আমাদের সেজো, মানে সেজো ভাই ছিলো ভীষণ পেটুক টাইপের। খাবারের ভাগে তার একটু বেশি চায়ই চায়। আম্মাও কেনজানি সেজোকে একটু বেশি বেশি দিতে পছন্দ করতো। আব্বা শুক্রবার এক বিশাল তরমুজ আনল। সব ভাই-বোন মিলে পরিবারে আমরা সাতজন। এশার নামাজ শেষ করে আম্মা তরমুজ কেটে সবাইকে ভাগ করে দিলেন।
এখানেও সেজোকে বড় টুকরা দিল আম্মা। আমার ভীষণ রাগ হলো। রাগ বলেতে খুব রাগ। ইচ্ছে করছিল তরমুজ না খেয়ে থাকি। তরমুজ আমি একটু বেশিই পছন্দ করি। তারপরও আম্মা ঐ সেজোকে বড় টুকরা দিলো।
বড় আপাও মাঝে মাঝে এই সেজোর পক্ষ নেয়। আমাকে ঠাস করে একটা চড় দিয়ে বললো, ও একটু বেশি নিলে তোর ক্ষতি কী? খবরদার রাকিবের দিকে তাকাবি না। কেউ একজন একটু বেশি খেলে কিছু বলতে নেই মতিন। রাকিব তো তোরই ভাই, তাই না? বড় আপার শাষনে আমি আর কিছু বলতে পারি না। বড় আপা আমার খুব প্রিয় মানুষ। কিন্তু মনে রাগ আমার থেকেই যায়।
আমাদের পাশের বাসায় ভাড়া থাকতো বিথিরা। বিথির বাবা নাকি বিশাল চাকরি করে। রাকিব বলে, বড় চাকরি না করলে কেউ অফিস থেকে ফেরার সময় এত এত খাবার নিয়ে বাসায় আসে। আমি বললাম, ধুর বেকুব। আব্বাও তো চাকরি করে। মতিন বলে, আরে না না। আব্বার মত চাকরি না। আব্বা তো জুট মিলে চাকরি করে। আমার মনে হয় বিথির বাবা ব্যাংকে চাকরি করে। ব্যাংকে নাকি অনেক টাকা। সারাদিন শুধু টাকা গুনে। আমাদের কথা শুনে বড় আপা হাসেন। বড় আপা এইটে বৃত্তি পেয়েছে। এখন ক্লাস নাইনে। আমি সেভেন, রাকিব সিক্স, শিলা আর কনা থ্রি ও ওয়ানে। বড় আপার হাসি দেখে রাকিব বললো, আমি ঠিক বলেছি না বুবু?
রাকিব রোজ রোজ বিথির বাবা কী নিয়ে বাসায় ঢুকতো আমাদের এসে জানাতো। এই নিয়ে বড় আপা ভীষণ রাগও করতো। বড় আপার রাগ দেখে রাকিব একটু চুপসে যেত। এই বিথিও ছিলো ভীষণ বজ্জাত মেয়ে। কী দরকার এমন করে রাকিবকে লোভ দেখানো। বিথির বাবা যেই বাইরে থেকে কিছু নিয়ে বাসায় আসতো অমনিই একটু পর বিথি খাবারটা হাতে নিয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে যেত। রাকিবের জন্য আমাদের ভীষণ লজ্জা হতো। এই নিয়ে আম্মা অনেকবার বকেছে রাকিবকে। বিথি আর রাকিব একই ক্লাসেই পড়ে। বিথির মত এমন বেহায়া মেয়ে আমি একটিও দেখিনি বাবা।
একদিন সন্ধ্যার পর পর রাকিব এসে আমাকে বললো, ভাই জানিস আজ বিথি কি খেয়েছে? আমি বললাম, আমি কিন্তু বড় আপাকে এক্ষুনি বলবো তুই আবার বিথির খাবারের দিকে তাকিয়েছিস।
রাকিব আমার কথা কানে নিলো না। বললো, ইয়া বড় আইসক্রিম। আইসক্রিমের উপর মিমি চকলেট দেয়া। যেই অমনি কামড় দিলো ভিতর থেকে দুধের মালাই বের হতে থাকলো। উফফফফ বিথির পুরো নাক মুখ তো লেপটে গেলো দুধ মালাইয়ে। খেতে নাকি ভীষণ মিষ্টি। আমাদের স্কুলে ঐ জাফর চাচার আইসক্রিমের মত অত কম মিষ্টি না। খুব খু-উ-ব মিষ্টি। রাকিবের উপর আমার খুব রাগ হলো। ইচ্ছে করছে ঠাস করে একটা চড় দেই। কারো খাওয়া অমন করে কেউ দেখে নাকি! আজ কেনজানি রাকিবের কথা শুনে আমারও লোভ পাচ্ছে। আমাদের ক্লাসের খসরু বলেছে এমন একটা আইসক্রিমের কথা। নতুন এসেছে। খুব নাকি স্বাদের। খুব দামি আইসক্রিম।
তারপর থেকে রোজ রোজই রাকিব এই আইসক্রিমের কথা উঠতে-বসতে বলতো। আম্মাতো একদিন ভীষণ মেরেছে এই নিয়ে। তারপরও রাকিব ঐ আইসক্রিম নিয়ে গল্প করা ছাড়েনি। তখন ঘোর বর্ষা। মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। ঠিক সেই সময় রাকিবের হলো ভীষণ ভয়ানক রকমের জ্বর। জ্বর কিছুতেই কমছে না। জ্বরের ঘোরে রাকিব আবোল-তাবোল বকছে। আমরা সবাই ভয় পেয়ে গেলাম। আব্বার জুট মিলের ডাক্তার আঙ্কেল এসে ওষুধ দিয়ে গেলেন। আমরা রাকিবের পাশে বসে আছি। বড় আপা তিনশ একবার আয়াতুল কুরসি পড়ে রাকিবের মাথায় ফু দিলো। বেশ কিছুক্ষণ পর আস্তে আস্তে রাকিবের জ্বর কমতে শুরু করলো। রাকিবের জ্বর একটু কমলেই আমরা সবাই ঘুমাতে গেলাম।
ঘুমটা তখন পুরোপুরি আসে নি। হঠাৎ করে মাঝ রাতে চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করলো রাকিব। তার জ্বর আবার বেড়েছে। মাথায় অনবরত পানি দেওয়া হচ্ছে। জ্বর কিছুতেই কমছে না। আব্বা বৃষ্টির মধ্যে আবার ডাক্তার আঙ্কেলকে ডেকে আনতে গেলেন। এই জ্বরের মধ্যে রাকিব এখন আইসক্রিম খেতে চাইছে। বিথির খাওয়া সেই আইসক্রিম। রাকিব আমাকে বললো, ভাই, তুমি আর আমি একসাথে মিলে খাবো। আমার মালাই খেতে ইচ্ছে করে না। আমি উপরের চকলেটটা খাবো আর তুমি মালাই। আমার ভীষণ কান্না পাচ্ছে। একটুও রাগ হচ্ছে না রাকিবের উপর। ইচ্ছে করছে দৌঁড়ে গিয়ে একটা আইসক্রিম নিয়ে এসে রাকিবের হাতে দিয়ে বলি এই নে তোর আইসক্রিম। শুনেছি শামীম চাচার দোকানে এই আইসক্রিম পাওয়া যায়। সকাল হলেই দৌঁড়ে যাবে। স্কুলের পিকনিকের জন্য টাকা জমানো মাটির ব্যাংকটা ভেঙ্গে শামীম চাচার দোকানে গিয়ে একটা আইসক্রিম নিয়ে আসবো। আমার কেনজানি একটুও ঘুম পাচ্ছে না। কখন সকাল হবে এই নিয়ে আমি বসে আছি।
রাকিব মারা গেল ফজরের আজানের পর পর। জ্বর কমছে না দেখে ডাক্তার আঙ্কেল সকালে সদর হাসপাতালে নিতে বললেন। কিন্তু তার আর প্রয়োজন হলো না। শেষ রাতে আমি, বড় আপা একটু ঘুমিয়েই পড়েছিলাম কিন্তু আম্মার চিৎকার শুনে ঘুম ভেঙ্গে দেখি রাকিব নেই। আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না। আমার মনে হচ্ছে রাকিব আইসক্রিম খেতে এমন ভণিতা করছে। আমি দৌঁড়ে গিয়ে মাঠির ব্যাংকটি এনে রাকিবকে দেখালাম। কিন্তু তার কোন সাড়া শব্দ নেই। বড় আপা আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। আমি কী করবো বুঝতে পারলাম না। আমার মনে হচ্ছে সবকিছু বোধহয় ওলট পালট হয়ে যাচ্ছে।
আমার ঠিক মনে আছে। রাকিব যেদিন মারা গেল সেদিন ভোরটা ছিলো ঝলমলে আলোয় ভরা। লাল টকটকে একটা সূর্য উঠেছিলো সেদিন। বর্ষার আকাশে এমন সূর্য দেখা যায় না। মনেই হয় নি সারারাত মূষলধারে এত বৃষ্টি হয়েছে।
আমাদের বাসার সামনে বিশাল এক কাঠবাদাম গাছ। রাতের বৃষ্টির জলের কণা এই বাদাম গাছের পাতায় লেগে আছে। রাকিবের লাশ ধরে কাঁদছে সবাই। আমি একটুও কাঁদছি না। আমি কাঠবাদাম গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছি। তাকিয়ে আছি কাঠবাদাম গাছের পাতাগুলোর দিকে। মনে হচ্ছে এই বাদাম গাছের পাতাগুলো কেঁদে চোখের জল জমিয়ে রেখেছে। এই জল রাকিবের জন্য। স্কুল থেকে ফিরে মাঝে মাঝে সময় পেলেই রাকিব এই বাদাম গাছে উঠে বসে থাকতো। আম্মা বারণ করতো। তারপরও রাকিব মাঝে মাঝে এই গাছে উঠতো। আমি জানি এই বাদাম গাছটির সাথে রাকিবের একটা মায়ার সর্ম্পক আছে। ভীষণ রকমের মায়া।
হ্যাঁ, কত দেখেছি এমন আইসক্রিম। এক দুই তিন হাজারটা। আমার কখনো একটিবার ইচ্ছে করে নি এই চকবার আইসক্রিমটা খাই। বড় আপাও ঠিক তাই। কেমন করে খাবো আমরা! মধ্যবিত্তের টানাপড়েন মাড়িয়ে এসে এখন আমরা অনেক স্বচ্ছল। অনেককিছু পেয়েছি। কিন্তু একটিবারও যে ঐ আইসক্রিমটা ছুঁয়ে দেখার সাহস পাইনি।
বর্ষা এলেই আমি কাঠবাদাম গাছ খুঁজি। বৃষ্টির জলে ভেজা কাঠবাদাম গাছ। আমি দেখতে চাই এখনো কি রাকিবের জন্য তারা কাঁদে কি না। ঠিক যেমন করে মা, বাবা, বড় আপা আর আমি কাঁদি।
গল্পের বিষয়:
গল্প