পুকুর ঘাট

পুকুর ঘাট
-তোর বাচ্চাটাকে আমাকে দিয়ে দে আপু। আমি তাকে নিয়ে যেতে এসেছি। অন্ধকার ঐ ছোট্ট ঘরে আমার খুব একা লাগে।
মিতুর কথা শুনে আমি আসিফকে ডেকে তুললাম। চারিদিক অন্ধকার। রাত আনুমানিক তিনটা হতে পারে। আসিফ নাক ডেকে ঘুমাচ্ছিল। গায়ে ধাক্কা দিতেই শোয়া থেকে বসে বলল, “কী হয়েছে তানিয়া?” প্রশ্ন করে এক হাতে বাতি জ্বালিয়ে দিলো আসিফ। আমি কান্না করছি শব্দ ছাড়া। আসিফ আবারো আমার গায়ে ঝাঁকুনি দিয়ে জানতে চাইলো, “তানিয়া কী হয়েছে তোমার? কাঁদছ কেন?” আমি আমতা আমতা করে বললাম, “মিতু আবার এসেছিল। সে আমার পেটের বাচ্চাকে নিয়ে যেতে চায়। আসিফ তুমি বলো, তানিয়া আমার বাচ্চা নিয়ে কী করবে? তাকে মেরে ফেলবে?”
আসিফ আমার মাথা টেনে তাঁর বুকে চেপে ধরে বলল, “তানিয়া, আমরা কালই ডাক্তারের কাছে যাব। তুমি তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যাবে।”আমি আসিফের বুক থেকে মাথা তুলে বললাম, “আমাকে তোমার অসুস্থ মনে হয়? গর্ভবতী মানেই অসুস্থ? আমি সারাদিন সংসারের সব কাজ করতে পারি। আমি ও আমার পেটের বাচ্চা দু’জনেই সুস্থ আছি। তাহলে কেন ডাক্তার দেখাতে হবে?”
আসিফ আর কোনো কথা বলেনি। দেয়ালের দিকে দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে আছে। আমার সেদিকে মন নেই। আমার ভয় শুধু মিতুকে নিয়ে। সে কেন বারবার আসে আমার বাচ্চা নিয়ে যেতে? মিতু কি আমার উপর প্রতিশোধ নিতে চায়?
আমার বাবার বাড়ি গাজীপুরের কাপাসিয়ায়। আমাদের বাড়িতে একটি পুকুর আছে। একদম নিজস্ব পুকুর। পুকুরে আমাদের পরিবারের কেউ গোসল করে না। অথচ বাবা পুকুর ঘাট পাকা করেছেন নুড়ি পাথর দিয়ে। বিকেলের একটা সময় আমি আর ছোট বোন মিতু এই পুকুর ঘাটে বসে থাকতাম। ছিমছাম, নীরবতা সারাক্ষণ। বজলু চাচা ঘাসে ভরা মাঠটিকে আর এই পুকুর ঘাট পরিষ্কার করে রাখেন। আগে কখনো এতো পরিষ্কার থাকতো না। গাছের পাতা পড়ে চারিদিক বিছিয়ে থাকতো।
বাতাসে ভেসে আসা ধূলোবালি, হঠাৎ কয়েক ফোটা বৃষ্টিতে কাঁদামাটি আর আবর্জনার স্তুপে পরিণত হয়েছিল। বাবা একদিন অফিসে যাবার সময় দেখলেন আমরা পুকুর ঘাটে দাঁড়িয়ে দুই বোন গল্প করছি। বাবা পরদিনই বজলু চাচাকে ডেকে বললেন, “বজলু মিয়া, মেয়ে দুটো পুকুর ঘাটে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। একটু পরিষ্কার থাকলে তো বসতেও পারে।”তারপর থেকে পরিষ্কার পুকুর ঘাটের সিড়িতে বসি আমরা। একদম পুকুরের পানিতে পা ভিজিয়ে বসে গল্প করি। দুই বোনের কেউ সাতার জানি না। পা ভিজিয়ে গল্প করার ফাঁকে হাত দিয়ে পানি ছিটাতে ভালো লাগে। মিতু আমার দেড় বছরের ছোটো। যত খুনসুটি, সব তাকে ঘিরেই। আবার গলায় গলায় ভাব যদি বলা হয়, সেটাও মিতুর সাথেই। কিন্তু সেই একমাত্র বোন আমার ভালোবাসার পথে বাঁধা হয়েছিল।
আমি আসিফকে ভালোবাসি। প্রচন্ড রকমের ভালোবাসা যাকে বলে। কিন্তু মিতুর সাথে আমার গলায় গলায় ভাব হলেও আসিফকে ভালোবাসার কথাটি আমি তাকে জানাতে পারিনি। আসলে জানাতে চাইনি। আমি চেয়েছি আগে আসিফ নিজে জানুক, আমি তাকে কতোটা ভালোবাসি। আসিফের জন্য আমার শখের দুইটা টিউশনি আমি বাদ দিয়েছি। মানুষ মানুষের বাড়িতে যায় বিকেল বেলা। আর আমি বিকালে তো সম্পূর্ণ অবসর সময় কাটাই। পুকুর ঘাটে মিতুর সাথে গল্প করি। তখন যদি আসিফ আমাদের বাড়ি আসে, তাহলে কিন্তু তাকে মন ভরে দেখতে পারি। দুয়েকটা কথা বলার সুযোগও হয়। যদিও যেদিন থেকে বুঝতে পারি যে এই মনটা আসিফকে ভালোবেসে ফেলেছে, সেদিন থেকে তাঁর সাথে বেশি কথা বলতে পারি না।
অনেক লজ্জা ভর করে আমার দুই চোখে। খালাতো ভাইয়ের সাথে কথা বলতে নিশ্চয় এতো লজ্জা থাকার কথা নয়। কিন্তু আমি তো মনে মনে অনেক কিছু ভাবতে থাকি। অথচ মিতু আসিফের সাথে অনবরত কথা বলতে পারে। তখন মনে মনে বলি, “মিতুরে, তুই যদি আসিফকে ভালোবাসতি তাহলে লজ্জায় কথা বলতে পারতি না।” আসিফ বেশিরভাগই আসতো সকাল বেলা। সকালে এসে কোনোদিন দুপুরে খেয়ে যেত কোনোদিন না খেয়েই চলে যেত। আমি আসতে আসতে আসিফের চলে যাবার সময় হতো। কোনোদিন এসে পেতামও না। বাড়ি এসে শুনতাম, আসিফ এসেছিল। হঠাৎ একদিন কী মনে করে টিউশনি দুটো ছেড়েই দিলাম। কারণটা শুধু আমি জানি। যেন সকালের সময়টা আমি বাড়ি থাকতে পারি। আসিফকে যেন দেখতে পারি।
সেদিন ছিল সোমবার। আগের দিন রাত জেগে মুভি দেখার জন্য বেলা করে ঘুম থেকে উঠতে হয়েছে। মিতুকে বিছানায় পাইনি। পাওয়ার কথাও নয়। আমি বেলা করে ঘুম থেকে উঠলেও মিতু সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে। তাছাড়া সে তো আর আমার মতো রাত জেগে মুভি দেখেনি। ফ্রেস হয়ে বারান্দায় তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে এসে চোখ গেল আমাদের পুকুর ঘাটে। মিতু কথা বলছে আসিফের সাথে। তার মানে আসিফ এসেছে। অথচ আমি এতো বেলা ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিলাম। আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে চুল ঠিক করলাম। নতুন জামা পড়ব? না, মিতু অন্য কিছু ভাবতে পারে। নতুন জামা পড়ার উপলক্ষ থাকতে হয়।
আসিফ আসার বিষয়টা আমার কাছে উপলক্ষ হতে পারে। কিন্তু মা-বাবা, মিতু ভাববে বাইরে বের হবো না যখন তাহলে নতুন জামা কেন? আয়নায় তাকিয়ে লজ্জা লাগছে। মনে হচ্ছে যেন আসিফ তাকিয়ে আছে আমার দিকে। মিতু আর আসিফ এখনো পুকুর ঘাট থেকে ফিরে আসেনি। আমি ধৈর্য্য হারিয়ে ফেলছি। এক সময় পা বাড়িয়ে ঘর থেকে বের হলাম। আসিফ আর মিতুকে দেখা যাচ্ছে না। তারা কি সিড়ি বেয়ে নিচে নেমেছে। এগিয়ে গিয়ে আমার চোখকে বিশ্বাস করকে কষ্ট হচ্ছে। মিতু আর আসিফ পানিতে পা নামিয়ে সিড়িতে বসে আছে। ওদের পেছনে ঘাটে দাঁড়িয়ে থাকতে আমার কষ্ট হচ্ছে। মিতুর হাত আসিফের কোলের কাছে। আসিফ এক হাতে মিতুর হাত ধরে অন্য হাতে আঙ্গুল টানছে । আমার মনে হচ্ছে মাথা ঘুরে পড়ে যাব। কোনো রকমে বাড়িতে গিয়ে রুমে শুয়ে পড়লাম। দুই চোখে যেন বন্যা হচ্ছে। খালে যেন নদীর স্রোত বয়ে যাচ্ছে। বালিশের এক কোণ ভিজে গেছে আমার চোখের পানিতে। কেন এমন হলো আমার সাথে?
আমার আনন্দ মরে গেছে। সারাদিন ঘরে বসে থাকি। মিতু রোজ নিয়ম করে পুকুর ঘাটে যেতে বলে। ভালো লাগছে না বলে দেই। দেয়ালে এক দৃষ্টিতে বোবা প্রাণীর মতো তাকিয়ে থাকি। আসিফ কয়েকদিন পর পর আমাদের বাড়ি আসে। ভালো মন্দ জিজ্ঞেস করে আমাকেও। আমি হুম, হ্যাঁ বলে নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা করি। কিন্তু আমার মন খারাপের চেহারা বাবা-মায়ের চোখ এড়ায়নি। মা একদিন বাবার সামনে বলল, “আমরা আরো তোর জন্য ছেলে দেখব ভাবছি। বিয়ে শাদি দেব তোকে। অথচ তোর চেহারায় মরা মরা ভাব দেখে তো সাহস করতে পারছি না।”
আমি তখনো চুপ করে আছি। আমার ভাঙ্গা হৃদয়টাতেও টুকরো হওয়া আয়নার মতো আসিফের ছবি ভেসে বেড়াচ্ছে। আমাকে নিশ্চুপ থাকতে দেখে বাবা প্রশ্ন করলো, “তুই কি কাউকে পছন্দ করিস? আমরা না হয় যোগাযোগ করবো।”
আমার ভেতরের কান্নাগুলো জেদে পরিণত হচ্ছে। কী মনে করে যেন মুখ ফসকে বলেই ফেললাম, “আসিফকে পছন্দ আমার। অন্য কাউকে বিয়ে করতে পারবো না।” কথাটুকু বলার পর মনে হচ্ছে বলাটা ঠিক হয়নি। আমি রুমে চলে গেলাম। মিতু তখন ফোনে কার সাথে যেন কথা বলছে। আমার বুকের ভেতর তখন বিরহের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলছে। নিশ্চয় আসিফের সাথে কথা বলছে মিতু। আমি বাড়িটার কোথাও গিয়ে যে একটু একা থাকবো সে উপায় দেখছি না। তাই চলে গেলাম পুকুর ঘাটে। পা দুটো নামিয়ে দিলাম পানিতে। পানিতে নিজের ছবি ভেসে উঠেছে। পানি ছিটিয়ে না দেখার ভান করতে থাকি আমি। পানি ছিটানোর চেষ্টা করি। মিনিট পনেরো পর মিতু এলো পুকুর ঘাটে। তার চোখ ভর্তি পানি। সে কান্না করছে। আমি সে কান্নার কারণ জানি না। একেকটা সিড়ি পেরিয়ে আমার কাছে চলে এলো। পানিতে নেমে আমার মুখোমুখি দাঁড়ালো। তখনো তাঁর চোখ থেকে পানি পড়ছে অনবরত। তারপর রাগে চক্ষু বড় করে আঙ্গুল তুলে আমাকে বলছে, “ছোটো বেলা থেকে বান্ধবীও তুই বোনও তুই। আর সেই তুই আমার ভালোবাসা কেড়ে নিতে চাস? বাবা মায়ের কাছে বলেছিস আসিফ ভাইকে ছাড়া বিয়ে করবি না। এতো স্বার্থপর তুই? এতো লোভ তোর মধ্যে?”
আমি আর সহ্য করতে পারিনি। মিতুকে জোরে তাঁর গালে চড় বসিয়ে দিলাম। চড়ের আঘাতে মিতু পুকুরে কাত হয়ে পড়ে গেল। পড়ে হাবুডুবু খাচ্ছে। আমি বা মিতু কেউ সাতার জানি না। আমি তবুও হাত বাড়িয়েছি। কিন্তু মিতুর নাগাল পাচ্ছি না। উপায় না দেখে দৌড়ে বাবা-মা’কে ডাকতে ডাকতে বাড়ি গেলাম। বাবা-মা আর আমি ফিরে এসে মিতুকে জীবিত পাইনি। পানি খেয়ে ভেসে উঠেছে উপরে। বাবা টেনে তুললেন মিতুকে । উপুড় করে পানি বের করার চেষ্টা করলেন, হাসপাতালে নিয়ে গেলেন। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। বাবা-মা জানতো মিতু মাথা ঘুরে পানিতে পড়ে গেছে। আমি ঘাট থেকে দেখে দৌড়ে গিয়ে বাবা-মা’কে খবর দিয়েছি। কিন্তু পৃথিবীর কেউ জানে না, আমার হাতের চড় খেয়ে মিতু পানিতে পড়ে গেছে। আমিই মিতুর হত্যাকারী।
আসিফের সাথে আমার বিয়ে হলো এর পরের বছর। আসিফ খালার কথা ফেলতে পারেনি। আমাকে বিয়ে করে নরসিংদী নিয়ে এসেছে। মিতুর বিষয়টা আমরা ভুলে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগলাম। কিন্তু হয়তো ভোলা হয়নি বা ভুলে থাকা যায় না অথবা চেষ্টা করিনি। কিংবা ভুলতে চেয়েও ব্যর্থ হয়েছি। আর এখন তো মিতু মাঝে মধ্যেই হুট করে চলে আসে আমার কাছে। আমার সন্তানকে নিয়ে যেতে চায়। তাঁর নাকি অন্ধবার কবরে একা থাকতে ভয় লাগে, কষ্ট হয়। তলপেটে প্রচন্ড ব্যথা অনুভব করি। মাথাটা ঝিম ঝিম করছে। মনে হচ্ছে আমার সময় হয়ে এসেছে। চোখ দুটো বন্ধ হয়ে যেতে চায়। শরীরের সব শক্তি যেন হারিয়ে ফেলেছি। আসিফ ফুলগাছের গোঁড়া পরিষ্কার করছে। তাকে ডাক দেয়ার শক্তিটুকুও নেই। আমার চোখ বন্ধ হয়ে গেল। আবার যখন চোখ মেলে তাকিয়েছি, তখন নিজেকে আবিষ্কার করলাম হাসপাতালের বিছানায়।
জানতে পারি আমি দু’দিন ধরে হাসপাতালে। আমার জরায়ুতে টিউমার হয়েছিল। অপারেশন করা হয়েছে। আমি আর কখনো মা হতে পারবো না। মাতৃত্বের স্বাদ পাবো না কোনোদিন। আমি পেটে হাত দিলাম। পেট আর ফোলা লাগছে না। তাহলে কি আমার ডেলিভারি হয়ে গেছে দু’দিন আগেই? আমার সন্তান কোথায়? আমার ছেলে হয়েছে নাকি মেয়ে? নার্স স্যালাইনের স্পিড নিয়ন্ত্রন করার চেষ্টা করছে। জানতে চাইলাম আমার বাবা-মা কোথায়? আসিফ কোথায়? নার্স বলল তারা বাইরে আছে। ডাক্তার তাদের নিষেধ করেছে আমাকে যেন এখন বিরক্ত না করে। আমি আবার জানতে চাইলাম, আমার বাচ্চা কোথায়? তাকে কি অন্য কেবিনে রাখা হয়েছে? নার্স বলল, “কিসের বাচ্চা? আপনি তো গর্ভবতী ছিলেন না। আপনার তো টিউমার ছিল জরায়ুতে।”
আমি এসব কী শুনছি? এটা কীভাবে হতে পারে? আমি তো গর্ভবতী ছিলাম। নিজের শরীর, মনের সাথে এত বড় ধোকা আমি খেতে পারি না। আমি কি তাহলে আসিফকে কোনো সন্তান উপহার দিতে পারবো না? মিতুর কথাটি বারবার আমার কানে বাজছে। “তোর বাচ্চাটাকে আমাকে দিয়ে দে আপু। আমি তাকে নিয়ে যেতে এসেছি। অন্ধকার ঐ ছোট্ট ঘরে আমার খুব একা লাগে।”
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত