কুদাল আর সিমেন্ট এর খালি বস্তা টা নিয়ে অল্প ফাক করা নতুন গেট দিয়ে ডুকতে গিয়ে নিজের অজান্তেই ধাক্কা খেলাম কারো সাথে,,, আমি খেয়াল আগেও করিনি এখনো না চেয়েই সরি বলে চলে আসতে যাবো তখনই আমাকে থমকে দাড়াতে হলো মৃদু কন্ঠের মিষ্টি আওয়াজ শুনে। আওয়াজ টা তো আমার চিরচেনা আর এটা নিতান্তই আমার প্রিয়তমার কন্ঠের আওয়াজ। তবোও মনের সন্দেহ দূর করার জন্য পিছনে ফিরে তাকালাম, তাকাতে তাকাতে বললাম আমি দুঃখিত তাড়াহুড়ো করে,,,,কথাটা শেষ করার আগেই আমার মুখ হা হয়ে গেলো। অবাকের চরম পর্যায়ে চলে গেলাম লিমা কে সামনে দেখে। জীবনে কল্পনা করিনি আজ এভাবে এই অবস্থায় লিমার সাথে আমার দেখা হবে৷ এর চাইতে বুঝি মরন যন্ত্রণা হয়তো ভালো ছিলো আমার জন্য।
মূহুর্তের মধ্যে আমাকে দেখে লিমার চোখ বেয়ে পানি ঝড়তে লাগলো,তার এ জিনিস টা আমি কখনো সহ্য করতে পারতাম না, এখনো পারিনি, মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে ফিরিয়ে নিলাম। আমার পাথুরে মনটা আরো পাথরের ন্যায় শক্ত করে বললাম আমি আবারও দুঃখিত তোমার সামনে পড়ার জন্য। মায়ার এখনো আসে তাই তুমি করেই বলেছি, আপনি শব্দ টা গলা দিয়ে বের হবে না। অনিক তুমি এখনো আগের কথা মনে করে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছো? তোমাকে দেখতে আমার অনেক ইচ্ছে করছে,আমার দিকে ফিরে কথা বলো। প্লিজ অনিক। বুকটা ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছিলো আমার। তবুও মনটা শক্ত করে বললাম এগুলো তোমার বাহানা মাত্র,আমি চলে গেলে ঠিকই না দেখে থাকতে পারবা। আমি জানি লিমা খুব কষ্ট পেয়েছে কথা টা শুনে৷ এখনো কাদছে। কাদুক হালকা হোক কেদে, আমার ভিতর ফেটে গেলেও চোখ দিয়ে পানি ঝড়তে দিলাম না৷ বললাম আমি তোমার শশুর বাড়িতে রাজমিস্ত্রী কামলা হিসেবে এসেছি। মিস্ত্রি দের মতো আচরণ করবা। বেশি আধিক্ষেতা দেখাতে যেয়ে তোমার সুখের সংসার তছনছ করিও না। আমি আগেও ভালো ছিলাম তোমাকে নিয়ে, এখনো ভালো আছি তোমাকে ছাড়া। তুমিও মানিয়ে নাও।
আর এসব ফালতু কান্না বন্ধ করে সংসারের কাজে মন দাও। এগুলো যদি তোমার স্বামী, শাশুরী ননদ দেখে তাহলে তোমার কপালে দুঃখ আছে। এই বলে আমি আমার কাজ করার জন্য ছাদে চলে আসলাম। সেও দৌড়ে রুমে চলে গেলো, আমি জানি সে অনেক কাদবে এখন, খুব কাদবে৷ খুব কষ্ট পেয়েছে সে। ছাদে আসার পর কোনো অবস্থাতেই কাজে মন বসাতে পারছিনা। ভিতর টা দুমরে মুচরে যাচ্ছে আমার। যেখানে লিমাকে নিয়ে আমার ভালোবাসার সংসারের ঘর বানানোর কথা। আজ আমি সেখানে লিমার আর তার স্বামীর সুখের ঘর বানানোর কাজ করতে আসছি। যেখানে লিমাকে নিয়ে আমার একসাথে খাওয়ার কথা, সেখানে তার রান্না খেতে হবে তার বাড়ির কামলা হয়ে। একজন প্রেমিকের জন্য এ কষ্ট গুলো কি পাহাড় সম নয়? এর চেয়ে বড় যন্ত্রণা আর কি হতে পারে? খুব ইচ্ছে করছে একটু কাদতে, কাদতে পারলে হয়তো বুকটা হালকা হতো। পাথুরে এই মনটা আর পাথুরে করে রাখা যাচ্ছেনা৷
নিজের সহকর্মী রা কাজ করছে আর আমার বুকে চলছে হাহাকার এর রাজত্ব। সহকর্মী এক বড় ভাই পাশে এসে কাদে হাত রেখে বললোঃ মন খারাপ করিস না অনিক। মধ্যবৃত্ত ছেলেদের এসব মেনে নিয়েই জীবন পাড় করতে হয়। তুমি দেখেছো সবকিছু? হুম দেখলাম তুই প্রতিনিয়ত যার কথা একলা হলে ভাবিস ,, যাদের গল্প শুনিয়ে আমাদের কান ঝালাপালা করে ফেলতি একসময়, আজ সেই মেয়েকে আগে না দেখলেও ঠিক ই বুঝতে পারলাম এটাই তোর সেই লিমা ছিলো। বড় ভাই আমি জানতাম না এটা তার স্বামীর বাড়ি। জানলে জীবনে এই গ্রামে ভুলেও আসতাম না। আমি জানলে কি তোরে আসতে দিতাম? জীবনে কে পারবে সহ্য করতে নিজে প্রেমিকার বাড়িতে কামলা দিতে? তোর কোনো কাজ করা লাগবে না। চুপচাপ বসে থাক। ভাই আমার খুব কষ্ট লাগতেছে। আমার ভিতরের অবস্থা টা কিছুতেই বলে বুঝাতে পারবো না ভাই। অনিক তুই জীবনে অনেক কষ্ট সহ্য করে বড় হয়েছিস আমি জানি। আমি জানি তোর সহ্য ক্ষমতা অসীম। এটাও জানি তোর খুব কষ্ট হচ্ছে এখন কিন্তু তোর এই পাথুরে মন টা আরো পাথর করে রাখতে হবে৷
ভাইয়ের কথামতো চুপচাপ বসে আছি ছাদে। কোনো কাজ করতে ইচ্ছে করছেনা। কোনো কাজেই মন বসছে না। বার বার অতীত মনে পড়ছে। মনে পড়ছে তার সাথে কাটানোর প্রতিটা মুহুর্ত। তার সাথে প্রতিটা মুহুর্তের স্মৃতি চোখের সামনে ভেসে উঠছে, আর সাথে বুকের মাঝে অসহ্য যন্ত্রণা শুরু হয়ে গেছে। এসব ভাবতে ভাবতে দুপুর হয়ে গেছে, বাড়ির মহাজন এসে কাজ দেখে গেছেন আর দুপুরের খাবারের জন্য বলে গেলেন। আমার গলা দিয়ে তার সামনে খাবার নামবে না, যেখানে লিমা আমাকে বাতাস করে ভাত ভেড়ে খাওয়ানোর কথা সেখানে কি করে অন্যের টা দেখবো। তাই বড় ভাই কে বললাম আমি খাবো না। বড় ভাই বিষয়টি বুঝতে পেরে মহাজন কে বললো সে এখানে খাইতে চায় না, তাকে কিছু টাকা দিন বাইরে থেকে খেয়ে আসুক। কথাটা শুনে লিমার চোখ ছলছল করে উঠেছিল, সে হয়তো চেয়েছিলো তার হাতের রান্না খাই, আমি টাকাটা নিয়ে বের হয়ে গেলাম বাজারের উদ্দেশ্যে।
বাসা থেকে বের হয়েই রাস্তায় আসা মাত্রই দেখা হলো জাকারিয়ার সাথে। সে আমার চেয়ে কিছুটা বড় হলেও আমরা পূর্বপরিচিত ছিলাম। কারন সে আমার বোনকে বিয়ে করতে চেয়েছিলো, বাবা রাজি হননি তাই বিয়ে করতে পারেনি। শুনেছি দীর্ঘদিন পরে নাকি বিয়ে করেছিলো। তাছাড়া তার সাথে আমার দুয়েকবার লিমার সাথে রিলেশন থাকা অবস্থায় ঝগড়া হয়েছিল। সেই থেকেই সে আমার চেনা জানা। তার সামনে পড়ায় সে আমাকে বললো আরে অনিক যে, কি অবস্থা তোমার? এই এলাকায় কেন? কিভাবে? আমি বললাম আপনাদের ছাদের কাজটা আমরা ই করতেছি। ওহ আচ্ছা তো যাচ্ছো কোথায়? বাজারে, খাবার খেয়ে আসি। কি বলো, তুমি আমার বাসায় কাজ করতে এসেছো সে হিসেবে আর এমনিতেও তুমি আমার রিলেটিভ হতে, ধরে নাও রিলেটিভ ই৷ আজকে আমাদের বাসায় খাবে। চলো। আমি বার বার নিষেধ করছিলাম যে আমি খেতে পারবোনা। সে তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো কেন লিমার হাতের রান্না কি খাইতে মানা নাকি? আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, লিমার হাতের রান্না মানে? কেন? লিমার সাথে দেখা হয়নি?
এতক্ষণে বুঝতে পারলাম সে আমার বোনকে না পেলেও কি হবে, আমার কলিজাটা ঠিকই পেয়েছে। সেই তাহলে লিমার জামাই। আমি জানি সে আজকে আমাকে দিয়ে মধুর প্রতিশোধ নিবে। সে আবার বললো কি ভাবছো অনিক। আসো তোমার ভাবির হাতের রান্না খাবে। কেন কষ্ট করে বাজারে যেতে হবে? আমি যেতে চাইলাম না। সে জোড় করে আমাকে নিয়ে গেলো। সে বলতে লাগলো খাবারের টেবিলে বসে, শুনো বউ সবুরে মেউয়া ফলে একটা কথা আসেনা? আমি সেটা পেয়েছি। আমার সামনে তার স্বামী বউ ডাকায় সে অস্বস্তি বোধ করছে বুঝতে পারলাম। তাই আমিই আগ বাড়িয়ে বললাম ঠিক বলেছেন জাকারিয়া ভাই৷ যদি মানুষ ধৈর্য ধরতে জানে কষ্ট করতে জানে তাহলে ঠিকই এর ফল পায়, হোক তারতারি বা দেরিতে।
জাকারিয়া আর আমি বুঝতে পারলেও লিমার আমাদের কথার মানে বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে। তাই সে অস্বস্তি বোধ করছে। আমার সামনে তার জামাইকে ভাত বেড়ে দিতেও তার হাত কাপছে। আমি এসব আর দেখতে চাচ্ছিলাম না বিধায় অল্প খেয়ে তারাতারি উঠে গেলাম। খাওয়াদাওয়া শেষ করে ছাদে এসে বসে বসে অতীতের কথাই ভাবছিলাম। জাকারিয়া আসলো ছাদে, দেখলো আমি বসে আছি বাকি সবাই কাজ করতেছে। সে বললো কি ব্যপার অনিক? হুম কি সমস্যা? না এটা লিমার শশুর বাড়ি ঠিক আছে তোমার তো শশুর বাড়ি না। হুম তো? কাজ না করে খেয়ে দেয়ে বসে আসো যে? বড় ভাই পাশ থেকে এসে বললো জাকারিয়া কাজ এর তদারকি তোমার বাপজান করছে করবে। কাজ বুঝে পেলেই হয়, এখানে এত কথা বলার দরকার নাই। অযথা তাকে বিরক্ত করিও না।
আমি আবার বিরক্ত কই করলাম আচ্ছা যাচ্ছি বউটার সাথে রোমান্স করে আসি৷ কথাটা আমার কানে তীরের মত আসলো। কেন জানি তাকে মেরে ফেলতে ইচ্ছে করছিলো। তাও সব সহ্য করে যাচ্ছি৷ বড় ভাই বলল আমার বাইকের চাবি নিয়ে বাসায় চলে যা। এখানে তোর থাকার দরকার নেই। তার কথামতো বাইকের চাবি নিয়ে বাইক নিয়ে রাস্তায় বের হবো এমন সময় জাকারিয়া আসলো কাছে। এসে বললো অনিক আমাকে একটু বাজারে নামিয়ে দিয়ে যাইও৷ মন না চাইলেও উঠালাম আর জানালার দিকে চোখ গেলে দেখলাম লিমা কান্না করছে। স্পষ্ট তার চোখের জল গড়ানো দেখছিলাম। কিন্তু মুছে দেওয়ার অধিকার টুকু নেই। মাঝ রাস্তায় এসে সে বললো অনিক জানি তোমার কষ্ট হয়েছে,, এসব ব্যবহার করতাম না আমি যদি তোমার বাবা তোমার বোনকে বিয়ে দেওয়ার সময় আমাকে অপমান না করতো। সেটা বুঝলাম কিন্তু লিমাকে কেন ছিনিয়ে নিলেন?
ওইটাও প্রতিশোধ হিসেবে। কি রকম? মনে নেই এই লিমার দিকে তাকাইছিলাম বলে বাজারে সবার সামনে কি মাইর টা ই না মারছিলা? হুম বুঝেছি। মধুর প্রতিশোধ নিয়েছেন। হুম ভালো থেকো আর আমাদের জন্য দোয়া করো যেন তারাতাড়ি বাচ্চা নিতে পারি। দাতে দাত চেপে রাগ কন্ট্রোল করে জোড়ে বাইকের ব্রেক কষলাম, তাকে নামিয়ে দিয়ে ফুল স্পীডে বাইক চালাচ্ছি। মনে হাজারো অতীত সহস্র স্মৃতি মিলিয়ন বিলিয়ন কল্পনা অসংখ্য যন্ত্রণা। হৃদয় টা অচেনা৷ চলছি আমি অজানায়।
গল্পের বিষয়:
গল্প