একটি তাঁরার গল্প

একটি তাঁরার গল্প
পাঁচ বছরের রিলেশনের পর পারিবারিক ভাবে আমার আর ইমন এর বিয়ে হয়। যেদিন আমাদের বিয়ে হয় সেদিন তার সে কি কান্না!আমি অবাক হয়ে তাঁকে জিজ্ঞাস করলাম,বাবা-মাকে ছেড়ে যাচ্ছি আমি আর কাঁদতেছো তুমি!পাগল নাকি! সে তখন আমার হাত দুটো ধরে বললো,’আমার কত দিনের স্বপ্ন পূরণ হচ্ছে তুমি জানো?খুশিতে তো আমার মরে যেতে ইচ্ছে করছে!’
ওর মাঝে সেদিন আমি সেই পাঁচ বছর আগের ইমনকে উপলব্ধি করতে পেরেছিলাম।আমি একটু বদমেজাজি আর একরোখা হওয়ার কারনে,আমাকে পটাতে ওর অনেক কাঠখোর পোড়াতে হয়েছে।কতবার যে আমার হাতে চড়-থাপ্পড় খেয়েছে তার কোনো হিসেব নেই।টানা 2 বছর পিছনে পড়ে ছিলো।একটা সময়ে এসে আমার ও মায়া পরে গেলো।যেদিন ওকে হ্যাঁ বলেছিলাম সেদিন ওর সেই বাচ্চাদের মতো খুশি হওয়া!আজও আমার চোখে ভাসে!
আমাদের পাঁচ বছরের রিলেশনশিপে একটা দিন ও সে আমার সাথে রাগ করে থাকতে পারেনি।কত সময় এমন হয়েছে,আমি রাগ করে সারাদিন ফোন অফ করে রেখে দিয়েছি।বিকালে কিংবা রাতে বারান্দায় গিয়ে দেখতাম,ও দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে বসে আছে কিংবা দাড়িয়ে আছে।আমি তখন ওকে ফোন দিলে খুশিতে আটখানা হয়ে কল রিসিভ করতো।আমি তখন কত বকাবকি করতাম কিন্তু আমার বকা গুলোও যেনো ওর কাছে মধুর লাগতো!সারা মুখে যেনো খুশি উপচে উপচে পরতো! ওর এসব পাগলামি গুলো মাঝে মাঝে খুব বিরক্ত লাগতো!একবার খুব রাগ হয়েছিলো।ওকে বকাঝকা করে ব্রেকআপ করে দিলাম!সব জায়গা থেকে ব্লক করে দিলাম।
আমার খুব যখন রাগ হয় তখন অনেক ঘুম পায়!সেবার ও তাই হলো।কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম জানি না।যখন ঘুম ভাঙলো তখন অনুভব করলাম বাহিরে অনেক বৃষ্টি হচ্ছে। হঠাৎ খেয়াল হলো ইমন এর সাথে ঝগড়া হয়েছে।আর প্রতিবার ঝগড়া শেষেই রাগ ভাঙাতে বাসার নিচে আসে।কিন্তু এখন তো বৃষ্টি।এর মধ্যেই চলে আসে নি তো? একথা মনে হতেই হুরমুর করে উঠে বারান্দায় চলে গেলাম।যা ভেবেছিলাম ঠিক তাই হলো।কি তমুল বৃষ্টি তার মাঝে ও দাড়িয়ে দাড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছিলো।আর ক্ষণে ক্ষণে কেঁপে কেঁপে উঠছিলো। আমি দৌড়ে রুম থেকে বেরিয়ে গিয়ে মাকে জিজ্ঞাস করলাম’কখন থেকে বৃষ্টি হচ্ছে?’ মা বললো ৩ ঘন্টার উপরে হবে। মায়ের কথা শুনে একটা ধাক্কার মতো খেলাম।এই তুমুল বৃষ্টিতে ৩ ঘন্টা ধরে কোনো স্বাভাবিক মানুষ কি করে দাড়িয়ে থাকতে পারে?
আমি আর এক সেকেন্ড ও দেরি না করে নিচে গিয়ে আগে একটা থাপ্পড় দিলাম তারপর ভিতরে নিয়ে আসতে লাগলাম।পুরো শরীর কেঁপেই যাচ্ছিলো।সেই অবস্থাতেই জিজ্ঞাস করছিলো,’তোমার রাগ কমছে?প্লিজ ব্লকগুলা খুলে দাও।মরে যাবো নাহলে।’ আমি ভেবে পাচ্ছিলাম না একটা মানুষ এতোটা আজব হয় কি করে!কিন্তু ওই মুহূর্তেই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছিলাম,’এই পাগলাকেই বিয়ে করবো আমি।’সেদিন ও চলে যাওয়ার পর বাসায় অনেক ঝামেলা হয়েছিলো ঠিকই কিন্তু সবাইকে সবটা জানাতে পেরেও হালকা লাগছিলো।মা-বাবা প্রথমে চিল্লামিল্লি করলেও পরে আস্তে আস্তে মেনে নিয়েছিলো। এরপর একসময় ওর আমার দুজনেরই গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট হয়ে গেলো।দুজনে চাকরি ও পেয়ে গেলাম। এতোগুলো বছর চলে গেলো অথচ সেটার মধ্যে সেই প্রথম দিনের মতো ভালোবাসা বিরাজমান ছিলো। আমাদের বিয়ের পর আমার প্রতি ওর ভালোবাসা যেনো আরো বেড়ে গিয়েছিল! আল্লাহ্ কিছুকিছু মানুষের মনে হয়তো আকাশের সমান ভালোবাসা দিয়ে পাঠায়।
চার দিকে এতো এতো বিচ্ছেদ, এতো এতো অবিশ্বাসের মাঝেও কিছুকিছু মানুষ উজাড় করে ভালোবাসা বিলিয়ে যাচ্ছে। ইমনকে প্রায় সময় জিজ্ঞাস করতাম,’সবাই তো একটা সময়ে এসে বদলে যায়!তুমি বদলাও না কেনো?’
ইমন হাসতে হাসতে বলতো,’তুমি বদলাতে দিলে তো বদলাবো!তাছাড়া তুমি তো আমার অভ্যাসে পরিনত হয়ে গেছো।তুমি তো জানোই আমি আমার অভ্যাস বদলাতে পারি না।’ দুজনেরই অফিস যেহেতু সকালে ছিলো,সেহেতু নাস্তা বানাতে খুব ভোরে উঠতে হতো।প্রায় সময় ঘুম থেকে উঠে দেখতাম অনেক লেট হয়ে গেছে।তাড়াহুড়ো করে কিচেনে গিয়ে দেখতাম ও ওলরেডি নাস্তা তৈরি করে ফেলেছে!আমাকে দেখলে কি মায়া মায়া একটা হাসি দিতো।
মাঝেমাঝে অবাক হয়ে আল্লাহ্ কে বলতাম,’আমাকে তুমি কত ভালোবেসে এমন একটা মানুষকে দিয়েছো!যতই শুকরিয়া করি না কেন,কম হয়ে যাবে। যেদিন আমার অফিস থেকে বের হতে দেরি হয়ে যেতো,সেদিন বের হয়ে দেখতাম ইমন একটা রিকশা নিয়ে দাড়িয়ে আছে।আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞাস করতাম তুমি এদিকে আসলা কেনো?অজথাই বাচ্চাদের মতো কাজ করো! ইমন তখন বলতো,’তোমার সাথে যতক্ষন থাকি ততক্ষণ-ই আমি স্বর্গীয় সুখ অনুভব করি।’ সেদিন যখন অফিসে আসছিলাম ইমন পিছন থেকে হাতটা ধরে বললো,’আচ্ছা আরেকটু থাকো না!’ আমি হেসে দিয়ে বললাম,’ইশশ হঠাৎ ঢং বাড়লো নাকি!’ তখন ও আরো কাঁচুমাচু মুখ করে বললো,’আজ কি তোমার অফিসে বেশি কাজ আছে?আজ না গেলে হয় না?’ আমার তখন কিছুটা খটকা লাগলো।
আমি ওর কাছে বসে জিজ্ঞাস করলাম,’তোমার কি শরীর খারাপ লাগছে?এভাবে কথা বলছো কেনো?’
ও তখন করুন দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে বললো,”না।শরীর ঠিক আছে।কিন্তু কেমন জানি খালি খালি লাগছে।মনে হচ্ছে যেনো তোমাকে হারিয়ে ফেলবো” আমি তখন হাসি দিয়ে বললাম,’ধুর কি যে বাচ্চাদের মতো কথা বলো!আমি হারাবো কোথায়?আর তোমাকে ছেড়ে হারানো তো কোনো প্রশ্নই আসে না।হারালে একসাথে হারাবো।” ইমন তখন হাসিহাসি মুখ করে বললো,”তোমাকে আমি অনেক বেশি ভালোবাসি!ট্রাস্ট মি!” আমি বললাম,’আমি তো জানি সেটা।আচ্ছা তুমি যখন চাচ্ছো না আজ তাহলে অফিসে যাব না।’ ইমনের চোখমুখ তখন উজ্জ্বল হয়ে উঠলো।ঠিক তখনই ফোন টা বেজে উঠলো! দেখলাম বস ফোন করেছে।রিসিভ করতেই বস বললো ‘খুব আর্জেন্ট মিটিং ডেকেছে।তাড়াতাড়ি যেনো চলে যাই।’ নিমিশেই মনটা খারাপ হয়ে গেলো!ইমনের জন্যে খুব খারাপ লাগছিলো।
ওকে বিষয়টা জানাতেই বললো,’আরে তুমি যাও।সমস্যা নাই।আর আমিও তো একটু পর চলে যাব।যেহেতু মিটিং ডেকেছে অফ দেওয়ার তো প্রশ্নই আসে না!’ আমি তখন বললাম,’আচ্ছা আজ তাহলে তোমার অফিস যাওয়ার দরকার নেই।তুমি বাসায় থাকো।আমি কল করলে তুমি গিয়ে অফিস থেকে নিয়ে এসো।আজ আমরা অনেক ঘুরবো।’ ইমন খুব খুশি হয়ে গেলো তখন।কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বললো আচ্ছা সাবধানে যাও।আমি তোমার কলের অপেক্ষা করবো। ইমনের এমন অদ্ভুত আচরণে আমার কেমন কেমন জানি লাগছিলো।ও পাগলামি করে ঠিকই কিন্তু এমন অদ্ভুত আচরণ আগে কখনও করেনি। যতক্ষণ মিটিংয়ে ছিলাম আমার কোনো মনোযোগই ছিলো না।শুধু ভাবছিলাম কখন মিটিংটা শেষ হবে আর পাগলটার সাথে দেখা করবো।
মিটিং শেষ হতেই বসকে বলে ছুটি নিয়ে নিলাম।ইমনকে ফোন করে বলে দিলাম আধাঘন্টার মধ্যে যেনো চলে আসে।ও তখন বললো,’তুমি একটু ওয়েট করো,আমি এক্ষুনি উড়ে চলে আসছি।’ এক ঘন্টার উপরে হয়ে যাচ্ছিলো কিন্তু ইমনের আসার কোনো নামই নেই।ওকে ফোন দিচ্ছিলাম কিন্তু ধরছিলো না।একটু রাগ হচ্ছিল।আবার চিন্তা ও হতে লাগলো। তার কিছুক্ষণ পরই ওর নাম্বার থেকে কল আসলো।কিছুটা স্বস্তি আর কিছুটা রাগ নিয়ে ফোন রিসিভ করে কিছু একটা বলতে যাব, ঠিক তখনই ওপাশ থেকে ভেসে আসলো অচেনা কন্ঠস্বর!উনি বলে উঠলো,’আপনি কি মিসেস ইমন?’আমি এতো বেশি অবাক হলাম যেনো কথাই বের হচ্ছিল না।ওই পাশ থেকে হ্যালো হ্যালো করে যাচ্ছিলো।আমি বিস্ময় কাটিয়ে বললাম,’জি আমি মিসেস ইমন।কিন্তু আপনি কে?আর আপনার কাছেই বা ওর ফোন কেনো?হারিয়ে ফেলছে তাই না?’ লোকটা তখন শীতল কন্ঠে বললো,”কিছুক্ষণ আগে আপনার হাজবেন্ট এক্সিডেন্ট করেছে!”
মানুষ চলে যাওয়ার আগেই হয়তো এতোটা মায়া বাড়িয়ে যায়। আমাদের ঘরের প্রতিটা জিনিসের সাথে ছেলেটার অস্তিত্বে মিশে আছে।শুধু ছেলেটাই নাই! চলেই যখন যাবে এতো এতো ভালোবাসার খুব কি দরকার ছিলো? ওকে ঘিরে আমি কোনো কষ্টের স্মৃতি খুঁজে পাই না! খুব করে ভাবি একটু কেনো কষ্ট দিলো না!তাহলে হয়তো সেই কষ্ট টাকে কেন্দ্র করে ভুলে যেতে পারতাম। অনেক আফসোস হয় কেনো আরো কিছু সময় মানুষটার সাথে কাটালাম না! পৃথিবীটাতে একটুখানি ভালোবাসার কত অভাব!সেখানে এই উজাড় করে ভালোবাসা বিলানো মানুষ গুলো কেনো হারিয়ে যায়? আমাকে হারানোর ভয় পাওয়া মানুষটা নিজে হারিয়ে গেলো।এক বুক শূন্যতা দিয়ে আমাকে ফেলে গেলো।
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত