আড়ালে

আড়ালে
খুব ভোরবেলা শুয়েই থাকি আমি। হঠাৎ প্রিয় রিংটোন টা বেজে উঠলো, এত সকালে মায়া আমাকে কল দেবে ভাবতে পারিনি।
– হ্যালো, আসসালামু আলাইকুম।
– উমম, ওয়ালাইকুম আসসালাম। এত সকালে কল যে?
– আপনি কী এখনো ঘুমোচ্ছেন?
– হুম কেন?
– আচ্ছা শোনেন, আপনি এখন মোড়ের মাথায় আসুন আমি ওখানে আসছি।
– তুমি আসছো মানে এত সকালে কেন?
– জানিনা আসেন।
– আজব! তুমি জানো এখন কুয়াশা পড়ছে। আর কুয়াশার মাঝে মেয়েরা সেফ নয়।
– জানতাম আপনি এসব বলবেন। আমি ওখানে দাঁড়িয়ে আছি এটা কখন বললাম? বলেছি আমি আসছি। আমি রুমে রেডি হচ্ছি আপনি আসেন তাড়াতাড়ি।
– উফফ আর পারিনা। আচ্ছা দেখি।
এই হলো বাচ্চা গার্লফ্রেন্ড দুদিন পর ভার্সিটি তে যাবে এখনো বাচ্চা দের মতো স্বভাব গেলোনা। বকা যে দিবো কান্না শুরু করে দেবে নয়ত রাতের খাবার না খেয়েই শুয়ে থাকবে। আমাকে ইমোশনাল ব্লাকমেইল করে সবসময় বুঝি। দেখতে সুন্দরি আছে গুণেও সুন্দর। তবে ঝামেলা হচ্ছে বাচ্চাদের মতো করে সবসময়। এই যে সকালবেলা মায়া আমাকে কল দিলো এখন যদি আমি না যায় আজ সারাদিন মুখ গোমড়া করে থাকবে বা কোনো কথা বলবেনা। বড্ড পাগলী একটা মেয়ে।
– হ্যাঁ হ্যাঁ কই তুমি। আমি তোমার বাসার পাশে।
– আচ্ছা দাঁড়ান আমি আসছি! দারোয়ান ঘুমোচ্ছে খুব সাবধানে গেট খুলতে হবে এইজন্য বুঝলেন।
– হুম এ আর নতুন কি।
– আচ্ছা আজ আমাকে কেমন লাগছে?
– হুম ভালো তোমাকে সবসময় সুন্দর লাগে।
– হুম। আচ্ছা মাস্টারমশাই আমাকে বলেন তো এখন কেন আপনাকে ডেকে আনা হয়েছে?
– জানিনা। তুমি বলো।
– এ’মা গেস করেন কেন ডাকলাম।
– আমাকে দেখতে ইচ্ছা করছিলো এইজন্য।
– কিছুটা ঠিক তবে পুরোটা না। আপনি ফেইল মারছেন। আচ্ছা চলেন।
– কোথায় যাবা আচ্ছা আমার সাথে আপনার হাঁটতে কেমন লাগছে?
(বলেই তাকাল আমার দিকে মায়া। ওর চোখেমুখে খুশি যেন খেলা করছে। আমি চুপ করে আছি, ওর সামনে এলে কেন জানি কথা বলতে ভুলে যায় মেয়েটা বকবক করবে আরও জানি)
– আচ্ছা শুনেন, প্রতিসপ্তাহে দু একদিন আমরা এইভাবে হাঁটব কেমন।
– আচ্ছা দেখা যাবে।
– আপনার শীত লাগছেনা! আমার কিন্তু বেশ লাগছে।
– আমার জ্যাকেট খুলে দেবো? আর তোমার চাদর আমাকে দাও।
– নাহ থাক। হাত টা দেন ধরে হাঁটব।
– হুম। আমার হাত ধরতে তোমার কেমন লাগে?
– একদম পঁচা লাগে, তবুও ধরি হিহিহি।
– মায়া! তুমি বড় হবে কবে? মানে বড়দের মতো আচরণ কবে করবে?
– কখনওই নাহ। আপনি আমার পাশে থাকলেই হবে, থাকবেন মাস্টারমশাই?
– আমার এখন কফি খেতে ইচ্ছা করছে খাবে?
– এখন কোথায় পাবেন?
– কেন! রতন মামার চায়ের দোকানে। ওইযে রাস্তার পাশে সামনে গেলেই পাবো।
– আচ্ছা চলেন তবে।
– আজকের কফিটা সুন্দর ছিলোনা মায়া?
– হুম শীতের সকালে আপনার সাথে কফি খেয়ে অনেক ভালো লাগছে।
– বাহ! এবার চলো আমরা বাসায় যায়।
– হুম আরেক টু।
– নাহ চলো, তোমার কলেজ আছে না।
– আচ্ছা আমার সাথে আপনি একদিন দূরে কোথাও ঘুরতে যাবেন প্লিজ বলেন?
– সে পরে দেখা যাবে এখন এসব নিয়ে ভাবার দরকার নাই।
– ভালো কথা মনে পড়লো গতকাল আপনার জন্য একটা টিশার্ট দেখলাম অনলাইনে ওইটা আপনাকে গিফট দিবো। না করলে কিন্তু কান্না করে দেবো।
– মায়া তুমি জানো, তুমি কতটা ছেলেমানুষি করো সবসময়?
– হ্যাঁ করি, আর করব শুধু আপনার জন্য।
মেয়েটাকে বাসায় দিয়ে মোড় থেকে সামনে আগাতেই আমার হাতে একটা নীল খাম দিলেন হামিদ সাহেব। এই নীলের খামের অর্থ কেবল আমি আর হামিদ সাহেব-ই জানি। হামিদ সাহেব মায়ার বাবা। উনি আমাকে আর কিছুই বললেন না, কেবল আমার কাঁধে হাতটা রেখে একটা ভরশা করে যেন চলে গেলেন। আমি খাম হাতে আমার মেসের দিকে আগাচ্ছি। ও হ্যাঁ আমার পরিচয় দেওয়া হয়নি। আমি মেঘ অনার্স থার্ড ইয়ার, অর্থনীতির ছাত্র এজন্য হিসাব টা ভালো বুঝি।
আর মায়া হলো একটা মেয়ে যেকি’না মানুষিক রুগী। ওর বাবার অঢেল সম্পদ। মায়া দেখতেও ভিষণ মায়াবী। এবার কলেজ শেষ করে ভার্সিটি তে যাবে। বছর দুই আগে একটা ছেলের সাথে মায়ার সম্পর্ক ছিলো ওর নাম কাব্য। খুব সুন্দর ছিলো ওদের ভালোবাসা। দুজন-ই দুজন কে প্রচণ্ড ভালোবাসতো। তবে একটা ঘটনা রোড এক্সিডেন্টে ছেলেটা মারা যায়। মায়া ব্যাপার টা সামলে নিতে পারেনি। তারপর এক বছর বড়বড় ডক্টর দেখিয়েও কাজ হয়নি। একদিন আমি বৃষ্টির ভেতর ভার্সিটি শেষ করে বাসায় আসছিলাম আমার কাছে ছাতা ছিলোনা তাই কিছুটা ভিজে গেছিলাম। তবে খুব খুধা লেগেছিলো তাই মেসে আসতে বাধ্য হই। আসলে বাইরে থেকে কিনে খাবার মতো সামর্থ্য আমার ছিলোনা। একটা গাড় বাদামী রঙের জামা পরে আমার সামনে একটা মেয়ে এসে দাঁড়াল, এসেই আমাকে বলল,
– আপনি আমাকে এত কষ্ট দেন কেন? আমি কাঁদলে আপনার ভালো লাগে তাই না? মেয়েটার এই কথা শুনে আমি যেন মূর্তির মত দাঁড়িয়ে রইলাম, আর মনেমনে ভাবছি ‘ঢাকা শহরে এসব পাগল কোত্থেকে আসে, তবে দেখতে তো সুন্দরি আর বড়লোকের মেয়ে মনে হচ্ছে তবে আমাকে এসব বলে কেন?’ কোনো কথা না বলে চলে এলাম সামনে থেকে।
এর দুদিন পর একজন ভদ্রলোক আমার মেসে আসে। এসে আমাকে তার অফিসে যেতে বলে, অফিসে যাবার পর সব ঘটনা আমাকে বুঝিয়ে বলে। আমি প্রথমে রাজি হইনি। ভালোবাসা নিয়ে অভিনয়? এর থেকে বড় অপরাধ আর কী হতে পারে? জনাব হামিদ সাহেব আমার হাত টা ধরলেন বললেন ‘আমার মেয়ে আমার কলিজার টুকরা। গত একবছর কারও সাথে কথা বলেনি আজ তোমাকে দেখে বলেছে। আমি তোমার কাছে আমার মেয়ের আনন্দটুকু চাচ্ছি দেবেনা? তোমার বাবার বয়সি একজন কে ফিরিয়ে দেবে তুমি?’ তারপর চুপ করে চলে আসি। এরপরে প্রতিমাসে আমাকে নীল খামে টাকা দেয়। এখন ভালো একটা বাসাতে আমি থাকি শুনেছি এই বাসা হামিদ সাহেবের মেয়ের জন্য কিনেছিলেন। মেয়েটা কিছুতেই বুঝেনা আমি মেঘ আমি কাব্য নই। সে আমাকে কাব্য বলেই ডাকে।
ওই বললাম অর্থনীতির ছাত্র হিসাব টা ভালো বুঝি, মেয়ে সুন্দরি আমার জন্য পাগল তার উপর বাবার এত এত সম্পদ কোন ছেলে হাতছাড়া করবে? আমি দেখতে অসুন্দর নই মাশাল্লাহ তবে বাবার কোনো টাকাপয়সা নেই এই হচ্ছে সমস্যা। বড় ভাইয়া আর্মিতে আছেন, তাকে খুলে বললাম সব। ভাইয়া হামিদ সাহেবের সাথে কথা বললেন। কারণ ভাইয়া বললেন ‘সারাজীবন তো এভাবে চলেনা। মেঘ এখন জবের জন্য ট্রাই করবে জব খুঁজবে। আর আপনার মেয়ের জন্য অনেক করেছে এখন এই ব্যাপারে আপনি কী বলেন?’ হামিদ সাহেব বলেছিলেন ‘আমার মেয়ের খুশির জন্য আমি সবই করতে পারব। যেহেতু মেঘ সুদর্শন ছেলে তাই আমি আমার মেয়েকে ওর হাতেই তুলে দিতে সম্মত আশাকরি আপনারা আর অমত করবেন না’
অতঃপর আমাদের বিয়ের কথা পাকাপোক্ত হলো, মায়া আমার প্রথম ভালোলাগা। এর আগে আমি প্রেম নিয়ে কোনোদিন ভাবিনি। তবে মেয়েটাকে নিয়ে এখন ভাবি, সত্য বলতে এখন আমি মায়াকে আমার মায়া বলেই দাবী করি। আর নিজের নাম টা এখন “কাব্য মাহমুদ মেঘ” করে ফেলেছি যাতে মায়া ধরতে না পারে। এখনো আমাদের দেখা হয়, সেই আগের মতো ফুচকা খাবার জন্য বাহানা করে, সেই আগের মত আমাকে শপিং করে দেয়। আমি মায়াকে বুজিয়ে বলেছি ‘মায়া জানো তুমি আমাদের বিয়ের কথা হচ্ছে, তুমি কী বিয়ের জন্য তৈরি বা ম্যাচিউর’ মায়া চুপচাপ থেকে বলে, আপনি তো আচ্চা বোকা মানুষ। বাবা কী এখুনি বিয়ে দেবেন বলেছেন নাকি? আমি যখন স্টাডি কম্পিলিট করব ঠিক তখন। এখন বিয়ে দিবে নাকি। আপনি এসব এখুনি কেন ভাবছেন চলেন আজকে আইসক্রিম খাবে।
মেয়েটার মাঝে এখনো ছেলেমানুষি অনেক। এই মেয়েটাকে আমি কতদিন-ই বা চিনি। তাকে বিয়ে করা ঠিক হবে? আমি কী কোন অন্যায় করছি? আমি আমার বিবেক কে বারবার প্রশ্ন করেছি। হ্যাঁ অন্যায় কেন বলিনি ভালোবাসার সেই কাব্য আমি নই। কেন তাকে ঠকাচ্ছি? তার ভালোবাসা নিয়ে খেলার অধিকার নিশ্চয় আমার নেই, তবে কেন?
আবার ভাবছি, আমি মায়াকে সব বলে দিলে মানুষিক ভাবে আবার ভেঙ্গে পড়বে হয়ত আর বাঁচানো যাবেনা এবার। কাব্য যে দুনিয়াতে আর নেই এটা ধ্রুব সত্য। একটা মিথ্যে যদি একটা প্রাণ বাঁচিয়ে রাখে একটা পরিবারের হাসির কারণ হয় তবে সেই মিথ্যা কখনওই দোষের না। মায়ার বাবা জনাব হামিদ সাহেব ভালো একজন মানুষ অঢেল টাকা থাকা সত্বেও মেয়ের জন্য পাগল। না না আমি কোনো সুযোগ নেইনি তো। নীল খামের ব্যাপার টা তারা আমাকে দিয়েছে। তাছাড়া আমি শুধু শুধু কেন এসব করব? যখন মায়ার ইমোশনের যায়গা টা বুঝতে পারলাম তখন কিন্তু নীল খাম আমি ফেরত দিয়েছি। আমি একজন খাটি প্রেমিক হতে চেয়েছি, মধ্যবিত্ত প্রেমিক যেমন হয় আমি তেমন হতে চেয়েছি।
অপেক্ষা কবে টিউশনির বেতন দেবে, অল্পকিছু টাকা, তারপর তার সামনে এক বাক্স চুড়ি কিনে হাটু গেড়ে বসে বলা ‘মায়া আমি কিছু জানিনা জানতে চাই না। আমি কিছু মানতেও চাই না। তোমার কিছু থাক না থাকা সব বাদ, আমি শুধু তোমাকে চাই, সারাজীবনের জন্য তোমাকে আমার করে পেতে চাই। আমি মধ্যবিত্ত পরিবারের খুব সাধারণ এক ছেলে, তুমি কী সারাজীবন আমার পাশে থাকবে আমার মায়াবতী হয়ে? কথা দিচ্ছি মৃত্যু ছাড়া আর কিছুই আমাদের আলাদা করতে পারবেনা। তুমি কী আমার পাশে থাকবে?’ মায়া সেদিন আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করেছিলো। আমি বুকের ভেতর এক প্রশান্তি অনুভব করলাম, খুঁজে পেলাম আমার প্রকৃত ভালবাসা। মেয়েটাকে রেখে দিলাম আমার কাছে। ওকে কলেজে ড্রপ করে আমার ভার্সিটি তে ক্লাস। একদিন মায়ার বাবার দয়ার বাসা টা ছেড়ে দিলাম, ভেবেছিলাম নিজের যোগ্যতায় নিজে মায়াকে কাছে টানবো। ভেবেছিলাম আমার অভাবের দিনে মায়াকে আমি পাবো। আমার মন খারাপের দিনে মায়াকে পাবো। সব খারাপ লাগার দিনে মায়াকে পাবো আমি।
দেখতে দেখতে তিনটা বছর চলে গেলো। মায়া এখন বড় হয়েছে, সেই ছেলেমানুষি আর নেই। এখন সে অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। আর আমি মাস্টার্স শেষ করা এক বেকার। শহরের এই প্রান্ত থেকে ওই প্রান্ত জবের জন্য আমি ব্যাকুল। ভেবেছিলাম মেয়েটা আমাকে ছেড়ে চলে যাবে। আমার কিছুই নাই এখন! সুন্দর ক্যারিয়ার, টাকাপয়সা কিচ্ছু না। এই তো সেদিন মায়াকে বললাম ‘তুমি নাহয় আমাকে ভুলে যাও, দেখো আমার যে কিছুই হচ্ছেনা আমাকে দিয়ে কিছু হবেনা’ মেয়েটা আমার চোখের দিকে তাকিয়ে ছিলো কেবল আর কিছুই বলেনি। শুধু বুঝেছিলাম ওর ভেজা চোখে আমার চোখ মিশে গেছে। মায়ার বাবার গাড়ি আছে তবুও আমার সাথে হেঁটেহেঁটে বাড়ি যাবে। আমার সাথে হাঁটতে নাকি ওর ভিষণ ভালো লাগে।
বেকারত্ব তখনো আমাকে ছাড়েনি এদিকে অল্পকিছু টাকা জমিয়ে মায়ার জন্য সামান্য কিছু কিনে দেবার মাঝে আমি আনন্দ খুঁজে পাই। আর মায়া খুঁজে পায় কেবল ভালোবাসা। গভীর এক সাগর ভালোবাসা। মায়াকে দেখেছি আমার দেওয়া কমদামী সবকিছু ব্যবহার করতে, ও চাইলে দামীসব ব্রান্ডের কসমেটিক্স ব্যবহার করতে পারে।
একদিন বলেছিলাম মায়া হেসে হেসে বলেছিলো ‘বিয়ের পর যখন বেতন পাবেন প্রতিমাসে তখন আমাকে এভাবে কিনে দেবেন হুম? আমি তখন সেগুলোই পরব। কারণ বিয়ের পর আপনি-ই তো সব কিনে দেবেন তাই পরার অভ্যাস করছি, আমার ভালোই লাগে জানেন’ আমি মেয়েটার কথা শুনে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি। মেয়েটা লজ্জা পায় আমার তাকানো দেখে।
এখন অপেক্ষা করি একটা জব হবার। তারপর মায়াকে আমার ছোট্ট ঘরের লক্ষ্মী বউ বানানোর। লাল টুকটুকে একটা শাড়ি পরে আমার ঘরের বউ হয়ে আসবে। প্রথম আমি সেদিন মায়াকে বুকের সাথে জাপ্টে ধরব আমার অনেক দিনের স্বপ্ন। জাপ্টে ধরে বলবো, ‘ভালোবাসি তোমাকে বলা হয়নি ছিলো সব আড়ালে, অবেলায় কেন কাব্যকে হারালে’
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত