেই সংসারে অশান্তি শুরু হলো বড়ো ছেলে গ্যাস্ট্রিক এর কথা বলে বউ আর দুই বাচ্চা নিয়ে চলে গেলো আর ছোট ছেলে অফিস শেষে বাসায়ই ফিরতো না ওর চাকুরী যাবার খবর শুনেছিলাম অনেকদিন পরেই টাকার গরমিলের জন্যে – –নেশায় জড়িয়েছে শুনেছি , আসলে বন্যার পানি সবকিছু শেষ করে যখন গৃহস্থের ভিটায় চলে আসে তখন চেয়ে দেখা ছাড়া কিছুই করার আর থাকে না আমি একা হয়ে গেছি কারণ ছেলে আমাকেই দায়ী করে তার সংসার ভাঙ্গার জন্যে । “ম্যাডাম আপনার জিনিস এসে গেছে” দোকানদারের কথায় উঠে দাঁড়িয়ে বললো – “আমি আসি আগামীকাল আমার মেয়ের জন্মদিন তাই ছোট একটা জিনিস অর্ডার করেছিলাম দোয়া করি ভালো থাকুন সবসময়” মেয়েটার চোখের দিকে তাকাতেও ভয় পাচ্ছিলাম মনে হচ্ছিলো আমি যে দেনা মিটাতে সব গহনা বিক্রি করতে এসেছি ও ঠিক বুঝে ফেলবে ! বারবার মনে হচ্ছিলো বলি –
“আমার সব থেকেও কিচ্ছু নাই একবার আমাকে একটা সুযোগ দাও তুমি” বলা হয়না কিছুই শুধু অস্ফুট করে বলি—
“যেখানেই থাকো তুমি আর তোমার মেয়ে ভালো থাকো মা”
গল্পের বিষয়:
গল্প