ঘুরে দাঁড়ানো

ঘুরে দাঁড়ানো
“আমার মৃত্যুতে কারো হাত নেই” কাগজে ছোট্ট করে লিখে, আফজাল সাহেব ফ্যানের সাথে ঝুলে গেলেন। চারদিকে ধমকা হাওয়া বইছে। বাতাসও যেনো বলছে, টাকা চাই; টাকা চাই। আফজাল সাহেবের স্ত্রী, বড় মেয়ে লিপিকে নিয়ে বাজারে গেছেন। ছোট ছেলে-মেয়ে গুলো গতকাল নানার বাড়ি গেছে। বড় মেয়ে কয়েকদিন আগে আসলো শ্বশুরবাড়ি থেকে। মেয়েটাকে বিয়ে দিতে গিয়ে বাড়ির জায়গাটাও জামানত দিতে হয়েছে, গ্রামের মাতব্বরের কাছে।
মানুষের থেকে কিছু ঋণ করতে হয়েছে মেয়ের জামাইকে মটর সাইকেল দিতে গিয়ে। বিয়ের সময় ১লাখ টাকা, ছেলের বাবার হাতে দেওয়ার পরই বিয়ে হয়েছে। মেয়েকে বিয়ে দিতে গিয়ে আজ রাস্তায় নেমে গেলেন, আফজাল সাহেব। মেয়ে আসছে কিছু টাকা নিতে, ছেলে ব্যবসা করবে। সেটাও মেয়ের বাবা দিতে হবে। চারদিকে ঋণের ভয়ে নিজেই দুনিয়া ছেড়ে, সবার ঋণ থেকে বাঁচতে চাইলেন। সন্ধ্যা নাগাত লিপি ও তাঁর মা বাসায় ফিরে এসে দেখলেন ভেতর থেকে দরজা দেওয়া। লিপি তাঁর বাবার মোবাইলে কল দিলো, ঘরের ভেতরে মোবাইল বাজিতেছে। দরজার ফাঁক দিয়ে লিপি দেখে তার বাবা ফ্যানের সাথে ঝুলে আছে।
একটা চিৎকার দিলো লিপি। আর বলে “বাবা, আমার টাকা চাই না। শ্বশুরবাড়ি আর যাবো না। ওঁরা টাকার জন্য আমাকে মেরে ফেলবে। আর টাকা দিতে গিয়ে তুমি আমাদের ছাড়বে। তোমাকে হারাতে চাই না। ” কিরে কি হয়েছে? লিপির মা বলে উঠলো। লিপির বাবাও লিপির সামনে দাঁড়ানো। লিপি চোখ খুলে বুঝলো, তাঁর বাবা আসলে মারা যায়নি। এতক্ষণ এইসব স্বপ্নে দেখছিলো। লিপি এখনো কান্না করছে। লিপির মা, তাঁকে শান্ত্বনা দিচ্ছে। সকাল হতেই লিপির বাবা আফজাল সাহেব ৫০হাজার টাকা এনে লিপির হাতে দিলো। আর বলে, “মা’রে, আমি আর এরচেয়ে বেশি দিতে পারবো না। আমাদের ফসলের জমিটার কিছুটা বিক্রি করে সকল ঋণের টাকা দিয়ে দিয়েছি মাতব্বরকে। কিছুটা জমি আছে, তোর ছোট বোনটাকে বিয়ে দিতে গিয়ে, ওটা না হয় দিবো । সব তোকে দিলে বাকিরা কি করবে আর। একটা ভাইও আছে তোর। “
আফজাল সাহেবের চোখের কোণে একটু পানি জমে গেছে। লিপি তাঁর বাবার অসহায় মুখটা দেখে আর চুপ থাকলো না। লিপি টাকা গুলো তার বাবার হাতে দিয়ে বলে, “আমি টাকা চাই না। আমি ওই বাড়িতে আর যেতে চাই না। টাকা নিয়ে গেলে কয়েকদিন ভালো থাকবো। তাঁর পর আবার বলবে টাকা নিয়ে যেতে। আমি আর যাবো না। ওই সংসার আমার চাই না। লিপির মা এসে বলে, ” এমন কথা বলতে নাই মা। আমরা তোর ভালোর জন্য বলতেছি, ছেলেটা ভালো। তোকে অনেক ভালো রাখবে। কয়েকদিন যাক সব ঠিক হয়ে যাবে। “তোর মা ভালো বলতেছে। আমরা বুঝিয়ে বলবো। আজকে আসতে বল, তোর স্বামীকে। ” আফজাল সাহেব বললেন।
লিপি বলে, “আমি সংসার করবো না। আমি আজই থানায় মামলা করবো। আমার সংসার করার ইচ্ছে নাই। লিপির বাবা মা অনেক বুঝানোর পরও লিপি মানতে নারাজ। লিপি তাঁর মা’কে নিয়ে থানায় গিয়ে শ্বশুর-শ্বাশুড়ি সবার নামে যৌতুক ও শারীরিক নির্যাতনের মামলা করলেন। থানার অফিসার’কে দেখালেন নিজের শরীরে আঘাতের চিহ্ন।
পরেরদিন লিপির স্বামী ও শ্বশুর’কে থানায় নিয়ে গেলো পুলিশ। লিপির উপর অত্যাচারের কথা জানতে চাইলে অস্বীকার করে তাঁরা। আর কিছু টাকা দিয়ে মামলা শেষ করতে বলে। থানায় জানায় লিপি মানসিক রোগী। কয়েকদিন পরই পুলিশও টাকা নিয়ে লিপিকেই দোষী করে ডিভোর্স হয়ে যায় কোর্টের মাধ্যমে। যতো টাকা দিয়েছে আফজাল সাহেব, সবই অস্বীকার করে লিপির শ্বশুরবাড়ির লোক। খালি হাতে ফিরতে হলো লিপিকে।
লিপির মা ও বাবা লিপিকে বুঝায়। আফজাল সাহেব বলে, ” মা’রে সমাজে একটা অবস্থান আর টাকা না থাকলে। মিথ্যাবাদীর কাছে হার মানতে হয়। তুই যা খুশী করতে পারস। নিজের জীবনটা গুছিয়ে নিতে পারস। আমরা বাধা হবো না। লিপি তাঁর পিতাকে জড়িয়ে ধরে অনেক কান্না করে। আর বলে, “আমি পড়াশোনা করতে চাই। শহরে চলে যাবো অনার্স শেষ করে চাকুরী করবো। নিজের পায়ে দাঁড়াবো ‘ঠিক আছে , তোর মামার সাথে কথা বলে ঢাকায় পাঠিয়ে দিবো। ” লিপির মা বললো। কয়েকদিন পরই লিপি ঢাকায় চলে আসলো। গ্রামের কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেছিলো। তারপরই বিয়ে দিয়ে দেয়। বছরখানেকের ভিতরই সব শেষ।
লিপি শুরু করলো পড়াশোনা। গ্রামের জমিতে আফজাল সাহেব ভালো করে চাষাবাদ শুরু করলেন। সাথে মানুষের জমিও নিলেন। মেয়ের কথা মতো একটু ঘুরে দাঁড়ানোর শেষ চেষ্টা। সেই ৫০হাজার টাকায় লিপির কলেজে ভর্তি ও ফসলের জমি করা। লিপি পড়াশোনা করছে। আফজাল সাহেবের ফসল ভালো হলো। বছর যেতেই সকল ঋণের থেকে মুক্ত। সংসারও ভালো চলছে। কয়েক বছরের ভিতর, আফজাল সাহেবও সচ্ছল হয়ে গেলেন। লিপিও পড়াশোনা করছে। নিজে কিছু করবেই। ৫বছরের ভিতর অনার্স শেষ করে গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার চাকুরীও পেয়ে গেলো লিপি।
এতকিছু সহজে হয়নি। লড়তে হয়েছে নিজের সাথে, সমাজের সাথে। মানুষের কটু কথা, ডিভোর্সি মেয়ে কেউ বিয়ে করবে না। নানান কথা লিপি ও তাঁর পরিবার শুনতে হয়েছে প্রতিবেশী, আত্মীয় সবার থেকে। চাকুরী পাওয়ার পরই লিপি বাচ্চাদের, সকলকে এটাই বুঝাতে চাইতো নিজে কিছু করো। কয়েক মাসে একজন ভালো শিক্ষক হিসাবে পুরো গ্রামে পরিচিত হয়ে গেলো। নানান জায়গা থেকে ভালো ভালো বিয়ে আসে লিপি তা ফিরিয়ে দেয়। কথায় আছে সুদিনের মাছির অভাব হয় না। আফজাল সাহেব ভালো অবস্থান হয়ে গেলো। বছর পরে লিপি নিজের টাকায় পাকাবাড়িও করলো।মাঝে মাঝে ভাবে, একটু ঘুরে দাঁড়াতে হলে কিছু ত্যাগ করতে হয়। একজন জীবন সাথী এমন হওয়া দরকার যে অনেক কষ্টে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। লিপিকে বুঝবে, তাঁর পরিবারকে বুঝবে।
লিপি মা-বাবা বিয়ের কথা বললে, লিপি বলে, “একজন ঠিক আসবে। যে সকল কিছু জানার পর আমার সাথে থাকবে। ওই মানুষটাকে নিয়ে জীবনে আরো অনেক উপরে যাবো। যৌতুক নয়, আমাকেই একটা উপহার ভবাবে । ওই মানুষটা আসবেই। আরেকটু অপেক্ষা করি ” লিপির মা-বাবাও অনেক খুশী লিপির কাজে, তাঁর চেষ্টায় আজ এত কিছু। মেয়ে মানেই বোঝা নয়। তাঁরাও পারে কিছু করতে। বোঝা মনে করে যৌতুক দিয়ে বিয়ে নয়। একটু ভরসা আর সাহস দিলে নারীও অনেক এগিয়ে যাবে। এটাই সবাইকে বুঝায় লিপির মা-বাবা। অনেক ভালোই দিন কাটছে লিপি ও তাঁর পরিবারের।
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত