টানা ১১টি ইন্টারভিউ দেবার পর অবশেষে একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে আমার ডাক পরলো ৷ জয়েনিং লেটার হাতে পেয়েছি ৷ সামনের সপ্তাহে চাকরিতে জয়েন করতে হবে ৷ তবে তারা একটি শর্ত দিয়েছে, শর্তটা আমাকে অবশ্যই পূরণ করতে হবে, তবেই চাকরি পাবো ৷ কিন্তু সমস্যা হলো শর্তটার কথা লেটারে উল্লেখ্য নেই, তবে সামনের সপ্তাহে অফিসে গেলেই জানা যাবে ৷ টাকা সম্বলিত কোনো শর্ত যে নয় এটা নিশ্চিত!, কাঙ্খিত দিনক্ষণ অনুযায়ী অফিসে গিয়ে উপস্থিত হলাম ৷ স্বয়ং কোম্পানির মালিক অমিত চৌধুরী আমাকে তার অফিসরুমে ডাকলো ৷ গেলাম তার রুমে ৷ কোনোরকম উদ্বিগ্নতা ছাড়া জরতাহীনভাবে তার সাথে কথা বলতে লাগলাম এবং, তার কথা মন দিয়ে শ্রবণ করলাম ৷ একপর্যায়ে কোম্পানির মালিক বলে উঠলেন,
-তোমার চাকরি কনফার্ম হয়ে যাবে যদি আমার একটা শর্ত মানো ৷ আসলে শর্ত নয়, ওটাকে বলে প্রস্তাব! হকচকিয়ে উঠে বললাম,
-প্রস্তাব! কি রকমের প্রস্তাব? অমিত চৌধুরী মৃদ্যু হেসে গম্ভীর গলায় বললো,
-আমার বোনকে বিয়ে করতে হবে ৷
হতভম্ব হয়ে গেলাম ৷ এমতাবস্থায় আমি যেনো পাথর হয়ে আকাশ থেকে থপাস করে পরলাম ৷ এটা কি শুনলাম আমি? আমার কান কি সত্যিই এমনকিছু শুনেছে? কানকে বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে ৷ হয়তো আমি স্বপ্ন দেখছি ৷ স্বপ্নই হবে । বাস্তবে এমন কিছু ঘটার কোনো সম্ভাবনা নেই । চমকে উঠলাম, যখন অমিত চৌধুরী বলে উঠলো, কী ব্যাপার থম মেরে গেলে কেন ? আমার প্রস্তাবে তুমি কি রাজি নও? মৃদ্যুভাবে কেশে বললাম, দেখুন আপনি কি বলতে চাচ্ছেন আমি কিছুই বুঝতে পারছিনা । আমি তো আপনার কোম্পানির কর্মচারী হতে যাচ্ছি ৷ আমাকে কেন আপনার বোনের হাজবেন্ড বানাতে চাচ্ছেন? এটা কি হয় বলেন? আপনার বোন তো ডিজার্ভ করে আপনার মত কোনো শিল্পপতির ছেলেকে!
-এতো কথা শুনতে চাইনা ৷ তুমি বিয়েতে রাজি কিনা শুধু এতোটুকু বলো ৷
-আপনি কি সত্যি চাচ্ছেন আপনার বোনকে আমি বিয়ে করি?
-তোমার কি মনে হচ্ছে ফাইজলামী করছি আমি?
-না না, তা মনে হবে কেন?
-তাহলে এমন প্রশ্ন করছো কেন?
-ঠিকআছে, আমি রাজি আছি ৷ কিন্তু এর আগে আপনার বোনকে আমি দেখতে চাই!
-দেখবে, বিয়ের দিনই দেখবে ৷ তুমি যা ভাবছো সেরকম কোনো সমস্যা নেই আমার বোনের ৷ সে সবদিকে পারফেক্ট ৷ সুন্দরী, গুণবতী ও সুশিক্ষিত মেয়ে ৷ শারিরিক বা মানসিক কোনোরকমের সমস্যা নেই তার!
-আশ্চর্য! এরকম একটি মেয়ের জন্য আমাকে কেন সিলেক্ট করছেন বুঝছিনা ৷ আমি তো তার সম-কক্ষের না! তাছাড়া, আপনি তো আমার সম্পর্কে তেমন কিছুই জানেন না ৷ কাগজে কলমে যা লিখা আছে সেটুকুতে তো আমার পরিচয় সীমাবদ্ধ নয় ৷ আমি তো ভালো ছেলে নাও হতে পারি ৷ আমার একদিনের ইন্টারভিউতে কিভাবে বুঝলেন যে আমি আপনার বোনের জন্য উপযুক্ত?
-উপযুক্ত বলেই তোমাকে বেছে নিয়েছি ৷ এবং তোমার সম্পর্কে যথেষ্ঠ ইনফরমেশন পেয়েছি আমরা ৷ ওতেই যথেষ্ঠ!
-এটা কি আপনার একার সিদ্ধান্ত? আপনার বোন কি বিয়েতে রাজি আছে?
-তার কথামতই তোমাকে বেছে নেওয়া হয়েছে!
-কি বলেন? তারমানে সে কি আমাকে চেনে?
-সেরকমভাবে চেনে না, তবে ইন্টারভিউয়ের দিন সে তোমাকে দেখেছে ৷ এর আগে সে তোমাকে দেখেছিলো কিনা আমার জানা নেই!
-প্লিজ, আমি তার সাথে কথা বলতে চাই!
-কিন্তু সেটা সম্ভব নয়!
-কিন্তু কেন?
-কালকে তোমাদের বিয়ে অনুষ্ঠিত হবে ৷ বিয়ের রাতে তার সঙ্গে তুমি দেখা করতে পারবে, এর আগে নয়!
-আচ্ছা, যদি আমি বিয়েতে মত না দেই?
-সহজ হিসাব, তোমার চাকরিটা হবেনা ৷ শুধু আমার কোম্পানিতেই নয়, কোনো কোম্পানিতেও না!
-তারমানে আমাকে নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে যেতে হবে?
-যদি এমনটাই মনে করো,তবে তাই!
-ঠিকআছে, বিয়েতে রাজি আমি!
-তোমার বাসায় এখনই রওনা দিবো আমরা, তোমার বাবা, মায়ের সাথে কথা বলবো চলো!
শেষপর্যন্ত সামিয়াকে বিয়ে করে নিলাম ৷ রাত ১০টার দিকে বাসর ঘরের দিকে রওনা দিলাম ৷ রুমে ঢুকলাম ধীর পায়ে ৷ সামিয়ার দিকে দৃষ্টি দিলাম ৷ সে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বসে আছে ৷ আমি কিঞ্চিৎ উদ্বিগ্ন ভাব নিয়ে বেডে বসলাম ৷ সামিয়া অকস্মাৎ, বলে উঠলো,
-আচ্ছা, আপনি এতো সহজে বিয়েতে রাজি হলেন কি করে ? আপনি কি সত্যটা জানতেন না? অবাক হয়ে জিজ্ঞেসা করলাম,
-কি সত্য? বুঝতে পারছিনা কি বলছেন?
-ও, তারমানে ভাইয়া আপনাকে বিষয়টা খুলে বলেনি!
-কোন বিষয়টা?
-আমি যে ধর্ষিতা, সেটা জানতেন না? স্তম্ভিত হয়ে চোখদ্বয় গোলগোল বানিয়ে বললাম,
-কিহ? আমাকে তো এটা জানানো হয়নি!
-তো, এখন কি করবেন?
-সত্যিই কি আপনার সঙ্গে ওরকম অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটেছে?
-আমি ধর্ষিতা, এটা জানার পর আপনি আমাকে স্ত্রী হিসেবে মেনে নিতে রাজি আছেন কিনা শুধু এতোটুকু বলেন!
-বিয়ে যেহেতু করেছি সেহেতু আপনাকে স্ত্রী হিসেবে মেনে নিতে আমার কোনো আপত্তি নেই ৷ আর ধর্ষিতা মেয়েকে স্ত্রী হিসেবে মেনে না নেবার কোনো কারণ তো দেখছিনা ৷ এখানে আপনার তো কোনো দোষ নেই ৷ একজন জানোয়ারের অপরাধের জন্য আপনি কেন শাস্তি পাবেন? সমাজে এমন অনেক মেয়ে রয়েছে যারা বিয়ের আগে একজনের সঙ্গে ফিজিক্যালি রিলেশন করে অন্যজনকে বিয়ে করে ৷ আপনি তো সেরকমটা করেন নি ৷ আপনি ওরকম কিছু করলে তখন হয়তো ব্যপারটা নিয়ে আপত্তি করতাম! সামিয়া মিহি হেসে বললো,
-সত্যি একটা কথা বলি,আমি ধর্ষিতা নই ৷ আপনাকে পরীক্ষা করতে এই মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছি ৷ আর হ্যাঁ, শুধু আপনার সঙ্গে নয় আমার ভাইয়ের সঙ্গেও এই মিথ্যা নাটকটা সাজিয়েছি ৷ আমার ভাই বিশ্বাস করে যে আমি ধর্ষণ হয়েছি ৷ আজ থেকে ২ মাস ১৫ দিন আগের ঘটনা ৷
ভাইয়ার মনে মনুষত্ব্যবোধ জাগাতে রাত ১০টার দিকে বাসায় ফিরেছিলাম ছেঁড়াকাটা পোশাকে, গায়ে নখের আঁচর কেটে জখম করেছিলাম যাতে তার নিকট ব্যাপারটা বাস্তবিক মনে হয় ৷ আমার গাড়ির ভেতরে এতোকিছু করে বাসায় ফিরি ৷ ভাইয়া আমাকে এমনরুপে দেখে নানারকম প্রশ্ন করতে থাকে ৷ এমন কেন হলো এটাও বলে! ভাবী আর মা আমার বিষয়টা বাস্তব মনে করে ভাইয়াকে জানিয়ে দেয় ৷ ভাইয়া সিদ্ধান্ত নেয় মামলা করবে ধর্ষকের নামে ৷ জবাবে আমি বলি ধর্ষকের নাম ঠিকানা আমার জানা নেই, তার চেহারা মুখোস দিয়ে ঢাকা ছিলো ৷ একথা শুনে ভাইয়া মামলা করার সিদ্ধান্ত পাল্টায় ৷ ধর্ষণের নাটক করার পরদিনই ভাইয়া বদলে যায় ৷ সে তার শালিকাকে ধর্ষণ করার যে প্ল্যান করেছিলো সেটা সে ভুলে যায় ৷ আমি এটা জানতে পেরেছিলাম ভাইয়ার কথোপকথন শুনে ৷৷
সে তার বিশ্বস্ত বন্ধুর সাথে বাসার বাগানে দাঁড়িয়ে ব্যপারটা নিয়ে ফোনে আলাপ করেছিলো ৷ আমি তখন বাগানের দিকে যাচ্ছিলাম ,ভাইয়ার খুব কাছাকাছি একটা গাছের নিকট দাঁড়াতেই তার শালিকাকে নিয়ে কথা শুনতে পাই, এরপরই ধর্ষণের জঘন্য পরিকল্পনার কথা কানে আসে ৷ এও বুঝতে পারি যে ভাইয়া তার শালিকাকে প্রস্তাবে রাজি করাতে না পেরে এমন সিদ্ধান্ত নিচ্ছে ৷ আর ধর্ষণ শুধু সে একা নয় তার বন্ধকে সঙ্গে নিয়ে করবে ৷ কত জঘন্য পৈশাচিক পরিকল্পনা ছিলো তার ৷ বুঝতে পেরেছিলাম সে ভালো কথায় পথে আসবে না ৷ তাই আমাকে পরিকল্পনা করতে হলো ৷ তবে, নিজের মাথা দিয়ে ভাইকে শুধরানোর পরিকল্পনাটা পাইনি ৷ ফেসবুকে একটি গ্রুপ রয়েছে, গ্রুপের একজন নানাজনের সমস্যার সমাধান খুবই যৌক্তিকভাবে দিয়ে দিতো ৷ আমার সমস্যাটা তার নিকট শেয়ার করি,তবে পোস্টের মাধ্যমে নয়, তার ইনবক্সে ৷ এতে সে আমার নিকট এইরকম পরিকল্পনার কথা ব্যক্ত করে ৷
আমি পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করি এবং শেষপর্যন্ত পরিকল্পনাটা সাকসেস হয়! আপনি হয়তো কিছু একটা মিলানোর চেষ্টা করছেন, ঠিক না? ভাবছেন ঠিক এরকম কিছুর সমাধান তো আপনিও একজনকে দিয়েছেন! আসলে আপনি যে মেয়েটিকে এরকম পরিকল্পনার কথা বলেছিলেন সেই মেয়েটি অন্য কেউ নয় আমিই! হিমাদ্রী নামের আইডিটা আমারই ছিলো!, আপনার পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করার পর যখন সফল হই, তখন থেকে আপনাকে আমি ফলৌ করতে থাকি ৷ আপনার সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য জেনে নিই ৷ আপনি মাস্টার্স কম্প্লিট করেও চাকরি পাচ্ছেন না, ইন্টারভিউ দিয়ে রিজেক্ট হচ্ছেন ,সবকিছু জানতে পারি ৷ সত্যি বলতে আপনাকে নিয়ে অনেকটা ভাবতে থাকি আমি ৷ আপনার ঠিকানা পেয়ে কয়েকদিন আপনার বাসাতেও গিয়েছিলাম ৷ আপনার মায়ের সঙ্গে কথাও হয়েছে ৷৷ ওনার নিকট নিজেকে আমি আপনার ক্লাসমেট হিসেবে পরিচয় দিয়েছিলাম ৷ যদিও পুরো বিষয়টা আপনার নিকট অজানা ছিলো ৷ আমি ধর্ষণের নাটক করার পর ভাইয়া আমার বিয়ের জন্য পাগল হয়ে যায় ৷৷
আমি তাকে বলি বিয়ে করবো তবে আমার পছন্দ অনুযায়ী ৷ ভাইয়া এতে রাজি হয় ৷ আমি তাকে বলি যে কোম্পানিতে অ্যাসিস্টেন্ট নিয়োগ নেওয়ার সার্কুলার দেওয়া হোক ৷ একজনকে নিয়োগ নেওয়া হবে তবে স্যালারি খুবই সন্তোষজনক! এই সার্কুলারে যতজন আবেদন করবে তাদের প্রত্যেকের ইন্টারভিউ নেওয়া হবে ৷ এদের মধ্যে যাকে ভালোলাগবে তাকে বিয়ে করবো ৷৷ আমি জানতাম তুমি এই চাকরির জন্য আবেদন করবে, কারণ তোমার ইনবক্সে চাকরির সার্কুলারের ফর্মটা দিয়েছিলাম ৷৷ তুমি যেদিন ইন্টারভিউ দিলে সেদিন তো আমি বোর্ডে উপস্থিত ছিলাম ৷ ইন্টারভিউ পর ভাইয়াকে তোমার কথা বলি ৷ ভাইয়া কোনোরকমের আপত্তি ছাড়া রাজি হয়ে যায় ৷এতোকিছু করার পর আজকে আমি তোমাকে পেলাম! এটা ভেবে ভালেোলাগছে যে তোমার মতো এতো ভালো মনের একজন মানুষকে আমার স্বামী হিসেবে পেয়েছি!
এতোক্ষণ সামিয়ার কথাগুলো শুনে বাকরুদ্ধ আমি! হতবাক মন আর কম্পমান শরীরে লাজুক চাহনীতে তাকে দেখছি ,আর ভাবছি, সত্যিই মানুষের জীবন কত বৈচিত্রময়! কখন কি ঘটে কেউ জানেনা ৷ আমার জীবনটা এতোদিন ব্যর্থতায় ভরা ছিলো, আর আজ সফলতায় ঘেরা! সামিয়ার হাতের আঙ্গুলে আলতোভাবে স্পর্শ করে বললাম,
-মন থেকে বলছি তোমার মত বুদ্ধিমতী ও সৎ নারী কারো স্ত্রী হওয়া মানে সেই মানুষটি খুবই ভাগ্যবান ৷ হ্যাঁ, আমিও ভাগ্যবান তোমাকে পেয়ে!
গল্পের বিষয়:
গল্প