উদ্ধত এই মন আমার

উদ্ধত এই মন আমার
আরিফের মনটা খুবই খারাপ। কারও দিকে সরাসরি তাকাতেও সঙ্কোচ হচ্ছে। মনে প্রচন্ড অপরাধবোধ। নিজের ভেতর মনে হচ্ছে আবর্জনার জঞ্জাল। প্রতিদিনই সে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়ে বের হয়। নজর নীচু রাখবেই। কিন্তু এক পর্যায়ে কি যে হয় তার! নিজের মুখের ঘন দাঁড়ির কথা সে ভুলে যায়। গায়ে লম্বা জামার কথাও সে ভুলে যায়। মাথার টুপিটার অস্তিত্ব সে টের পায় না। ভুলে যায়, সে কালও মসজিদে দাঁড়িয়ে বয়ান করেছিলো। যখন তার হুঁশ ফিরে, তখন হা-হুতাশই তার সঙ্গী হয়। এভাবেই চলছে তার। কিভাবে যে এত বড় রোগ তাকে পেয়ে বসলো! এ থেকে কি নিস্তার নেই?
লম্বা সময় শেষে কিছুদিন ভালোই ছিলো সে। মনে করেছিলো ভেতরের সাপটা মরে গেছে। কিন্তু একদিন সাপটা ফণা বের করলো। সাপটির হঠাৎ আক্রমনে সে একদম চিৎপটাং। চিল্লা শেষে কয়েকদিন ভালো থাকে সে। সপ্তাহ গেলে আবার যেই সেই। কেন এমন হয়? তার ঈমান কি এখনও মজবুত হয় নি? তাহলে ঈমানের মেহনত আরও বাড়াতে হবে? সে নিজের ভেতরে এই রোগ লালন করে। কোন আলিমের দিকে সরাসরি তাকাতে সে ভয় পায়। পাছে তার চোখের অন্ধকার ধরা পড়ে যায়। তার মনে হতে থাকে, এ অন্ধকার তার চোখে ফুটে আছে। সত্যিকারের দৃষ্টিসম্পন্ন কেউ ঠিকই তা দেখে ফেলবে! বিভিন্ন মুজাকারাগুলোতে এ বিষয়টিও আলোচনায় আসে। তখন সেও প্রতিজ্ঞা করে। কিন্তু তবুও সে বার বার ফেল করে কেন?! জুমারাতে শবগুজারিতে হাসান ভাইয়ের সাথে তার নিয়মিত দেখা হয়। এবার ঠিক করলো, ভাইয়ার সাথে বিষয়টি নিয়ে সে পরামর্শ করবে। পরের বৃহস্পতিবার সে ঠিকই ভাইয়াকে পেয়ে গেলো।
-” ভাইয়া! কিছু ব্যক্তিগত পরামর্শ। “
-” চলো, বসি।” সে আজ পুরোপুরিই নিজের সমস্যাটি বলতে পারলো।
-” ভাইয়া! এটি কি আমার দূর্বল ঈমানের কারণে?”
-” কিছুটা, তবে এটিই একমাত্র কারণ নয়।”
-” ব্যাপারটা একটু ব্যাখ্যা করবেন?”
-” আচ্ছা! তোমার কি রাসুলের কথার উপর বিশ্বাস নেই যে, যে দেখে আর যাকে দেখা হয়, দু’জনের উপর আল্লাহ তায়ালার লানত? তোমার কি এ বিষয়ের উপর ঈমান নেই যে, এর জন্য আখিরাতে শাস্তি পেতে হবে? “
-” অবশ্যই আছে, ভাইয়া!”
-” তাহলে ঈমান তো ঠিকই আছে।
আর এ বিষয়ে তোমার ইলমও আছে। আসলে এটি আখলাকের সমস্যা। ঈমানের কমতির কারণে যেমন আমালে সমস্যা হয়, তেমনই আখলাকের কমতির কারণেও আমালে সমস্যা হয়। ধরে নিলাম, দাওয়াত দিতে দিতে ঈমান মজবুত হয়ে যাবে, আখলাকও কি? না। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আল্লাহ তায়ালা ঈমান, আখলাক, আমাল ঠিক করার জন্য ভিন্ন ভিন্ন মেহনত দিয়েছেন। ঈমানের মেহনত যদি দাওয়াত হয়, তাহলে আখলাক ঠিক করার জন্যে দিয়েছেন তাযকিয়া। দেখো! আখলাক হলো ভেতরের জিনিস। এর সম্পর্ক নফসের সাথে। নফসের তাযকিয়া দ্বারাই আখলাক শুদ্ধ হয়। তোমার এই রোগটির সম্পর্কও নফসের সাথে। কেবল ঈমানের দাওয়াত দিয়ে এই রোগ সারবে না। দেখো, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘ হে যুবক সম্প্রদায়! তোমাদের মধ্যে যারা সামর্থ রাখে, তারা যেন বিয়ে করে নেয়, আর যদি সমর্থ না হয়, তারা যেন রোজা রাখে।
দেখো, রাসুল এ নসীহত যুবক সাহাবাগনকে উদ্দেশ্য করে করেছেন। তাদের ঈমানের মজবুতির কথা তো উল্লেখেরই প্রয়োজন নেই। রাসুলও তাই চোখ ও লজ্জ্বাস্থানের হিফাজতের জন্য আরও বেশি ঈমান বাড়ানোর নসীহত করেন নি, সরাসরি রোজার মাধ্যমে মুজাহাদার প্রেসক্রিপশন দিয়েছেন। দেখো! তুমি বলছ, চিল্লা দিয়ে এলে কয়েকদিন ভালো থাকি, কিন্তু সপ্তাহ পেরুলেই আবার যে কি হয়! দেখো, দাওয়াত, তালীম, ইবাদতের দ্বারা রুহ শক্তিশালী হবে। কিন্তু আমলের উপর উঠার জন্যে নফসকেও দূর্বল করা চাই। এজন্যেই কম খাওয়া, কম ঘুমানো, কম কথা বলার কথা বলা হয়। যেন মুজাহাদার মাধ্যমে নফস দূর্বল হয়। আজ জামাতে আগের মতো মুজাহাদা আমরা করি না। ফলে দাওয়াত -তালীম-ইবাদতের দ্বারা রুহ শক্তিশালী হয়, তার শক্তিতে কয়েকদিন চলতে পারি বটে, কিন্তু নফস কাবু না হওয়ায় এ সমস্ত বাতেনী রোগ বহাল তবিয়তে চাঙ্গা থাকে। আশা করি, আমার কথা তোমার বুঝে এসেছে। আচ্ছা! তোমার তাসবীহাতের কি অবস্থা? “
-” ভাইয়া! তাসবীহাতে এখনও পাবন্দ হতে পারি নি। “
-” ইন্না লিল্লাহি! সকাল বিকাল তাসবীহাত তো এ জন্যই দেয়া হয়েছে,
যেন তাসবীহাতের নূরের কারণে গুনাহ থেকে বাঁচা সহজ হয়ে যায়। এখন তো শয়তানকে ঠেকানোর কোন অস্ত্র তোমার হাতে রইলো না। আজ থেকেই ধ্যানের সাথে তিন তাসবীহ শুরু করে দাও। আর ঐ কম কম করার মুজাহাদাও লাগবে। তবে এ জমানায় কম খাওয়ার অর্থ হলো বেশি না খাওয়া।”
-” ইন শা আল্লাহ, ভাইয়া! জাযাকাল্লাহ।”
-” কাল চলো এক জায়গায় যাই। “
-” কোথায় ভাইয়া?”
-” আগাম বলা হবে না।”
পরদিন আরিফ হাসানের সাথে চললো। চট্টগ্রাম শহর থেকে বাসে করে উত্তর দিকে। ছোট্ট এক বাজারে নামলো। বাজার থেকে সরু রাস্তা দিয়ে পশ্চিমে চললো রিক্সা যোগে। সাদা-মাটা এক বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালো। হাসান ফোনে কার সাথে যেন কথা বললো।
-” হজরত! হাসান বলছি। এই তো আপনার বাড়ির সামনে। ” অনুমতি পেয়ে হাসানের সাথে এক ঘরে ঢুকলো। আরিফ ঢুকেই মনে মনে বলে উঠলো, এ তো কোন মিথ্যাবাদীর চেহারা হতে পারে না। শতোর্ধ্ব একজন বৃদ্ধ। চেহারা নূরে ঝলমল। হুঁশ একশতভাগ পরিপূর্ণ, স্মরণশক্তি জোয়ানদের চেয়ে কম নয়, কথা অনেকটাই স্পষ্ট বুঝা যায়। আরিফকে উদ্দেশ্য করে তিনি বললেন,
-” মুজাহাদা করো তো?” কথোপকথন থেকে বুঝা গলো, মুজাহাদা মানে তাবলীগের কাজ। তিনি হজরত ইলিয়াস রহঃ এর কুরবানির প্রশংসা করলেন। খুব গুরুত্বের সাথে দাওয়াতের মেহনতের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরলেন।
-” বাবা! ভার্সিটিতে তো ক্লাস করতে যেতে হয়। নজরের খুব হিফাজত করবে।”
অতঃপর তিনি নফসের দুষ্টুমি থেকে বাঁচার জন্য এক আমল শেখালেন। এটি তাঁকে তাঁর শায়খ শিখিয়েছিলেন, ওনাকে শিখিয়েছেন ওনার শায়খ হজরত আল্লামা আনোয়ার শাহ কাশ্মিরি রহঃ। সেদিন ওখানে আরিফরা ঘন্টা দেড়েক ছিলো। এই বুড়ো মানুষটির শক্তিশালী কথাগুলো শুনলো। তিনি রোযা রাখার কথাও বললেন। কী আশ্চর্য! আরিফ রোযা রাখতেও সক্ষম হচ্ছে, কিছু আমলও করতে পারছে। নফসের দুষ্টুমিও হঠাৎ অনেক কমেছে। আরিফ ভাবে, আমাকে ওখানে বার বার যেতে হবে। সামান্য সময়ের কি শক্তি রে বাবা!!
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত