পেন ও ইনক প্রাণী দুটি এখনো শিশু। দেখতে অন্যান্য বড়দের মতো মোটাসোটা দেখালেও বয়স কম হওয়ায় অভিজ্ঞতা শূন্যের কোটায়। জন্মভূমি সাইকোইস্ট গ্রহের সিকিভাগ পথও তারা চিনে না। তাদের গৃহশিক্ষক প্রাথমিক শিক্ষা হিসেবে গ্রহটির পথ, মানচিত্র, সীমানা এসবই শেখাচ্ছিলেন। কিন্তু পেন ও ইনক বেশ চঞ্চল। মাঝেমধ্যে কাউকে কিছু না বলে একা একা বাইরে ঘুরতে বেরিয়ে পড়ে। এতে পথ হারিয়ে সাইকোইস্ট গ্রহের সীমানা রেখার বাইরে চলে যায় মাঝেমাঝে। সীমান্ত প্রহরীরা কয়েকবার তাদেরকে আটক করে বাসায় ফিরিয়ে দিয়েছে। শিশু না হলে এখন কারাগারে দিন কাটাতে হতো পেন এবং ইনককে। আর একবার কারাগারে গেলে কখনো বের হওয়ার নিয়ম নেই সে গ্রহে।
একদিন ঘটলো ভয়ানক এক দুর্ঘটনা। সাইকোইস্ট গ্রহে শুরু হলো উলকা ঝড়। এধরণের প্রচন্ড উলকা ঝড়ের সাথে প্রাণীদুটি পরিচিত ছিল না। উলকা ঝড়ে দুর্যোগ সেভ কেন্দ্রে আশ্রয় নেয়া প্রাণীগুলো ছাড়া সবাই ধ্বংস হয়ে গেল। সেদিন পেন ও ইনক ঘুরতে ঘুরতে সীমান্তের কাছাকাছি এসে পড়েছিল। ঠিক তখন শুরু হয় উলকা ঝড়। সীমান্ত রক্ষীরা প্রাণ বাঁচাতে দুর্যোগ সেভ কেন্দ্রে ছুটতে থাকে। ফাঁকা সীমান্তে কিছু বুঝার আগেই পেন ও ইনক সীমানা রেখা পেরিয়ে অন্য গ্রহে ঢুকে যায়। উলকা ঝড় বা দুর্যোগ সেভ কেন্দ্র সম্পর্কে তাদের কোন ধারণাই ছিল না। ঝড়ের সময় তারা যদি সীমান্তের কাছাকাছি না থাকতো তাহলে নিশ্চিতভাবে ধ্বংস হয়ে যেতো।
পাশের গ্রহে তখন উলকা ঝড় ছিল না। পেন ও ইনক পাশের গ্রহের ভিতরে সীমানা ধরে চলতে সুবিধা পাচ্ছিল। তারা সাচ্ছন্দ্যে গা এলিয়ে চললো। সে কক্ষপথে যাচ্ছিল একটি পরিব্রাজক সসার। পেন ও ইনককে দেখে পরিব্রাজক সসারটি থামলো। সাইকোইস্ট গ্রহের প্রাণী দুটিকে চিনতে পেরে সসারের যাত্রীরা আনন্দে ফেটে পড়লো। তারা পেন ও ইনককে ঝটপট সসারে তুলে নিল। শত্রু গ্রহের এ প্রাণী দুটিকে কী কাজে ব্যবহার করা যায় তা নিয়ে পরিব্রাজকযাত্রীরা ঝগড়ায় লিপ্ত হল। ডাকাত প্রকৃতির কয়েকজন বললো- আমরা এ দুই প্রাণীকে জিম্মি করে সাইকোইস্ট গ্রহের একটা বিরাট অংশ পণ হিসেবে করায়ত্ত করবো। পদার্থ বিজ্ঞানী দুজন জোর দাবী জানালেন- তারা প্রাণী দুটিকে গিনিপিগ বানাবে।
ভিনগ্রহ নিয়ে গবেষণাকারী কয়েকজন বললো- এ দুই প্রাণীকে আমরা শুভ্রগ্রহে পাঠাবো। শুভগ্রহ সম্পর্কে আমাদের ধারণা নেই বললেই চলে। এদের কাজে লাগিয়ে শুভ্র সম্পর্কে ধারণা পেলে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় একটা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে পারবো। আমরা ধর্মগ্রন্থে জেনেছি, শুভ্রের প্রাণীরা নাকি খুবই বুদ্ধিমান। যেমন তাদের প্রখর বুদ্ধিবিবেচনা ঠিক তেমনি কর্মদক্ষতা। যেমন তারা ভদ্র-ন¤্র ও কমল তেমনি জঘন্য, হিং¯্র ও কঠোর। তাই এরা আমাদের জন্য বিপজ্জনক। ফ্লাই সসারের যাত্রীরা গ্রহগবেষকের যুক্তিগুলো মেনে নিলো। সবাই একমত হয়ে পেন ও ইনককে শুভ্রতে পাঠানোর পরিকল্পনা করতে লাগলো। শুভ্র গ্রহ হচ্ছে পৃথিবী। পৃথিবীকে তারা শুভ্র গ্রহ হিসেবে চিনে। পেন ও ইনককে নিয়ে বিশেষ শক্তিসম্পন্ন একটি ফ্লাইং সসার ছুটে চলছে পৃথিবীর দিকে। এর কোনো চালক নেই। স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলছে এটি। একজন দক্ষ জলজ্যান্ত চালকের যে বুদ্ধিমত্তা ও অনুভূতি, অভিজ্ঞতা যা থাকতে পারে এর সবই আছে স্বয়ংক্রিয় সসারটির।
আটারশত বছর সময় ধরে সৌর জগতের বিভিন্ন গ্রহ উপগ্রহ এবং নানাধরণের কক্ষপথ অতিক্রম করে পৃথিবীর কক্ষপথে ঢুকলো ফ্লাইং সসারটি। ১৭৮৫ সালের ২৪ মার্চ পৃথিবীর একটি উঁচু পর্বতে সেটি অবতরণ করলো। স্বয়ংক্রিয়ভাবে খুললো ফ্লাইং সসারের দরজা। পেন ও ইনক আনন্দে লাফাতে লাফাতে বাইরে এলো। এতো দিনে তারা অনেকটা পরিপক্ব হয়ে উঠেছে। সম্পূর্ণ নতুন জায়গা ও পরিবেশ দেখে তারা বেশ উল্লসিত। তাদের মাথার চারদিকে অত্যন্ত শক্তিশালী ক্যামেরার ল্যান্স বসানো রয়েছে। আর শরীরের বিশেষ স্থানে আছে পরমাণু বিস্ফোরক। যে গ্রহ থেকে তাদের পাঠানো হয়েছে সেই গ্রহবিজ্ঞানীরা পেন ও ইনকের গতিবিধি এবং পৃথিবী নামক গ্রহের রহস্য পর্যবেক্ষণ করে বিশেষ বিশেষ তথ্য সংরক্ষণ করছে। পৃথিবী গ্রহে পেন ও ইনকের ওজন আশিগুণ বেড়ে গেছে। উড়াল দেয়াতো দূরের কথা শরীর নিয়ে হাঁটতেও ভীষণ কষ্ট হচ্ছে তাদের। সীসার মতো ঘনত্ব ও পুরো তাদের শরীর কাঠামো। এই ওজন বেড়ে যাওয়া সংক্রান্ত বিষয়টি ধরা পড়ে পর্যবেক্ষণকারী বিজ্ঞানীদের যন্ত্রে। তারা ওজন কমানোর উপায় বের করতে আলোচনায় বসে গেলো।
কিছুক্ষণের মধ্যে সাইকোইস্ট গ্রহের প্রাণী দুটির ওজন স্বাভাবিক হয়ে গেলো। পেন ও ইনক এখন ইচ্ছেমতো চলাফেরা করতে পারছে। এমনকি তারা উড়াল দেয়ারও সক্ষমতা পেয়ে গেছে। মাত্র আট ঘন্টায় উড়াল দিয়ে দিয়ে পৃথিবীর সব উঁচু পর্বতে একবার ঘুরে ফের অবতরণ করা পর্বতে ফিরে এলো। সমস্ত পৃথিবী তাদের কাছে সাইকোইস্ট গ্রহের একটি ছোট খেলার মাঠ মনে হলো। এতো কম পরিসীমার গ্রহে এতো উন্নত প্রজাতির প্রাণী মানুষ বাস করে দেখে পেন ও ইনকের চেয়ে বিজ্ঞানী দল বেশি আশ্চর্য হলো।
পেন ও ইনক তাজিংডং এভারেস্টে একটু বিশ্রাম নিয়ে সিদ্ধান্ত নিলো এবার সমতলের দিকে তারা যাবে। তাদের ফ্লাইয়ের একটি সমস্যা হলো একবার উড়াল দিলে যেখানে থামার ইচ্ছা সেখানে হঠাৎ থামতে পারে না। ফ্লাইং বন্ধের পর অন্তত ১৫ সেকেন্ড আগে চলার গতি স্থির হয় না। এই ১৫ সেকেন্ড তাদেরকে অনিচ্ছায় চলতে হয়। এতে প্রায় হাজার কিলোমিটার পথ তারা সামনে চলে যায়। তাই পেন ও ইনক পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নিলো আর উড়বে না। বরং তারা হেটে হেটেই পথ চলবে। এতে তারা স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে লাগলো। তারা যেকোনো প্রাণীর আকৃতি ধারণ করতে পারে। তাই যখন যেখানে ইচ্ছা বিচরণ করা তাদের জন্য বেশ সহজসাধ্য হয়ে গেলো। আকৃতি পরিবর্তনের কারণে কেউ তাদের সন্দেহও করতে পারলো না। পেন ও ইনক এভাবে বেশ সতর্কতার সাথে মানুষ জাতির সাথে মিলেমিশে চলাফেরা করতে থাকলো। একসময় দুজন চলে এলো আরাকান সা¤্রাজ্যে। এই সা¤্রাজ্যের মানুষদের কিছু আচরণের রহস্য মানুষদের প্রতি তাদের আগ্রহকে বেশ বাড়িয়ে তুলে।
১৭৮৫ সাল থেকে টানা ৫৩ বছর আরাকান সা¤্রাজ্যে বেশ কৌতুহল নিয়ে কাটালো পেন ও ইনক। তাদের কাছে রপ্ত হয়ে গেল পৃথিবীর নিয়মকানুনের অনেক কিছু। তারা এটাও বুঝে গেল এই দীর্ঘ সময় এখানে রাজা ছিলেন মুসলিম জাতি থেকেই। ১৩ জন রাজার দেখা তারা পেল। এই সময়টুকুতে তারা পৃথিবীর মানুষদের নিয়মনীতি দেখে বেশ মুগ্ধ হলো। কিন্তু এ সময়ের পরবর্তীতে পেন ও ইনক খুবই হতাশ হলো। মানুষ হয়ে মানুষকে নৃশংসভাবে হত্যা করাকে তারা ভাবতেই পারেনি। এতো রক্তপাত ও সহিংসতা দেখে তারা হতবাক হলো। এবার পেন ও ইনক সহজেই বুঝে গেল শুভ্রগ্রহে যেমন সেরা বুদ্ধিমান প্রাণী মানুষ আছে তেমনি তাদের ভেতর একটা সংক্রামক রোগ আছে। এই রোগ যাকে আক্রমণ করে সে বন্য হিং¯্ররে মতো হয়ে যায়। পেন ও ইনক পৃথিবী নামক শুভ্র গ্রহকে আর নিরাপদ ভাবতে পারলো না।