আষাঢ় মাসের দুপুর। সকাল থেকে অনবরত বর্ষণে সূর্যের দেখা নেই। দিনের বাকি সময়টুকুতে দেখা দিবে বলে মনে হয় না। এখন বৃষ্টি না থাকলেও আকাশ কালো মেঘে আচ্ছাদিত। ঘোর অন্ধকার হয়ে এই নামলো বৃষ্টি। এখন থেকে যদি সন্ধ্যা অবধি টানা বৃষ্টি হয় তবে বাড়ি পথ মাড়িয়ে উঠোনে জল গড়াবে। গোয়াল ঘরটা স্যাঁতস্যাঁতে হয়ে যাবে। গরু তিনটের থাকতে বেশ কষ্ট হবে।
স্যাঁতস্যাঁতে হওয়ার আগেই একটা ব্যবস্থা করতে হবে। গরু তিনটেই চেরাগ আলীর ভরসা। জমিজিরাত নাই বললেই চলে। মৎস আড়তের মালিক সাত্তার মহাজনের এক বিঘা জমিন বর্গাচাষ করে। এক ফসলি জমিন। অগ্রহায়ণ মাসে বোনা আমন ধান তোলা যায়। তাছাড়া বছরের বাকি সময় এই টুকরো জমিটা পানির নিচেই থাকে। ওই ক’টা ধান দিয়ে কোনোরকমে মাস পাঁচেক চলে। তারপর ধারদেনা করে দিনাতিপাত করতে হয়। চেরাগ আলীর বয়স হয়ে গিয়েছে। সত্তর ছুঁইছুঁই। মুখভর্তি লম্বা সাদা দাড়ি। চুল পেকেও ধবধবে। তবু বয়সের ভারে খুব একটা নুয়ে পড়েনি। বেশ বলবানই মনে হয়। কাজকাম বলতে পেশায় একজন জেলে। বর্ষার মৌসুমে বিলেঝিলে, নদীনালায় মাছ ধরে কাঁধে করে গাওগেরামে বাড়ি বাড়ি বিক্রি করে। শুকনো মৌসুমে সাত্তার মহাজনের আড়ৎ থেকে মাছ নিয়ে বিক্রি করে। এভাবেই কোনোরকম কায়ক্লেশে জীবন অতিবাহিত করে চেরাগ আলী।
বৃষ্টি নামলো আকাশ ভেঙে। ভারী বর্ষণ। বৃষ্টির পানি উঠোন গড়িয়ে বেশি দূরে যেতে হয় না। একটু গড়ালেই অথই পানি। চেরাগ আলী বারান্দার ফালাটা ভর করে ওঠে দাঁড়ালো। দৃষ্টি তার বিলের দিকে। বিলজুড়ে কিনারাবিহীন এক সমুদ্রের মতো অথই জল। বোনা আমন ধান গলা ডুবিয়ে কোনোরকম মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। একটা দুটো ডিঙি নাও বেরি জাল ফেলে মাছ ধরছে। চেরাগ আলীর নিজের কোনো নৌকা নেই। জালও নেই। যেকোনো একটা জিনিস নিজের না থাকলে কেউ কাজে নিতে চায় না। আর যদিও নেয়, সারাদিন জলে ডুবিয়ে মারে। গতকাল রাতে চেরাগ আলী নয়াবড়ির মজনুকে বলে আসছিলো মাছ ধরতে গেলে যেন তাকে নেয়। সমস্যা নেই মজনু, জলে আমিই থাকব সারাদিন। এই প্রতিশ্রুতিও ছিলো। তবুও তারা নিলো না। চেরাগ আলীর বয়স হয়ে গিয়েছে। তাই কেউ অতটা আগ্রহ দেখায় না। এই জিনিসটা চেরাগ আলীও অনুভব করে। অসহয়ায় লাগে নিজেকে। তবুও বেহায়পনা করতে হয় তাদের সাথে। চেরাগ আলীর ছেলেসন্তান নেই। একটা মাত্র মেয়ে। রুপাই। কঠিন মনের মানুষ। শ্যাম বর্ণের চেহারার এই মেয়েটা যেন পৃথিবীর একমাত্র সুশ্রী। ঈশ্বরের দেয়া কৌমুদি ছুয়েছুয়ে পড়ছে শরীরের ভাঁজ বেয়ে।
চেরাগ আলী হতাশার দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বিল থেকে নজর তুলে নিয়ে উঠোনের মাথায় ফেলে। বর্ষার পানি বাড়ছে। এভাবে আরও দুইদিন বাড়লে ঘরের চৌকাঠে এসে ঠেকবে। তখন তো মহামুশকিল হয়ে যাবে। ভাবতেই শরীর কাঁটা দিয়ে ওঠে। মুখ শুকিয়ে আসে চেরাগ আলীর। চৈত্র মাসের খরার মতো। ঘরের ভেতর থেকে স্ত্রী ছপুরা বেগমের চেঁচামেচির তুমুল আওয়াজ আসছে। কত কইরা কইছি চালের ছন কয়টা একটু বদলাইয়া দেও। খালি বলে টাকা কই পাইমু। ক্যান, ভাইজানের কাছে গেলেই তো ছনের ব্যবস্থা কইরা দেয়। ভাইজানরে তো আমি কইয়াই রাখছি। তারপরও যাইতে মন চায় না। এহন কও দেখি, এই আষাঢ় মাসে রোজ বৃষ্টি হইব আরা আমি রোজ ঘরের পানি সেইচ্ছা ফালাইমু। যত জ্বালা আমার হইছে।
বারান্দায় দাঁড়িয়ে কথাগুলো শুনেও না শোনার ভান করে আছে চেরাগ আলী। ছপুরা বেগম একরথিও মিথ্যে বলেনি। তবুও চেরাগ আলী না যাওয়ার একটি বিশেষ কারণ আছে। আত্মীয়স্বজন অভাবী হলে কিছুকিছু মানুষের চোখ বদলে যায়। তাদের বদলে যাওয়া চোখ জানে কিভাবে সম্পর্ক ছিন্ন করতে হয়। কিভাবে রক্তমাংস আর উঁচুনিচুর তফাৎ করতে হয়। চেরাগ আলী আত্মীদের এই দূরত্ব বুঝতে পারে। কিন্তু সইতে পারে না। জগতের সব কষ্ট সওয়া গেলেও মানুষের অবহেলা সওয়া যায় না। অবহেলার ফলা শরের চেয়েও দ্রুতগতিসম্পন্ন। গভীর ক্ষতধারী। ছপুরা বেগম একা একা কথা বলেই যাচ্ছে। কেউ শুনছে না ভেবে রাগ ভারী হয় তার। রুপাইকে ডাকে। তারও কোনো সাড়শব্দ নেই। আশেপাশে কোথাও আছে বলেও মনে হয় না। ছপুরা বেগম আরও তীব্রভাবে রেগে যায়। অনর্গল বলতে থাকে, ডিঙ্গি মাইয়া হইছে এখনো বাড়ি বাড়ি ঘুইরাবেড়ানো গেলো না। ক্যান তোর এত পইপই করে ঘুইরাবেড়ানো লাগবে ক্যান। তুই কি বেডা মানুষনি। বিয়া হইলে বছরের মাথায় বাচ্চা হইব। তুই এত ঘুরবি ক্যান। আসুক আইজ বাড়িতে। পা ভাইঙা ঘরে শুয়াইয়া রাখমু। হারামজাদি কোহানকার!
‘আহ ছপুরা অহন একটু থামো তো। অনেক করছো বকবকানি। এমনিতেই আছি মহাচিন্তায়। আল্লার দোহাই, অহন একটু থামো তুমি। ’ নিরবতা ভেঙে বলে চেরাগ আলী। ঝড়ের গতিতে ঘরের ভেতর থেকে দোর অবধি আসে ছপুরা বেগম। রোষাগ্নি চোখে তাকায় চেরাগ আলীর দিকে। ফোঁসফোঁস করে বলে, ‘কি কইলা তুমি? কও কও আবার কও। আমি বকবকানি করি? ছনের কথা কইলাম তাতে তোমার গায়ে ফুসকা পড়লো না। হারামজাদি মাইয়ার কথা কওনেই গায়ে ফুসকা পইড়া গেলো?’ ‘চুপ করো ছপুরা। এই বয়সে একটু আধটু এমন করবেই। বিয়া হইলে সব ঠিক হইয়া যাইবো। ’ নিচুস্বরে বলে চেরাগ আলী। ‘মাইয়া যদি কোনো অঘটন ঘটায় তয় আমারে কিছু কইতে পারবা না। আগেই জানাইয়া দিলাম কথাখানা। ’ বলতে বলতে ঘরের ভেতরে যায় ছপুরা বেগম। চেরাগ আলী আর একটি কথাও বলে না। চুপচাপ বসে থাকে। ভাবে জীবনের কথা। কতটা উত্থানপতনে যাপিত হয়। কতটা সহায় সম্বলহীন হলে অযোগ্য হয় সমাজে।
বৃষ্টি মাথায় নিয়ে বাড়ি ফিরে রুপাই। জলে ভিজে চুপসে গেছে শরীর। কচু পাতার সাহয্যে কোনোরকম মাথাটা বাঁচিয়েছে। বারান্দায় পা রাখতেই চেরাগ আলী ইশারায় কাছে ডাকে। কানে কানে বলে, কোথায় ছিলি? তোর মা রেগে আছে। এখানে বস। কাঁধ থেকে গামছাটা নামিয়ে আবার বলে, এই নে শরীরটা মুছে নে। নইলে জ্বর আইবো। রুপাই শরীর মুছে হাত পা ভাঁজ করে বাবার পাশে বসে। বাম পায়ে একটা রূপার নূপুর। বেশ লাগছে দেখতে। রুপাই ভাবে আর নুপুরটা বারবার ছুঁয়ে দেখে। কি ভাবে রুপাই ? মাঝেমধ্যে মুচকি হাসে। এ হাসি অদ্ভুত হাসি। এ হাসিতে পুরুষ মানুষকে খুন করা যায়। পুরুষ মানুষ কঠিন মনের হলেও এমন হাসিতে দিব্যি খুন হয়। হতেই হয়।
ভাবতে ভাবতে রুপাই হঠাৎ বলে, আইচ্ছা বাজান, মতি ভাই মানুষটা কেমন?’
‘আমাগো মতি? জিগ্যেস করে চেরাগ আলী।
‘জ্বে বাজান। ’
‘লাখে একটা অমন ভালো পোলা পাওয়া যাইব কিনা জানি না।
তয় আইজ হঠাৎ মতির কথা জিগাইলি ক্যান? মতিরে কি নতুন দেখসনি? ছোডকাল থেইকাই তো দেখতাছস। ‘না বাজান কইছিলাম কি, যদি মতি ভাইয়ের সাথে মিলে মাছ ধরা যাইতো, ভালো হইতো না?’ বেশ আগ্রহ নিয়ে জিগ্যেস করে রুপাই।
‘তা হইতো। কিন্তু মা, আমি বয়স্ক মানুষ। ওদের মতো নৌকা নাই, জাল নাই, দরা টানার শক্তিও নাই। ওরা কি আমারে নিবে তাদের দলে? নিবে না। ’ একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কথাগুলো বলে চেরাগ আলী। রুপাই’র চেহারায় কালো অন্ধকার নেমে আসে বাবার এমন অসহায়ত্বের কথা শুনে। অশ্রু টলমল করে চোখের পাতায়। অন্যমনস্ক হয় পড়ে। আবার ভাবে। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে, বাবা আমি একবার মতি ভাইয়ের লগে কথা কইয়া দেখমু?’ ‘না থাক। তুই কথা কইলে কি না কি ভাববে। আমিই একবার বলেকয়ে দেখবনে। ’ বলে চেরাগ আলী। রুপাই’র মন শান্ত হয় না। ধীর হয় না। বেদনারা স্রোত বাড়ায়। ভেতর ভাঙে। কুড়ি বছরের মেয়ে সয়ে নিতে পারে। গরিবের ঘরের জন্ম নিলে অনেককিছুই সইতে হয়। ঘাত-প্রতিঘাত, মানুষের অবজ্ঞা অবহেলা দূরত্ব সবকিছুই।
গল্পের বিষয়:
গল্প