বিয়ের কদিন পরেই আমার স্ত্রী নিতু দুধ গরম করতে গিয়ে যখন অনেকখানি দুধ ফেলে দিলো চুলোয় তখন আমার মা তার কাছে গিয়ে এক ধমক দিয়ে বললেন,’দুধ ফেললা ক্যান?’ নিতু ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বললো,’মা,আমি বুঝতে পারিনি। বিয়ের আগে কখনো দুধ গরম করিনি তো আমি তাই এমন হয়েছে।আর এমন হবে না কোনদিন মা!’ মা ওর কথা না শুনেই পাল্টা ধমক দিলেন। বললেন,’এ বাড়িতে অত বড়োলুকি দেখালে চলবে না। কাঁচা মেরে কাজ করতে হবে।বুঝেছো?’ নিতু এ বাড়ির নতুন বউ তো। তাছাড়া এমন ভাবে হয়তো কেউ তাকে কোনদিন ধমক দেয়নি।তাই মার ধমক সে সহজ ভাবে নিতে পারলো না।নিতু ছোট বাচ্চাদের মতো ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো।
মা এবার যেন আরো সুযোগ পেলেন। তিনি মুখ বিজলে দিয়ে বললেন,’এইখানে তো অত আহ্লাদ দেখাইলে চলবো না মা।কান্দন আমার পছন্দ না।মুখ বন্ধ করো।করো বলছি!’ নিতু মুখ বন্ধ করতে গিয়ে উল্টো আরো জোরে কেঁদে উঠলো।কী মহা বিপদ! এতোক্ষণ আমি ঘরে ছিলাম। এবার আর সহ্য হলো না।ঘর থেকে বের হয়ে রান্না ঘরে গেলাম। গিয়ে দেখি তখনও মা থাকে বকছে। ‘বললাম চুপ করতে সে আরো আমার সাথে রাগ দেখাইয়া গলা বড়ো করে কাঁদে। কতবড়ো বেয়াদব মাইয়া!’ আমি কাছে গিয়ে এবার বললাম,’মা,কী হয়েছে শুনি?’ মা বললেন,’তোর বউ একটা বেয়াদব। মারাত্মক বেয়াদব।’ আমি বললাম,’কেন?কী করেছে সে মা?’
‘বেয়াদবি করেছে আমার সাথে।’
‘কী বেয়াদবি করেছে?’
‘তোর কাছে আমার কৈফিয়ত দিতে হইবোনি? দুইদিন হইলো না বউ ঘরে আনছো আর এক্ষনি বউয়ের কাছে মুরিদ হয়ে গেছো!’
আমি এবার হেসেই ফেললাম। হেসে বললাম,’মা আমি ও ঘর থেকে কিন্তু সব শুনেছি। আসলে তুমি যে ব্যাবহারটা করেছো নিতুর সাথে এটা কোন মায়ের ব্যাবহার হতে পারে না। ছিঃ!’ আমার মা আমার মুখ থেকে এমন কথা শুনে যেন তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন। কিন্তু তাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে এবার আমি নিজেই বলে উঠলাম,’আচ্ছা মা, তোমার কী মনে আছে তোমার ছোট মেয়ে সন্ধির কথা।ওর যখন বিয়ে হলো ওর ননদ ওকে একদিন মজা করে শুধু বলেছিল,তোমারে কী ফ্যামিলি থেকে ভালো শিক্ষা দেয়নি তোমার মা।আদব কায়দা শিখাইনি! সন্ধি বাড়িতে এসে যখন তোমার কাছে এই কথা বললো তখন তুমি কী বলছিলা? কেমন করে বকছিলা সন্ধির ননদকে?বলোনি সেদিন তুমি,ওই মেয়ের চুল ছিঁড়ে ফেলবা তুমি?বলোনি ওই মেয়ে একটা ডাইনি? আচ্ছা মা সন্ধির ননদ যদি তার ওই ব্যাবহারের জন্য ডাইনি হয়।চুল ছেড়ার যোগ্য হয় তবে তোমার অবস্থান কোথায় তা তুমি নিজেই ভেবে দেখো!
আর শুনো মা,সব মেয়েরাই কিন্তু ঘর থেকে সবকিছু শিখে আসে না। শশুর বাড়িতে এসেই সংসারের সবকিছু শিখে।আর এইসব কিছু শিখায় শাশুড়িরাই।আজ যে ব্যাবহার তুমি নিতুর সাথে করেছো তা যদি তোমার সাথে নিতু করতো তবে তোমার কেমন লাগতো তা একবার ভেবে দেখো!’ এই কথা বলে আমি নিতুর একটা হাত ধরে টেনে ওকে ঘরে নিয়ে আসলাম।নিতু ঘরে ফিরে বললো,’আপনি মার সাথে এমন বিহেভ করলেন কেন?মা মন খারাপ করবেন না!’ আমি ওর হাতটা শক্ত করে ধরে বললাম,’মা হলেই অন্ধ ভাবে তার সবকিছু মেনে নেয়া যাবে না। সন্তান হিসেবে আমার কর্তব্য হলো তার ভুল ধরিয়ে দেয়া।আর আমার ধারণা তিনি তার ভুল বুঝতে পারবেন!’ নিতু আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বললো,’তাই যেনো হয়।’
হ্যা তাই হলো। পরদিন সকাল বেলা নিতুকে হঠাৎ করে ডেকে নিলেন মা তার ঘরে। তারপর নিতুর হাত ধরে তিনি বললেন,’মাগো,আমি বুঝতে পারিনি।না বুঝে তোমার সাথে খারাপ ব্যবহার করে ফেলছি। অনেক খারাপ কথা বলছি তোমারে।ধমক দিছি। তুমি আমারে মাফ করে দেও মা। তুমি মাফ না করলে মহান আল্লাও আমারে মাফ করবো না!’
নিতু মৃদু হেসে বললো,’আমি তো আপনার মেয়ের মতো।মা তো মেয়েকে বকে এবং আদরও করে। সন্তান কী আর মায়ের বকা মনে রাখে?রাখে না।সে মনে রাখে মায়ের আদর!’
মা তখন কী যে খুশি হলেন। খুশি হয়ে নিতুকে জড়িয়ে ধরে তার কপালে চুমু খেয়ে বললেন,’মাগো,আমি ভাবছিলাম শুরু থেকে যদি তোমারে টাইট দিয়ে না রাখি তবে তুমি আমার মাথায় ছড়বা। আমার কথার দাম দিবা না। কিন্তু এখন বুঝছি, আসলে খারাপ ব্যবহার করে ভালো কিছুর আশা করা যায় না।উত্তম ব্যাবহার আর ভালোবাসার মাধ্যমেই
ভালো কিছুর আশা করা যায়। ভালো কিছু অর্জন করা যায়!’ ও ঘর থেকে সবকিছু শুনেছি আমি।শুনে মনে মনে বলেছি,যদি প্রতিটি পরিবারের শাশুড়িরা এমন হতো,যদি ছেলেরা এক পাক্ষিক না হয়ে সত্যটা বিবেচনা করতো,আর বউয়েরা যদি শাশুড়িকে তার মায়ের মতো ভাবতো, তবে পৃথিবীর প্রতিটি সংসার কী স্বর্গ হয়ে উঠতো না?
গল্পের বিষয়:
গল্প