শিলকড়ই গাছ। গাছের গোড়ায় মোল্লা টি স্টল। এই টি স্টল থেকে সোজাসুজি তাকালে কাশিমপুর কারাগারের প্রধান ফটক দেখা যায়। শিমু বসে আছে মোল্লা টি স্টলের একটা টুলে। ভোর থেকে বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টির মাত্রাটা খুব বেশি। এই বৃষ্টি এত সহজে থামবে বলে মনে হচ্ছে না। টি স্টলের চারপাশে পানি জমতে শুরু করেছে। ভেতরেও একটু আধটু পানি ঢুকছে। এমন করে বৃষ্টি হতে থাকলে কিছুক্ষণের মধ্যে দোকানে পানি জমবে। শিমুর পায়ে নতুন স্যান্ডেল। শিমু সেই স্যান্ডেল খুলে হাতে নিল। শিমু ইচ্ছে করেই স্যান্ডেল হাতে নিল। ভেজা সেন্ডেল পায়ে দিয়ে হাঁটতে কেমন যেন গা শির শির করে। এটা শিমুর খুব অপছন্দ।
টি স্টলের মালিক সবুজ মোল্লা। মোল্লা এখন দোকানে নেই। তাঁর আট-দশ বছরের মেয়েটা বসে আছে। মেয়েটাকে আগে কখনো দেখেনি শিমু। আজ প্রথম দেখল। যদিও এই মেয়ের কথা মোল্লার মুখে অনেকবার শুনেছে। মেয়েটা দেখতে খুব সুন্দর। সে অনেকক্ষণ ধরে শিমুর দিকে তাকিয়ে আছে। মেয়েটার তাকানো দেখে শিমুর খুব অস্বস্তি লাগছে। যদিও এতটুকু একটা মেয়ের তাকানোর মধ্যে তেমন কিছু যায় আসে না। তারপরও শিমুর খারাপ লাগছে। শিমু ইচ্ছে করেই মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করে, তোমার বাবা কোথায়? মেয়েটা খুব গম্ভীর হয়ে বলল, আমার নাম পুতুল। আমি এখন এই দোকানের মালিক। মেয়েটার কথা শুনে শিমু একটা হাসি দিয়ে বলল, তাই বুঝি? মেয়েটা এবার আরো গম্ভীর হয়ে বলল, হ। পুতুলের কথা শুনে শিমু হাসছে। মোল্লা বোধহয় মেয়েকে এমন করে কিছু বলে গিয়েছে। দোকানে নানা কিসিমের লোকজন আসে। এত লোকজনের মাঝে এই ছোট মেয়েটার দোকানে বসে থাকতে সাহস লাগে। মোল্লা নিশ্চয় মেয়েকে সাহস দিতে বলেছে, এই দোকান এখন তোমার। আমি না থাকলে এই দোকানের মালিক তুমি। তোমারেই সবকিছু খেয়াল রাখতে হবে।
মোল্লা মানুষটা এমনই। খুব সাদা-সিদে। সাদা-সিদে হলেও তাঁর ভেতর কেমন একটা সাহস আছে। সেই সাহস দেখে শিমুর খুব ভালো লাগে। এই সাহস বোধহয় মোল্লা মেয়েকেও দিয়েছে। অন্য সময় এই পুতুলের সাথে বেশ জমিয়ে আলাপ জুড়ে দিত শিমু। আজ তা করল না। শিমু এখন তাকিয়ে আছে কাশিমপুর কারাগারের প্রধান ফটকের দিকে। বৃষ্টির জন্য ঠিক ভালো করে দেখা যাচ্ছে না। তারপরও শিমু তাকিয়ে আছে। বৃষ্টি কমলেই শিমু ফটকের দিকে যাবে। আজ তেরো তারিখ। মাসের এই তারিখে শিমু আসে ইকবালের সাথে দেখা করার জন্য। প্রতি মাসের তের তারিখ শিমু সকাল সকাল এই কাশিমপুর কারাগারে এসে হাজির হয়। গফরগাঁও থেকে গাজীপুরের এই কাশিমপুর কারাগার। রোদ-বৃষ্টি যা-ই হোক শিমুর এ্খানে আসা চায়। এসে প্রথমে এই সবুজ মোল্লার দোকানে বসে। মোল্লা খুব ভালো মানুষ। শিমুকে বেশ সম্মান করে।
শিমু আসার দিন সকাল সকাল দোকান খুলে বসে থাকে। শিমু প্রতিবার আসার আগে এই মোল্লাকে জানিয়ে রাখে ফোনে। এমনটা খুব কম হয় যে শিমু এসে মোল্লাকে দোকানে পায়নি। তবে আজ মোল্লাকে দোকানে পেল না। বোধহয় কোনো একটা কাজে ব্যস্ত। ব্যস্ত বলেই হয়তো মেয়েকে বসিয়ে রেখে গিয়েছে। হুট করে বৃষ্টি থেমে গেল। সকাল থেকে যেমন করে বৃষ্টি হচ্ছিল তাতে মনে হয়নি এত সহজে বৃষ্টি থামবে। বৃষ্টি থামতেই শিমু হাতে ঝুলিয়ে রাখা স্যান্ডেল আবার পায়ে দিল। শিমু বসে আছে। পুতুল মেয়েটা এখনো ঠিক আগের মত তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে। সে কিছু একটা বুঝার চেষ্টা করছে। এটা দেখে শিমুর খুব মজা লাগছে। মাঝে মাঝে পুতুলের দিকে তাকিয়ে মজা লাগার বিষয়টা মাথায় আসলেও অন্য চিন্তার কারণে বিষয়টা নিয়ে কিছু ভাবতে পারছে না। শিমু এখন ইকবালের কথা ভাবছে। শিমু চায় না এখন এই ইকবাল ছাড়া অন্য কোনো বিষয় তাঁর মাথায় আসুক।
ভার্সিটিতে ডিপার্টমেন্টের সবচেয়ে পরিচিত জুটি ছিল ইকবাল আর শিমু। এই নিয়ে সবাই বলাবলিও করত। সাজিদ-মিলা আর শোয়েব-শান্তা জুটিকে ছাড়িয়ে এই দুজন হয়ে গেল লাইলি-মজনু। ডিপার্টমেন্টের সবাই লাইলি-মজনুই ডাকত তাদের। এই নিয়ে ইকবাল আর শিমুর তেমন একটা মাথা ব্যথাও ছিল না। ছাত্র হিসেবে খুব ভালো হলেও ইকবাল ছিল বেশ পাগলাটে। মাঝে মাঝে এমন সব কান্ড-কারখানা করে বসত যে শিমু লজ্জায় দু-তিনদিন ভার্সিটি যাওয়া বন্ধ করে দিত। তখন ইকবালের উপর খুব রাগ হতো। রাগ হলেও কখনো এই নিয়ে ইকবালকে সামনা-সামনি কিছু বলত না শিমু । শিমু ঠিক বুঝে গিয়েছিল ইকবাল এমনই। থার্ড ইয়ারে পরীক্ষার হলে বিশাল এক কান্ড করে বসল ইকবাল। কথা প্রসঙ্গে মোকলেস স্যারকে বলে বসল, শিমু আমার বউ।
কথাটা ইকবাল বেশ জোর দিয়েই বলল। পরীক্ষার হলে ইকবালের মুখে এমন কথা শুনে সবাই মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে। মোকলেস স্যার খুব শান্ত প্রকৃতির মানুষ। কিন্তু সেদিন বেশ রেগে গেলেন। রেগে গিয়ে ইকবালকে হল থেকে বেরও করে দিলেন। মাঝে মাঝে ইকবাল এমন সব কান্ড করে বসে যে শিমুর খুব বিরক্ত লাগে। এই নিয়ে ডিপার্টমেন্টে নানা কথা-বাতা হয়। শিমু এসব এড়িয়ে যেতে চেষ্টা করে। সব সময় এড়িয়ে যাওয়া সম্ভবও হয় না। কাছের লোকজন দু-চার কথা শুনিয়ে দেয়। তখন খুব কষ্ট হয়। মাঝে মাঝে ক্যাম্পাসে আসাও বন্ধ করে দেয় শিমু।
খুব ভালো ছাত্র হয়েও ফাইনাল ইয়ারের শেষের দিকে পড়ালেখা লাটে তুলল ইকবাল। এই নিয়ে শিমুর সাথে রোজদিন ঝগড়া-ঝাটিও হতে লাগল। ইকবাল কিছুই বলে না। সব সময় কেমন যেন শান্ত হয়ে বসে থাকে। ইকবাল এমনটি কখনো ছিল না। ক্যাম্পাসে ইকবাল আসা মানেই হইহুল্লোড় এটা সেটা করে মাতিয়ে রাখা। কিন্তু সেই ইকবাল কেমন করে যেন খুব শান্ত হয়ে গেল। ঠিকমত ক্লাস করাও বন্ধ করে দিল। শিমু বুঝতে পারে ইকবাল কিছু একটা লুকাচ্ছে। পরীক্ষার আগে আগে হঠাৎ করে ক্লাসে আসা বন্ধ করে দিল। ইকবালের ফোনটাও বন্ধ। ভার্সিটির হলে ইকবালের রুমমেট সিরাজ জানালো, বেশ কয়েকদিন ইকবাল হলে আসছে না। শিমুর কাছে পরিচিত যতগুলো ঠিকানা ছিল যোগাযোগ করল কিন্তু ইকবালের কোনো খোঁজ পাওয়া গেল না। ইকবাল কখনো নিজের পরিবার নিয়ে কিছু বলতে চাইতো না। সব সময় এড়িয়ে যেত। কেমন একটা হেয়ালী করত। ইকবালের এসব আচরণ নিয়ে শিমুর তেমন একটা মাথা ব্যথাও ছিল না। শিমুর মনে হতো এই ইকবালই তার জন্য যথেষ্ট। একটা মানুষকে অন্ধের মত ভালোবাসা বলতে হয়তো এমনই বুঝায়। শিমু এই অন্ধের মত ভালোবাসার জন্য আর অন্যকিছু নিয়ে চিন্তাও করেনি।
ইকবালের এমন আচরণে শিমুও খুব অভিমানী হয়ে উঠে। সিদ্ধান্ত নেয় আর ইকবালের খোঁজ নিবে না। নিজের ভেতর প্রচন্ড এক অভিমান নিয়ে শিমু ইকবালের বিষয়ে চুপচাপ বসে থাকে। ক্যাম্পাসে এই নিয়ে অনেক কথা হয়। কিছু কিছু বন্ধু-বান্ধবী টিপ্পনী কাটে। তারপরও নিজের ভেতর কষ্ট নিয়ে শিমু ক্যাম্পাসে যায়। ফাইনাল ইয়ারের পরীক্ষায়ও ইকবাল অনুপস্থিত। শিমুর বিশ্বাস ছিল পরীক্ষার সময় ইকবাল ফিরে আসবে। কিন্তু পরীক্ষায় ইকবাল আসেনি। স্যাররা এই নিয়ে বেশ আফসোসও করলেন। এত ভালো ছাত্র হয়ে এমন করে সবকিছু থেকে সরে যাওয়া দেখে সবাই আফসোস করতে লাগল। শিমু চুপ করে থাকে। কারো কোনো প্রশ্নের উত্তর তাঁর জানা নেই। শিমুর মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে এই ক্যাম্পাস ছেড়ে ইকবালের মত কোথাও পালিয়ে যেতে।
শিমু কারাগারের প্রধান ফটকের দিকে হাঁটছে। বৃষ্টি যেমনটা থেমেছে বলে ভেবেছে ঠিক তেমনটা থামেনি। এখনো গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। এই বৃষ্টি গায়ে পড়তেই খুব ভালো লাগছে। কেমন একটা শীত শীত অনুভব হচ্ছে। শিমু একটা জায়গায় গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। এই জায়গাটিতে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল। আর সামান্য কিছু হাঁটলেই কারাগারের গেইট। এদিকে বৃষ্টির বেগ আবার বাড়ছে। বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর শিমু আবার মোল্পার টি স্টলের দিকে হাঁটা শুরু করল। শিমু টি স্টলে ফিরে আসল আবার। ততক্ষণে সবুজ মোল্লা চলে এসেছে। শিমুকে দেখে বলল, বইন কেমন আছেন? শিমু একটা হাসি দিয়ে বলল, ভালো আছি।
‘সকালে এত বৃষ্টি দেখে খুব ভয় পাইছিলাম বইন। আজকে আপনার আসার তারিখ। এদিকে পুতুলের মায়ের খুব অসুখ। সকাল সকাল পুতুলরে দোকানে বসায় রেখে বাসায় গেলাম।’ ‘পুতুলের মায়ের কী হয়েছে?’ ‘যা খায় সব বমি করে। এত বমি আমি কোনো দিন দেখি নাই। পেটে কিছু রাখে না। গত রাত থেকে এমন অবস্থা। সকালে মকবুল ডাক্তারের বাসায় গিয়ে অসুধ আনলাম। খুব ভয় পাইছিলাম বইন। খুব ভয়।’ ‘এখন কী অবস্থা?’ ‘আল্লাহর অশেষ রহমত আছে। সে এখন ভালো। ডিম ভাজি আর কাঁচা মরিচের ভর্তা দিয়ে ভাত খাইলো। ভাত খাওয়ায়ে ওষুধ দিলাম।’ সবুজ মোল্লা লোকটা সহজ সরল। এত সহজ সরল মানুষ পৃথিবীতে খুব কম দেখা যায়। এই মানুষটা শিমুকে খুব সম্মান করে। গত তিন বছর ধরে শিমু এই কাশিমপুর কারাগারে আসে। আসলে এই দোকানেই বসে। সবুজ মোল্লা শিমুকে বোনের মত সম্মান করে। শিমু আসার তারিখটা মোল্লার মুখস্থ। তেরো তারিখ। প্রতি মাসের তেরো তারিখ।
একটা সময় বকসিবাজারে মাসুদ নামে ইকবালের এক মামাতো ভাই থাকত। শিমু ইকবালের সাথে একবার গিয়েছিল সেই মাসুদের কাছে। বয়সে ইকবালের অনেক বড় হলেও দুজনের মধ্যে সর্ম্পক ঠিক বন্ধুর মত। ইকবাল নিখোঁজ হওয়ার পর শিমু বেশ কয়েকবার গিয়েছিল বকসিবাজারে। মাসুদের সাথে আর দেখা হয়নি। তিনি অনেক আগে এই বাসা ছেড়েছেন। তারপরও শিমু মাঝে মাঝে ক্লাস শেষ করে বকসি বাজার গিয়ে ঘুরতো। শিমুর মনে হত একদিন না একদিন সেই মাসুদ ভাইয়ের সাথে তাঁর দেখা হবে। সত্যি সত্যি মাসুদ ভাইয়ের সাথে শিমুর দেখা হয়ে গেল একদিন। তবে সেটা বকশিবাজারে না। দেখা হয় কমলাপুর ষ্টেশন। ফাইনাল পরীক্ষার পর শিমু বাড়ির যাওয়ার জন্য গফরগাঁও এর ট্রেনে উঠল মাত্র। প্লাটফর্মে মাসুদ ভাইকে দেখে শিমু দ্রুত ট্রেন থেকে নেমে পড়ল। সেদিনই জানল সব কথা। কেন মাসুদ এমন করে উধাও হলো। ‘তুমি বোধহয় জানো না যে ইকবাল খুনের আসামী’
মাসুদ ভাইয়ের মুখে কথাটা শোনার পর শিমু কাঁপছে। কথাটা তাঁর একটু বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে না। ইকবাল এমন একটা কাজ কখনো করতে পারে না। কখনো না। ক্লাসরুমে টিকটিকি মারল বলে যে মানুষ তুলকালাম কান্ড করে বসে, সেই মানুষ দিব্যি একটা মানুষকে খুন করবে এটা কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছে না শিমু। তারপরও শিমু খুব শান্ত গলায় মাসুদ ভাইকে বলল, কাকে খুন করেছে? ‘তাঁর বাবাকে।’ শিমু এবার একটা চিৎকার দিয়ে বলল, বাবাকে? ‘হ্যাঁ, বাবাকে। ইকবালের যখন এগারো বছর বয়স ঠিক তখন ইকবালের মা বাড়ির পেছনের পুকুরে পানিতে ডুবে মারা যান। এলাকার অনেকে বলে এটা ইকবালের বাবার কাজ। খুব অত্যাচার করত ইকবালের মায়ের উপর। ইকবালের মায়ের মৃত্যুর পর তাঁর বাবা আরেকটা বিয়ে করে। এই বিয়ে কোনোভাবে ইকবাল মেনে নিতে পারেনি। আমার মনে হয় মায়ের মৃত্যুর বিষয়ে ইকবাল কিছু একটা জানত। কিন্তু সেই ছোটবেলায় বাবার ভয়ে কখনো মুখ খুলেনি। হয়তো মনে মনে এমন কিছু পুষে রেখেছিল।’
একটানা কথাগুলো বলে মাসুদ ভাই একটু থামলেন। কথাগুলো বলার সময় তিনি খুব অস্থির থাকলেও এখন বেশ শান্ত। বাকি কথাগুলো বলতে তাঁর খুব কষ্ট হচ্ছে। বুঝা যাচ্ছে তিনি ইকবালকে খুব পছন্দ করতেন। শিমু তাকিয়ে আছে মাসুদ ভাইয়ের দিকে। সে কিছুই বলছে না। মাসুদ ভাই কিছুক্ষণ সময় নিয়ে আবার বলা শুরু করল,
‘সৎ মায়ের সংসারে বেশ অবহেলা আর নির্যাতিত হয়ে বড় হতে থাকল ইকবাল। মাসুদের পড়ালেখার বিষয়ে তাঁর বাবার তেমন কোনো অবদান নেই।
ছোটবেলা থেকেই এটা সেটা করে নিজের পড়ালেখার খরচ নিজে চালাতো। মাঝে মাঝে খুব কষ্ট হতো। কষ্ট হলেও কাউকে কিছু বুঝতে দিত না। ভার্সিটি পড়াকালীন ইকবাল বাংলাবাজারে গিয়ে মাঝে মাঝে আট-দশদিন কাজ করত। কাজটা আমিই ঠিক করে দিয়েছিলাম। তাছাড়া কিছু টিউশনিও করত। কিছু টাকা হাতে আসলে আবার ক্যাম্পাসে যেত। শেষের দিকে আর পারছিলো না। তখন গ্রামে চলে গিয়েছিল। গ্রামে যাওয়ার আগে আমার কাছে একবার গিয়েছিল। তখন খুব অস্থির ছিল ইকবাল। আমি আগে কখনো তাঁর বাবাকে নিয়ে একটা শব্দও করতে শুনিনি। ঐদিন দেখলাম কতটা রাগ আর ক্ষোভ পুষে পুষে এই ইকবাল এত বড় হয়েছে। সত্যি আমি বুঝতে পারিনি ইকবাল এমন একটা কাজ করে বসবে। বুঝতে পারলে আমি কখনো বাড়ি যেতে দিতাম না।’
শিমুর মনে পড়ল। আসলেই ইকবাল মাঝে মাঝে কিছু না বলে আট-দশদিন নিখোঁজ হয়ে যেত। একটা মানুষ এতটা কষ্ট আর অভিমান বুকে চেপে রেখে দিন কাটিয়েছে অথচ শিমু একটিবারও বুঝতে পারেনি। শিমুর হাত-পা কেমন নিস্তেজ হয়ে পড়েছে। গফরগাঁওগামী ট্রেন কখন যে ছেড়ে দিয়েছে শিমু বুঝতেও পারেনি। কেমন যেন অসাড় হয়ে মাসুদ ভাইয়ের কথাগুলো শুনে যাচ্ছে। মাসুদ ভাইয়ের ট্রেন ছাড়ার সময় হয়ে উঠল। তিনি তাড়াহুড়া করতে করতে বলল, আমার ট্রেন ছেড়ে দিচ্ছে। তোমার ফোন নাম্বারটা দাও। আমি সময় করে তোমাকে ফোন দিব। শিমু কেমন যেন শান্ত হয়ে বসে আছে। মাসুদ ভাইয়ের এগিয়ে দেওয়া মোবাইলে নিজের ফোন নাম্বারটা তুলে দিল। মাসুদ ভাইকে কী বলবে, কী জানতে চাইবে তা কিছুই তার মাথায় আসছে না। মাসুদ ভাই শুধু নিজে থেকে বলল, ইকবাল এখন কাশিমপুর কারাগারে।
সেদিন শিমু আর গফরগাঁও ফেরেনি। কমলাপুর ষ্টেশন থেকে সোজা কাশিমপুর কারাগার। কোনো কিছুই শিমুর জানা নেই, চেনা নেই। তারপরও এই কাশিমপুর কারাগারে চলে আসল। কারাগারে পৌঁছাতে পৌঁছাতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। কী করবে, কাকে বলবে কিছুই তার জানা নেই। শুধু ঐ ইকবালের নামটি ছাড়া। শুধু নাম দিয়ে কী আর খুঁজে পাওয়া যায়? নিজের ফোন নাম্বারটি দিলেও মাসুদ ভাইয়ের ফোন নাম্বারটি রাখা হয়নি ভুলে। তখন মাথায় সত্যি সত্যি কাজ করেনি কী করবে, কী বলবে। কারাগারের গেইটে গিয়ে ঠিকমত কিছুই বলতে পারল না শিমু। ইকবালকে খুঁজে না পেয়ে হতাশ হয়ে মোল্লা টি স্টলে গিয়ে বসল। সেদিন থেকেই এই সবুজ মোল্লার সাথে শিমুর চেনা-জানা।
বৃষ্টি এবার বেশ জোরেই শুরু হয়েছে। বাতাস হচ্ছে খুব। মোল্লা টি স্টলের সামনের দিকে ঝুলে থাকা পলিথিন বাতাসের কারণে বেশ শব্দ করে নড়ছে। শিমু সেই পলিথিনের দিকে তাকিয়ে আছে। শিমুকে এমন চুপচাপ বসে থাকতে দেখে সবুজ মোল্লা বলল, আট বছর আগে পুতুলের মা আমার সাথে পালায়ে আসল। দুজন মিলে জীবন চালাতে খুব কষ্ট হচ্ছিল। আমি গরীব মানুষ। গেরেস্থ বাড়ির মেয়ে পুতুলের মা। আমি বললাম, তুমি বাড়ি ফিরা যাও। আমার সাথে থাকলে তোমার খুব কষ্ট হবে। পুতুলের মা আমার কথা শুনলো না। আমার সাথেই থাকল। এখন আল্লাহ রহমতে আমরা ভালো আছি। সুখে আছি। মানুষটার কোনো কষ্ট দেখলে আমার আর ভালো লাগে না। গত রাত থেকে আমার মন খারাপ ছিল। সকালে পুতুলের মা দুইটা খাবার মুখে দেওয়ার পর মনে জোর পাইলাম।
সবুজ মোল্লার কথা শিমু শুনছে কি না বুঝা যাচ্ছে না। শিমু তাকিয়ে আছে বাতাসে নড়তে থাকা সেই পলিথিনটার দিকে। শিমু কাঁদছে। সবুজ মোল্লা বুঝতে পারে শিমু তার কথা শুনছে। শুনছে বলেই কাঁদছে। সবুজ মোল্লা কথা পাল্টে বলল, বইন, আমাগো ইকবাল ভাইয়ের সাথে কি দেখা হইছে আপনার? ইকবালের নামটা শুনে শিমু সবুজ মোল্লার দিকে মাথা ঘুরিয়ে তাকালো। শিমুর চোখে পানি। তারপরও শিমু খুব স্বাভাবিক। এমন করে হয়তো অনেকবার শিমু এই সবুজ মোল্লার সামনে কেঁদেছে। গল্প করেছে। তাই হয়তো এমন করে কেঁদেও চোখের পানি না মুছে সবুজ মোল্লার দিকে তাকায় শিমু। হঠাৎ সবুজ মোল্লা কেমন যেন অস্থির হয়ে উঠে। কিছুটা রেগেও উঠে। অভিমান আর রাগ মেশানো কন্ঠে উত্তেজিত হয়ে বলে উঠে, আপনি এই কাশিমপুর আর আইসেন না বইন, আর আইসেন না। কেন এমন করে এসে বসে থাকেন? কেন?
শিমু স্থির হয়ে সবুজ মোল্লার দিকে তাকিয়ে আছে। সবুজ মোল্লা এবার হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলল, যে মানুষ বেঁচে নাই তাঁর জন্য এমন করে কারাগারের দরজায় দিনের পর দিন কেন ঘুরেন বইন? আপনারে এমন করে ঘুরতে দেখলে আমার খুব কষ্ট হয়। সবুজ মোল্লার এমন আচরণ দেখেও শিমু শান্ত হয়ে বসে থাকে। এই মানুষটাকে শিমুর খুব ভালো করে চেনা হয়ে গেছে। এমন ভালো মানুষ পৃথিবীতে খুব একটা দেখা যায় না। শিমু জানে সবুজ মোল্লার ভেতর কষ্ট হচ্ছে। শিমুকে সে নিজের বোনের মত মনে করে। বোনের মত ভাবে বলেই তাঁর ভেতরের কষ্টটা বেশি। ইকবালের ফাঁসি হওয়ার বিষয়টা মোল্লা হয়তো অনেক আগেই জেনেছে। জেনেও শিমুকে কিছু বলেনি। হয়তো শিমু কষ্ট পাবে বলে বলেনি। সবুজ মোল্লার মনে হয়েছে এই মানুষটা একটা আশা নিয়ে এখনো বেঁচে আছে। এই আশা নষ্ট করে মানুষটাকে কষ্ট দিতে চায়নি সে।
ইকবালের সাথে দেখা করার কথা বললেও কখনো কারাগারের ভেতর শিমুকে যেতে দেখেনি সবুজ মোল্লা। মাঝে মাঝে তো এই দোকানে কিছুক্ষণ বসে থেকে বাড়ি ফিরে যায়। এসব দেখে মোল্লার খটকা লাগে। খোঁজ নিয়ে জানতে পারে ইকবাল নামের লোকটার বছর খানেক আগে ফাঁসি হয়ে গেছে। বিষয়টা জানার পর শিমুকে এমন করে আসতে দেখেও মোল্লা কিছু বলত না। ইচ্ছে করেই বলত না। কিন্তু আজ কী হলো সে নিজেই বুঝতে পারে না। গত রাতে স্ত্রীর অসুখ দেখে মনটা কেমন অস্থির হয়ে উঠে। ভীষণ ভালোবাসে এই মানুষটাকে। ভালোবাসে বলেই নিজের ভেতর পুষে রাখা ভালোবাসার কষ্টের তীব্রতা সে বুঝতে পারে। এই তীব্রতা ভীষণ কষ্টের। ভীষণ কষ্টের। শিমুকে এমন একটা কষ্ট বহন করতে দেখে তাঁর খুব কষ্ট হচ্ছে। শিমু প্রতিমাসেই এই কাশিমপুর আসে। ভাসির্টিতে তেরো তারিখ ইকবালের সাথে প্রথম দেখা হয়েছিল শিমুর। দুজনের মধ্যেকার সম্পকের পর থেকে প্রতি মাসের তেরো তারিখ তারা প্রায় একসাথে কাটিয়েছে। ক্যাম্পাস বন্ধ থাকলেও কোনো না কোনোভাবে দুজন একসাথে মাসের এই তারিখটায় দেখা করত। দুইজনেই জানে এই তারিখটা তাদের জন্য বিশেষ একটা দিন।
অনেকক্ষণ হয়ে গেল শিমু চুপ করে বসে আছে। শিমুর চোখে এখনো পানি। চোখটা আলতো করে মুছে নিয়ে শিমু বলল, গত তিন বছরে আমি এই কাশিমপুর এসেছি আটত্রিশবার। এই আটত্রিশবারে ইকবালের সাথে আমার দেখা হয়েছে মাত্র একবার। ইকবালের ফাঁসির ঠিক সপ্তাহখানেক আগে। তার আগে আমার সাথে কখনো সে দেখা করেনি। প্রতিবার আমি আসতাম আর ফিরে যেতাম। ইকবাল ইচ্ছে করে আমার সাথে দেখা করত না। আমি জানতাম ইকবালের ফাঁসি হবে। কখন হবে তা জানতাম না। তবে বিশ্বাস ছিল ফাঁসির আগে একবার হলেও ইকবাল আমার সাথে দেখা করবে। যেদিন আমার সাথে সত্যি সত্যি দেখা করতে রাজি হলো সেদিন আমি বুঝে গেলাম ইকবালের সময় শেষ। খুব শীঘ্রই ফাঁসি হবে। আমাদের দেখা হয়েছিল ঠিকই কিন্তু কথা হয়নি। সত্যি কোনো কথা হয়নি। ইকবাল আমাকে দেখে বাচ্চাদের মত করে শুধু কাঁদলো। তাঁর এমন কান্না দেখে আমার খুব ভালো লাগছিল। মনে হচ্ছিল এই আমার সেই ইকবাল। অভিমান করলে ইকবাল এমন করে কেঁদে ফেলত। ক্যাম্পাসেও এমন করে কেঁদে ফেলত। ঠিক বাচ্চাদের মত করে। তাঁর এই কান্না দেখলে আমার যে কী ভালো লাগত। আমি ইচ্ছে করেই মাঝে মাঝে কাঁদাতাম এই ইকবালকে।
কথাটা বলে শিমু একটু থামল। কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর আবার বলল, ইকবালের কান্না দেখে আমি কিছুই বলিনি। সেদিনের পর আমি অনেকবার এই কাশিমপুর আসলেও কখনো আর কারাগারের গেইটে যায় নি। ইচ্ছে করে যায় নি। আমি বুঝে গিয়েছিলাম ইকবালের ফাঁসি হবে। বুঝে গিয়েছিলাম বলেই আর কখনো খোঁজ নিই নি। আমি ইকবালের শেষ স্মৃতিটা নিয়ে বেঁচে থাকতে চাই। আমি এখনো মনে মনে ভাবি এই কারাগারের ভেতর ইকবাল আছে। ইকবালের সাথে শেষ দেখার স্মৃতিটা আমার একটা সাহস। এখানে আসলে আমার সেই সাহসটা বেড়ে যায়। একটা মানুষকে ভালোবাসার জন্য সাহস আর শক্তি লাগে। আমি আসি সেই সাহস আর শক্তি নিতে। এই সাহস আর শক্তি নিয়ে কতদিন বেঁচে থাকব জানিনা কিন্তু কাশিমপুর আমার জন্য অনেককিছু। আমি বেঁচে থাকা অবদি এই কাশিমপুর কারাগারে আসব।
কথাটা শেষ করে শিমু মোল্লা টি স্টল থেকে বের হয়ে হাঁটা শুরু করল। শিমু ফিরে যাচ্ছে গফরগাঁও হাই স্কুলে। গফরগাঁও হাই স্কুলের অংকের শিক্ষিকা ইয়াসমিন আক্তার শিমু সেন্ডেল পায়ে তুমুল বৃষ্টির মধ্যে হাঁটছে। ভেজা সেন্ডেল পায়ে তার আজ একটু গা শির শির করছে না। বৃষ্টির বেগ বাড়ছে। সবুজ মোল্লা কাঁদছে। চোখে জল নিয়ে সবুজ মোল্লা একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে ছাতা বিহীন বৃষ্টিতে ভিজে শান্তভাবে হেঁটে যাওয়া শিমুর দিকে।
গল্পের বিষয়:
গল্প