প্রকৃত পিতা

প্রকৃত পিতা
যখন জানতে পারি আমার স্ত্রী সানিয়া মাদক কারবারির সাথে জড়িত তখন মনে হচ্ছিল নিজের মাথার চুলগুলো নিজেই টেনে ছিড়ে ফেলি। আজ যখন একলোক আমাদের ফ্ল্যাটে এসে সানিয়াকে খুজতে থাকে তখন আমি তাকে প্রশ্ন করি,
-ওকে কী দরকার আপনার?
-ভাই বকশিবাজারে ইয়াবার বড় একটা ডিল পাইছি। পুরা চারশ পিস।
তাই আফার থিকা ট্যাবলেট নিতে আইছি। আমি লোকটিকে কিছু না বলে সানিয়াকে ডাক দিলাম। আমার তখনো বিশ্বাস হচ্ছিল না সানিয়া এরকম কিছুর সাথে জড়িত থাকতে পারে। যখন সানিয়া খুব আতিথেয়তার সহিত লোকটিকে ঘরে বসতে দিলো তখনি আমার সকল বিশ্বাস ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেল। সানিয়া আর আমার বিয়েটা লাভ ম্যারেজ তাই দুপরিবারের কেউই আমাদের সাথে নেই। অনেক কষ্ট করে দুই ছেলেমেয়েকে নিয়ে ঢাকার একটি ফ্ল্যাটে থাকি আমরা। আমি মাস্টার্স পাশ করা সত্ত্বেও কোন চাকরি পাইনি তাই পরিবারকে টিকিয়ে রাখতে গ্যারেজে মিস্ত্রির কাজ নেই। আমার বাবার গ্যারেজ থাকায় ছোটবেলাতেই কাজটা আয়ত্তে এনেছিলাম। গতমাসে হঠাৎই সানিয়া আমাকে বলে,
-শোনো, তোমারতো একার টাকায় সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হয়। তাই আমি চিন্তা করেছি গার্মেন্টসে চাকরি করবো। দুই ছেলেমেয়ের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে আমিও সায় দিয়েছিলাম সানিয়াকে। লোকটি চলে যাবার সাথে সাথে আমি সানিয়ার থেকে বাকী ট্যাবলেট গুলো নিয়ে পুড়িয়ে ফেলি। এই নিয়ে আমাদের মাঝে তুমুল ঝগড়া হয়। আমার কথা হলো যত কষ্টেই থাকি পরিশ্রম করে সংসার চালাবো দুজন কিন্তু এসব অবৈধ উপায়ে কোন অর্থ উপার্জন করা যাবেনা। আর সানিয়ার কথা সে আর কোন অভাব অনটনে থাকতে চায়না। একপর্যায়ে যখন সানিয়া আমাকে বলে,
-তুই যদি এতোই ফেরেস্তা হয়ে থাকিস তবে তোর সাথে আমি থাকবোনা। কালই তোকে আমি ডিভোর্স দিবো।
সেদিন সানিয়াকে হাজার বুঝিয়েও আমি ডিভোর্স আটকাতে পারিনি। একপর্যায়ে হাল ছেড়ে দেই, সানিয়াই আমাকে ডিভোর্স দিয়ে দেয়। আর সাথে করে আমার ছেলে মেয়ে দুটোকেও নিয়ে যায়। এর কিছুদিন পরই সানিয়া ওর সাথেই মাদক কারবারির সাথে জড়িত একটি ছেলেকে বিয়ে করে। আমি অসংখ্য বার চেষ্টা করেও আমার ছেলে মেয়ে দুটোকে নিজের নিকট আনতে পারিনি। কারণ সানিয়ার একটাই কথা ছিল,
-আমার নতুন স্বামী ওদের দুজনকে মেনে নিয়েছে। তাই আমি চাইনা ওদেরকে তোমার নিকট দিয়ে সৎমায়ের মার খাওয়াতে। তোমার যদি ওদেরকে দেখতে ইচ্ছে হয় তবে মাঝে মাঝে আসতে পারো, এটুকুই। আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম যদি ছেলে মেয়ে দুটোকে নিজের নিকট আনতে পারি তবে আর দ্বিতীয় বিয়ে করব না। আমি প্রায় একদিন দুদিন পরপরই আমার ছেলেমেয়েদের দেখতে যেতাম কিন্তু এই ব্যপারটা ওর নতুন স্বামী তানিম মোটেই পছন্দ করত না। প্রথম দিকে সানিয়া আমাকে প্রায়ই বলতো,
-শোনো তুমি এভাবে রেগুলার এসোনা তো। তানিম এটা পছন্দ করে না। সানিয়ার কথামতো এরপর আমি পাঁচ ছয়দিন পরপর যেতাম। একদিন আমার সাতবছর বয়সী মেয়েটি বলে,
-আব্বু আমাকে তোমার কাছে নিয়ে চলো। এখানে আমার ভালো লাগে না। নতুন আব্বু আমাকে অনেক ব্যথা দেয়।
এতটুকু মেয়ের মুখে এই কথা শুনে সেদিন সানিয়াকে আমি বিষয়টা খুলে বলি। কিন্তু সানিয়া কিছুতেই বিশ্বাস করতে চায়না উল্টো আমাদের মাঝে তুমুল ঝগড়া হয়। সানিয়ার হাসবেন্ড সেদিন আমাকে বাজেভাবে গালিগালাজ করে এবং গায়ে হাত তুলে বাসা থেকে বের করে দেয়। আমি হাজার চেষ্টা করেও আমার বাচ্চাদুটোকে নিয়ে আসতে পারিনি। এরপর যখনি আমার ছেলেমেয়েদের সাথে দেখা করতে যেতাম তখনি আমাকে অপমানিত কিংবা মারধোর করে বের করে দেওয়া হতো। একপর্যায়ে সানিয়া ও ওর স্বামীর প্রতি আমার এমন ক্রোধের জন্ম নেয় যে আমি এক কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি। আমার সবচেয়ে বেশি রাগ ছিল সানিয়ার প্রতি। তাই একদিন আমি সানিয়ার বাড়িতে নজরদারি করতে থাকি, যখন ওর হাসবেন্ড বাসা থেকে বের হয় তখনি আমি ওদের দরজায় নক করি। সানিয়া আমাকে দেখেই বলে,
-কী হলো তুমি আবার আসছো? তোমার কী একটুও লজ্জা নেই যে এতো মার খেয়েও আবার আসছো? এক্ষনি বের হও তানিম এসে পরবে কিন্তু। আমি সানিয়াকে পাত্তা না দিয়ে ওকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে বেডরুমে প্রবেশ করলাম। একপর্যায়ে সানিয়া আমার পিছন থেকে কলারটা চেপে ধরে। আমি আর একমুহূর্ত দেরী না করে কোমরে গুজে থাকা চাকুটা সরাসরি ওর গলায় বসিয়ে দিলাম। এই বলেই টেবিলে মুখ লুকিয়ে কেঁদে দিলেন মারুফ। ওসি তন্ময় এতক্ষন ধরে মনোযোগ দিয়ে শুনছিলেন তার কথাগুলো। তিনি জানেন যে এখানে বিন্দুমাত্র মিথ্যা নেই। কারণ যখন সানিয়ার বর্তমান স্বামীকে পুলিশ এ্যারেষ্ট করার পর জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় তখন সে স্বীকার করেছে যে সে মাদক কারবারির সাথে জড়িত এবং মারুফকে সে কয়েকবার মারধোরও করেছে বাসায় আসার কারণে। হঠাৎই মারুফ টেবিল থেকে মুখ উঠিয়ে ওসি তন্ময়ের দিকে তাকিয়ে বলেন,
-স্যার আমার কী শাস্তি হবে?
-আপনি যেহেতু সব সত্যটা প্রথম ধাপেই স্বীকার করেছেন তাই আপনার মৃত্যুদন্ড মওকুফ করা যেতে পারে আমাদের সুপারিশে। তবে যাবজ্জীবন কারাদন্ড হবে এটা নিশ্চিত।
-স্যার কত বছরের?
-বাংলাদেশের আইনে প্রায় চৌদ্দবছর।
আমি জানি আপনি আপনার ছেলেমেয়েদের নিয়ে চিন্তিত। আপনি চিন্তা করবেন না, আমার স্ত্রী গত দশবছর যাবৎ সন্তানহীন। অর্থাৎ আমাদের কোন সন্তান নেই। আমি আপনার ছেলেমেয়েদের দায়িত্ব নিলাম। আমার স্ত্রী ওদেরকে মায়ের মতোই আগলে রাখবে। ১৪বছর পর ওসি তন্ময়ের বাড়িতে আজ এক এলাহি কান্ড। কারণ তার মেয়ের আজ বিয়ে। দুর থেকে মারুফ স্টেজের উপর সাজগোজ করা মেয়েটির দিকে একনয়নে তাকিয়ে রয়েছেন। হঠাৎ ওসি তন্ময় স্টেজের কিছু দুরে দাঁড়িয়ে থাকা জীর্ণশীর্ণ লোকটির দিকে এগিয়ে গেলেন। কাছে আসতেই তিনি চিনতে ভুল করলেন না।
-আরে আপনি? আসুন। আজ আপনারই মেয়ের বিয়ে।
-না স্যার। আপনি আমার ছেলে মেয়ে দুটোকে যেভাবে মানুষ করেছেন তাতে আপনার পা ধরে সারাদিন বসে থাকলেও ঋণ শোধ হবেনা। আমি চাইনা এই অনুষ্ঠানের মধ্যে আমাকে ওর বাবা পরিচয় দেন। ওসি তন্ময় গর্বে নিজের চোখ থেকে কয়েকফোঁটা অশ্রু বিসর্জন দিলেন আর তাকে জড়িয়ে ধরলেন। অনুষ্ঠানে আগত সবাই এই কান্ডে কিছুটা হতবিহ্বল হয়ে গেল। একপর্যায়ে লোকটি বিদায় নিয়ে চলে গেল। ওসির ছেলে আর মেয়ে দুজন স্টেজ থেকে দৌড়ে এসে বললো,
-বাবা এই নোংরা লোকটি কে? তাকে জড়িয়ে ধরলে কেন? তন্ময় একটি মুচকি হাসি দিয়ে বলল,
_ইনি হলেন তোমাদের প্রকৃত পিতা।
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত