শাওন! আই এম প্রেগন্যান্ট” শাওনের সাথে দেখা হওয়ার পর থেকেই নাহার কথাটা বলার জন্য হাঁসফাঁস করছিলো। সে বুঝে উঠতে পারছিলো না, কথাটা কিভাবে বলবে। অনেক্ষণ যাবত বলতে গিয়েও বলতে পারেনি। যখনি বলতে যাবে ঠিক তখনি আবার শাওন কিছু না কিছু বলতে শুরু করে। এভাবেই অনেক সময় কেটে যাওয়ার পর সে শাওনের কথার মাঝ পথেই বলে ফেলল, “শাওন! আই এম প্রেগন্যান্ট!” কথার মাঝ খানে শাওনের হাই উঠেছিলো। নাহার কথা শুনে এমতবস্থাতেই সে থেমে গেলো। মুখও বন্ধ করতে পারছিলো না। দশ-পনেরো সেকেন্ড সে হা করে-ই রইলো। তার বিস্ময় কাটতেই পাশে রাখা পানির বোতলটা নিয়ে পানি খেলো, “চলো উঠি!” পানির বোতলের মুখটা ঘুরাতে ঘুরাতে শাওন বলল। নাহার কিছু বলল না। শাওনের সাথে সেও উঠে হাঁটতে শুরু করে। কিছুদূর যাওয়ার পর নাহার তার ডান হাতের কাই আঙ্গুল দিয়ে শাওনের কাই আঙ্গুলে ধরলো, “কিছু বললে না তো!”
“কি ব্যাপারে?”
“কিছুক্ষণ আগে যে বললাম।”
“অহ!” শাওন নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বলল, “বুঝতেসি না কি বলবো।
এক দিকে যেমন বাবা হওয়ার আনন্দে মনটা ভরে উঠছে। খুশিতে নাচতে ইচ্ছে করছে। অপর দিকে ঠিক একইভাবে হাতাশা গ্রাস করে নিচ্ছে। এখনো তো ক্যারিয়ার গড়া হলো না। এখনি যদি বাবা হয়ে যাই কিভাবে কি করবো! বিয়েও করা হয়নি। সমাজের মানুষ কী বলবে। আচ্ছা আমি তোমাকে ভেবে বলি, কী করবো!” নাহার শাওনের কাই আঙ্গুলটা ছেড়ে দিয়ে বলল, “আচ্ছা ঠিক আছে।” নাহার একটা রিক্সা ডাক দিয়ে উঠে পরলো। শাওন উঠতে চাইলে নাহার বলল, “তোমার যাওয়া লাগবে না। আমি একা যেতে পারবো।”
নাহার রিক্সাওয়ালার কাঁধে হাত দিয়ে বলল, “মামা! আপনি যান!” শাওন আর দাঁড়ালো। নিজ গন্তব্যে হাঁটা দিলো। পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে ধরিয়ে আপন মনে হাঁটতে লাগলো। গভীর রাত। নাহারের মন খারাপ। বারান্দায় ইজি চেয়ারটায় বসে বই পড়ছে। তার মন খারাপ থাকলে সে বই পড়ে। নিজের বেদনা বইয়ের পাতার সাথে মিশিয়ে দেয়। বিকালের কাহিনিটা সে এখনো ভুলতে পারছে না। সে ভেবেছিলো শাওন খুশি হবে। কিন্তু তার পুরো উল্টোটা হলো। সে চাইলে শাওনের মুখের উপর বলে দিতো পারতো, তোমার সিদ্ধান্ত জানতে চাইনি। তুমি বাবা বলে শুধু মাত্র খবরটা তোমাকে জানানোর জন্য বলেছি। কিন্তু সে বলেনি। নিজেকে ঠান্ডা রেখেছে। সে দেখতে চায়, শাওন এ ব্যাপারে কী বলে।
প্রায় রাত তিনিটা বাজে নাহারের ফোন বেজে উঠে। শাওনের মেসেজ। ‘নাহার! এবোরশন করে ফেলো! এখনি আমাদের বাচ্চা নেয়াটা ঠিক হবে না।’ নাহার মেসেজটা পড়ে মোবাইলটা পাশে রেখে কিছুক্ষণ দম ধরে বসে রইলো। তারপর অনেক ভেবেচিন্তে মোবাইলটা নিয়ে কাঁপা কাঁপা হাতে লিখলো, ‘শাওন! আমি তোমার সিদ্ধান্ত জানতে চাইনি। আমি খুশির সংবাদটা শুধুমাত্র তোমার সাথে শেয়ার করেছি। এর বেশি কিছু নয়। এক মাস তোমার হাতে সময় আছে। চাইলে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে ফিরে আসতে পারো।’
বেশ কিছু বছর পার হয়ে গেছে। নয় বছর হবে। শাওন বিয়ে করেছে। এরপর আর কোনোদিন নাহারের সাথে যোগাযোগ হয়নি। সে-ই যোগাযোগ করেনি। নিজের ক্যারিয়ারের চিন্তা করে-ই ঐ ঝামেলা থেকে সরে এসেছে। ক্যারিয়ার গঠনের পর নাহারের সাথে যোগাযোগ করতে চেয়েছিলো। কিন্তু কোথাও নাহারের সন্ধান পায়নি। তারপর বিয়ে করে ফেলেছে। তিন-চার বছর হয়েছে বিয়ে করেছে। এখনো বাচ্চা-কাচ্চা হয়নি। অনেক ডাক্তার দেখানোর পরও কোনো উপকার হয়নি। তার কোন এক বন্ধু বলেছে যে তার পাশের এলাকাতে এক চেম্বারে স্বামী-স্ত্রী দুইজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার বসেন। অনেক ভালো ডাক্তার তাদের থেকে চিকিৎসা নিয়ে অনেকে উপকৃত হয়েছে।
সেও ভেবেছে তাদের চিকিৎসার জন্য ঐ চেম্বারে একবার যাবে। এবার কোন ফায়দা হলে হবে না হলে কোন সন্তান পালক নিয়ে সারা জীবন কাটিয়ে দেবে। ডাক্তার চেম্বারের সামনে দাঁড়িয়ে মহিলা ডাক্তারের নামটা পড়তেই শাওনের বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো। কামরুন নাহার। ডাক্তারের সাথে দেখা করার জন্য তার মনটা কেমন জানি করতে লাগলো। কিন্তু ঐদিন আর তার মহিলা ডাক্তারের সাথে দেখা করা হলো না। কারণ তার যেতে হয়েছে পুরুষ ডাক্তারের কাছে। তার আগের চিকিৎসার সব ফাইল দেখে নিশ্চিত হওয়ার জন্য তাকে আবার কিছু পরীক্ষা করতে বলে দেয়া হলো।
তার স্ত্রীকেও ডা. কামরুন নাহার বেশ কিছু পরীক্ষা দিয়েছেন। ডাক্তার দেখানো শেষে দুজন-ই চেম্বার থেকে বেরিয়ে পরলো। অনেক চেষ্টা করেও শাওন ডা. কামরুন নাহারকে দেখতে পারেনি। দু-দিন পর রিপোর্ট নিয়ে শাওন চেম্বারে হাজির হলো। এবার তার অপেক্ষার অবসান ঘটেছে। ডা. কামরুন নাহার স্বামী-স্ত্রী দু-জনকেই ডেকেছেন। রুমে ডুকতেই শাওন এর বুকে চিনচিন ব্যথা অনুভুত হলো। তার সন্দেহ-ই সঠিক। আট-নয় বছর আগে ফেলে আসা মেডিকেল স্টুডেন্ট কামরুন নাহার-ই আজকের এই ডা. কামরুন নাহার। নাহারকে দেখে শাওন কিছু বলতে চাচ্ছিলো কিন্তু নাহার তাকে কোনো সুযোগ না দিয়েই বলল, “আপনার স্ত্রীর কোনো সমস্যা নেই। সে সম্পূর্ণ সুস্থ। আপনাকে দেয়া ডা. দিমানের পরীক্ষাগুলো করিয়েছেন?”
“জি।”
“দেখি!”
শাওন ফাইলটা নাহারের দিকে বাড়িয়ে দিলো। ফাইলটা দেখে নাহার বলল, “অতিরিক্ত ধুমপানের কারণে আপনার শুক্রাণুতে শুক্রকিটের পরিমাণ কমে গেছে। যার ফলে আপনার বাচ্চা হচ্ছে না।” শাওন কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। তার চোখে পানি জমে গেলো। মনে হচ্ছে এখনি সে কেঁদে দিবে। ডান হাত দিয়ে চোখের পানি মুছে উপরের দিকে তাকাতেই নাহার বলল, “আপনি কাল এসে একবার ডা. দিমানকে আপনার রিপোর্টটা দেখান! সে আপনাকে পরামর্শ দিবে।” “আজ দেখানো যাবে না?” শাওনের ভয়েস টোনে স্পষ্ট ফুটে উঠেছে যে কষ্টে তার বুক ফেটে যাচ্ছে। কিন্তু প্রকাশ করতে পারছে না। নাহার বুঝেও না বুঝার ভান করছে। তা দেখে শাওনের চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছা করলো। কিন্তু কিছু করার নেই। সে অনেক কষ্টে নিজেকে সংযত রাখছে।
“না আজ পারবেন না। আজ উনার একমাত্র মেয়ের স্কুলে প্রোগ্রাম। সেখানেই গিয়েছেন। আপনার কাল আসতে হবে।”
“ম্যাম! আপনার মেয়ের বয়স কত?” শাওনের চোখ পানিতে আবার ছলছল করে উঠলো।
“প্রায় ন’বছর!”
শাওন আর সহ্য করতে পারলো না। ফাইলগুলো হাতে নিয়ে চেম্বার থেকে দৌড়ে বেরিয়ে পড়লো। পিছু পিছু তার স্ত্রীও বের হয়ে আসলো। রিক্সায় উঠে শাওন সিগারেট ধরাতেই তার স্ত্রী বলল, “তুমি আবার সিগারেট খাচ্ছো! মাত্র-ই ডাক্তার কী বলল, শুনোনি?”
শাওন সিগারেটটা হাত থেকে ফেলে দিয়ে তার স্ত্রীর ডান হাতটা মুঠ করে ধরে বলল, “ললিতা! আমি কখনো-ই সিগারেট ছাড়তে পারবো না। আমার বাবা হওয়ার ইচ্ছাটাও আজ মরে গেছে।” সে ফাইলগুলো ফেলে দিলো, “তুমি আমার থেকে ডিভোর্স নিয়ে আরেকটা বিয়ে করো। মা হও! প্লিজ আমাকে ছেড়ে চলে যাও! আমি চাইনা আর বাবা হতে! প্লিজ তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যাও” বলতে বলতে শাওন ডুকরে কেঁদে উঠলো।
গল্পের বিষয়:
গল্প