বাইরে থেকে ফিরে এসেই শ্বাশুড়ীর রুমে উঁকি দিলাম।নামাজ শেষ করে তিনি চুপচাপ বসে তসবিহ পড়ছেন।
ফ্রায়েড চিকেন,স্যান্ডউইচ প্লেটভরে সাজিয়ে এনেছি।সাথে দুরকমের সস। এগিয়ে দিয়ে বললাম,খেয়ে নিন।আমি বাচ্চাদের দিয়ে আসি।
তিনি বললেন,অগো রে এইহানেই আইতে কও।একলগে বইয়া খাই।আর আইজকা বাগার আনো নাই? না,আজ বার্গার আনিনি।একসাথে এতকিছু খেলে সমস্যা হতে পারে।অন্যদিন আনবো। আইচ্ছা,তয় তুমি মুখহাত ধুইয়াসো তারপর একসাতে খাই। আমি সায় দিয়ে রুম থেকে বের হলাম। দলবেঁধে রেস্টুরেন্টে গিয়ে ফাস্টফুড খাওয়ার ব্যাপারটা শ্বশুরবাড়িতে এসে আমি প্রায় শূন্যের কোঠায় নামিয়ে এনেছি।বিয়ের আগে বান্ধবীদের মনরক্ষার্থে দু’চারবার গিয়েছিলাম, তাও ফেরার সময় মা দাদীর জন্য পার্সেল ছাড়া বাড়ি ফিরিনি।কিন্তু বিয়ের পর আমাকে কেউ রেস্টুরেন্টমুখী করতে পারেনি।যেটা খাবো সেটা বাড়িতে পার্সেল করে নিয়ে এসে সবাইকে নিয়ে হৈ-চৈ করে খেয়েছি।ঢাকা শহরের যত নামী দামী রেস্টুরেন্ট আছে ,আমি প্রায়ই সেখানকার দু’একটা জনপ্রিয় আইটেম বাসায় পার্সেল করে নিয়ে আসার চেষ্টা করি,আমার শ্বাশুড়ীর জন্য।
এটা চিরাচরিত বাঙালি বউ হিসেবে শ্বাশুড়ীর মন যোগানোর কৌশলের কোন অংশ নয়।এটা আমার এক ধরনের দুর্বলতা,পেছনের প্রজন্মের প্রতি অকথিত এক দুর্বলতা।রেস্টুরেন্টের মনোরম পরিবেশে বসে আমার খাওয়া,আর বাড়িতে আরেকজনের গতানুগতিক সাধারন খাদ্যগ্রহন,দুজনের পার্থক্য সৃষ্টির মূহুর্তটাকে আমি কোনভাবেই মেনে নিতে পারিনি। এই দুর্বলতাটুকু কেন জানি আমার মধ্যে সবসময়েই ছিল।বলতে গেলে বিয়ের আগে থেকেই। কি পোশাকে! কি খাবারে!কি মননে!সিঁড়ির কয়েকধাপ নিচেই পড়ে থাকেন তারা,যে দূরত্বে তাদের মনকে সহজে ছোঁয়া না যায়!নতুন যুগের চাকচিক্যের আধিক্যে তারা না চাইতেও খুব বেশি সাদামাটা হয়ে পড়েন। সাদাকালো এই প্রজন্মকে চিনতে পারার সূচনায় আমার নিজের দাদার প্রতি কেমন একটা প্রগাঢ় মমতা যে জেগেছিল একদিন!
বিয়ের আগের ঘটনা সেটা।স্কুলের সবচেয়ে প্রিয় বান্ধবী সোমাকে এক টিফিনে বাড়িতে নিয়ে এসেছি। দাদা খেতে বসে নাতনীর বান্ধবীর পরিচয় জিজ্ঞেস করছিলেন।আমি আশ্চর্য হলাম, ওর কিংবা ওর বাবার নাম শুনে দাদা ওকে চিনতে পারলেন না!যেখানে সোমাকে আমরা ক্লাসের সবাই চিনি! অবশেষে সোমা যখন তার দাদার নাম বললো তখন তিনি ওকে চিনতে পারলেন কিন্তু আমার মন অজান্তেই ভীষন ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। একদিন আমিও কি সোমার নাম উল্লেখ না করা পর্যন্ত ওর পরবর্তী প্রজন্মকে চিনতে পারবো না! আমার মেয়েদুটোকে ওদের দাদীর ঘরে রেখে আসি,স্কুলের হোমওয়ার্ক শেষ হবার পর পরই।ওরা দাদীর সাথে গুটুর গুটুর গল্প করে,খিলখিল হাসে। কখনো আমার ব্যাগ থেকে আতরের শিশি সুরমার কৌটা বের করে লুকিয়ে ঘরে রেখে আসে,যেটা তাকে দেয়ার জন্যই একসময় কিনে এনে ব্যাগে রেখে দিয়েছি।
শ্বশুরকে অবশ্য জীবিত পাইনি।আমার বিয়ের আগেই তিনি মারা গিয়েছেন।দেবর ভাসুর কিছুই নেই,ননদ আছে একজন।সে আসে মাঝেমধ্যে। বলা যায় খুব নীরব একটা সংসার আমার।তবে সে নীরবতা জমে যাওয়ার আগেই সেটা ভেঙে ফেলার তোড়জোড় করতে থাকি আমি। সমাপ্তিতে পৌছে যেতে থাকা একটি মানুষের দিনরাতকে একটু সজীব করে তোলার আপ্রাণ চেষ্টায় আমার সন্তানরাই আমার পাশে থাকে সবসময়। কখনো শ্বাশুড়ীর চোখে চশমা এঁটে দুলে দুলে কোরআন শরীফ পড়ার সময় আমার মনে হয় আহা! তার বোধহয় একা একা লাগছে,পাশে বসে কেউ শুনলে খুব ভালো লাগতো হয়তো। ইবাদাতের মানসিক একাকীত্ব হয়তো নেই,থাকা উচিত নয়,কিন্তু শারীরিক! তার সেই পাশের একজন আমিই থাকি অনেক সময়,কখনো বাচ্চাদের পাঠিয়ে দেই।কোন সন্ধ্যায় সবাইকে নিয়ে হাজির হই নবী-রাসূলদের কথা শুনতে। পড়তে পড়তে শ্বাশুড়ীর গলা ধরে আসে,আমিও আনমনে চোখের পানি মুছি। বাচ্চারা গালে হাত দিয়ে চুপচাপ আমাদের দেখে।
আমার নানা-নানীর সাথেও আমি তাদের একাকীত্ব ঘুচিয়ে দেওয়ার মত আচরন করতাম। পাশাপাশি আধুনিক যন্ত্রপাতির সাথে পরিচয় ঘটানোর মাধ্যমে আমরা কাছাকাছি আছি এমনটা অনুভব করতে পারার মত যুগের দূরত্বটা কমিয়ে আনতে চাইতাম। আমি অবাক হয়ে দেখলাম আমার মেয়েরাও ঠিক তেমনটাই করছে।অথচ আমি ওদের শিখিয়ে দেইনি,কিন্তু মনে মনে চেয়েছি। ওদের প্রচেষ্টার ফলাফল স্বরুপ আমার শ্বাশুড়ী এখন নিজেই গিজারে পানি গরম করে।শরীর ভালো না থাকলে ফোনের লক খুলে অ্যাপস থেকে কুরআন পড়ে,তেলাওয়াত শোনে,তাসবীহ পড়ে।আমার মেয়েদের মুখে বিজ্ঞানের নতুন নতুন আবিষ্কার জেনে বিস্মিত হয়,আমাদের সাথে সেটা নিয়ে আলোচনা করে।নতুন রেসিপি দেখে রান্না করতে হুটহাট রান্নাঘরে চলে আসে।
আমি ইদানীং আনন্দের একটি নতুন দিক খুঁজে পেয়েছি আমার এই দুর্বলতার ফলাফলস্বরূপ।গত সপ্তাহে আমার ননদ সিমি এসেছিল বাইরের একগাদা খাবার-দাবার নিয়ে। খুব হৈ-চৈ করে বললো, দেখো মা তোমার জন্য কি এনেছি,এসব তো তুমি কখনো খাওনি। তারপর মুখ বাঁকিয়ে বললো,রেস্টুরেন্টে গিয়ে সব তো নিজেরাই খেয়ে দেয়ে চলে আসে, তোমার কথা কে কবে মনে করে বলেছে, বাড়িতে বুড়ো শ্বাশুড়ী পড়ে রয়েছে তার জন্য দুটো নিয়ে যাই! আমার শ্বাশুড়ী কিছু না বলে খাবারগুলো নেড়েচেড়ে দেখতে লাগলেন। চিকেনটা হাতে নিয়ে বললেন,এইডা কেপসি চিকন তো!আমি কিন্তু কেপসি ছাড়া খাইনা।বার্গারটা খুলে খুঁটিয়ে মনযোগ দিয়ে দেখে বললেন, নাহ! আমি যেইডা খাই এইডা সেইরকম না।পিজ্জায় এক কামড় বসিয়ে বললেন,এইডা আছে মোটামুটি,তয় কি জানি নাই নাই মনে হইতাছে। আমার প্রচন্ড খুশি লাগলো।কোথাও গেলে নতুন খাবার দাবারের বেলায় বয়স্করা যেমন মুখভঙ্গি অন্যরকম করে বলে,যেই জিনিসটা খাইতাছি,এইডার নাম কি গো?
অথবা নতুন কিছু দেখলে বৃদ্ধরা যেমন বিস্মিত হয়ে বলে,কত কিছুই যে কালে কালে দেখমু! – আমার শ্বাশুড়ীর স্বভাবে এটা এখন আর নেই।কেউ তাঁকে আনাড়ি ভেবে পরে নিজেই হুট করে চমকে যায় আর সেই চমকটা নিজ চোখে দেখতে পাওয়া আমার জীবনে ভীষন আনন্দের একটা ব্যাপার।এখন ঠিক সেই চমকটাই আমি উপভোগ করতে যাচ্ছি ভেবে মনটা আনন্দে নেচে উঠলো। আমার ননদ সিমি হতভম্ব হয়ে বসে আছে।মা এসব কি বলছে!কথা শুনে মনে হচ্ছে এসব খাবার তার খুবই পরিচিত, শুধু পরিচিতই না বরং সবচেয়ে ভালো আইটেম চেখে দেখার অভিজ্ঞতা তার আছে।কোনটায় কি নেই সেটাও তার বৃদ্ধ বয়সের জিহ্বায় ধরা পড়ে গেছে!এটা কিভাবে সম্ভব! কথাটা বলেই ফেলল সিমি।তোতলাতে তোতলাতে বললো,মা!তু তুমি এসব খাবার কোত্থেকে খেলে?তাও আবার সবচেয়ে বেস্টগুলো!মনে হচ্ছে এসব খাবার তুমি অনেক খেয়েছ!
শ্বাশুড়ী কাটাকাটা গলায় বললেন,হ,খাইছিই তো।তোমার আইজকা মনে পড়ছে যে মায়েরও এসব খাইতে মনে চায়,আর আমার বউ ফাঁকফোঁকর খুঁজে কবে সে আমারে আবার আইনা খাওয়াইবো।অনেক সময় বয়সের কারনে আমার এইসব খাবার হজম অয় না,তহন বৌমা নিজেই বাড়িতে যতটুক পারে রান্না কইরা খাওয়ায়।শাহেদের বিয়ার পরেই আমি এসব খাওন চিনছি।আর তুমি আমার বৌমারে খোঁটা দিলা, তুমি কবে কোনদিন তোমার বাড়িতে শ্বাশুড়ীর কথা মনে কইরা খাওন আনাইছো কও তো মা? সিমি মুখ নিচু করে চুপ করে রইলো। আমার শ্বাশুড়ী বললেন,আইচ্ছা,আনছো খারাপ করো নাই।এহন কতা অইলো,যাওনের সময় তুমি তোমার শ্বাশুড়ী,দাদীশ্বাশুড়ীর লেইগা এইসবকিছুই লইয়া যাইবা,আরো ভালোটা।বুঝছ? সিমি মুখ নিচু করেই মাথা নাড়লো। শ্বাশুড়ীকে নিয়ে ছাদে এসেছি। বাড়িটা নিজেদেরই,দোতলা,ভাড়াটিয়াশূন্য।কাছেপিঠে আর কোন বাড়ি নেই।মেয়েরা ঘুড়ি ওড়াচ্ছে।হাতের নাটাই নিয়ে আমিও এগিয়ে গেলাম ওদের সাথে যোগ দিতে।আমার শ্বাশুড়ী বাগানের গাছগুলোতে সুন্দর করে পানি দিচ্ছেন।
হঠাৎ তিনি ছুটে এলেন আরে আরে,তোমার ঘুড়িতো কাইট্টা যাইবো মনে হইতাছে, দেহি দেহি আমার কাছে দাও।দুহাতে নাটাইটা ধরে তিনি চমৎকার ক্ষিপ্রগতিতে ঘুড়িটা সামলাতে লাগলেন।আমি মুচকি হেসে ওদের মাঝে এসে দাঁড়ালাম।বাচ্চাদের চোখে তুমুল উত্তেজনা,দাদীকে হারাতেই হবে।আমার শ্বাশুড়ী যেন এক ধাক্কায় ফিরে গেছেন তার শৈশবে,ঝলমল করছেন কথায় আর কাজে।আমার কন্ঠনালী তৃপ্তিতে ডুবে গেল। হঠাৎ আমার ভেতরে একটা সূক্ষ অনুভূতির অস্তিত্ব টের পেলাম আমি–“আমরা ভালো আছি”।তিন প্রজন্মের নানা রঙের মনগুলো আজ এই গোধূলীতে একাত্ম হতে পেরে ভালো আছে।
গল্পের বিষয়:
গল্প