রুমমেট বললে ছাত্রজীবনের কথাই তাড়াতাড়ি মাথায় আসার কথা। কিন্তু কফিল আহমেদ এখন শিক্ষক পেশাদার মানুষ। ছাত্রজীবনে কোনো রুমমেট পাওয়া হয়নি তাঁর। তবে শিক্ষক জীবনে পেয়েছেন। একটি মধ্যম আকারের রোমে চারজন শিক্ষক থাকেন। রোমের চারকোনে চারটি ছোট সাইজের খাটে রুমমেট সবাই মিলেমিশে ঘুমান। কফিল আহমেদ একটু ভবঘুরে স্বভাবের। বাকি তিনজন তিন স্বভাবের হলেও বেশ সংসারী। দিনরাত সংসার নিয়েই তাদের আলোচনা, চিন্তাভাবনা ঘুরপাক খায়।
কফিল আহমেদ তাদের কোনো কিছু নিয়েই মাথা ঘামান না। তাঁর ভাষায় বলা যায়, তিনি অনধিকার চর্চা করেন না। কিন্তু বাকি তিনজন ঠিক এর বিপরীত। কফিল আহমেদের সবকিছু নিয়ে তারা মাথা ঘামান। বলা যায় অনধিকার চর্চা করেন। সেদিন রুমমেট জামান মাহমুদ চূড়ান্ত ধরনের অনধিকার চর্চা করলেন তার ঘুম নিয়ে। তিনি নাকি সারারাত জাহাজের ইঞ্জিনের মতো ঘটঘট খটখট শব্দে নাক ডাকান। কথাটি একা-একা ডেকে নিয়ে বললে কফিল আহমেদের আপত্তি ছিল না। বললেন শিক্ষক মিলনায়তন অফিসে, সবার সামনে। তাঁর ধারণা, নাক ডাকানো ব্যাপারটি আসল উদ্দ্যেশ্য নয়। মূল উদ্দ্যেশ্য হলো তাকে সবার সামনে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলা। আর একটু লজ্জা দিয়ে আত্মতৃপ্তি পাওয়া।
তাই-তো কোনো প্রসঙ্গ বা ভূমিকা ছাড়াই অফিস ভর্তি সহকর্মীদের সামনে জামান মাহমুদ হঠাৎ যখন বলে উঠলেন- ‘কফিল স্যার সারারাত জাহাজের ইঞ্জিনের মতো ঘটঘট খটখট শব্দে নাক ডাকান। ছগির স্যার এজন্যে কানে তোলা ঢুকিয়ে ঘুমাতে যান। কাল দেখলাম, ছগির স্যারের সাদা কালারের তোলার দলা দুটি কানের ঘাম ও মাথার সরিষা তেলের মিশ্রণে কালো এবং স্যাঁতসেঁতে হয়ে গেছে।’ ভবঘুরে মানুষ কফিল আহমেদ। কথা কম বলেন। একান্ত প্রয়োজন ছাড়া কথা বলবেন-ই না। এখনও কিছু বললেন না। চোখ দুটো সরু করে ভারি ল্যান্সের চশমার উপর দিয়ে গভীরভাবে তাকালেন জামান মাহমুদের দিকে। চশমার দুটো কাচ আর দুটো চোখের তারা একসাথে একই দিকে যখন নিবদ্ধ হলো, মনে হচ্ছিল চারচোখে তাকাচ্ছেন কফিল আহমেদ।
ছগির স্যার একধরনের অপমান বোধ করলেন। চটজলদি বলে উঠলেন- ‘আপনি ভুল দেখেছেন স্যার। আপনি জানেন-তো আমার নাকে সাইনেসাইটিস প্রব্লেম আছে। সবসময় নাক দিয়ে পানি পড়ে। যেদুটি তোলার দলা দেখেছেন তা নাকে ঢুকিয়ে ঘুমাতে যাই। কেননা নাকের পানি মুখে ঢুকে….’ কথা পূর্ণ করলেন না তিনি। তাঁর হঠাৎ মনে হলো কী বলতে গিয়ে কী বলে ফেলছেন। কথার গোলমাল বাঁধিয়ে নিজেকে হাস্যকর বানাচ্ছেন।
উপস্থিত শ্রোতামন্ডলি হাসি চেপে রেখেছেন জোর করে। একজন হাসি চেপে রেখে কথা বলতে চাইলে খুক খুক করে কেশে হাসিকে কাশিতে রূপ দিলেন। তারপর বললেন- ‘তাহলে ঘুমাবার পর আপনি কি মুখ দিয়ে শ্বাস-প্রশ্বাস ছাড়েন?’ ছগীর স্যার রাগতস্বরে বললেন- ‘তাহলে কি মাছের মতো কান দিয়ে শ্বাস-প্রশ্বাস ছাড়বো?’ একথা শুনে সমস্বরে সবাই হেসে উঠলেন। হাসির শব্দ একটু স্থিমিত হলে কফিল আহমেদ কথা বলবেন বলে ভেতরে ভেতরে প্রস্তুতি নিচ্ছেন। কেননা তাঁর সম্পর্কে হাসি-কৌতুকমূলক যে রটনা জামান মাহমুদ রটিয়ে যাচ্ছেন এর প্রতিবাদ না করলে সম্পুর্ন বিষয়টি তিনি স্বীকার করছেন বলে সবাই ভাববে। তাই একটু পর একটু গলা খাঁকে বুকে তেজ এনে বললেন- দেখুন জামান মাহমুদ স্যার, আমার ব্যাপারে আপনি যা বললেন তা সম্পুর্ন মিথ্যে।
আপনার নিজের কথাটি আগে বলা উচিত ছিল। বারমাস আপনার পেটে অসুখ থাকে। এন্টিবায়োটিকেও কাজ হচ্ছে না। মাসে অন্তত দুবার পেটের অসুখ সিরিয়াস হয়ে যায়। তখন প্যান্ট নষ্ট করে ফেলেন। এইতো দুদিন আগেও এমনটা হয়েছে। বার মাস সারারাত আপনার পেটে কালবৈশাখীর ঝড় চলে। আপনার পেটের গুড়ুম গুড়ুম শব্দ বাইরে বেরোয় এটম বোমার শব্দে। সারারাত যে এটম বোমার শব্দে পেটের বায়ু বের করেন তা কিন্তু শুনতে শুনতে আমরা অভ্যস্ত হয়ে গেছি। কী বলেন ছগীর স্যার?
এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে ছগীর স্যারের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেন কফিল আহমেদ। জামাল মাহমুদকে বেশ জব্দ করা হয়েছে দেখে ছগীর স্যার একটু স্বস্তি অনুভব করে সাথে সাথে বললেন- তা-তো অবশ্যই। উনার পেটের বায়ু নির্গমনের শব্দ এখন আমাদের কান সয়া হয়ে গেছে। উনি উল্টো আমাদের খুঁত বের করছেন।’ জামান মাহমুদ বেশ চুপসে গেলেন। এ মূহুর্তে তিনি আর কথা বাড়ানোকে বুদ্ধিমানের কাজ মনে করলেন না। আস্তে আস্তে বসা থেকে উঠতে উঠতে বললেন- ‘যত দোষ নন্দ ঘোষ। আমার বায়ু কাহিনী অনেক পুরনো। নতুন করে বলার কী আছে।