আমার মা ছিলেন এক হিন্দু পরিবারের সন্তান। ভার্সিটি লাইফে বাবা আর মা ছিলেন বেস্টফ্রেন্ড। বেস্টফ্রেন্ড বললে ভুল হবে আসলে বন্ধুত্বের বন্ধন যদি কোন কিছু দিয়ে তুলনা করা যেত তাহলে তার সর্বোচ্চ পর্যায়ে ছিলেন তারা। আমার মায়ের মুখ থেকে যতটুকু শুনেছি যে ভার্সিটির প্রথম দিক থেকেই বাবা ছিলেন খুব শান্ত স্বভাবের। আর বাবার এই গুণটিই নাকি মাকে অনেক আকৃষ্ট করেছিল। ঢাকা ভার্সিটির উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের স্টুডেন্ট ছিলেন তারা। ক্লাসের সকল স্টুডেন্টরা যেসময় আড্ডামাস্তিতে ব্যস্ত থাকতেন তখন নাকি বাবা বসে বসে উপন্যাস পড়তেন। বাবার এরকম নিস্তেজ ভাব থাকার কারণে ক্লাসের তেমন কেউই বাবার সাথে কথা বলতেন না। কিন্তু ফাষ্ট সেমিস্টার পরীক্ষায় যখন বাবা ডিপার্টমেন্টের সবাইকে তাক লাগিয়ে প্রথম হয়ে জান তখনই বাবার প্রতি অন্যদের আগ্রহ বাড়তে থাকে। তখন আমার মায়ের নাম ছিল মৌমিতা রায়।
বাবার এসব ভালো গুণ দেখে আমার মাই আগে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। দাদির মুখ থেকে শুনেছি আমার বাবা নাকি ছোটবেলা থেকেই খুব ধার্মিক প্রকৃতির লোক ছিলেন। কখনো এক ওয়াক্ত নামাজও কাজা করেননি। তবুও বাবা কী ভেবে যেন আমার মায়ের সাথে বন্ধুত্ব করেছিলেন আর সেটা এখনো রহস্যই রয়ে গেছে। তো যাই হোক, এভাবেই চলছিল তাদের ভার্সিটি লাইফগুলো। আমার মা খুবই কৌতুহলপরায়ণ মহিলা ফলস্বরূপ তার সবকিছু সম্বন্ধে জানার আগ্রহটাও একটু বেশি। তাই তিনি বিভিন্ন সময় বাবার নিকট ইসলাম সম্পর্কে জানতে চাইতেন।
বাবাও পড়ালেখার পাশাপাশি মাকে ইসলাম সম্পর্কে বিভিন্ন ধারণা দিতেন। বাবার কথাবার্তা এবং চালচলনে আমার মা প্রতিনিয়তই অবাক হতেন। একসময় বাবাকে নিজের মনের কুঠিরে জায়গাও দিয়ে ফেলেন। কিন্তু মায়ের সংকোচ ছিল কীভাবে ভিন্ন দুটি ধর্ম ও সমাজের দেয়াল ভেদ করে আমি তাকে ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটাবো। কারণ এটা কখনোই দুই দিকের সমাজ খুব সাধারণের সহিত গ্রহণ করবে না। এভাবে বাবার প্রতি মায়ের ভালোবাসা ক্রমেই দৃঢ় হচ্ছিল কিন্তু তিনি কখনো সেটা প্রকাশ করার সাহস পেতেন না। ভার্সিটি লাইফের শেষ দিন যখন সবাই বিদায় নেবে সেদিন কার্জন হলের সামনের চত্ত্বরে মা বাবাকে একান্ত কথা বলার জন্য নিয়ে আসেন। তখনকার কার্জন হল এখনকার মতো এতো গোঁছালো ছিলনা, ছিল জঙ্গলের মতো। তো বাবা বললেন,
-কিছু বলবে মৌমিতা?
-না আসলে..
-আরে নিঃসংকোচে বলে ফেলো আমরাতো এতোদিন বেষ্টফ্রেন্ডই ছিলাম। আমার মা তখন চোখ বন্ধ করে এক নিঃশ্বাসে বলে ফেলেন,
-আসলে আমি জানিনা ভালোবাসা কী জিনিস! তবে আমি খুব করে অনুভব করছি আমার মনের কুঠিরে কেউ একজন বাস করছে। আর সেই কেউটা যে তুমি তাতে কোন সন্দেহ নেই। আমি তোমার জন্য ধর্ম ছাড়তেও রাজি আছি। তুমি কী আমাকে গ্রহণ করবে? বাবা নাকি সেদিন উত্তল লেন্সের চশমাটি ঠিক করতে করতে মায়ের দিকে অবাক নয়নে তাকিয়ে ছিলেন। কিছুক্ষন নিরবতার পর বাবা বললেন,
-হুম সবই ঠিক আছে তবে আমি চাইনা তুমি আমার জন্য নিজের ধর্ম, বাবা মা ও সমাজকে ত্যাগ করো। কারণ আমি যদি তোমাকে গ্রহণ করি এবং পরবর্তীতে তোমার কিছু হয় তবে আমি সবার নিকট তোমার জন্য দায়বদ্ধ থাকবো। তুমি যদি আমার জন্য সবকিছু ত্যাগ না করে স্বইচ্ছায় ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করো তবে আমি তোমাকে গ্রহণ করতে রাজি আছি। আমার মা সেদিন খুব কষ্ট পেয়েছিলেন এই ভেবে যে বাবা কী তাকে পরোক্ষভাবে রিজেক্ট করলো নাকি ঝুলিয়ে রাখলো? কয়েকদিন পর বাবা মা পুনরায় দেখা করেন এবং আমার মা সম্মতি জানান যে তিনি আগে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে চান তবে সেটা কেবলমাত্র বাবার ভরসাতেই। কারণ ধর্মান্তরিত হলে তখন আমার মাকে তার পরিবার কোন ভাবাভাবি বাদ দিয়েই ত্যাজ্য করে দিবেন।
আমার বাবা যেরকম ধার্মিক ছিলেন তেমনি তিনি আমার দাদা দাদি ব্যতীত কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হতেন না। তাই তিনি দাদা দাদির নিকট মাকে নিয়ে গিয়েছিলেন। বাবা ভেবেছিলেন হয়তো দাদা দাদি মাকে গ্রহণ করবেনা। কিন্তু দাদা দাদি যখন জানতে পারলেন তাদের ছেলের জন্য একটি মেয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করবে তখনি মাকে দাদি জড়িয়ে ধরে খুব সাদরে গ্রহণ করেছিলেন। আমার মা সেদিন এই প্রাপ্তির আনন্দে অশ্রু বিসর্জন দিয়েছিলেন আর ভাবছিলেন হয়তো আমি নিজের পরিবার, ধর্ম ও সমাজ ত্যাগ করে ভুল স্থানে পতিত হইনি। সেদিনই নাকি বাবা মায়ের ঘরোয়াভাবে বিবাহ সম্পন্ন হয়। আমার দাদা ছিলেন খুবই বুদ্ধিমান লোক তিনি জানতেন বিয়ের জন্য যদি অপেক্ষা করা হয় তাহলে মাকে হয়তো তার পরিবারের লোকজন জোরপূর্বক নিয়ে যাবে। যখন বিয়ের খবরটা মায়ের পরিবারের নিকট চলে যায় তখন তারা পুলিশ নিয়ে দাদাবাড়িতে আসেন মাকে নিয়ে যেতে। কিন্তু পরিবারে ফিরে যেতে মায়ের সম্মতি না থাকায় এবং বিবাহের কাবিননামা পুলিশকে দেখানোর পর তারা নিরুপায় হয়ে চলে যায়। যাওয়ার সময় তারা ধর্মান্তরিত হওয়ার কারণে মাকে ত্যাজ্য করে দিয়ে জান।
মা সেদিন খুব কেঁদেছিলেন কেননা পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার কষ্ট তারাই বুঝবে যারা বিচ্ছিন্ন হয়েছে। সেদিন দাদি মাকে জড়িয়ে ধরে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে, তোমাকে আমি কোনদিনও কষ্ট দিবোনা নিজের মেয়ের থেকেও তোমাকে বেশি স্নেহ করবো। দাদি সেদিন বাবাকে দিয়েও প্রতিজ্ঞা করিয়েছিলেন যে বাবা এরকম কোন কাজ যেন না করে যাতে আমার মা কষ্ট পায়। বাবাও সেদিন দাদির প্রতিজ্ঞায় সায় দিয়েছিলেন। সত্যি কথা বলতে আমার জন্মের পর আমি কখনো বাবাকে মায়ের প্রতি কোন খারাপ আচরণ করতে দেখিনি। বাবা হয়তো দাদির কথা রেখেছেন তবে আজ আমার সেই প্রাণপ্রিয় দাদি আর নেই। তিনি পাড়ি জমিয়েছেন অন্ধকার কবরে। এখনো প্রতি ভোররাতে আমি উঠে দেখি মা তাহাজ্জুদ নামাজের পর জায়নামাজে বসে আল্লাহর কাছে দুহাত তুলে নিজের অশ্রু বিসর্জন দেন। আমি কৌতুহলের বসে মাকে প্রশ্ন করি,
-মা তুমি প্রতিদিন ভোররাতে কার জন্য দোয়া করে কাঁদো?
-তোমার দাদির জন্য। যার ভালোবাসা না পেলে হয়তো আজ আমি এই সুখময় প্রাপ্তির স্বাদ পেতাম না, যার প্রতিজ্ঞা তোমার বাবা গ্রহণ না করলে হয়তো আজ আমি ভালোবাসা পেতাম না, যার স্নেহ না পেলে হয়তো আমি কখনো প্রকৃত মায়ের আদর উপলব্ধি করতে পারতাম না, যে আমাকে ধর্মশিক্ষা না দিলে হয়তো আমি আজ ধর্মভীরু হতে পারতামনা। তার জন্যই দোয়া করি যাতে আল্লাহ তাকে জান্নাত নসিব করেন।
গল্পের বিষয়:
গল্প