আমার অসুস্থ মাকে আমার স্বামীর কথায় আমার কাছে নিয়ে এসেছিলাম আমি তাকে চিকিৎসা করাতে।সেবা যত্ন করতে। আমাদের সাথে রাখতে। আমার তো কোন ভাই নাই।একটা বোন আছে। সেই বোনের আবার প্র্যাগনেন্সি চলছে। এমন সময় তো তারই আলাদা ভাবে সেবা যত্নের প্রয়োজন। মাকে আবার কখন সে সেবা যত্ন করবে!আমি ছাড়া মার আর কোন উপায় ছিল না।
তবুও আমি ভয়ে ভয়ে কিছু বলছিলাম না আমার স্বামী মনসুরকে। কিন্তু সেই একদিন আমায় বললো,’মিতু,একটা কাজ করি আমরা?’ আমি অবাক হয়ে বললাম,’কী কাজ?’ ‘মাকে নিয়ে আসি আমাদের এখানে। মাকে তো দেখার আর কেউ নাই!’ আমি বললাম,’যদি শাশুড়ি মা কিছু বলেন এতে?’ ‘ধুর বোকা।মা কী বলবেন?আমরা যদি না থাকতাম তবে তো তিনিও গিয়ে তার মেয়েদের কাছে থাকতেন। থাকতেন না?’ আমি বললাম,’হু থাকতেন।’ মনসুর এবার মৃদু করে হাসলো। হেসে বললো,’কালই তুমি যাও। মাকে নিয়ে আসো গিয়ে।’ আমি ওর কথামতো পরদিন গিয়ে মাকে নিয়ে আসলাম। কিন্তু মাকে নিয়ে আসার পর পরই আমার শাশুড়ি গাল ফুলিয়ে রাখলেন। আমার সাথে কথাটথা বলা একবারেই বন্ধ করে দিলেন।
রাতে তিনি আমায় ডেকে নিলেন তার ঘরে। তারপর বললেন,’বউমা, আমার অনুমতি না নিয়া তোমার মারে যে এই বাড়িতে আনলা তুমি?এতো বড়ো সাহস তোমারে কে দিছে?’ শাশুড়ি মায়ের এই কথা শুনে আমার কেমন কান্না এসে গেছে।আমি কান্নাভেজা গলায় সঙ্গে সঙ্গে শাশুড়ি মাকে বললাম,’আপনার ছেলেই তো বললো নিয়ে আসতে।মা তো অসুস্থ। তাকে তো দেখার আর কেউ নাই!’ আমার শাশুড়ি মা এই কথা শুনে বললেন,’তাকে দেখার নেই মানে কী?কাজের লোক রাখুক। আর তোমার যদি অত দরদ লাগে মার জন্য তাইলে তুমি মার বাড়িতে চলে গেলেই পারো।জামাইর সাথে ঘর সংসার করার তো দরকার নাই। আমার এখানে থাকলে আমার কথামতো থাকতে হবে।চলতে হবে আমার নির্দেষ মতো। আমার অনুমতি ছাড়া কিছু করলে তো এই বাড়িতে থাকা যাবে না।বুঝলা বউ মা?’
শাশুড়ি মার এমন ঝাঁজালো কথা শুনে মুখে আঁচল চেপে কাঁদতে কাঁদতে ঘর থেকে বের হয়ে আসলাম। তারপর বারান্দার দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ পর্যন্ত কাঁদলাম চুপিচুপি। মাকে এই সব কথা কিছুতেই জানানো যাবে না।মা এই অপমান সহ্য করতে পারবেন না। মনসুর এখন অফিসে।সে আসার আগ পর্যন্ত আমাকে চুপ থাকতে হবে। কিংবা সে আসলেই আর কী হবে। এই বাড়ির মালিক তো আমার শাশুড়ি।তার কথামতোই তো সব হবে।এতে মনসুরেরও তো কিছু করার নাই।তার মায়ের কথার উপর তো আর সে কোন কথা বলতে পারবে না।
চোখ মুখ মুছে ঘরে ঢুকতেই মা কাছে ডাকলেন আমায়।ধীরে সুস্থে আমি মার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম।মা এবার আমার হাতটা শক্ত করে ধরলেন। তারপর আমার চোখের উপর তাকিয়ে বললেন,’মার কাছে কান্না লুকাস?যে মা তোরে জন্ম দিছে সেই মার কাছে তুই কান্না লুকাতে পারবি মা?মা কী বুঝে ফেলবে না? তুই কী জানস না মায়েরা বিদেশ বাড়িতে থাকা সন্তানের কখন কী হচ্ছে তাও দেখতে পায় মনের চোখে! অনুভব করতে পারে!’ এবার আর কান্না লুকিয়ে রাখতে পারলাম না। হাউমাউ করে কেঁদে উঠলাম মার সামনে। মা এবার বললেন,’তোর শাশুড়ি আমায় এখানে নিয়ে আসার জন্য রাগ করেছে তাই না?’ আমি কান্নাভেজা গলায় বললাম,’না মা তেমন কিছু না!’ মা আমার দিকে তাকিয়ে অতি কষ্টেও হাসলেন। হেসে বললেন,’তাহলে বকলো কেন তোকে?’ ‘মা তুমি সব শুনে ফেলেছো তাই না?’
‘তোর শাশুড়ি আমায় শুনিয়ে শুনিয়েই বলেছে। এখন এক কাজ কর। আগামীকাল সকালে আবার আমায় বাড়িতে দিয়ে আয় গিয়ে।’ আমি মাকে জড়িয়ে ধরে বললাম,’তোমায় ওখানে দেখবে কে মা?’ মা বললেন,’আল্লাহ দেখবেন।অসহায়দের জন্য একমাত্র সহায় হলেন মহান আল্লাহ পাক। তিনি ছাড়া আর কোন গতি নাই।বুঝছস মা?’ আমি চোখের জল মুছে বললাম,’হু।’ রাতের বেলা অফিস থেকে মনসুর ফিরতেই শাশুড়ি মা তাকে ডেকে নিলো।ডেকে নিলেন আমাকেও।আমি উনার সামনে গিয়ে ভয়ে থরথর করে কাঁপছি।হয়তো তিনি এক্ষুনি বলবেন মাকে ঘর থেকে বের করে দিতে! মনসুর শাশুড়ি মার সামনে দাঁড়িয়ে বললো,’কেন ডেকেছো মা?’
‘তুই আর তোর বউ একটা ভয়ংকর অপরাধ করেছিস। কঠিন শাস্তি হবে তোদের!’ আমার কাঁপুনি আরো বাড়লো। মনসুর বললো,’সরি মা!আমি তো ভেবেছিলাম তুমি কিছু বলবে না। তুমি তো এমনিতেও ধর্মভীরু। নামাজ কালাম পড়ো।আমি ভেবেছিলাম এমন একটা মহৎ কাজ করলে তুমি আমাদের বাহবা দিবে।দেখো মা। আমার শাশুড়ির তো আর কেউ নাই।আমরা না দেখলে তাকে কে না দেখবে?’ মনসুরের চোখ কেমন টলমল করছে জলে। আমার শাশুড়ি এবার অদ্ভুত এক কান্ড করলেন। তিনি আমাদের হাতের ইশারায় ডাকলেন তার একেবারে কাছে যাওয়ার জন্য।আমরা তার কাছে গেলাম। একেবারে কাছে। ভয়ে ভয়ে। কাঁপতে কাঁপতে। তিনি এবার আমাদের অবাক করে দিয়ে দুজনের কপালে চুমু খেলেন। তারপর বললেন,’অবশ্যই তোমরা মহৎ কাজ করেছো। কিন্তু তোমাদের ভুল হলো আমায় আগে জানাওনি।শুনো তোমরা, কোন কিছু করার আগে ঘরের সবাই মিলে শলা পরামর্শ করতে হয়।এটা আমাদের নবীজির আখলাক।
তিনি পরামর্শ ছাড়া কিছু করতেন না।তোমরা যদি আমার কাছে বলতা তবে কী আমি কোনদিন না বলতাম তোমার মাকে এখানে আনার জন্য। আমিও তো আমার সন্তানের কাছে থাকি। আমার যেমন সন্তানের কাছে থাকার অধিকার আছে তেমন তোমার মারো আছে।ছেলের কাছে মা থাকবে আর মেয়ের কাছে থাকবে না এমন কোন নিয়ম ধর্ম কিংবা সমাজে নাই।মনে রাখো, মায়ের ছেলে সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে যতটুকু কষ্ট হয় মেয়ে সন্তান জন্ম দিতে গিয়েও ঠিক ততোটুকুই কষ্ট হয়। তোমার মারে এইখানে নিয়ে আসায় আমি রাগ করিনি গো মা। বরং আমি সীমাহীন খুশি হয়ছি। সকাল বেলা যে তোমায় বকাঝকা করছি এটা এমনিতেই। আমার কাছে না বলে কাজটা করছো বলে আমার একটু রাগ উঠছিলো মা। বৃদ্ধ বয়সে কোন বন্ধু পাওয়া যায় না। গল্প করার একটা মানুষ পাওয়া যায় না। আমার সীমাহীন ভাগ্য,আমি এই বৃদ্ধ বয়সে একটা বন্ধু এবং গল্প করার মানুষ পাইছি!’
শাশুড়ি মার কথা শুনে আমার চোখ থেকে টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়তে লাগলো। এই কান্না কিছুতেই দমিয়ে রাখা যায় না।আমি কেঁদে ফেললাম।গলা ছেড়ে কেঁদে ফেললাম। কাঁদতে কাঁদতে গিয়ে আমার শাশুড়ি মাকে শক্ত করে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরলাম।আর বললাম,’মা, মাগো, আল্লাহ যেনো আপনাকে একটা বড়ো বেহেশত দান করেন। সেই বেহেশতে যেন আমরা সবাই একসাথে থাকতে পারি!’ আমার শাশুড়ি আমায় শক্ত করে জড়িয়ে ধরলেন। তারপর বললেন,’ আমিন।সুম্মা আমিন।’
গল্পের বিষয়:
গল্প