ডায়েরির ভাঁজে

ডায়েরির ভাঁজে
আজ সকাল থেকেই অনেক বৃষ্টি। তাই ছাদে না গিয়ে বেলকনিতে দাঁড়িয়ে মেঘাছন্ন পরিবেশটাকে উপভোগ করার চেষ্টা করছিলাম। হঠাৎ গলির মাথায় চোখ পড়তেই দেখলাম অনেকজন বৃষ্টিতে ভিজে ফুটবল খেলছে। একটু পরেই চেঁচামেচির শব্দ শুনে আবার ওই দিকে তাকালাম। দূর থেকে দেখে যতটুকু বুঝলাম তা হলো, ফুটবলটা মনে হয় কারোর বাড়ির জানালার কাচের বারোটা বাজিয়েছে।
বাড়ির মালিক তাই ওদের ব্যান্ড বাজাইতেছে। যটনাটা দেখে আমার পুরনো কিছু স্মৃতি কোন রকম গ্রাভিটির ধার না ধেরে বেলকনি বেয়ে সোজা উপরে চলে আসলো। মস্তিষ্কে নাড়া দিয়ে সেই ভুলতে না পারা স্মৃতি গুলোকে চোখের সামনে মেলে ধরলো। তখন আমি ক্লাস টেনে পড়ি। পাড়ার সবাই এক নামে চেনে। ভালো কাজ যে করি তার জন্য না মূলত চিনে আমার দর্শীপনার জন্য। ছোট থেকেই খুবই দূরন্ত ছিলাম। ব্যাট হাতে বল পেটানো থেকে শুরু করে পাড়ার বখাটে ছেলেদের পিটিয়ে পিঠের ছাল তুলে দেওয়া এমনকি অন্যের বাগানের আম,পুকুরে মাছও শান্তিতে থাকতে পারতো না আমার জন্য। যা কিছু ছেলেদের করার কথা তথাকথিতভাবে তার সবটাই আমি করতাম। মায়ের হাজার বারণকেও পরোয়া করতাম না কখনো।
এমনি এক বৃষ্টির দিনে মাঠে ফুটবল খেলছিলাম। আমার সাথে পাড়ার কয়েকটা পোলাপানও ছিল। তুমুল বৃষ্টি যেখানে কেউ ঘর থেকে বের হওয়ার নাম নেয় না সেখানে আমরা মাঠে। আমরা ইচ্ছে মতো মজা করছিলাম। হঠাৎ মাঠের পাশ দিয়ে ছাতা মাথায় কেউ একজন যাচ্ছিল, খেয়াল করিনি। তাই বলটাতে যেই কিক করলাম ওমনি বলটা লাগলো তার পিঠে। সাথে সাথে সে মাটিতে পড়ে গেল আর হাতের ছাতাটা ছিটকে পড়লো একটু দূরে। বন্ধুরা কেউ সাহস করে বলটা নেওয়ার জন্য তার কাছে গেল না। আমি একাই গেলাম। দোষটা যদিও আমারই তবুও এমনভাব করলাম যেনো দোষটা তারই।
—কি মশাই!! দেখে চলতে পারেন না? আমার মুখে এই রকম রসকষহীন কথা শুনে আমার দিকে তাকাতেই আমি অবাক! কি ভালো দেখতে! একদম স্বপ্নের রাজকুমারের মতো। আমি এবার আমতা আমতা করে বললাম
—কি লেগেছে নাকি! কই দেখি তো? সে আলতো করে জবাব দিলো
—তেমন কিছু হয়নি।
—হুম,ঠিক আছে। এরপর থেকে সাবধানে হাঁটবেন।
তাকে আর কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে পাশে পড়ে থাকা বলটা নিয়ে চলে আসলাম। আসলে আমার স্বভাবটাই এমন। আরাশের সাথে প্রথম দেখাটা এভাবেই হয়।গল্পটা সেদিনকার মতো সেখানেই শেষ।
এর বেশ কিছুদিন পরের কথা। সেদিন আর ফুটবল না ক্রিকেট বল দিয়ে গাছের আম পাড়ার চেষ্টা করছিলাম। ঢিলটা বেশ জোরেই মেরেছিলাম। আমে লাগলে মনে হয় আমটা থেঁতলে নিচে পড়তো। কিন্তু দূর্ভাগ্যবশত ঢিলটা আমে না লেগে পাশকাটিয়ে সোজা চলে গেল তার পিছনের বিল্ডিং এর জানালায়।আর মূহুর্তের মধ্যে ঝনঝন শব্দ করে জানালার কাচ গুলো চোখের সামনে পড়তে লাগলো। আমার সাথে যারা ছিলো ওরা তো এক নাম্বারের ভিতুর ডিম। আমাকে সাহস দেওয়ার পরিবর্তে বাড়িওয়ালা কিভাবে আমার ব্যান্ড বাজাবে তা নিয়ে বিরাট বিশ্লেষণ শুরু করলো। আমিও খানিকটা ভয় পেলাম কারণ মায়ের হাজার বারণ করা সত্ত্বেও সেদিন বাড়ি থেকে বের হয়েছিলাম।এমনিতে প্রতিদিন এতো এতো নালিশ যায় আমার নামে। তাই কয়েকদিন হলো মা ভীষণ রেগে আছে। এখন যদি এই ব্যাপারটা মা জানে তাহলে আর রক্ষ্যে নেই। কমপক্ষে চার
-পাঁচদিন ঘরে বন্দী করে রাখবে। তাই যা করার আমাকেই বলতে হবে। আমি একাই গেলাম। বেল বাজিয়ে অপেক্ষা করছিলাম কখন আসবে। হঠাৎ যে দরজা খুললো দেখে আমিই হা হয়ে গেলাম। এতো সেই ছেলেটা। মনে মনে ভাবলাম কি ভালো ব্যাপারটা আবার দেখা হলো। মাথা ঝাড়া দিয়ে বললাম
—বলটা দিন তো। জানি না বারবার আপনার সাথেই কেন এমন হইতেছে। হঠাৎ করে বলটা হাতে দিয়ে বললো
—তুমি আমায় তুমি করে বলতে পারো। আমি অতোটাও বড় নই তোমার থেকে। বলটা নিয়ে মুচকি হেসে নিচে নামতে নামতে আবার ফিরে গিয়ে বললাম
—Sorry.এই রকম আর হবে না।তুমি প্লিজ আমার মাকে কিছু বলো না।
আমার জীবনে এই প্রথমবার অন্যায় করে কাউকে sorry বললাম। হঠাৎ লক্ষ্য করলাম পেছন থেকে একজোড়া চোখ আমাকে খুব ভালো করে উপর থেকে নিচ মাপছে। আমি বুঝতে পারলাম আমার চলাফেরাতেও শান্ত ভাব এসেছে। আমি! তাও আবার শান্ত,আবাক না!! খানিকটা অবাক আমিও হয়েছিলাম।
তারপর থেকে আমাদের প্রায়ই দেখা হতে থাকে। কখনো মাঠে, কখনো গলির মাথায়, স্কুল ছুটির পর রাস্তায়। পরে ওর সাথে কথা বলে জানতে পারি ওর নাম আরাশ, Inter 2nd year এ পড়ে। অত্যন্ত মেধাবী। তাই কলেজ এর সবাই এক নামে চেনে। অন্যদিকে আমি পড়ালেখায় একেবারে ঢেঁড়স, কোন রকমভাবে পাশ করতে পারলেই খুশি।
আমি বার বার অবাক হতাম ওকে দেখলে। যেমন সুন্দর দেখতে তেমন নম্র,ভদ্র, সবার সাথে কতো সহজে মিশতে পারে। আর আমি সম্পূর্ণ ওর বিপরীত। ভাবতেই অবাক লাগতো এই রকম বিপরীত দুটো মানুষের সাথে বন্ধুত্ব সম্ভব!! তবুও আমাদের অনেক ভালো বন্ধুত্ব হয়েছিলো। আমাদের এই দেখা হওয়ার মধ্যে যে ভালো ব্যাপারটা হয়েছিল তা হলো আমার ব্যবহার, চালচলনের ব্যাপক পরিবর্তন এসেছিলো। আগের মতো আমি আর মাঠে -ঘাটে চড়ে বেড়াতাম না। লক্ষীমেয়ের মতো সারাক্ষণ ঘরে বসে পড়াশোনা করতাম। মাঠের চেয়ে টেবিলের বই গুলোই একটু বেশি আপন মনে হতো। এইভাবে প্রায় ছয় মাস পাড় হলো। একদিন আমাদের বাড়িতে আরাশ মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে কি যেনো বলছে। হঠাৎ আমাকে দেখতে পেয়েই ওর কথাগুলো থমকে গেল। আসলে আমার এই ব্যাপক পরিবর্তনটা হয়তো ও লক্ষ্য করছিলো।আমার কাছে এসে বললো
—আমরা চলে যাচ্ছি। আমরা এখানে ছিলাম আমার hsc exam এর জন্য। পরীক্ষা শেষ তাই তাই এখানে আর থাকা হবে না। বাবার ট্রান্সফার যেখানে হয়েছে সেখানে যাবো। আবার যদি কোনো দিন দেখা হয় কথা হবে। ততদিন ভালো থেকো। Good bye. হঠাৎ করে কথা বলার সমস্ত জোর হারিয়ে গেলে যেমন হয় আমারও সেই রকম লেগেছিল। অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম আরাশের দিকে। মন বলছিলো অনেক কথা বলতে কিন্তু মুখ থেকে কোন স্বর বের হলো না। শুধু ভাবতে লাগলাম আমার মতো মেয়েকে কেবল মাত্র কিছুদিনের জন্য এক ভিনদেশী হাওয়া আমূল পাল্টে দিয়ে চলে যাচ্ছে। শুধুমাত্র তার মায়ার জরিয়ে।
সেই ঘটনার পর আজ পাঁচ বছর হয়ে গেছে। আমি কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে এখন ভার্সিটিতে পা রেখেছি। এই দীর্ঘ পাঁচ পাঁচটা বছরে আরাশের না কোন টেক্সট, না ফোন কল না কোনো কিছুই পাইনি আমি। আর নিজের ভালোবাসার কথাটাও জানাতে পারিনি। তবুও শহরের অলিতে গলিতে আমার একজোড়া চোখ আজও তাকে খুঁজে বেড়ায়।
সে আছে আমার মনের গহীন এক কোণে সেখানে সবার প্রবেশ নিষেধ, কেবল আমারি আনাগোনা। মন বলে আমাদের আবার দেখা হবে কোন এক বৃষ্টির দিনে। আরাশকে বলতে না পারা কথাগুলো আজও বন্দি আছে আমার ডায়েরির ভাঁজে। হয়তো সেদিন লেখাগুলিও মুক্তি পাবে।
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত