প্রতিক্ষার প্রহর

প্রতিক্ষার প্রহর
বিয়ের ঠিক তিনমাস পর উনি বাইরে চলে গেলেন। আমি উনার মা বাবা আর পড়া লেখা নিয়ে ব্যাস্ত হয়ে পড়লাম। অনার্স ২য় বর্ষের ছাত্রী আমি। আমার উনার কড়া নির্দেশ পড়ালেখার যেন ক্ষতি না হয়। শ্বশুর শাশুড়ির ও একই কথা পড়ালেখার যেন কোনো ক্ষতি না হয়। উনার সাথে রোজ কথা হয়। এখন ওনার সাথে কথা না বললে দমবন্ধ হয়ে আসার উপক্রম হয়ে যায়। নিজের চাইতে বেশি ভালোবাসি তাকে। উনার শূন্যতা বড়ো বেশি পোড়ায়। ৮মাস হয়ে গেছে উনি বাইরে গেছে যে। উনার প্রতিদিনের একই কথা
: যে দিন আমি বাড়ি আসবো সেই দিন তুমি সিঁদুরে লাল শাড়ি পরবে, আমার আনা সেই লাল কাচের চুড়ি দিয়ে দুহাত ভর্তি করবে। চুল গুলো যেন ছাড়া থাকে আর চোখে গাড় কাজল। উনার এইসব বায়নায় আমি হেসে উঠতাম। তখন কপট রাগ দেখিয়ে বলতো
:যে ভাবে বলছি ওই ভাবে না সাজলে খারাপ হবে কিন্তু, কখনো কথাই বলবো না।
আর আমি উনার কথায় রাজি হয়ে যেতাম। ১ বছর হয়ে গেল আর উনার আসার সময়ও হয়ে এলো। একপলক দেখার তীব্র ইচ্ছা গুলো প্রকট হয়ে উঠলো। এক সপ্তাহ পর আসবে উনি। কার জন্য কি আনবে তা কিনতে ব্যাস্ত। ফোনে কথা কম হয় এখন। বাড়ি আসার তোড়জোড় চলছে তাই হয়তো। মা বাবা বেশ খুশি, আর হবেই বা না কেন! তার কলিজার টুকরো আসছে বলে কথা। চার দিন আগ থেকেই মোবাইল বন্ধ। বার বার ট্রাই করেও তাকে পাওয়া যাচ্ছে না, হয়তো ব্যাস্ত তাই। বাড়ি আসবে বেশ গোছগাছ করবে তাই হয়তো।
দেখতে দেখতে চারদিন পার হয়ে গেল। আজ মা নিজ হাতে সব রান্না করলো। আমাকে চুলোর ধারে কাছেও যেতে দেয়নি। মা আমাকে তার নিজ হাতে সাজিয়েছে সিঁদুরে লাল শাড়ি হাত ভর্তি কাচের লাল চুড়ি, চুল গুলো বাঁধন মুক্ত করে দিলো আর চোখে গাড় করে কাজল দিলো। সবই আমার উনার কিনে দেয়া। মা আমাকে সাজিয়ে ননির পুতুল বানিয়ে রেখেছে। দুপুর ১টার কাঁটা ছুঁই ছুঁই বাড়ির গেটে বেশ কয়েকটি গাড়ি এসে থামলো। বেশ অবাক লাগছে এতো গাড়ি দেখে আবার উনার কথা ভেবে লজ্জাও লাগছে। হুম হয়তো উনার বন্ধুরা তাকে আনতে গেছিলো। আমি আর মা দরজার পাশে দাঁড়িয়ে আছি। গাড়ি থেকে উনার বেশ কয়েকজন বন্ধু নামলো , তাদের দেখেই চিনলাম। তারা সবাই আমাদের বিয়েতে এসেছিল।
আমার দু’চোখ ব্যাস্ত হয়ে গেল উনাকে খুঁজতে কিন্তু দেখা পেলাম না। এক এক করে সব গাড়ি চলে গেল। উনার সব বন্ধুরা জড়ো হয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে আবার কেউ কেউ ব্যাস্ত ভঙ্গিতে মোবাইলে কথা বলছে। কিছুক্ষণ পর তারা গেইট থেকে বেরিয়ে গেল। আমি আর মা বুঝার চেষ্টা করছি আসলে হচ্ছেটা কি! একটু পর দেখলাম দারোয়ান গেইট পুরো খুলে দিলো। নিঃশব্দে একটি এম্বুলেন্স বাড়ির গেইটে প্রবেশ করলো। বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠলো! হচ্ছেটা কি! মা আমার হাত শক্ত করে চেপে ধরলো। মায়ের শরীর ভীষণ কাঁপছে। উঠোনে গাড়ি থামিয়ে দিলো। সবাই মিলে একটি কফিন বের করে আনলো। সবাই কাঁদছে মাও কাঁদছে খুব কাঁদছে। আমি তাকে সামলানোর সাহস পাচ্ছি না। ধীরে ধীরে কফিনের কাছে গেলাম। কফিন খোলা হলো। কফিনের ভেতরে চোখ যেতেই বুকটা ধক করে উঠলো। কেমন যেন খালি খালি লাগছে। চারপাশ শূন্যতায় ভরে গেল। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে।
কফিনের পাশে বসে তার মুখ আলতো ছুঁয়ে দিলাম। সে ঘুমিয়ে আছে এই ঘুম ভাঙ্গবে না আর। খুব করে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছে তার পছন্দ মত সাজলাম তাও সে কথা বলছেনা, তার দেয়া শাড়ি চুড়ি সবই পরলাম তাও সে অভিমান করে আছে। আমি তার দেয়া সব কথা রাখলাম তাও সে চুপ করে আছে। সে না তার নিজের কথা রাখেছে , না আমার কথা রেখেছে। সে বলেছিল আমার চোখের লেপ্টে যাওয়া কাজল সে মুছে দিবে। সে তো দিচ্ছে না। বরং ঘুমিয়ে আছে। এই ঘুমকি ভাঙ্গবে তার? মা কাঁদছে চিৎকার করে কাঁদছে সেও তো প্রতিক্ষার প্রহর গুনছিলো তার ছেলের জন্য। এক বছর সবার প্রতিক্ষার প্রহর কাটিয়ে সে ঠিকই এলো তবে একেবারে ছেড়ে যাওয়ার জন্যেই এলো। সব ভেঙ্গে দিয়ে চলে গেলো। সেদিন তার বুকে মাথা ঠেকিয়ে প্রচুর কেঁদেছিলাম। অভিযোগ করেছি অনেক।
চার বছর হতে চললো আমি মা-বাবার সাথে সেই বাড়িতেই থাকি। সে তো চলে গেলো। কিন্তু তার জন্য পাওয়া দুইটা জন্নাতকে একা ছাড়িনি কখনো। আমি ছাড়া তাদের কেউ নেই আর আমার বেঁচে থাকার তারাই একটা কারন।
সেইদিনের পর মা তার ছেলেকে আর কোথাও যেতে দেয়নি। তাকে উঠোনের এক কোনে শিউলি গাছের তলায় দাফন করা হয় কারন মা তার ছেলেকে চোখের সামনে দেখতে চায় আর দুরে যেতে দেবে না। কিন্তু সে আর সুযোগ দিলোই না তার প্রতিক্ষার প্রহর গুনার। তার অপেক্ষায় এখন আর বসে থাকি না সকাল বিকেল তার পাশে বসে হাজার না বলা কথা হাজার অভিযোগ করি।
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত