বারবার এলার্ম কেটে দিয়ে উপুড় হয়ে ঘুমাচ্ছে যাকী। আর এলার্মটা একটু পর পর বেজেই চলেছে, উফ্। যাকী এবার বিরক্ত হয়ে, মাথার নিচ থেকে বালিশটা তুলে কানের উপর চেপে ধরল। আপু বাড়িতে থাকলে এই একটাই চৎড়নষবস. সারাদিন নামাজ পড়ার জন্য ঘ্যান ঘ্যান করে। আর কখন যেন মোবাইলে ফজরের নামাজের জন্য এলার্মটাও দিয়ে রাখে। উফ ্ উরংপঁংঃরহম. একটু পর আবারও ফোনটা বেজে উঠল। নাহ এবার আর যাকীর সহ্য হচ্ছেনা। নির্ঘাত এবার ফোনটাকে আছাড় মারবে। যেই ফোনটা হাতে নিল, অমনি ঘরের লাইটটা অন হয়ে গেল। ঘুম ঘুম অবস্থায় যাকী কোনোরকম একচোখ খুলে তাকালো। একি আপু তুমি এত রাতে?
নামিরাহ খুব শান্ত কন্ঠে বলল, এখন রাত নয় ভাই। ফজরের সময় হয়েছে, উঠে সালাত আদায় কর। যাকী খুব বিরক্ত হয়ে বলল, তোমাকে কতবার বলেছি আপু এভাবে আমার ঘুমের ডিস্টার্ব করবে না। তুমি জান! সকালে উঠেই আমার টিউটোরিয়াল এক্সাম আছে? নামিরাহ ভাইয়ের কাছে এসে স্নেহমাখা কন্ঠে বলল, আমি জানি তোর এক্সাম আছে। কিন্তু সবার আগে তোকে সালাত আদায় করতে হবে। সালাত আদায় করা ফরজ ভাই। যাকী জোরে চেচিয়ে উঠলো, প্লিজ আপু এখান থেকে যাও তো। এই ভোর বেলা কানের কাছে এসে ঘ্যান ঘ্যান একদম ভাল্লাগছে না। আমাকে একটু শান্তি মতো ঘুমোতে দাও তো। আর লাস্ট বারের মতো বলে দিচ্ছি আমার ফোনে এলার্ম দিবা না নাহলে কিন্তু ইনাম ভাইয়া কে ফোন করে বলবো তোমাকে যেন তাড়াতাড়ি নিয়ে যায়। নামিরাহ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, সালাত আদায় করবি না বলে আমাকে তাড়িয়ে দিতে চাইছিস! সকাল বেলা যাকী খুব তাড়াহুড়া করে কলেজে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে। নামিরাহ ভাইয়ের রুমে গিয়েও দরজার বাইরে থমকে দাঁড়ায়।
যাকী বোনের উপস্থিতি টের পেয়ে বলল, ভিতরে আসতে পার আপু। আর কিছু বলার থাকলে তাড়াতাড়ি বলো। এমনিতেও তুমি আজ আমার অনেক দেরি করে দিয়েছ। নামিরাহ অপরাধীসুরে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, আমি তোর কিভাবে দেরী করিয়ে দিলাম? যাকী নিজের ডান হাতে ঘড়িটা পরতে পরতে তাচ্ছিল্যের সহিত বোনকে বলতে লাগলো, ভোরবেলা নামাযের জন্য ডেকে ঘুমটা নষ্ট করে দিলে যার জন্য আমি সময় মতো জাগতে পারলাম না। আর এখন বুঝতেই পারছনা কী করেছ? তুমি জান প্রথম ক্লাস প্রিন্সিপাল স্যারের। উনি যে কড়া একটু দেরি করে ক্লাসে ঢুকলে আমাকে আধা ঘন্টা কান ধরিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখবে! নামিরাহ ভাইয়ের এহেন কথায় অবাক হয়ে গেল, ভাই আমি তোকে সালাত আদায় করতে ডেকেছিলাম। আমি চাইনা তুই দুনিয়ার সামান্য একটু আরাম আয়েশের জন্য জাহান্নামে যা।
যাকী দুহাত ঝাকিয়ে বলল, চষবধংব ংঃড়ঢ় আপু। এখন এত বড় লেকচার শোনার সময় আমার নেই। তাই তোমাকে বলছি আমার জাহান্নামে যাওয়া নিয়ে তোমার চিন্তা করতে হবে না। এখন আমি নামাজ না পড়লে কী হয়েছে বুড়ো বয়সে ঠিক নামাজ সহ সব ইবাদাত করবো। আর তখনতো আল্লাহ আমাকে জান্নাত দিবেই। কথাগুলো একটানা বলে ব্যাগটা কাধে নিয়ে কলেজের দিকে রওনা হলো যাকী। এদিকে নামিরাহ ভাইয়ের কথায় নিস্তব্ধ হয়ে গেছে। এসব কী বলে গেল যাকী!! আমি কী হেরে গেলাম ওকে বোঝাতে? বিকেল বেলা যাকী কলেজ থেকে এসে একটু ক্রিকেট খেলে। তারপর সন্ধা পর্যন্ত বিভিন্ন উপন্যাসের বই পড়ে। আজও তার কোনো ব্যাতিক্রম ঘটল না। ড্রইংরুমে সোফার উপর চিৎপটাং হয়ে শুয়ে বুকের উপর বইটা নিয়ে মনোযোগ দিয়ে হুমায়ুন আহমেদ এর একটা উপন্যাস পড়ছিল।
নামিরাহ কিছুক্ষণ ভাইয়ের গতিবিধি লক্ষ করে রুমে প্রবেশ করল। যাকী চোখ থেকে চশমাটা নাকের উপর টেনে বোনের দিকে একনজরে তাকিয়ে আবারও পড়ায় মনযোগ দিল। নামিরাহ একটু কেশে নিয়ে বলতে লাগল, জানিস ভাই, আমাদের পাশের বাড়ির সাফওয়ান ভাইয়ের নাকি এবার বিসিএস হয়ে গেলো। যাকী পড়ার মাঝেই বলল, হুম,,, তোমার আগেই শুনেছি। অবশ্য আমি এসব বিষয়ে আপডেট সংবাদ রাখি। নামিরাহ কিছুটা হতাশ কন্ঠে বলল, কিন্তু আমার কী মনে হয় জানিস, উনি এখন বিসিএস করে জীবনের সবচেয়ে বড় ভুলটা করলেন।নামিরাহ এর এমন কথায় যাকী চট করে উঠে বসল। বইয়ের ভিতর একটা আঙুল রেখে বইটা বন্ধ করে বলতে লাগলো, এসব কী বলছো আপু?
নামিরাহ ভাইয়ের পাশে এসে বসল, আতঃপর দৃঢ়কন্ঠে বলতে লাগলো, হ্যাঁ ভাই তার আগে একটা কথা বল, পড়াশোনা করতে কী কোনো কষ্ট হয় না? যাকী চোখ দুটো বড় বড় করে আপুকে বলতে লাগলো, কি যে বলনা আপু পড়াশোনা করতে আবার কষ্ট হয় না? এই যে সকালে উঠেই ক্লাসে যেতে হয়। সারা দিন ক্লাস, প্রাইভেট পড়তে হয়। সিলেবাস কাভার করতে হয়। পরীক্ষা দিয়ে ভালো রেজাল্ট করতে হয়। এক কথায় প্রচুর পরিশ্রম করতে হয়। নামিরাহ ভাইকে থামিয়ে দিয়ে বলতে লাগলো, ঠিক তাই, এজন্যই তো আমি বলছিলাম, সাফওয়ান ভাই ছোটবেলা থেকেই এতো কষ্ট করে পড়াশোনা শেষ করলো। কোথায় উনি একটু ঘুরে বেড়াবে, বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে আনন্দ করবে তা নয়, উনি রাতদিন খেটে পড়াশোনা করে বিসিএস ক্যাডার হলো। বিসিএসটা তো কয়েক বছর পরও করা যেতো।
যাকী এবার খুব জোরে চেচিয়ে উঠলো, ঢ়ষবধংব ংঃড়ঢ় আপু। তুমি তো পুরো পাগল হয়ে গেছ! তোমার থেকে না একটা ছোট্ট বাচ্চার মাথায় বেশি বুদ্ধি আছে। তুমি জান ভাইয়ার বয়স কত? ২৭ বছর! নামিরাহ অবুঝের মতো বলল, তো কি হয়েছে? এটা আর এমন কি বয়স? আমি তো বলিনি যে ওনার জীবনে বিসিএস করার দরকার নেই। শুধু বলেছি ছোট বেলা থেকে তো পড়াশোনার চাপে বোর হয়ে গিয়েছিল সেজন্য কয়েক বছর লাইফটাকে ইনজয় করতো। কিন্তু এখন যেহেতু বিসিএস করেই ফেলেছে সেহেতু চাকরি করতে হবে। তাই আমি সবকিছু চিন্তা করেই বলেছিলাম।
যাকী রেগে গিয়ে বলে উঠল, উফ্ আপু! তুমি কি মনে কর ২৭ বছর খুব কম বয়স? এখন যদি ভাইয়া বিসিএসের জন্য পড়াশোনা না করে লাইফটা ইনজয় করার ধান্দায় পড়ে যায়। আর কয়েক বছর পর তো ভাইয়া অনেক পড়াশোনাই ভুলে যাবে। আর তখন পরীক্ষা দিয়ে চান্স পেতে পেতে তো কয়েক বছর চলে যাবে। আর তখন ভাইয়ার বয়সও বেড়ে যাবে। শেষে দেখা যাবে ভাইয়ার সরকারি চাকরি হচ্ছে না। কারণ তখন সরকারি চাকরির বয়স শেষ হয়ে যাবে।
নামিরাহ একটু জোরেই বলে উঠলো, বীধপঃষু ভাই!
আমি তোকে এটাই বোঝানোর চেষ্টা করেছিলাম যে, একটা দেশে চাকরি করতে গেলে যখন নিদিষ্ট বয়স সীমা থাকে। আর সেই নিদিষ্ট বয়সসীমা পার হলে কখনোই সরকারি চাকরি পাওয়া যাবে না। তাহলে তুই কিভাবে ভাবতে পারলি যে আল্লাহু সুবহানাহু ওয়াতাআ’লার কাছে বৃদ্ধ বয়সের ইবাদতটা কবুল হবে অথচ আল্লাহু সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা যৌবনের সময়ের হিসেবটাই আগে নিবেন। তাহলে ভাব সামান্য একটু বয়সের জন্য যদি এই দেশে চাকরি পাওয়া না যায় তাহলে যুবক বয়সটা হেলায় নষ্ট করে বৃদ্ধ বয়সে ইবাদত করলে সেটা কিভাবে আল্লাহর কাছে গৃহীত হবে? একটা মানুষ তার যৌবনে যতটা গভীরভাবে ইবাদাত করতে পারবে বৃদ্ধ বয়সে ততটা পারবে না। তাহলে একটা সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ কিভাবে তার ইবাদতের জন্য বৃদ্ধ বয়সটা বেছে নিবে??
নামিরাহ খেয়াল করলো যাকীর মুখটা খুব চিন্তিত দেখাচ্ছে। তার চঞ্চল ভাইটা মূহুর্তেই চুপসে গেল। সে দু’হাতে নিজের মাথার সামনের চুলগুলো মুষ্টি করে ধরে রেখেছে। তখনই নামিরাহর ফোনটা বেজে উঠল। তাই সে দ্রুত ফোন রিসিভ করতে চলে গেল। কিছুক্ষণ পর, মাগরিবের আজান হচ্ছে। নামিরাহ যাকীর কাছে আসার জন্য রুম থেকে বের হতেই দেখলো, যাকী একটা সাদা টুপি পরে মসজিদের উদ্দেশ্যে রওনা করল। নামিরাহ ভাইয়ের এই আচরণে খুব খুশি হয়ে গেল। আল্লাহর কাছে অনেক শুকরিয়া আদায় করল।
রাতে, যাকী নামিরাহর রুমের সামনে এসে বলল, আপু ভিতরে আসব? নামিরাহ ভাইকে ভিতরে আসতে বলল। যাকী খুব নরম সুরে বোনকে বলতে লাগলো, আপু আমি কি তোমার থেকে একটা তাফসিরুল কুরআন নিতে পারি? নামিরাহর আনন্দ যেন চোখ মুখ ঠিকরে পড়ছে। সে নিজের আবেগকে দমিয়ে বলল, শুধু একটা কেন? আমার টেবিলের সমস্ত বই তাফসির সবগুলোই তোর। যখন যেটা পড়তে মন চাইবে সাথে সাথেই নিয়ে যাবি। যাকী বোনের থেকে একটা তাফসিরুল কুরআন নিয়ে মুচকি হাসি দিয়ে চলে গেল। নামিরাহ পরম তৃপ্তির সহিত ভাইয়ের যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলো।