বিনিময়

বিনিময়
-আঙ্কেল ছাড়ো, ব্যাথা লাগছে।
-আহা মামনী তোমাকে আমি অনেকগুলো চকলেট কিনে দিবো। তোমার নাহ ক্যাটবেরি খুব পছন্দ?
৬বছর বয়সী লাবণ্য খুব পীড়াপীড়ি করছে আসিফ সাহেবের নিকট থেকে ছাড় পেতে। কিন্তু আসিফ সাহেব অনেকটা শক্ত করে ধরে ছোট্ট লাবণ্যের স্পর্শকাতর স্থানে হাত দেওয়ার চেষ্টা করছে। হঠাৎই রুমের ভিতরে প্রবেশ করলো লাবণ্যর বাবা নাফিস। নাফিসকে দেখে অনেকটা হকচকিয়ে উঠে লাবণ্যকে ছেড়ে দিলো আসিফ। তন্মধ্যে লাবণ্য দৌড়ে গিয়ে ওর বাবাকে কান্নামাখা মুখে জড়িয়ে ধরলো। আসিফ এই মুহূর্তে ঠিক কী বলে পাশ কাঁটিয়ে যাবে তা ভেবে পাচ্ছে না।
-কী হইছে আম্মু? কাঁদো কেন?
-আব্বু লাবণ্যর কথার সমাপ্তি না ঘটতেই আসিফ বলে উঠলো,
-আরে খাটের কোণায় হাত লেগে একটু ব্যাথা পেয়েছিলো আরকি। তাই আমি কান্না থামানোর চেষ্টা করছিলাম। এদিকে আসো লাবণ্য মামুনিটা। এই বলেই যেই পুনরায় লাবণ্যকে স্পর্শ করলো ঠিক তখন লাবণ্য ওর বাবাকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।
-রাগ করেছো আমার সাথে? এই নাও তোমার জন্য ক্যাটবেরি এনেছি। কিন্তু অন্যান্য দিনের মতো আজ লাবণ্য আসিফের নিকট থেকে ক্যাটবেরি দুটো নিলোনা। আসিফ বিষয়টা বুঝে গেলেও তেমন কিছু বললোনা আর।
-আচ্ছা আম্মু! তোমার আম্মুর কাছে যাও এখন। তোমার বাবাটা আঙ্কেলের সাথে কথা বলবে। লাবণ্য ওর বাবার কথামতো অন্য রুমে চলে গেলো।
আসিফ আর নাফিস দুজন সেই কলেজ জীবনের বন্ধু এমনকি বর্তমানে তাঁরা ব্যবসায়িক পার্টনারও বটে। আসিফ প্রায়শই নাফিসের বাড়িতে আসে কিন্তু নাফিসের স্ত্রী লিনা আসিফকে একদমই দেখতে পারেনা। এর অবশ্য কারণও আছে। প্রধান কারণ হলো আসিফ এখনো অবিবাহিত এবং নাফিসের বাড়িতে আসলে মাঝেমধ্যেই লিনার দিকে কুদৃষ্টিতে তাকায়। নাফিস যদিও আসিফের অসংখ্য কুকর্ম সম্পর্কে অবগত কিন্তু বাল্যকালের বন্ধু এবং ব্যবসায়িক পার্টনার হওয়াতে বাড়িতে আসলেও কিছু বলতে পারে না। লিনা বেশ কয়েকবার নাফিসকে বিষয়টি অবহিত করলেও নাফিস বারংবারই বিষয়টি এড়িয়ে গেছে। তাই লিনাও আর তেমন কিছু বলে না এখন বরং যেসময় নাফিস বাড়িতে না থাকে তখন সে একলা রুমে দরজা আটকে বসে থাকে। রাতে যখন নাফিস আর লিনা ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলো ঠিক তখনি লাবণ্য বলে উঠলো,
-বাবা, আসিফ আংকেল না খুব পঁচা।লাবণ্যের কথা শুনে অনেকটা হকচকিয়ে উঠলো নাফিস। লিনা তখন ওয়াশরুমে থাকায় লাবণ্যের কথা শুনতে পেলোনা।
-কেনো আম্মু? কী হয়েছে?
-আমাকে ব্যাথা দেয়। আমি আর আঙ্কেলের থেকে ক্যাটবেরি নিবোনা। নাফিস ব্যপারটা কিছুটা আঁচ করতে পেরে মুহূর্তেই তাঁর মুখে বিন্দু বিন্দু ঘামের আবহ জেগে উঠলো।
-আচ্ছা মা। তোমার আম্মুকে কিছু বলোনা ঠিক আছে?
-হুম বাবা।
এই বলেই ছোট্ট লাবণ্য তাঁর বাবাকে জড়িয়ে ধরলো। তন্মধ্যে লিনা ওয়াশরুম থেকে এসেই বাবা মেয়ের এরকম জড়াজড়ি দেখে বললো,
-কী বাবা মেয়েরতো ভালোবাসা খুব উত্তমভাবেই ভাগাভাগি হচ্ছে আমাকে কী একটু ভাগ দেওয়া যাবে?লিনার কথা শুনে নাফিস নিজের চিন্তিত মুখে হালকা মুচকি হাসির রেখা টেনে বললো,
-না ভাগ হবেনা। এই বলে দুজনেই ফিক করে হেসে উঠলো।২দিন পর…
-কী হলো হঠাৎ এই রেস্টুরেন্টে ডাকলি কেন?
-আসিফ! একটা জরুরী কথা ছিল। কথাটা কীভাবে নিবি ঠিক বুঝতে পারছিনা। তবে আমি জানি তুই বেষ্টফ্রেন্ড হিসেবে আমাকে না করবি না।
-আরে কী হয়েছে বলবিতো?
-আমি আসলে তোর সাথে ব্যবসায়িক পার্টনার হিসেবে থাকতে চাচ্ছিনা। আমি লিনা আর লাবন্যকে নিয়ে অস্ট্রেলিয়া চলে যাবো।
-কিন্তু কেন?
-আসলে এই দেশটা আর ভালো লাগছে না। সব জায়গাতেই দূষিত বাতাসের ছোয়া। তাই আমি চাচ্ছি আমার মেয়েকে একটি ভালো পরিবেশে বেঁচে থাকার সুযোগ করে দেওয়ার। আমি চাচ্ছি তুই নতুন কোনো পার্টনার খুঁজে নে আর আমার অংশটুকু দিয়ে দে।
-কাম অন বয়। তোর সাথে কী আমি কোনো বিশ্বাসঘাতকতা করেছি এ কবছরে একবারও? আর আমি এখন নতুন পার্টনারইবা কোথায় পাবো? তোর ভাগ দিয়ে দিলেতো আমার ব্যবসা লাঠে উঠবে। কী হয়েছে পরিষ্কার করে বলবি?
নাফিস অনেকটা উত্তেজিত হয়ে বললো,
-কিছু হয়নিতো বললাম। তুই যেভাবে হোক ম্যানেজ কর। আজ আসি।
আসিফ অনেকটা অবাক নয়নে নাফিসের চলার পথের দিকে তাকিয়ে রইলো। আসিফের মাথা কিছুতেই কাজকরছে না যে কী থেকে ও কী করবে। হঠাৎই ওর একটি কথা কানে বাজতে লাগলো “দূষিত বায়ু”। এর মানে লাবণ্যের বিষয়টি নিয়ে কী ও এরকম রিএক্ট করছে? হঠাৎ আসিফ এক কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো। পাঁচদিন পর নাফিস ব্যবসায়িক শেষ সফর হিসেবে চিটাগাং গিয়েছে। আর এটা পুরোটাই ছিল আসিফের একটি চাঁল। কারণ লিনার প্রতি আসিফের অনেক আগে থেকেই একটি আকর্ষন ছিলো। আসিফের বিয়ে করার না কারণ হলো মূলত ওর ধারণা বিয়ে করলে এক নারী নিয়ে পরে থাকতে হবে। কিন্তু এখন সে বিয়ে ছাড়া অজস্র নারীর দেহে আনন্দ খুঁজে বেড়াতে পারে। আসিফের প্রবল ইচ্ছা লিনার সাথে একটি মুহূর্ত কাঁটানোর কিন্তু এটা যে এক অসম্ভব ব্যপার তা সে জানতো। কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপট ভিন্ন। আসিফের প্লান হলো যেভাবে হোক নাফিসকে ওর পথ থেকে সরিয়ে দেওয়া।
নাফিস বারবার লিনার ফোনে কল দিয়েই যাচ্ছে কিন্তু বারংবারই ফোন বন্ধ দেখাচ্ছে। নাফিসের মনে খানিকটা চিন্তার আবহ জেগে উঠলো। এভাবে পাঁচঘন্টা অন্তরও যখন মোবাইল খোলা পেলোনা তখন ব্যবসায়িক কাজ অপূর্ণ রেখেই ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলো। প্রতিটি সেকেন্ড যেনো তাঁর নিকট হাজার বছরের মতো দীর্ঘ মনে হচ্ছে। নাফিস যেই মুহূর্তেই বিপদের আশঙ্কা করে সেই মুহূর্তেই যেন ওর শ্বাস প্রশ্বাসের গতি প্রবলরূপ ধারণ করে। দরজায় কয়েকবার নক করার পরও যখন দরজা খুলছিলোনা তখন ওর হাত পা যেন থরথর করে কাঁপতে শুরু করে দিলো। নিজের কাছে থাকা মাস্টার কি টা দিয়ে দরজা খুলতেই স্তব্ধ হয়ে গেলো নাফিস। কারণ ডাইনিং রুমের মেঝেতে লিনার রক্তাক্ত নিষ্পাপ দেহটি পরে রয়েছে অবচেতন ভঙ্গিমায়। দৌড়ে গিয়েই জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে ডাকতে শুরু করলো লিনাকে। কিন্তু এই নিথর দেহে যে কোনো প্রাণের অস্তিত্ব নেই তা কী তার ষষ্ঠ ঈন্দ্রীয় জানে? হঠাৎই তাঁর মনে পরলো একমাত্র আদরের মেয়ে লাবণ্যের কথা। পাগলের মতো একের পর এক রুমে খুঁজতে লাগলো। পরিশেষে স্টোররুমে লাবণ্যের রক্তাক্ত দেহটিও পেয়ে গেলো নাফিস। দৌড়ে লাবণ্যকে জড়িয়ে ধরে কয়েকবার ঝাঁকি দিতেই খানিকটা টিপটিপ করে চোখ খুললো সে। অনেকটা ভাঙ্গা গলায় বললো,
-বাবা, আসিফ আঙ্ক…
পরমুহূর্তেই লুটিয়ে পরলো লাবণ্য তাঁর বাবার কোলে। নাফিস এক আত্মচিৎকারে মুখোরিত করে থমথমে পরিবেশের ব্যবচ্ছেদ ঘটালো। হঠাৎই তাঁর আর্তনাদরত হৃদয়টি থমকে গিয়ে এক পাথরতুল্য কঠিন হৃদয় ধারণ করলো। পাঁচ বছর পর আসিফ এখন নামকরা একজন ব্যবসায়ী। সেই ঘটনার পর নাফিসের দেখা পায়নি আর সে। আসিফ ভেবেছিলো নাফিস নিশ্চই প্রতিশোধ নিতে আসবে। তাই সে সবসময়েই ওত পেতে ছিলো যে যখনই নাফিস তাকে মারতে আসবে তখনই তাকে তাঁর বউ বাচ্চার মতোই পথ থেকে সরিয়ে দিতে হবে। কিন্তু অনাকাঙ্ক্ষিত কারণবসত এর পর তাঁর কোনো দেখাই পায়নি আসিফ। আজ আসিফের ব্যবসায়িক একটি নাইট পার্টি রয়েছে সিলেটের হবিগন্জে। পাহাড়ি উঁচু নিচু ঢাল বেয়ে এগিয়ে চলছে আসিফের গাড়ি। ড্রাইভার খুব সাবধানতার সহিত গাড়ি চালাচ্ছে। হঠাৎই কষে ব্রেক করলো গাড়িটি।
-কী হলো আমজাদ?
-স্যার সামনে একটা গাছ পইরা রইছে।
-চা বাগান দুইপাশে। গাছ আসলো কই থেকে এখানে?
-আমিও হেইডাই ভাবতাছি। দাঁড়ান নাইমা দেখি।
কিছুক্ষণ অতিবাহিত হয়ে গেল কিন্তু ড্রাইভারের কোনো সাড়াশব্দ পেলোনা সে। তাই নিজে গাড়ি থেকে নামতেই থমকে গেল। কারণ তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে তাঁর সেই চিরায়ত বাল্যবন্ধু নাফিস। চা বাগানের মালিক দূর রাস্তায় এক লোকের আত্মচিৎকার শুনতে পেলেন। তন্মধ্যে তাঁর দুজন এ্যাসিস্ট্যান্ট সহ রাস্তায় দৌড়ে এসে দেখেন একটি গাড়ির পাশে একজন লোক অচেতন অবস্থায় পরে রয়েছে। আরো একটু সামনে এগিয়েই দেখেন একলোকের গলা থেকে মাথাটা আলাদা করা আর লিঙ্গটাও কর্তন করা অবস্থায় পিচ ঢালা রাস্থায় রক্তাক্ত অবস্থায় পরে রয়েছে। এই প্রতিশোধ কী দুটো নিষ্পাপ জীবনের বিনিময় হিসেবে যথেষ্ট? প্রশ্নটা আপনাদের কাছেই….
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত