পরিবার কথন

পরিবার কথন
রাত এগারোটা বেজে আটচল্লিশ! রাত্রির ঠিক এই সময়টায় আমার অতিরিক্ত রোম্যান্টিক বর একটার পর একটা গান গেয়ে গেয়ে আমাকে শোনাচ্ছে। ঘরের এককোণে সুগন্ধ মোম জ্বালানো, মৃদু গন্ধে শয়নকক্ষে নেশার মতো পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। ছেলেটা আমার জন্য একটা শাড়ি কিনে এনেছে। এর ভেতর দু’- চারবার শাড়িটা পরে আসার জন্য বলেছেও, সুযোগ দেয়নি। আসলে, তার সুমিষ্ট গানের গলা আমাকে এক জায়গায় প্রায় বন্দী করে রেখেছে।
“যাও না, শাড়িটা পরে এসো। তোমাকে প্রাণভরে দেখব।”
“এভাবে একটার পর একটা গান গেয়ে চললে আমি যেতে পারছি না। তুমি আগে গান বন্ধ করো।”
“ও হ্যাঁ। আর গাচ্ছি না, তুমি যাও। আর হ্যাঁ, চোখে কাজল দিয়ো তো।”
আমি মিষ্টি হেসে শাড়ির প্যাকেটটা হাতে তুলে নিলাম। লাল টুকটুকে একটা জামদানি শাড়ি। ছেলেটার পছন্দ দারুণ বলতে হয়! ওয়াশরুমের দরজা আটকে আবার খুলে দরজা ধরে বললাম, “কপালে টিপ দিতে হবে?” “না থাক। আমি ছাড়া আর কারো নজর লাগবে বলে আশা করছি না। ঠোঁটে গাঢ় খয়েরী রঙের লিপস্টিক দিয়ো তো, তোমাকে অসম্ভব মানায়।” আমি মৃদু হেসে দরজায় ছিটকিনি এঁটে দিলাম। কিছুক্ষণ পর রুমে আসতেই দেখি অবাক কাণ্ড! সম্পূর্ণ রুমে পিটপিট আলো ফেলে মরিচবাতি জ্বলছে। পাশেই টি-টেবিলে একটা কেক রাখা। আজ আমাদের তৃতীয় বিবাহবার্ষিকী, ওর মনেই আছে। হঠাৎ পিছন থেকে আমার চোখ চেপে ধরতেই খিলখিল করে হেসে উঠলাম।
“হাসছো কেন? তোমাকে অসম্ভব সুন্দর দেখাচ্ছে!” আমি আবারও মিষ্টি হেসে বললাম, “তোমার মনেই আছে? আমি তো জানতাম ছেলেদের এসব বার্থডে, অ্যানিভার্সারি, ফার্স্ট ডেইটের তারিখ-টারিখ খুব একটা মনে থাকে না। রিমায়েন্ডার দিয়ে রেখেছিলে নাকি?” “গতবছর ভুলে গিয়ে কী অনর্থক কাণ্ড করেছিলাম, মনে পড়ে? তোমার সে কী রাগ! এখন চলো, কেক কাটা যাক।” কেক কাটার আগে শ্রাবণ আমার কপালে মিষ্টি একটা চুমু এঁকে দিলো। সুগন্ধি মোম এতোক্ষণে বোধ হয় আরো মৌ-মৌ গন্ধে সম্পূর্ণ ঘরে মাতাল পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। আমিও শ্রাবণের কানের কাছে মুখ নিয়ে কিছু একটা বলতে যাব, এমন সময় দরজায় ঠকঠক আওয়াজ হলো।
“বৌমা, ঘুমিয়ে গেছো?” আমি নিজেকে স্বাভাবিক করে নিয়ে নরম গলায় বললাম, “না মা। ঘুমোইনি।”
“আমার ঘরে একবার আসো তো মা।”
রাত বারোটা বেজে পাঁচ মিনিট। আমার শাশুড়ি এতোরাতে আমাকে খোশগল্প করতে ডাকছেন বলে মনে হচ্ছে না, গলার ভাঁজে রাগ অথবা অভিমান কিছু একটার ইঙ্গিত পেলাম। তাঁর ঘুম ভীষণ পাতলা। রাতে খুব একটা ঘুমান না, এটা ওটা বই পড়েন। আমার শ্বশুরকে নির্দেশ করে কী সব কথা বলেন। মাঝেমধ্যে এ ঘর থেকে সব শোনা যায়, হাসি ধরে রাখতে পারি না। আমি শাড়ির আঁচল টেনে ঘোমটা দিয়ে মায়ের রুমের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। তিনি ঘরের একোণ হতে ওকোণ হেঁটে বেড়াচ্ছেন। আমাকে দেখে ইশারায় ঘরের ভেতর ঢুকতে বললেন। “ব্যাপারস্যাপার কী, এতো রাতে সেজেছো কেন?” আমি আমতাআমতা করতে লাগলাম, কী বলব ভেবে পাই না। মাকে ভীষণ রাগান্বিত দেখাচ্ছে। কিছু বলতে যাব সেসময় মা বিছানার একপাশে বসে আবারও বললেন, “তোমার শ্বশুরের সঙ্গে আমি আর থাকতে পারছি না। কিছু একটা ব্যবস্থা করো বৌমা।” আমি কিছু না বুঝতে পেরে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম। তিনি আবারও বললেন, “ছেলেটাও হয়েছে গাঁধার গাঁধা, হতচ্ছাড়া! বাপের নাম রেখেছে। বলো ঠিক?”
“জ্বি মা!”
“জ্বি কী? বলো ঠিক।”
“ঠিক!”
“ওর সাথে সংসার করছো কীভাবে? আমি বলে তোমার শ্বশুরের ঘর করে গেলাম। তুমি এতো সুন্দর দেখতে-শুনতে, কোন দুঃখে ওর সঙ্গে থেকে জীবন নষ্ট করছো?”
আমি ভীতসন্ত্রস্ত হয়েই গ্লাসে পানি ভরে মায়ের মুখের সামনে ধরলাম। তিনি কিছু না বলে ঢকঢক করে এক নিশ্বাসে পানি খেয়ে গ্লাস খালি করে দিলেন। পানি খাওয়ার পর মায়ের রাগের মাত্রা তুলনামূলক কম মনে হচ্ছে। আমি তাঁর পাশে বসলাম। তাঁর বাম হাতের ওপর আমার ডান হাতটা রাখতেই তিনি কেমন বাচ্চাদের মতো খপ করে হাতটা আঁকড়ে ধরলেন। “কী হয়েছে মা? হঠাৎ মন খারাপ করেছেন কেন?” মা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “তোমার শ্বশুর দেখো পড়েপড়ে কেমন ঘুমোচ্ছে! সে আমার সাথে সারাদিনে কোনো আলাপ-আলোচনাই করে না। একটা জরুরী কথা বলতে বসেছি, বললাম যে ঘুমোবে না একদম। উঠে বসে আমার কথা শোনো। শুনছিলোও তাই। কথার মাঝপথে হঠাৎ ব্যাঙের মতো ঘ্যাঙর ঘ্যাঙর শব্দ শুনতে পেলাম। এদিক-ওদিক কোনোদিকে ব্যাঙ খুঁজে না পেয়ে তার দিকে তাকাতেই দেখি সে নাক ডেকে ঘুমোচ্ছে।”
আমি বাবার দিকে তাকালাম। সত্যিই তাই! মা এতো জোরেশোরে কথা বলছেন, চিৎকার চেঁচামেচি করছেন, অথচ তাঁর সেদিকে কোনো খেয়াল নেই। তিনি শান্তিতে ঘুমোচ্ছেন। ঘটনার এই মুহূর্তে আমার বর দরজায় একবার উঁকি দিতেই মায়ের চোখে চোখ পড়ে গেল। মা চেঁচিয়ে উঠলেন। “তোকে ডেকেছি এই ঘরে? হয়েছিস তো বাপের মতোই, বজ্জাতের হাড়ি! এখন এখানে কী করছিস? নিজের ঘরে যা।” আমি চোখ টিপে ইশারায় শ্রাবণকে “আসছি বলে” ঘরে যেতে বললাম। ও কিছু না বলেই চলে গেল। আমি মায়ের দিকে তাকিয়ে বললাম, “মা, আপনার চুলগুলো কেমন রুক্ষ দেখাচ্ছে। আসুন মাথায় তেল দিয়ে দেই।”
“বৌমা!”
“জ্বি মা?”
“তোমাকে আমার নিজের মেয়ের মতোই ভালোবাসি, বুঝেছো?”
“আমি জানি মা।”
“জেনে উদ্ধার করেছো। এবার যেটা জানো না, সেটা বলি?”
“জ্বি মা, বলুন।”
“তোমার সঙ্গ আমার খুব ভালোলাগে। এই যে তুমি আমার মাথায় তেল দিয়ে দিচ্ছো, মনে হচ্ছে আমি স্বর্গে আছি।”
আমি মৃদু হাসলাম। মায়ের রাগ বেশ খানিকটা পড়ে গেছে মনে হচ্ছে। আমি তাঁর মাথায় চিরুনি আঁচড়ে দিতে দিতে বললাম, “আপনি নিঃসন্দেহে ভালো মানুষ, মা। ভালো মানুষেরাই অল্প সময়ে একটা মানুষকে আপন করে নিতে জানে।”
“ভালো মানুষ বলছো?”
“অবশ্যই মা! নিঃসন্দেহে।”
“তাহলে আমার জীবনে তোমার শ্বশুরের মতো খারাপ মানুষকে পেলাম কেন? বলো। আর তোমার কপালটাও আমার মতোই খারাপ।”
মা কথার এ পর্যায়ে হাই তুললেন। একটু দম নিয়ে আবার বললেন, “তোমার জন্য আমার বেশ খারাপই লাগে। কার হাতে তোমাকে রেখে নিশ্চিন্তে চোখ বুজবো সেই চিন্তায় রাতে ঘুম আসে না। গর্ধবটা বাপের রগ পেয়েছে। তোমাকে ঠিকমতো সময় পর্যন্ত দেয় না।” দরজায় আবারও ছেলেকে উঁকিঝুঁকি দিতে দেখে আমার শাশুড়ির গলার আওয়াজ এবার বেড়ে গেল, “আবার এসেছিস কেন?” “মা, আমার প্রয়োজনীয় কিছু কাগজপত্র খুঁজে পাচ্ছি না। শান্তাকে যদি একটু ছাড়তে।” “হ্যাঁ, লাইনে এসেছিস এতোক্ষণে! তোদের প্রয়োজনীয় কাজের বেলাতেই বউয়ের কথা মনে পড়ে। তাছাড়া, কোনো দায়িত্ব-কর্তব্য নেই, কিচ্ছু না। অমানুষ পেটে ধরেছিলাম আমি। বউমা এখন তোর খাদিমদারি করতে পারবে না। যা, নিজের ঘরে গিয়ে বাপের মতো ঘ্যাঙর ঘ্যাঙ শব্দ করে নাক ডাক গিয়ে!” আমি বরের দিকে হতাশ দৃষ্টিতে তাকালাম। সে নিজেও কী করবে ভেবে না পেয়ে হনহন করতে করতে আমাদের রুমের দিকে ছুটলো। আমার শাশুড়ি এবার আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “দেখেছো মা? কী অমানুষের অমানুষ!”
রাত বারোটা বেজে সাতান্ন মিনিট! বাইরে মুশলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। মায়ের ভাষ্যমতে বাবা আগের মতোই ব্যাঙের মতো ঘ্যাঙর ঘ্যাঙর শব্দে নাক ডেকে ঘুমোচ্ছেন। মাকে অনেকক্ষণ ধরে মাথায় ঠাণ্ডা তেল দেয়াতে তিনিও ঘুমিয়ে পড়েছেন। আমি মায়ের ঘরের লাইট অফ করে নিঃশব্দে আমাদের শয়নকক্ষে প্রবেশ করলাম। সুগন্ধি মোম গন্ধ ছড়িয়ে নেশার মতো সৃষ্টি করে পুঁড়ে নিঃশেষ হয়ে গেছে। কোরিডোরের আবছা আলোয় টি-টেবিলে রাখা কেকটা শুধু দেখা যাচ্ছে। কোনোরকমে হাতড়াতে হাতড়াতে বিছানার কাছে পৌঁছালাম। ব্যাঙের মতো ঘ্যাঙর ঘ্যাঙ শব্দে নাক ডাকার আওয়াজ ছাড়া আর কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। ছেলেটা সত্যি সত্যিই ঘুমোচ্ছে। এই মুহূর্তে কেন জানি না আমি ভীষণভাবে আমার একজন পুত্রবধূর প্রয়োজন অনুভব করছি, যাকে জড়িয়ে ধরে রুদ্ধস্বরে দীর্ঘশ্বাস ফেলতে ফেলতে বলা যায়, “আমি বলেই তোমার শ্বশুরের ঘর করে যাচ্ছি।
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত