নানু ভাইয়ের স্মৃতিকথা

নানু ভাইয়ের স্মৃতিকথা

শীতের সকাল। টিনের চালের উপর জমে থাকা শিশির গুলো টুপটাপ করে পড়েছে। আমি তা মুগ্ধ নয়নে দেখছি। আমি, বাবা, মা,মাহমুদা, রাফি ও রাইসা সহ আজ ভোরেই নানুর বাসায় পৌঁছেছি। নানুমণি তো আমাদেরকে দেখা মাত্রই উনুনে একটা মাটির হাড়ি বসিয়ে দিয়েছে। সেই হাড়ি দিয়ে ভাপা পিঠা তৈরি হবে। নানু বাড়িতে আসা মানেই প্রত্যেক টা মূহুর্ত আনন্দ উপভোগ করা।

বিশেষ করে নানু ভাইয়ের গল্প। আজও তার ব্যতিক্রম নয়। নানুভাই ভীষণ মজার মানুষ। আমরা নানু ভাইয়ের ঘরের দিকে এগিয়ে আসলাম। নানুভাই আমাদের দেখে হাসি মুখে সালাম দিল ভিতরে আসতে বলল। তারপর আমরা সবাই নানু ভাইয়ের বিছানায় গোল হয়ে বসে পড়লাম। এখন শুরু হবে নানু ভাইয়ের মজার গল্প। আজ নানুভাই তার দেখা মুক্তিযুদ্ধের গল্প বলবে। তাই আমরা অধীর আগ্রহে বসে আছি। এরপর নানুভাই বলতে শুরু করলো, ১৯৭১ সাল। তখন আমার বয়স দশ ছুঁই ছুঁই। কোনো এক গভীর রজনীতে আমি বিছানায় শুয়ে ঘুমোতে চেষ্টা করেছিলাম আর মাইশা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। কিন্তু মা বাবার চোখে এতটুকু ঘুম নেই। মা খাটের এক কোনায় বসে কিছু একটা ভাবছে আর বাবা এপাশ থেকে ওপাশ পায়চারী করেই চলেছে।

হয়তো কোনো এক অজানা বিপদের আশংকায় বাবা মা কেউই ঘুমোতে পারছে না। কিছুক্ষণ পর একটা বিকট শব্দে আমরা আঁতকে উঠলাম। আমি ভয়ে মায়ের বুকে মুখ লুকালাম। আর বাবা দৌড়ে বাড়ির বাইরে চলে গেলেন।
পরদিন খুব ভোরেই মা আমাকে আর বোনকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তুললেন। মা আমার হাতে একটা টিফিন ক্যারিয়ার ধরিয়ে দিলেন এবং তিনি মাইশাকে কোলে নিয়ে হাতে একটা ব্যাগ নিলেন। আর বাবা আমাদের খুব প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে নিলেন। এরপর আমারা অজানার উদ্দেশ্যে পাড়ি জমালাম। আমরা হাঁটছি তো হাঁটছিই রাস্তা আর শেষ হচ্ছে না। আমাদের মতো অনেক মানুষ হেটে চলছে। একসময় আমরা খুব ক্লান্ত হয়ে গেলাম তাই বাবা খুঁজে খুঁজে একটা ঝোপের সন্ধান পেলেন। আমাদেরকে সেই ঝোপে বিশ্রাম নিতে বলে বাবা কোথাও চলে গেলেন। এখন আমি মা আর মাইশা সেই ঝোপের মধ্যে।

কিছুক্ষণ পর একটা গাড়ির শব্দ পেয়ে মা আমাকে ও মাইশাকে নিয়ে ঝোপের আড ালে লুকিয়ে পড়লেন। এরমধ্যেই একটা বিকট শব্দ হলো। সাথে সাথে মা আমাকে নিজের সাথে আঁকড়ে ধরলো আর মাইশা ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কেঁদে উঠলো। আমি মায়ের আঁচল থেকে মুখ বের করে ঝোপের মধ্যে দিয়ে বাইরে উঁকি দিতেই দেখতে পেলাম একটা লোক বুকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় ধপ করে মাটিতে পড়ে গেল। এদিকে মা মাইশার কান্না থামানোর প্রাণপণ চেষ্টা করে চলেছেন। কিন্তু মাইশা বুঝি পণ করেছে আজ কোনোভাবেই কান্না থামাবে না। তাই মা শেষে বাধ্য হয়েই মাইশার মুখে ফিডার ঢুকিয়ে দিলেন। আর মাইশাও কান্না থামিয়ে চুপচাপ খেতে লাগলো। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীরা তাদের আশেপাশে মানুষের উপস্থিতি আন্দাজ করতে পেরেছিল হয়তো। তাই হুংকার ছেড়ে গর্জে উঠলো, আগার আছপাছ কোযা হে তো ভাপা সা যাও। নেহিন তো গুলি মার দোংগা! আমি লোকগুলোর কোনো কথাই বুঝতে পারলাম না। কিন্তু মা হয়তো বুঝতে পেরেছেন তাই খুব শক্ত করে আমাকে আর মাইশাকে জড়িয়ে ধরে রেখেছেন।

কিছুক্ষণ পর লোকগুলো আবারও কি সব বলে শূন্যে কয়েকটি গুলি ছুঁড়ে সেখান থেকে প্রস্থান করল। এরপর মা তাদের অনুপস্থিতি টের পেয়ে আমাদের বাইরে নিয়ে এলেন। কিছুক্ষণের মধ্যে বাবাও চলে আসলেন। আমরা আবারও হাঁটা শুরু করলাম। অবশেষে আমরা একটা নদীর তীরে পৌঁছলাম। সেই নদীতে হাঁটুজল তাই সব মানুষ অনায়াসেই পার হতে পারছে। সেই নদী পার হলেই আমরা ইন্ডিয়ায় পৌঁছে যাব। মা একা আমাদের নিয়ে ইন্ডিয়ায় যাবেন।

আমি বাবাকে আসতে বললে বাবা জানালেন তাকে দেশের জন্যে যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করতে হবে। শুধু বাবাই নয় দেশের শত শত মানুষ দেশকে স্বাধীন করার জন্য লড়ে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে হানাদার বাহিনীরা এদেশের অনেক মানুষকে হত্যা করেছে। তাই বাবাও দেশের জন্য আমাদের পাঠিয়ে দিয়ে নিজে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিবেন। অবশেষে বাবা আমাদেরকে খুব করে আদর করে বিদায় জানালেন। আমরা তখন ইন্ডিয়ায়। এখানে আমাদের মতো অনেক মানুষ। কিন্তু বাবার সাথে আমাদের কোনো যোগাযোগ নেই। জানি না বাবা আদৌ কোথায় আছেন। মা জায়নামাজে আল্লাহর কাছে অনেক কান্নাকাটি করেন। আমিও মায়ের সাথে সালাত আদায় করি। এভাবেই চলছিল আমাদের দিনাতিপাত।

হঠাৎ একদিন বাইরের খুব শোরগোল শুনতে পেয়ে আমরা ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে আসলাম। আশেপাশে তাকাতেই বুঝলাম মানুষগুলোর মাঝে আনন্দ ঠিকরে পড়ছে। হঠাৎ মা আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলেন। সামনে তাকিয়ে দেখি বাবা। বাবার চোখে মুখে বিজয়ের হাসি। বাবা আমাদের জড়িয়ে ধরে বললেন, অবশেষে আমরা বিজয় অর্জন করতে পেরেছি। মা সাথে সাথে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলেন। আর আমি বাবার কপালে একটা চুমু এঁকে দিলাম। এরপর আমরা স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে এলাম। এসে দেখলাম আমাদের ঘর বাড়ি সব কিছু পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। কারণ মিলেটারিরা আমাদের ঘর বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু ঘর বাড়ি নেই তো কি হয়েছে? আমরা তো একটা স্বাধীন দেশ পেয়েছি। যেখানে মুক্ত বিহঙ্গের মতো ডানা মেলে উড়ে বেড়াতে পারবো।

এই পর্যন্ত বলে নানুভাই থেমে গেলেন। আর আমরা এতক্ষণ ধরে মুগ্ধ হয়ে নানাভাইয়ের গল্প শুনছিলাম। কতটা সুন্দর আর মার্জিত হলে মানুষ এভাবে কথা বলতে পারে তা নানুভাই কে না দেখলে বোঝা যাবে না। এরমধ্যেই নানুমণি ধোঁয়া উঠা গরম গরম ভাপা পিঠা নিয়ে হাজির হলেন। সেই পিঠার গন্ধ মূহুর্তেই পুরো ঘরে ছড়িয়ে পড়লো। নানুমণি আমাদের সামনে পিঠা নিয়ে আসতে আসতে বললেন, কি রে তোরা সবাই আসতে আসতেই আমার বুড়োটাকে দখল করে নিয়েছিস? নানুমণির এহেন কথায় আমার সবাই হো হো করে হেসে উঠলাম।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত