আমার নিজের মাকেই যখন মানুষ ‘খুনী, খুনী’ বলে তাচ্ছিল্য করে, তখন আমিও ঠিক তাদের মতোই তাচ্ছিল্যভরে একটা হাসি আনি মুখে। মায়ের সাথে সাথে আমাকেও প্রতি দফায় অপমানিত হতে হয়। আমি একজন খুনীর মেয়ে বলে! না তারা ভুল নয়, সত্যিই আমার মা খুনী। কিন্তু আমার এই যে তাচ্ছিল্যের হাসিটা, তা আমার মায়ের জন্য নয়। বরং যারা আমার মাকে এভাবে পদে পদে নীচ ঠাহর করে, তাদের জন্যই আমার এই হাসি। তার উপর আমার নাকি বাপেরও ঠিক নেই। না এটা আমার বা মায়ের বাক্য নয়, এমনটা ঐ লোকসমাজের বুলি। আমার মায়ের নাকি চরিত্রের ঠিক নেই, আর সেজন্যই আমার কোনো পিতৃ-পরিচয় নেই।
অবশ্য বাবার কথাটা ভুল নাকি সঠিক, আমার জানা নেই। কিন্তু এটা সত্য যে আমি আজ অবধি আমার বাবার পরিচয় কিংবা বাবা সম্পর্কে এতটুকু তথ্যও জানি না। এজন্যই মাঝেমধ্যে সন্দেহ হয় যে হয়তো তাদের কথা সত্যিও হতে পারে, তবুও আমি আমার মাকে খুব বেশিই ভালোবাসি এবং শ্রদ্ধা করি। তাই আমি কখনোই মন থেকে মেনে নিতে পারবো না যে আমার মা ঐরকম। শুধু আমি কেন? দুনিয়ার কোনো সন্তানই তার মা সম্পর্কে কোনো নেতিবাচক কথা শুনতে বা মেনে নিতে পারে না। আমিও তার ব্যতিক্রম নই। মাকে অনেকবার বাবাকে নিয়ে প্রশ্ন করেছিলাম। আমার বাবা কে? নাম কী? কোথায় থাকে? আমাদের সাথে থাকে না কেন? আমার বাবা কি আদৌ আছে নাকি পাড়ার সবার কথাই সত্যি?
শেষের কথাটা তুললেই মা আমার মুখ চেপে ধরতেন। বলতেন, ‘নাহ, এসব কিচ্ছু সত্যি না মা। ওদের কথা একদম কানে নিবি না। আমিই তোর মা, আমিই তোর বাবা। আমিই তোর সব।’ বলেই আমাকে নিজের বুকে জড়িয়ে ধরতেন আর চোখের অশ্রুতে নিজের গাল দুটো ক্রমাগত সিক্ত করতেন। আমি আর কথা বাড়াতাম না। মাকে ঘিরেই আমার দুনিয়া। বাবা নামের ব্যক্তিটাকে নিয়ে কখনোই আমার এতো আকর্ষণ বা আফসোস ছিলো না। মাঝেমধ্যে শুধু মন খারাপ হতো, এই আর কি। আর কিছুই না। কখনো বাবাকে নিয়ে কান্নাকাটিও করিনি। জানি না কেন।
চার বছর আগেকার এক দুপুরের কথা। আমি সবেমাত্র স্কুল থেকে ফিরেছি। আজ আমাদের নবম শ্রেণীর বার্ষিক পরীক্ষার ফলাফল দিয়েছে। বাহাত্তর জন স্টুডেন্টের মধ্যে আমি তৃতীয় স্থান দখল করেছি। আমার খুশি আর দেখে কে? নাচতে নাচতে বাসায় ফিরেই ব্যাগটা ছুড়ে বিছানার ফেললাম আর রেজাল্ট শিট হাতে মাকে ডাকতে লাগলাম।
কিন্তু মায়ের কোনো সাড়া পাচ্ছিলাম না। হঠাৎ করেই পেছন থেকে একজন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের হাত আমার মুখ চেপে ধরলো। সাথে সাথেই আরও দু’জন জোয়ানমর্দ ছোকরা আমার দুই পা বেঁধে কোলে তুলে নিলো। আর বলতে লাগলো, ‘মা-টা বাসায় নাই। আজকেই এই মাইয়ার কাম তামাম করা লাগবো। কত্তদিন ধইরা সুযোগ খুঁজতেসিলাম, আজকে পাইয়াই গেলাম। আয় আয় জলদি লইয়া যাই এইটারে। তারপর… হা হা হা!’ বলেই লোক ৩টা ভয়ংকরভাবে হাসতে লাগলো। আমি মুহুর্তেই চিনে গেলাম তাদেরকে। তারা আর কেউ নয়, আমাদের গ্রামের দাগি বখাটেগুলো। যাদের অনেকদিন থেকেই আমার উপর নজর ছিলো। আমি নিজেকে ছাড়ানোর খুব চেষ্টা করতে লাগলাম। কিন্তু আমি ব্যর্থ ছিলাম। মনে প্রাণে আল্লাহকে ডাকতে লাগলাম। তক্ষুণি হয়তো আল্লাহর ইচ্ছাতেই আমার মা পৌঁছে গেলো বাসায়। দরজা খোলা দেখেই হয়তো মা বুঝলেন আমি স্কুল থেকে ফিরে এসেছি। তাই আমার নাম ধরে ডাকতে ডাকতেই ঘরে ঢুকলেন। মায়ের কাঁধে এক গাদা লাকড়ি আর হাতে কুঠার। হয়তো কাঠ কাটতেই গিয়েছিলেন।
মা ঘরে ঢুকেই দেখেন আমার এই অবস্থা! ঐ তিনজন আমাকে তুলে নিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টায়। মা এক গগনবিদারী চিৎকার দিয়ে লাকড়িগুলো ফেলে কুঠার নিয়ে এগিয়ে এলেন। আর সাথে সাথেই একজনের কোমর বরাবর কোপ বসিয়ে দিলো। রক্তের ধারা বইতে লাগলো। বাকি দুইজন ঘাবড়ে আমাকে ছেড়ে দিলো এবং মাকে আক্রমণ করার জন্য লাকড়ি তুলে প্রহার করার চেষ্টা করলো। কিন্তু মা আবারও লোকটার হাতে কোপ বসিয়ে দিলো। অন্যজনের হাতে একটা ধারালো দা ছিলো, লোকটা নিমিষেই ওটা মায়ের বাহুর উপর চালিয়ে দিলেন। মায়ের হাত ডান হাত বেয়ে রক্ত ঝরা সত্ত্বেও মা থামলেন না। উনি হয়তো টের পেয়ে গিয়েছেন, উনার মেয়ের সাথে এই জানোয়ারগুলো কী করতে চেয়েছিলো। মা আগ-পিছ না ভেবে ঐ তিনজনকে মাটিতে ফেলে নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যা করলো।
ব্যস। সেই থেকেই আমার মা খুনী। সব জায়গায় রটে গেলো আমার মায়ের এই নৃশংসতার কাহিনী। কিন্তু কেউ আর জানলো না মূল ঘটনা কী ছিলো। কেউ জানতেও চাইলো না। সোজা পুলিশ এসে মাকে গরাদে নিয়ে গেলো। মা পুরোপুরি নিশ্চুপ হয়ে গেলো। একটু আগেকার মায়ের যে তেজদীপ্ত চেহারাটা দেখে হতবাক হচ্ছিলাম আমি, সেই চেহারাটাই তখন হয়ে গেছিলো মলিন, ফ্যাকাসে। হারিয়ে গেলো আমার মায়ের সকল তেজ, আমার মায়ের উজ্জ্বল চেহারাটা। মাকে জেলে নিয়ে যাওয়ার সময়ও উনার চোখ থেকে একফোঁটা জলও ঝরলো না। শুধু ঐ নয়ন দুটো অপলকে আমার দিকে চেয়ে রইলো। বোধ হলো, অনেক অনেক প্রশ্ন, অত্যাধিক স্নেহ, সীমাহীন জ্বালা, আবেগ আর শঙ্কা লুকিয়ে আছে ঐ টগবগ চাহনিতে। আমার মা হয়তো বারেবার আমায় জিজ্ঞেস করতে চাইছিলেন, ‘মা, তুই ঠিক আছিস তো মা? ঐ জানোয়ারগুলো তোকে কিছু করেনি তো? ঠিক আছিস মা?’ কিন্তু মায়ের মুখ দিয়ে আর কোনো কথা বের হলো না। খুনের দায় স্বীকার করে মা হয়ে গেলেন চিরস্তব্ধ।
আজ মায়ের ফাঁসি। মায়ের সাথে শেষ দেখা করতে গিয়ে আমি কাঁদতে কাঁদতে মৃতপ্রায়। আমার দুনিয়াতে যে আমার মা ছাড়া আর কেউ নেই। কেউ না! ঐদিনের পর থেকে আজ অবধি কতো উকিলের হাত পা ধরে আকুতি মিনতি করেছি আমি, হিসেব নেই। কিন্তু সবাই যে শুধু টাকাই বুঝে। আর আমার কাছে এক মা ছাড়া আর কিচ্ছু ছিলো না।
মা-মেয়ের সংসারে নুন আনতেই পান্তা ফুরোতো আমাদের। স্কুলের বেতনও দিতে পারতাম না। মা স্যার ম্যাডামদের পায়ে পড়ে এতোবছর আমার পড়ালেখা, অন্যদের বাসায় কাজ করে আমাদের পেট চালিয়ে গেছেন। সেখানে আজ এই মামলা মোকদ্দমার পয়সা কোত্থেকে জোগাড় করতাম আমি? তাও আমি আইনের দ্বারে দ্বারে আমার মায়ের প্রাণভিক্ষা চেয়েছি। দু’একজন উকিল রাজী হয়েছিলেন ঠিক, কিন্তু দিনশেষে তারাও বিত্তবানদের কাছে টিকতে পারলো না।
আমার মা আমার মান সম্মান বাঁচাতে আমার মা অন্যায় ও পাপীকে খুন করত্র উদ্যত হয়েছিলো। আর সফলও হয়েছিলো। তাই আজ ঐ তিনজনের হয়ে সব্বাই লড়ছে। তাদের খুন হয়েছে আমার মায়ের হাতে। কিন্তু যদি আজ আমার কিছু হয়ে যেতো, তাহলে ঐ পশুগুলোর জন্য কেউ কিছু করতো না। কেউ না! কিচ্ছু নাহ! আজব দুনিয়া! হাস্যকর নিয়মনীতি! মাস দুয়েক কেটে গেছে। এক এতিমখানায় আশ্রয় নিয়েছিলাম আমি। জীবনধারণের জন্য ওখানেই টুকটাক সহায়তা ও কাজও করছি। আজ হঠাৎ সেখানেরই একজন বয়স্ক কর্মকর্তা আমায় চুপিসারে উনার কক্ষে ডেকে পাঠালেন। এবং জানতে চাইলেন, ‘আচ্ছা, তোমার কাছে বাঁধানো একটা ছবি দেখেছি। ছবির উনি তোমার কে হন?’ আমি কিছুটা সন্দিহান হয়ে জবাব দিলাম, ‘আমার মা।’
জবাবটা শুনেই বয়স্ক লোকটা কিছুক্ষণ চুপ মেরে গেলেন। আমি উনার এমন প্রতিক্রিয়ার কোনো কারণ বের করতে পারলাম না। উনি স্থিরদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমার মায়ের নাম আয়েশা?’ উনার এই প্রশ্নটা শুনেই আমি চমকে উঠলাম। আমি তো কখনো এখানের কাউকে আমার মায়ের সম্পর্কে কিছুই বলিনি। কিচ্ছু না। তবুও উনি কীভাবে আমার মায়ের নাম জানতে পারলেন? আমি কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই উনি হেসে বললেন, ‘অবাক হচ্ছো, তাই না? অবাক হওয়ারই কথা। আমি নিজেও অবাক হচ্ছি। এটা সম্ভবত তখনকার ছবি, যখন তোমার মায়ের বয়স চব্বিশ বা পঁচিশের কাছাকাছি ছিলো। ঠিক না?’ আমি হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ালাম। উনি উপরনিচ মাথা নাড়িয়ে নাড়িয়ে বলতে লাগলেন, ‘তাহলে তুমিই সে?’
আমি উনার এই কথার কোনো অর্থ বুঝতে পারলাম না। আমাকে ভ্রু কুচকে থাকতে দেখে উনিই পুনরায় বলতে থাকলেন, ‘মেয়েটা বড্ড উদার মনের অধিকারী ছিলো। বড্ড বেশিই উদার। নাহলে কেউ কি রাস্তায় কুড়িয়ে পাওয়া কোনো শিশুকে একদম নিজের বাচ্চা ভেবে বড় করে তুলে? ওর তখনো নিজেরই বিয়ে হয়নি। নিজেই এক এতিম শিশু ছিলো। মা বাপ নেই। আমাদের এখানেই বড় হয়েছে। দিনশেষে, অন্য এক শিশুকে নিজের মাতৃত্বের স্বাদ দিতে দিতে এমন সিদ্ধান্তও নিয়ে নিলো যে নিজেই কখনো বিয়ে করবে না। আর ঐ বাচ্চাটা তুমিই ছিলে। অবশ্য অন্য কেউও বিয়ে করতে চাইতোই না। আয়েশার কোলে একটা শিশু দেখলেই সবাই আকাশ পাতাল ভাবনা শুরু করে দিতো। কতো কটু কথাও শুনতে হয়েছে আয়েশাকে। তাও সে তোমায় দূরে ঠেলে দেয়নি। সে লালন পালন করতে করতে তোমাতেই নিজের দুনিয়া গড়ে তুলেছিলো। যার জন্য সে অন্য কাউকেই আর নিজের দুনিয়াতে ঠাঁই দিতে চাইছিলো না। তোমাকে আগলে রেখেই সারাটা জীবন কাটিয়ে দিতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলো।’
উনার এই কথাটা শোনামাত্রই আমার এতোদিনের অনেক অজানা রহস্য খোলাসা হয়ে গেলো। আমি পুরো স্তব্ধ। আমি তাহলে নিজেই এতিম ছিলাম? আর এই আমাকে গড়ে তোলার জন্যই… কতোকিছু শুনতে হলো আমার মাকে। আল্লাহ! সব শুধু আমার জন্যই! আমার মা চরিত্রহীনা নন, সবাই মিথ্যে অপবাদ দিতো আমার মাকে। পবিত্র আমার মা। আমার মা, মায়ের চেয়েও উপরে। মা! নিজের মধ্যে এতোকিছু লুকিয়ে রেখেছিলো আমার মা? এতোকিছু? শুধুমাত্র আমার জন্য? আমার জন্য! নিজের মায়ের চেয়েও অনেক বড় ভূমিকা পালন করে গেলেন এই মা। আমি.. আমি বাকরুদ্ধ! মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা আর ভালোবাসাটা আরও অনেক অনেক অনেক বেড়ে গেলো। আমি কাঁদতে শুরু করে দিলাম। আমি আমার এই মায়ের ঋণ জীবনেও শোধ করতে পারবো না। কখনোই পারবো না।
আমার মা আজও আমার জন্যই সবার কাছে ঐ তিনজনের খুনী হিসেবে সমাদৃত। তবে আমার কাছে.. আমার মা খুনী অবশ্যই, কিন্তু ওদের খুনী নয়; আমার মা আমার শ্লীলতাহানির খুনী! গর্বিত আমি! এমন মায়ের মতো মা লাখে একটা হয়, নাকি কোটিতে একটা হয়, জানা নেই। কিন্তু আমি পেয়েছি, এমন মায়ের দেখা। ভাগ্যবতী আমি! যে আমার মান ইজ্জতকে বাঁচাতে গিয়ে মা নিজেই হারিয়ে গেলো। হারিয়ে গেলো মায়ের দেহটা। কিন্তু সে মা নামক আত্মাটাই হয়তো এখনো আমার সুরক্ষায় চারপাশে ভিড়তে থাকে। শুধু আমার জন্য। নিজের সন্তানের জন্য।
গল্পের বিষয়:
গল্প