চাকরিজীবি যোদ্ধা

চাকরিজীবি যোদ্ধা
আমার নাম সুপ্রভা। আমি মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে এবং মধ্যবিত্ত পরিবারের বউ। যথেষ্ট শিক্ষিত আর সুন্দরী হওয়ার দোষী হওয়ার শর্তেও আমার দুই সন্তানের ভালো শিক্ষার জন্য আমার চাকরী করা আমার বিরাট অপরাধ। আমি আপনাকে সে গল্প শোনাতে চাই।আপনাকে লিখতে হবে বলছি না। আমি শুধু শোনাব। বাকিটা আপনার ইচ্ছে।
একে তো শরীরের এই অবস্থা, কিছুদিন আগে অপারেশন হলো। তার উপর মেয়েটাও জ্বর কাশি। মায়ের কাছে এলাম।মায়ের ও জ্বর কাশি। ভালো লাগে না কিছু। কিছুদিন ধরে বার বার কল আসছিলো ওনার আইডি থেকে। ধরা হয় নি। হয়ত ওনার টাইম নেই লেখার তাই কল দিচ্ছিলো। আমি কল করলাম, তিনবার রিং দেওয়ার পর ধরলেন না। তিনবার দিলাম কারণ এখন ফ্রি আছি। মেয়ে ঘুমাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর দেখলাম তিনি আমাকে কল দিলেন। তখন এই কথা গুলো বললেন। ওনাকে সহজ করার জন্য আরো কিছু কথা বললাম। উনিও বললেন। আজকের রান্না কি করলেন জিজ্ঞেস করলাম।
উনার মন মেজাজ খুব একটা যে ভালো নেই তা বুঝতে পারলাম। কেউ যখন আমাকে তাদের গল্প লিখতে বলে আমার খারাপ লাগে না। ভালোই লাগে। তাদের কথা গুলো এলোমেলো হয়। আমি চেষ্টা করি গুছিয়ে লিখতে। হয়ত ওটাই আমার একমাত্র ক্রেডিট। গল্প তো ওদের। ওনার গল্প শুনেই রাতেই মেয়ে ঘুমানোর পর লিখতে বসলাম রাত 1 টাই। আমার নাম সুপ্রভা, আমরা তিন বোন দুই ভাই। আমার বাবা স্কুলের প্রধান শিক্ষিক। ছোট বেলা থেকে আমাদের অভাবের সংসারে দেখেছি বাবাকে কেমন মাথা উচু করে চলতে। বড্ড গর্ব করতাম আমরা বাবাকে নিয়ে। বাবাও আমাদের নিয়ে। সবাই পড়ালেখায় যে ভীষণ ভালো ছিলাম। বাবা সব মেয়ে আগে চাকরি ধরিয়ে তারপর বিয়ে দিলেন। আমি সবার ছোট। আমিও সরকারি স্কুলের চাকরি ধরেছি। বাবা ছোট্ট একটা স্ট্রোকে কাউকে কষ্ট না দিয়ে মারা গেল।
ভাইয়েরা দায়মুক্ত হওয়া দরকার ছিলো তাই আমারও বিয়ে দিয়ে দিলো। আমার স্বামী তপন একটা প্রাইভেট ফার্মে চাকরি করে। বেতন কম, আত্মসম্মান কম, খাটনী বেশি। আমার চাকরী গ্রাম সাইডে। বিয়ের পর বাসা নেওয়া হলো মূল শহরে। ওর সুবিধার জন্য। আমার কিছু বলার ছিলো না। প্রথমে মাস নাকি শশুড়বাড়িতে থাকতে হবে। বউ থিতু হবে না নইলে, চাকরী করা মেয়ে নিয়ে যাওয়াই সবার একটু খবরদারী খাটাতে হবে বলে মনে হয় সবাই মনে করে। মেয়ে চাকরী করে মানেই যে মেয়েকে অনেক চালাক- চতুর, রান্না পারদর্শী, মুখে মুখে কথা বলা মেয়ে হয় এইটা আমাদের দেশে কেন ধারণা করা হয় জানি না। ১৫ দিনের ছুটি ছিলো। বিয়ের পরে চাকরি করব না এমন কোন কথা যখন ছিল না, যখন জানেই চাকরিতে জয়েন দিবো বলে উঠতে বসতে এত বার চাকরি করা বউ যোগ করে তখন জয়েন দেব শুনলেই কেন আকাশ ভেঙে পরলো বুঝলাম না।
-এখনো তো ঘরের মেহমানেই বিদায় হয় নি? বউ জয়েন দিবে?
যেন বউ আসার আগে ওদের ঘরে আত্নীয় স্বজন আসতো না। শিড়দাঁড়া সোজা ছিলো তো, বুঝলাম যুদ্ধ ছাড়া শুরু করা যাবে না। বাসা ভর্তি মানুষ রেখে সাতটায় রেডি হয়ে বের হয়ে গেলাম জয়েন দিতে কারণ পরীক্ষা শুরু হচ্ছিল। স্কুল শেষে বাড়িতে গিয়ে খেয়ে দেয়ে এলাম। বিকালের দিকে রওনা দিলাম আবার শশুড়বাড়িতে। পৌঁছালাম রাতের আট টায়। ততক্ষনে গোলটেবিলের মিটিং বসে আছে। উপেক্ষা করে ফ্রেস হয়ে রান্না ঘরে ডুকলাম। শুরু হলো খোটা,
-তেল কত আছে দুইদিনে বুঝা যাবে।
আসলেই দুইদিনে বুঝে গেলাম। এইভাবে পারা যাবে না। তাই ওকে বললাম শহরের বাসায় চলে যায়। তুমি তো সপ্তাহ না যেতেই জয়েন করেছ। বাসা তো আছেই। ওখান থেকে সহজ হবে। ঐ যে পুরুষ সিংহ মূহুর্তে গর্জে উঠল। শরীর সত্যিই পারছিলো না। তাই সেদিন চাকরি শেষে বাপের বাড়িই রয়ে গেলাম। ফোন এলো। -ওখানেই থেকে যাও না তো। সপ্তাহ খানিক থাকার পর মা ভাইয়ের চিন্তায় ঘুম হারাম। তপন কে ডেকে এনে ভালো মন্দ খাইয়ে আমাকে সহ বিদায় দিলেন।
শহরের বাসায় উঠলাম। সংসার সাজালাম। রাতে রান্না করে রাখতাম। সকালে দুইজনে নাস্তা করে টিফিন নিয়ে বের হতাম। আমাকে আগে বের হতে হতো। ওর দশ মিনিটের রাস্তা। আমাদের দেশের চাকরি করা মেয়েদের স্বামীদের মনোভাব এখন অনেক উন্নত হলেও কিছু মানুষের সেই রয়ে যায়। সংসারের কাজ। বউ করবে। যারা স্বামীর সাহায্য পায় তারা স সত্যিই ভাগ্যবান। তাও সবটা করে দুইজনের ভালোই চলছিল। ভালো বলতে আমার চাকরির টাকাও লেগে যেত সবটা করে আসতে মাস শেষে। লাগলে আমরা অবশ্যই সব করব। কিন্তু তপনের তা মুখ ফুটে বলতে পুরুষত্বে লাগতো। শশুড়বাড়িতে সবার ধরনা চাকরির টাকা সব বাপের বাড়িই যাচ্ছে আমার। শুধু শুধু ছেলেটা সব সহ্য করছে। সংসার হচ্ছে না। ধারণা টা ভাঙ্গায় নি সে, তাই চলতে থাকে।
তিন বছর হয়ে গেল। আর কত? এইবার তো বাচ্চা লাগবে। চাকরির জন্য কি বংশের বাতি আনা বন্ধ হবে নাকি? কত মেয়ে বাচ্চা সামলে করছে না? নাকি যারা চাকরি করে তাদের বাচ্চা হয় না? তখন নিজেদের জন্য না হলে সবার জন্য একটা বাচ্চা লাগবে। কিন্তু কেউ এসে একবেলা বাচ্চাটা রাখবে না।ব্যাপারটা কি অদ্ভুত না? ছয় মাসের ছুটি। আমার ছেলে নীল হওয়ার আগেই নিয়েছিলাম দুই মাস পরের চারমাস। আগাগোড়া মা সব করে গেলো। তখন বংশের প্রদীপ দেখতে কেউ একরাত জাগতে আসে নি। মা কেন রয়ে যাবে মেয়ে জামাইয়ের বাসায় সেটাও বড় মাথা ব্যাথা। তাই ভাই সহ আমার জন্য আমার বাচ্চা দেখার জন্য আমাদের পাশেই বাসা নিলো মায়েরা। সারাদিন মা দেখে। মাস শেষে বাপের বাড়ি কিছু দিতে গেলেই ভ্রু কুঁচকানো বাঁকা হাসি। এইভাবে চলতে চলতে একবার হাঁপিয়ে উঠি। স্বামীকে বললাম, ছেড়ে দিই চাকরি টা? পারবে বাসা ভাড়া দিয়ে সবটা সামলাতে? বাচ্চার পরের ভালো স্কুলের খরচ তুলতে?
-পরের মাসে প্রমোশন হবে, এরপর ছেড়ে দিও। ছয় বছর পরেও সে চাকরি ছাড়তে পারার মতো প্রমোশন টা এলো না। কিন্তু আরেকটা ছেলে এসে গেলো। দুইটাই মায়ের হাতেই। ঠাম্মির কাছে বেড়াতে যায়। তখন তার হা-হুতাশের শেষ থাকে না। নাতিদের কাছে পায় না। তখন তো আমারো মেরুদণ্ড সোজা। তাই বলি,
– আসুন না তো বাসায় থাকবেন। রান্নাবান্না তো সব করেই যাই। শুধু নাতি দুটো দেখে রাখবেন। এখন তো আর রাত ও জাগতে হবে না। কোলেও রাখতে হবে না। তখন আমার বেয়াদপ আখ্যাটা আরো বড় হয়ে তার অনেক দিনের পুরানো কোমর ব্যাথাও বেড়ে যায়। আমি হেসে চলে আসতে পারি না। খুব রাগ হয়। জানি না কার উপর হয়। ভাইয়েরা সংসারী হয়েছে। তাদের এত মাথা ব্যাথা নেই এখন আর বোনদের নিয়ে। সব বোনেরা নিজেদের যুদ্ধে ব্যস্ত। মা তখনো আমাদের দিয়ে যাচ্ছে। তাও মাকে মেয়ের টাকায় ঘরের আসবাব গড়ার অপবাদ নিতে হয়। মা অস্বীকার করতে করতে আর না পেরে গর্ব নিয়ে বলে,
– হে, আমার মেয়েরা দিচ্ছে। দিবে না তো। সবাই চাকরি করে। এইদিকে ঘরের পাঁচ খরচ সামলে একটা সেভেসিং এর ব্যস্ত সবাই। বাচ্চারা এখন বড় হয়েছে। স্কুলে যায়। ওদের কাউকে লাগে না এখন। স্কুলেই দিন কেটে যায়। ভালো স্কুল ভালো টিউশন যখন নিশ্চিত করলাম।
এখন সমস্যা হলো আমি সংসারের কোন কাজেই করি না। আমার কোন টান নেই সংসারের প্রতি। ঘরের প্রতিটা আসবাব যখন আমার টাকায় কেনা তখন আমায় শুনতে হয় চাকরি করে কি এমন করে ফেলেছি? সে প্রমোশন টা এইবার এলো তপনের। কারণ আমার সেভিংস টা মিচ্যুয়ার হবে আর টাকা ওর খুব কাজে লাগবে কিছু একটা করতে তাই আর চাকরি করা লাগবে না আমার। এতদিন যখন সারারাত জেগে সকালে আবার চাকরি করে বাসায় ফিরে রান্না করে আমার চাকরিটা ছাড়া চলছিল না, এখন যখন সব ঠিক হলো তখন সেটা আর লাগবে না। ব্যাপারটা আবার আমার শিড়দাঁড়ার।আমি ছাড়বো না। কারণ সিদ্ধান্ত আমার। আমার বাচ্চার ফিউচারের। আমি কখনো ছাড়তে চাই না।
এখন এইটা আমার অপরাধ। আর আমার দোষ আমি এখনো যথেষ্ট সুন্দরী হওয়াতে আমার চরিত্রেও দাগ লাগানো ব্যাপারটা বেশ সহজ হয়ে গেলো। কিন্তু তাও আমি বললাম, এত গুলো বছর একা লড়ে চাকরি করে এসেছি। বাকিটা পথ ও ঠিক একা লড়তে পারবো। কিন্তু আমি আমার বাচ্চাদের একটা ভাঙ্গা পরিবারের যন্ত্রনা দিতে চাই না। এখন আমি কি করব আমি বুঝতে পারছি না। আমি লিখছি আর ভাবছি, আমি হয়ত এক সুপ্রভার কথা লিখছি। আর এমন হাজারো চাকরি জীবি দিদিদের রোজ করতে থাকা যুদ্ধ জয়ের গল্প লিখছি। যারা ভাবে শুধু চাকরি তো করে। আর যারা ঘরে বসে হা হুতাশ করে। চাকরী করতে পারছি না। তারা কি এই যে সারাদিন চাকরি করার ধকল টা আসলেই বুঝতে পারি? শুনিয়ে দিই আমরা,
– চাকরি তো করছে, নিজের ইচ্ছে মতো খরচ করতে পারে ডিসিশন নিতে পারে। একবার তাদের ভেঙ্গেচুরে শুধু শিড়দাড়ার জোরে হেসে উঠাটা বুঝতে পারি? অনেকে বলবে এখন এইসব হয় না। কিন্তু আমি জানি, আমি দেখেছি, এখনো চাকরি জীবি মেয়েদের এইসব সহ্য করে যেতে হয় রোজ। এইসব তো শুধু ঘরের। বাইরের গুলো তো এখনো বাদ। আমি সুপ্রভা দিদিকে বললাম, তুমি ছেড়ো না তোমার চাকরি। সে শুধু বিড়বিড় করে যাচ্ছে, ও যে আমার চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তুলছে গো! আমি জানি না, এর উত্তর কিভাবে দিতে হয়। অনেকক্ষন চুপ করে বললাম, উনি যদি চালাতে পারে ছেড়ে দাও চাকরি, বাচ্চাগুলো ও এইসব ঝগড়াঝাটি আর দেখবে না। উনি এইবার চিৎকার করে উঠলেন,
– এইটা যে শুধু শুরু নয়, তার গ্যারান্টি কি? এখন যদি চাকরি ছাড়ি আর কি পাবো? আমার শিড়দাঁড়া যে ভেঙে দিবে সে। আমি ধর্য্য হারালাম। তাহলে কি চাইছেন? কেমন একটা যুদ্ধ জয়ের কণ্ঠে বললেন, আমি যুদ্ধ জয়ের গল্প সবাইকে শোনাতে চাই, আরো যুদ্ধ জয়ের গল্প শুনতে চাই।
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত