হৃদি, তোমার অস্বস্তি লাগছে না তো? গোলাপের পাপড়ি দিয়ে সাজানো খাটে বউ সেজে বসে আছি । মায়ের অসুস্থতার জন্য বাবার আপত্তি থাকা সত্ত্বেও হুট করে হৃদুর সাথে বিয়েটা হয়ে গেল। হৃদুকে ভালোবাসি না তা নয় । অনেক ঝড়ঝাপটার পর হৃদু আজ আমার স্বামী। হৃদুর দিকে না তাকিয়েই বললাম, না লাগছে না। হৃদু কি দিয়ে কথা শুরু করবে ভেবে না পেয়ে বলল, তোমার বোনকে আমার ভয় লাগে। আমি এবারও না তাকিয়েই বললাম, কেন? তোমার বোনের সাথে কথা বললেই মনে হয় সারাক্ষণ উনি রেগেই থাকে। তুমিতো তার সঙ্গে বেশ হাসিমুখেই কথা বলো জানতাম।
ভয় ভয় বুকে হাসিমুখে কথা বলি । আমি আমার দুর্বলতা প্রকাশ করতে পছন্দ করি না নিন্তানই কারণ ছাড়া, আর আমি আমার ভালোবাসার মানুষগুলোর সাথে হেসেই কথা বলি তা তো তুমি জানো ! যাদের সঙ্গে আমি হাসিমুখে কথা বলি বুঝতে হবে তাদের আমি ভালোবাসি। যেমন- তুমি। হৃদুর মুখ থেকে আজ ভালোবাসার কথা শুনে লজ্জা করছে। মাথা নিচু করেই বসে রইলাম। কাঙখিত পরিচিত মানুষটার কাছে লজ্জা পাওয়ার কথা না। তবুও পাচ্ছি। হৃদু বলল, তুমি এখনও বড় হলে না। কচি কলা পাতা রঙের একটা জরজেট শাড়ি আমার হাতে দিয়ে বলল, ভারী শাড়ি গয়না পরে আছো সব খুলে আগে ফ্রেশ হয়ে আসো।
আমি বিছানা থেকে নামার জন্য পা বাড়াতেই তোয়ালে আর টির্শাট নিয়ে সে হণহণ করে নিজেই ওয়াশরুমে ডুকে গেল। কি হল ব্যাপারটা! আমি শাড়ি বদলাবার কোন ব্যবস্থা করতে পারছি না। সবসময় মা শাড়ি পরিয়ে দিয়েছে। মা তো এমনিতেই অসুস্থ সারাদিনের বিয়ে বাড়ির ধকলের পর ক্লান্তিতে হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে ! ভাবী বাসা ভর্তি মেহমান সামলাতে ব্যস্ত। শাড়ি পরতে না পাড়ার কারণে মানুষটার দেয়া শাড়ি পরা হবে না ? মনটা মানছেই না । এতবছরের পরিচয়ে মানুষটা কখনও তো কিছু চায় নি। শাড়ির ভাজটা খুললাম। হৃদুর সাথে একটা জায়গায় আমার খুব অমিল। শাড়ি আমার পছন্দের না। আমার মতে শাড়ি পরার মত ঝামেলার কাজ আর হয় না। শাড়ি পরে তো হাঁটতেই পারি না।
হৃদু মাথা মুছতে মুছতে ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে এসেছে। তবুও চুল থেকে হালকা গড়িয়ে পানি পড়ছে। তার মুখ হাসি হাসি। আমি প্রথমবার তার দিকে তাকালাম, মানুষ সবসময় বলে মেয়েরা মায়াবী হয়। আজ কথাটা পুরোপুরি ঠিক মনে হচ্ছে না কোন ছেলেও এত মায়াকাড়া চেহারা নিয়ে জন্মাতে পারে ? সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এই ছেলেকে দেখলে নীড়ার জায়গায় অবশ্যই তাকে নিয়ে লিখত। সাদা টির্শাট আর ব্লু রঙের জিন্সে হৃদুকে দেখে বুকের ধুকপুকানি বেরে গেল। ফর্সা মুখটা ব্লিডিং এর বাহিরে সাজানো মরিচের বাতি থেকে আসা হালকা নিয়ন আলোতে আরও অপূর্ব লাগছে । হৃদু চারবছর আগে ধরেই নিয়েছিল আমি তাকে ভীষণ অপছন্দ করি। অথচ সে হারিয়ে যাবার পর ছটফট করেছি মানুষটাকে একবার চোখের দেখা দেখার জন্য। তখন অবশ্য বুঝতে পারি নি মানুষটাকে আমিও ভালোবেসে ফেলেছিলাম। হৃদু বা হাতে ঘড়িটা পরতে পরতে বলল,শাড়ির ভাজ খুলে সারারাত বসে থাকলে হবে ? যাচ্ছি। হৃদু করুণ গলায় বলল, শাড়ি পড়া লাগবে না। আশ্চর্য! ছেলে তো। কেন লাগবে না? তুমি তো শাড়ি পরতে পারো না।
আমি একটু রাগী মুখেই বললাম, হৃদু শোন কিছুক্ষণের জন্য রুম থেকে বের হও। আমি চেইঞ্জ করব। আমি না ডাকা পর্যন্ত রুমে আসবে না। আর শোন আমি একাই শাড়ি পরবো। তোমাকে শাড়ি পরতে হবে না। অবশ্যই হবে। না পরা পর্যন্ত আমার মন শান্ত হবে না। সবসময় মনে হবে আমার জন্যে বেচারা শাড়ি পরা বাঙালি নারী দেখা থেকে বঞ্চিত হল। মন খারাপ থেকে হবে সন্দেহ । সেখান থেকে মনে হবে তুমি অন্য শাড়ি পরা মেয়ে দেখে আফসোস করছ ! তারপর একদিন দেখা যাবে আমাদের দূরত্ব হয়ে গেছে। তুমি সারাক্ষণ এত কথা বলো কিভাবে ? তুমি একটুও বদলাও নি হৃদি । বদলে গেলে খুশি হতে ? না । তুমি এখন রুম থেকে যাও তো হৃদু। আমি শাড়ি পরবো। আমার নিজেরো শাড়ি পরতে ইচ্ছে করছে। তোমার জন্যও পরবো। মন খারাপ থেকে মুক্ত হব। হৃদুর অবাক মুখটা দেখতে ভালো লাগছে। আমি হা হা করে শব্দ করেই হেসে উঠলাম। তাকে ধাক্কা দিয়ে বারান্দায় বসিয়ে রাখলাম।
রাগ করার বদলে হৃদু বারান্দায় বসে থেকেই বলল, হৃদি কাউকে এত ভালোবাসা ঠিক না! যে হারিয়ে গেলে বেঁচে থাকা দায় হয়ে যাবে। ভালোবাসাটাকে শক্তি করতে হয় দুর্বলতা নয়। হৃদু। কি? তোমার কি মনে হয় আমি মরে যাব ? মরে যাবে কেন? এসব কি ধরনের কথা? হারিয়ে আমি তখনই যাবো যেদিন তুমি হারাতে দেবে। এই জন্যেই আমার মনে হচ্ছে তুমি মনে করছ আমি মরে যাব। তাই কম ভালোবাসতে চাইছ? হৃদু চুপ করে থেকে বলল,শাড়ি পরা হল? হৃদুর সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। হৃদু বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেল। কিছু বলছ না যে হৃদু? আলতো করে আমার কপালের উপর আসা চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে খোঁপাটা খুলে দিল। শীতের হাওয়া দিচ্ছে। খোলাচুলগুলো উড়ে গিয়ে হৃদুর মুখে লাগছে। আর্দশ ছেলে বলতে যা বুঝায়, হৃদু তাই। হৃদু হাসছে। হাসির কী আছে? শাড়িটাও ঠিক করে পরা শিখলে না।এজন্য হাসছি। তুমি অদ্ভুত ছেলে হৃদু।
আমি মোটেই অদ্ভুত নই। আমি ছাপোষা অতি সাধারণ সাদামাটা বলেই তোমার আমাকে অদ্ভুত মনে হয়। তুমি খুশি হয়েছ তো হৃদি? খুশি হয়েছে কি না বলতে পারছি না তবে আজকের মত পাওয়ার আনন্দ অনেকবছর হয় নি। ইচ্ছে করছে হৃদুকে জড়িয়ে ধরতে। এই মনে করার জন্য আজ লজ্জা ইতস্ততবোধ কোনটাই কাজ করছে না ।
প্রথমবার হৃদু যখন বাসায় বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এল। তখন খুব রাগ হচ্ছিল। বন্ধুত্বকে স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কে পরিণতি দিতে হবে কেন? মায়ের অসুস্থতার জন্য তার মুখের উপর কিছু বলতে পারলাম না। আর বাবাকে ভীষণ ভয় পাই। এখন কিছু বলতে গেলেই বলবে তোর জ্ঞানের কথা তোর কাছে রাখ। বাবা মা কে ভীষণ ভালোবাসে। মায়ের কথা বাবা কখনও ফেলতে পারে না। এই বয়সেও তাদের জুটিটা হিংসা করার মত।
কাউকে না জানিয়ে হৃদুকে না করার উদ্দেশ্য তার সাথে দেখা করতে গেলাম। সরাসরি না করাও ঠিক না। এমন কিছু কথা বলব যাতে হৃদু নিজে বিয়েটা ভেঙে দেয়। ধরেই নেবে আমাকে নিয়ে সে সুখী হতে পারবে না। হৃদুর সামনে দাঁড়াতেই সে জিজ্ঞেস করল,কেমন আছ হৃদি? কতকিছু মনে গুছিয়ে রেখেছিলাম তাকে বলব বলে। চেনা ডাকনাম ধরে ডাকায় সব পরিকল্পনা বেস্তে গেল। বছর চারেকপর মানুষটার মুখে হৃদি নাম শুনলাম। হৃদি তাকিয়ে আছো কেন? কিছু তো বলো? আমি নিজেকে স্বাভাবিক করে বললাম,ভালো আছি। হৃদুকে কিছু বলতে ইচ্ছে করল না। আমি যাচ্ছি। না যাবে না। দুমিনিট বসো। তোমাকে দেখে ভালো লাগছে। আমি বাধ্য মেয়ের মত দু’মিনিটের জায়গায় দু’ঘন্টা বসেছিলাম। কিন্তু কোন কথাই বলতে পারি নি।
ভোর রাতের দিকে ফোন বেজে উঠল। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে শোনা গেল, হৃদি জানো আমি স্বপ্ন দেখেছি আমরা পুতুলের মত সুন্দর একটা বাচ্চা মেয়ে নিয়ে খেলা করছি। আমি সেই বাচ্চা মেয়েটির বাবা আর তুমি মা। হৃদি ভোরের স্বপ্ন নাকি সত্যি হয় তুমি বিশ্বাস করো? হৃদুর কোন কথার উত্তর না দিয়ে ফোন কেটে দিলাম। বাকিরাতটুকু জেগে আমি কল্পনা করেছি হৃদুর বর্ননার মত সুন্দর একটি দেবশিশু আমার সামনে খেলা করছে। সকাল থেকে সবকিছুই এলেমেলো হয়ে গেল। বোনের চোখে তা ধরা পড়ে গেল। এরিয়ে যেতে চাইলেও তার কাছে আমি কিছুই লুকাতে পারি না। কি হয়েছে তোর? সত্যি জানতে চাও? জানতে চাই জানি। আর তুই আমাকে মিথ্যা বলবি না তাও জানি।
আমি হৃদুকে প্রচন্ডরকম ভালোবেসে ফেলেছি। সেটা আজ বুঝতে পারলি? তুই অনেক আগে থেকেই ওরে ভালোবাসিস। হৃদুর শরীরের চেনা ঘ্রাণে মাতাল হয়ে আছি।জোরে নিঃশ্বাস বইছে। এমন সময় দরজায় কড়া নাড়ার আওয়াজ হল। হৃদু আমাকে ছেড়ে দিয়ে দরজা খুলতেই ভাবী বলল,হৃদুর সাথে দেখা করতে দুজন লোক এসেছে। হৃদুর মুখটা ছোট হয়ে গেল। কাউকে কিছু বুঝতে না দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে অভয়ের হাসি দিয়ে রুম থেকে বের হয়ে গেল। আমি পরিকল্পনা করতে লাগলাম আজ ভালোবাসার কথাটা হৃদুকে জানিয়ে দেব। হঠাৎ ভাবনার দেয়াল ছেদ হল বোনের কথায়। বোন বলল,বুনু মন শক্ত করো। তোমার হৃদু দেশের জন্য কাজ করবে। তোমার গর্ব হওয়া উচিত। কি হয়েছে? এভাবে কথা বলছো কেন? হৃদু আবার তাড়াতাড়ি চলে আসবে। তোমার হৃদুকে আজ যেতে হবে।
কথাটা শুনে বুকের ভেতর ভূমিকম্প শুরু হয়েছে। আমি ভেঙেচুড়ে যাচ্ছি। আমাকে একা থাকতে হবে জানতাম। কিন্তু আজকের রাত থেকেই ? বিয়ের রাতে এর চেয়ে কোন কঠিন সত্যি হয় না। চোখের জল আটকে রাখতে চাইছি। কিন্তু পারছি না। তীব্র কষ্ট আর ভয় আমাকে চেপে ধরেছে। হৃদু ঘরে ঢুকলো । হৃদুকে ভালোবাসি কথাটি বলার মত আওয়াজও আমার মুখ থেকে বের হচ্ছে না। হৃদু দুহাত দিয়ে গাল দুটো ধরে মাথা উঁচু করল। হৃদি তাকাও আমার দিকে। মন খারাপ করো না। আমার স্ত্রীর চোখে জল মানায় না। বিজয়ের আনন্দে মেতে ওঠা কোন এক ডিসেম্বরে আমাদের আবার দেখা হবে। তোমার ভালোবাসা আমাকে ফিরিয়ে আনবে। হৃদু আমার কপালে চুমু খেয়ে বলল,আমাদের মেয়ের নাম রাখবে জয়ী। হৃদু আমার দুহাত একসাথে করে জাতীয় পতাকাটা তুলে দিয়ে মুঠোবন্দি করে স্যালুট দিয়ে বলল,জয় বাংলা। শিশের আওয়াজ কানে এল। হৃদু আর একমুহূর্তও দাঁড়ালো না।
বারান্দায় বাবার বুকে মাথা দিয়ে দাঁড়িয়ে দেখছি হৃদুর চলে যাওয়া। যতদূর দৃষ্টি যায়।হৃদু আর পিছনে ফিরে তাকায় নি। রাতের অন্ধকারে মিশে গেল হৃদু। চিৎকার করে কাঁদতেও পারছি না। বাবা আর বোনকে শুধু বারবার বলছিলাম আমার হৃদুকে এনে দেও। বাবা আমাকে ঘুমের ঔষধ দিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিল। ফুলের পাপড়িগুলো এখনও শুকায় নি। হাতের মেহেদীর রঙ ওঠে নি। মোমবাতিগুলো ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে দিলাম। সবকিছু এখনও সাজানো শুধু মানুষটা নেই। পতাকাটা বুকে জড়িয়ে ধরে ফুফিয়ে কাদঁতে লাগলাম। যে ফুলের বিছানায় ভালোবাসা মিশ্রিত হওয়ার কথা ছিল সে বিছানায় হৃদয়ের রক্তক্ষরণ অশ্রু হয়ে মিশে যাচ্ছে।
বারবার মনকে বিশ্বাস করাতে চাইছি চলে যাওয়া মানে প্রস্থান নয়। ভোরের আযান হচ্ছে। শাড়িটা পাল্টে পতাকাটা আলমারিতে তুলে রেখে ক্যালেন্ডারে দাগ কাটলাম। সূর্যোদয় হচ্ছে। আকাশের দিকে তাকিয়ে বললাম, আমার হৃদুকে ভালো রেখো। আগের দিন বিয়ে বাড়ির ঝামেলা যাওয়ায় প্রচুর কাজ ছিল। সারাদিন তেমন খারাপ না লাগলেও কাজ শেষ করে চাদরটা গায় জড়িয়ে পতাকাটা হাতে নিয়ে বারান্দায় দাঁড়ালাম। পশ্চিমা আকাশে সূর্য হেলে পড়েছে। ডিসেম্বরের শহরে তোমার ফেরার অপেক্ষায় দুটি চোখ প্রতিটা নির্ঘুম রাতে।
গল্পের বিষয়:
গল্প