অফিসের কাজে অনেক বেশিই ডুবে ছিলাম হঠাৎই একজন বার্তাবাহক এসে খবর দিলেন যে একজন মহিলা এসেছেন আমার সাথে দেখা করতে, নিচে অপেক্ষা করছে। আমার সাথে সচরাচর তেমন কেউ অফিসে আসে না দেখা করতে, তাই কিছুটা অবাক হয়েই বললাম, উনাকে বসতে বলো আমি আসছি।
কিন্তু কাজের চাপ এতটাই ছিল যে আমি দেখা করতে যাওয়ার কথা প্রায় ভুলেই গেলাম। প্রায় ২ ঘন্টা পর হঠাৎ আমার খেয়াল হল কেউ একজন অপেক্ষা করছে। নিজেকে অনেক বেশি অপরাধী মনে হতে লাগল। দ্রুত নিচে গেলাম। ওয়েটিং রুমে ঢুকতেই দেখলাম, কাচুমাচু হয়ে একটি মেয়ে এক কোণায় মাথা নিচু করে বসে ঝিমাচ্ছে। বোঝাই যাচ্ছে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে করতেই মেয়েটা ঘুমিয়ে পড়েছে। তবে মেয়েটাকে চিনি বলে মনে হচ্ছে না। কিছু না ভেবেই কাছে গিয়ে সালাম দিতেই, মেয়েটা লাফিয়ে উঠে চোখ কচলাতে লাগলো। আমাকে দেখে এতটাই অপ্রস্তুত হয়ে গেল যে হাতের ব্যাগটা নিচে পরে গেল। মেয়েটা স্বাভাবিক এর চেয়েও অনেক বেশি সুন্দর, মায়াবী। চোখ মুখে বিষন্নতা। মৃদু হেসে আমার দিকে এগিয়ে এসে বললো,
– আপনি কি তানহা ম্যাডাম ? আমি তাকে বসার জন্য ইশারা করলাম। মুখোমুখি বসতে বসতে বললাম,
-জ্বি মেয়েটা কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে আমার দিকে ঝুকে এসে বললো,
– একটু পানি খাওয়াবেন প্লিজ। আমি পানি দিলাম। মেয়েটা অপলকভাবে আমাকে দেখছে। আমি নিরবতা ভেঙে বললাম,
– আমি কি আপনাকে চিনি?
– না।
– তাহলে আপনি আমার খোজে কেনো এসেছেন?
– কিছু কথা বলতে চাই যদি সময় দেন তো।
– তার আগে বলুন আপনি কে? মেয়েটা এবার আবার মুখটা গম্ভীর করে বললো,
– আমি রাহা সাদাতের স্ত্রী।
– কোন সাদাত?
-আপনার প্রাক্তন।
প্রাক্তন কথাটা মেয়েটা খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই বললো। কিন্তু আমি কিছুটা বিব্রত বোধ করলাম। কারন ১০ বছর অনেক সময়, এত বছর পর আমার প্রাক্তনের স্ত্রী আমাকে কেন খুজবে। হিসেব মিলাতে না পেরে কিছুটা বিরক্তি নিয়েই বললাম,
– দেখুন আমি অফিসে আছি, কি বলবেন দ্রুত বলে চলে যান পারসোনাল বিষয় অফিসে আলাপ আমার একদম পছন্দ না।
– আপু আপনার ফোন নাম্বার যোগাড়ের অনেক চেষ্টা করেছি পারিনি। বাধ্য হয়েই অফিসে এসেছি।
– অফিসের ঠিকানাটা কোথায় পেয়েছেন?
– আমার শ্বশুর দিয়েছেন।
– ভালো বলুন কি বলবেন শুনছি আমি।
– আমার শুধু একটাই প্রশ্ন এমন কি হয়েছিল যার জন্য আপনি ৯ বছরের রিলেশন ভেঙে ঐ মানুষটাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। আমি যতোটুকু জানি আপনাদের দুই পরিবারের সম্মতিতে আপনাদের আংটি বদলও হয়েছিল। আমাকে কি কারণ টা বলা যাবে?
– আপনি কি এত বছর পর এইসব তদন্ত করতে মাঠে নেমেছেন?
– আপু আমি গতকাল রাতের ট্রেনে খুলনা থেকে ঢাকায় এসেছি শুধুমাত্র আপনার সাথে দেখা করবার জন্য, আজ রাতেই আবার চলে যাবো।
– খুলনা থেকে এসেছেন শুধু এর উওর জানার জন্য?
– হ্যা
– ঠিকাছে শুনুন আমি ঐ মানুষটাকে ছাড়িনি, মানুষটাই আমাকে ছেড়েছে, আর হয়ত আমাদের এক হওয়া ভাগ্য লিখা ছিল না তাই এক হতে পারিনি। হয়তো সাদাত আপনার ভাগ্যে লিখা ছিল তাই আপনি পেয়েছেন।
– আপনাদের লাস্ট কনভারসেশন কি মনে আছে তানহা ম্যাডাম?
– না নেই আর প্লিজ আপনি এখন আসতে পারেন আমার খুবই বিরক্তি লাগছে এসব বিষয় নিয়ে ঘাটাঘাটি করতে?
– আপনাদের লাস্ট কনভারসেশন টা আমি আগে দেখেছিলাম, পুরোটাই ভালোবাসায় ভরপুর ছিল
আর আপনি সাদাতকে একটা কথা বলেছিলেন যে ১০ বছর পর আপনি সাদাতকে বা সাদাতের স্ত্রীকে খুজে বের করবেন এবং কিছু প্রশ্ন করবেন।
– দেখুন তখন ঐ বয়সে মাথায় কি ঘুরছিল মনে নেই তবে এখন তেমন কোনোই আগ্রহ বোধ করছিনা।
– কিন্তু আমি করছি, আপনার প্রশ্ন গুলি বলুন আমি উত্তর দিচ্ছি।
– দেখুন আপনি এখন যেতে পারেন আর আপনার যা জানার সব আপনার স্বামী আর শ্বাশুড়ির কাছ থেকে জেনে নিবেন।
তবে আমি মনে করি এত বছর পর এর কোনো মানেই হয়না। আপনি সাদাতের স্ত্রী, স্ত্রী আর প্রেমিকা এক না। আমি ৯ বছরে তাকে যতটা জেনেছিলাম বুঝেছিলাম আপনি তা ৯ মাসেই পেরেছেন। আমি কেন তাকে পাইনি তা নিয়ে ঘাটাঘাটি না করে আপনি যে তাকে পেয়েছেন তার ভালোবাসা পেয়েছেন তার সঙ্গী হয়ে জীবন পাড় করতে পারছেন এতে শুকরিয়া আদায় করুন। আর আপনাদের পরিবারে কোনো ঝামেলা হলে নিজেরাই সমাধান করুন এত বছর পর আমাকে অহেতুক টানবেন না কারন আমি আপনার স্বামীর সাথে পরকিয়াও করছিনা ইভেন তার কোনো খোজ ও এই ১০ বছরে রাখিনি।
– আমার স্বামী বেচে থাকলে তাকেই জিজ্ঞাসা করতাম।
– সাদাত বেচে নেই!
– না বছর খানেক আগে স্ট্রোক করে মারা গেছেন।
জানিনা বিশ্বাস করবেন কিনা আমি সাদাতের স্ত্রী হয়েছি সঙ্গী হয়েছি কিন্তু ভালোবাসার জায়গাটা সে আপনাকেই দিয়ে রেখেছিল। প্রায় রাতেই ঘুমের মধ্যেই বিড়বিড় করে আপনার নাম নিত আর ক্ষমা চাইতো আমার শ্বাশুড়িও মৃত্যুর আগে আপনার নাম নিয়ে ক্ষমা চেয়েছেন। আমি জানিনা তারা এমন কি করেছেন যার জন্য সবাই আপনার কাছে ক্ষমা চাইছেন। তবে আমি এতটুকু বুঝেছি আপনি প্রেমিকা হয়ে ৯ বছরে যতটা ভালোবাসা পেয়েছেন যতটা তার মনে জায়গা করতে পেরেছেন আমি স্ত্রী হয়েও ৯ বছরে একই ছাদের নিচে থেকেও তা পারিনি। সাদাত এর কাছে আপনার নাম টা এতবার শুনেছি যে আমাদের জীবনে না চাইতেও আপনি ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিলেন। আপু আমি শুধু একটা কথাই বলতে চাই আপনি আর আমার শ্বাশুড়ি দুইজনই জিতে গিয়েছেন নিজেদের ইগো নিজেদের জেদের কাছে। কিন্তু সাদাত হেরে গিয়েছিল তার ভালোবাসার কাছে। আর আমি হেরে গিয়েও জিতে গিয়েছি কারন সাদাতের দেয়া সেরা উপহার তার সন্তান আমার কাছে আছে।
সেদিন যাই হয়েছিল যদি ভালোবাসার মানুষটির হাত না ছেড়ে শক্ত করে ধরে রাখতেন তাহলে সাদাতের সাথে আরোও ৯ টি বছর কাটাতে পারতেন। আর সিয়াম আপনার সন্তান হতো। যার নামটাও আপনিই রেখেছিলেন। ভুল কিছু বললে প্লিজ ক্ষমা করে দিবেন আপু আসি। মেয়েটা এক নাগাড়ে অনেক গুলি কথা বলে হৃদয়টাকে ক্ষত বিক্ষত করে দিয়ে চলে গেল। মনে হচ্ছিল পুরোটাই স্বপ্ন। পুরোনো ক্ষতটা আবারো কষ্ট দিতে লাগল।
গল্পের বিষয়:
গল্প