একদিন বাবাকে বলে দিয়েছি তিনি যেন আমার বন্ধুর মত থাকেন। তারপর থেকে বাবার অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে যাচ্ছি। দেখা হলেই ‘ইয়ো ব্রো’ বলে সম্বোদন করছেন। বাবার উচ্চারণজনিত সমস্যা আছে। তিনি ‘স্থাপন’ কে ‘এস্থাপন’, ‘স্থায়ী’ কে বলেন ‘এস্থায়ী’। তাই তাঁর মুখে ‘bro’ শব্দটা ‘borrow’ এর মতন শোনাচ্ছে। আজীবন তাঁর কাছ থেকে Return বিহীন borrow করে এসেছি, এখন আমি কি দিব তাঁকে?
সেদিন ফোন টিপছিলাম শুয়ে শুয়ে, বাবা ধপ করে এসে পাশে শুয়ে পড়লেন। ফোনের দিকে তাকিয়ে বললেন, “কিরে লোপার সাথে কতদূর তোর?” আমি ভয় পেয়ে তাড়াতাড়ি ফোন লক করে সোজা হয়ে পড়ে রইলাম। বাবা আবার বললেন, “আরে, তোরে দিয়ে হবেনা ব্যাটা! না পারলে আমারে দে। আমি সেট করে দিচ্ছি”
“বাবা। কি বলছো এগুলো?”
“আরে ব্যাটা তোর মত থাকতে কত রিংকি, মিংকি, পিংকি পটাই ফেলছি।
তখন তো স্মার্টফোন ও ছিল না। চোখ মারলে ইয়েস, মুখ বাঁকাইলে নো” “বাবা ওসব আগেকার যুগ। এখন এক মেয়ের জন্য কত ক্যান্ডিডেট জানো? সবাই অনলাইনে ট্রাই করে, মেয়ে দুই-তিন মাস সবাইরে চেক করে বেস্ট অপশন চুজ করে”। “তো হইতে পারিস না বেস্ট অপশন? সারাদিন তো ফোন নিয়েই পড়ে থাকিস। বৃদ্ধাঙ্গুল ক্ষয় করে ফেলছিস, তাও হয় না গতি? ছ্যাহ!” বাবা আমাকে তাচ্ছ্বিল্য করে বালিশে মাথা রেখে সিলিং এ তাকালেন। কিছুক্ষণ পর দেখলাম বাবা কিছুটা মুড অফ করেছেন। “কি হয়েছে বাবা? মুড অফ কেন?” “আর বলিস না রে। তোর ভাবি যা শুরু করসে!” মনে মনে তিনবার আস্তাগফিরুল্লাহ পড়লাম। সময়ের মারপ্যাঁচে মা কেও ভাবি বলতে হচ্ছে।
“মা কি বলছে?”
“সে আমাকে হাসতে দেখে, দেখেনা হাসি শেষে নিরবতা”
“তুমি নিরব ই বা থাকো কখন বাবা? সারাদিন তো বকবক ই করো”
“আমারো কষ্ট হয়, বুকে ব্যাথা হয়, জানিস ওসব?”
“গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ যে নিয়মিত খাওয়া হয়না সেটাই প্রধান কারণ”
“আজকাল ঘুম হচ্ছেনা রাতে। ডিপ্রেশনে ভুগছি বোধহয় রে”
“সারা বিকেল পড়ে পড়ে ঘুমালে রাতে ঘুম হবে!”
“তুই বড্ড বেশি বুঝিস dude. এরপরও তোর সিজি উপরে উঠে না, আফসোস!”
আমাকে ক্লিন বোল্ড করে দিয়ে বাবা ধীরে সুস্থে উঠে চলে গেলেন। এদিকে বাবার বন্ধুত্ব আমার জন্যে খুব ভারী যাচ্ছে। যখন তখন রুমে এসে পড়েন, আর পিঠে হাত চাপড়ে বলেন “কিরে দোস্ত, কি করছিস?” আর আমার মেয়ে বন্ধুদের বেলায় বাবার দারুণ আগ্রহ। সেদিন ওয়াশরুমে ছিলাম।
কলের শব্দে তাড়াহুড়া করে বের হয়ে দেখি বাবা ফোন ধরে বসে আছেন। “হ্যালো! ভাবি! আসিফ তো টয়লেটে। গত আধঘন্টা ওখানেই আছে। আপনার ভাবি আবার দুপুরে মূলা রেঁধেছে তো তাই”। বাবার কথা শুনে আমার মাটি ফাঁক করে তিনহাত গভীরে ঢুকে পড়তে মন চাইলো। এরকম টা আমার সাথে তিনি হরহামেশাই করে যাচ্ছেন। গুরুত্বপূর্ণ চ্যাটিং করছি, তখন এসে বলবেন “দোস্ত, আয় না পাবজি খালি। তোর ভাবি সিরিয়াল দেখছে। আমি একা একা বোর হচ্ছি”। একটা ছেলের জন্য বাবাকে অযুহাত দেখানো খুবই কঠিন একটা কাজ। কারণ ছেলের কি কাজ, কতটুকু কাজ, সেসব বাবা ভাল করেই জানেন। আজকাল পড়তে বসলে টেবিলের কাছে দাঁড়িয়ে চিৎকার দিয়ে বলেন, “কোপ রে কোপ! এবার তো সিজি ফোর হয়ে যাবে তোর। আমারি জীবনে কিছু হল না। আজীবন মিডল ক্লাস চাকরিই করে যাব”। আমি বোধহয় পৃথিবীর প্রথম ছেলে যার সাথে তার বাবা কম্পিটিশন করছে।
বাবার এই বন্ধু বন্ধু ব্যবহারে আমিও মাঝেমাঝে অভ্যস্ত হয়ে যাই। সেদিন মাকে ভুল করে বলে ফেললাম, “ভাবি এক কাপ চা দিও”। মা ও একেবারে চুলায় শিক গরম করে এনে পিঠে বসিয়ে দিলেন। বাবার এসব বিরক্তিকর আচরণ সহ্য করতে করতে ক্লান্ত হয়ে বাবাকে বললাম, “দোস্ত, এই নে ১২ টাকা। একটা বেনসন নিয়ে আয়তো”। আর যায় কোথায়, “তবে রে!” বলে সঙ্গে সঙ্গে পা থেকে জুতা খুলে আমাকে ইচ্ছেমত ধোলাই দিলেন। তাও অন্তত বন্ধুর ভুত যে নামলো ঘাড় থেকে, সেটাই শান্তি।
গল্পের বিষয়:
গল্প